নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তারুণ্যের আলোয় সহজ পথ...

সত্য পছন্দকারী সাহসী এক ছেলে...

বাউন্ডেলে ডটকম

সত্য পছন্দকারী সাহসী এক ছেলে...

বাউন্ডেলে ডটকম › বিস্তারিত পোস্টঃ

নতুন দিগন্ত

২৭ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ৮:৩২

নতুন দিগন্ত





( এক)



ছাত্র হিসেবে রবীন যেমন মেধা, তেমনি বুদ্ধিমান। কাজ করে জাহাজ ডিপুতে। থাকে বিধবা মা আর ছোট বোনকে নিয়ে এক কুখ্যাত পল্লীতে। পিতার আকস্মিক মৃতুতে সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্বের ভার এসে পড়ে ওর মাথার ওপর। চেয়েছিল, নাইট কলেজ করে ইকোনমিক্সে মাষ্টার্স করবে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা আর সম্ভব হয়নি। উত্তরাধীকার সূত্রে পিতার যৎসামান্য বেতনের চাকুরীতে জয়েন করে বাধ্যতামূলক সংসারের হাল ধরতে হয় ওকে। সম্ভবতঃ সে কারণেই আজ ক’দিন যাবৎ মন মেজাজ একদম ভালো নেই রবীনের।



রবীন সাধারণ একজন কর্মচারী। হেল্পারের কাজ করে। তাতে ক’পয়সা আর মাইনে পায়। ক্রমাণ্বয়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয়। মায়েরও হয়েছে যত জ্বালা! সংসারে অভাব অনটন কবে না ছিল! এ তো নতুন কিছু নয়! আগেও ছিল, আছে, থাকবেও! কিন্তু প্রভাবতীর একমাত্র চিন্তা রবীনকে নিয়ে। কলেজ ছেড়েছে অবধি কাজ থেকে ফিরে এসে ক্ষীণ আলো অন্ধকার ঘরে হাত-পা টান টান করে শুয়ে থাকে বিছানায়। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেও আজকাল খুব একটা মেলামেশা করেনা। কথাবার্তা বলে না। বিষন্নতায় ছেয়ে থাকে মন-মানসিক। সারাক্ষণ উদাস, অন্যমনস্কভাব। চেহারাটা দুদিনেই শুকিয়ে একেবারে রুগ্ন দেখাচ্ছে। মুখে হাসি নেই। মনে আনন্দ নেই। রাতদিন কিসের চিন্তায় যে তন্ময় হয়ে ডুবে থাকে, চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মাথার চুলগুলিও উস্কোখুস্কো। বোঝা যাচ্ছে ক’দিন চিরুণী পড়েনি। পরনের জামা কাপড়ের অবস্থাও তদ্রুপ! মলিনতার ছাপ প্রকট! চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে! ভেবে হয়রান প্রভাবতী, নিশ্চয়ই রাতেও ঘুম হয় না পোলার! হঠাৎ কি যে হইল, কিচ্ছু বুঝিনা! কুনো ব্যায়ারামে ধড়ে নাই তো! পোলা কয়ও তো না কিছু!



মায়ের মন, সর্বদা কু-ই গায়। কিছুতেই স্বস্তি পায়না। নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে হন্‌হন্‌ করে গিয়ে দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়লেন রবীনের ঘরে। ঢুকেই থমকে দাঁড়ান প্রভাবতী। দেখলেন, হ্যারিকেনের আলোটা নিভু নিভু প্রায়। ক্ষীণ মৃদু আলোয় জ্বলছে। আবছা অন্ধকারে কিছু ঠাহরই করা যাচ্ছে না। হঠাৎ রবীনকে পাশ ফিরতে দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন,-“হ্যাঁ রে রবী, হইছে কি তড়! কুনো ঝামেলা হইছে বুঝি ডিপুতে! কিরে, কথা কস্‌ না ক্যান!”



রবীন বরাবরই চুপচাপ, শান্ত প্রকৃতির। ঢোল পিটিয়ে কখনো মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না। তা’ছাড়া জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন কে না দ্যাখে! প্রত্যেকেরই সাধ জাগে, ইচ্ছে হয়। যা প্রচন্ডভাবে রবীনকেও উৎসুক্য করে তুলেছিল। জীবনে উন্নয়ণ ও আর্থিক স্বচ্ছলতার অণ্বেষণে রবীন মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, অন্যের গোলামী না করে, অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজের মালিকাধীনে স্বাধীন ব্যবসা বাণিজ্য করাই সব চেয়ে উত্তম। নিজেকে কারো কাছে মাথা নত করতে হবেনা! জবাবদিহীও করতে হবেনা কাউকে! লাভ-ক্ষতির হিসেবও কাউকে দিতে হবেনা! কিন্তু তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সেটাইবা আসবে কোথা থেকে! কে দেবে ওকে এতগুলো টাকা! দিনকালের যা পরিস্থিতি, বিনিময় ছাড়া কোনো কিছু পাওয়া বা হাসিল করা বড়ই দুর্লভ! তা’হলে!



রবীন উপায়ান্তরহীন হয়েই মায়ের অজান্তে নিজের সদ্য পার্মানেন্ট চাকরিটা মাত্র ত্রিশহাজার টাকায় বেচে দিয়ে একটা বিদেশী কোম্পানির শেয়ার কিনে ফেলে। সৌভাগ্যক্রমে বছর ঘুরতেই স্বয়ং মা লক্ষীই যেন ওর অর্থের ভান্ডার একটু একটু করে ক্রমশ ভরে দিতে লাগলেন। মন্ত্রের মতো ঘুরে গেল রবীনের ভাগ্যের চাকাটা! রীতিমতো বদলে গেল ওর লাইফ ষ্টাইল, জীবনধারার পদ্ধতি, পোশাক-আষাক, থাকবার বাসস্থান, ইত্যাদি! বেড়ে গেল নিত্যনৈমিত্তিক শৌখিন ও বিলাসীসামগ্রীর প্রয়োজনীয়তা। যা স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করেনি! কোনদিন কল্পনা করেনি, ওর কাঙ্ক্ষিত আশা -স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবে! ওর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে!



একেই বলে বরাত। একটা ফলদায়ক বৃক্ষও এতো সহসা কখনো বেড়ে ওঠেনা। অবাক হয় পাড়াপর্শীরা। বিরল ওর সৌভাগ্য। ব্যবসা-বাণিজ্যও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরে। যেটা ছিল রবীনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। প্রয়োজনে জার্মান, হংকং, সিঙ্গাপুর নানান দেশ-বিদেশে ওকে ঘুরতে হয়। যার জগৎ ছিল কর্মস্থল থেকে বাসস্থান। খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার। ভাবাই যায়না। স্বপ্নের মতো মনে হয়। যেন আকাশের চাঁদটাই পেয়ে গিয়েছে হাতে! আর নাগাল পায় কে! নিত্য নতুনের সমারোহে খুঁজে পায় অধিকতর উন্নত জীবন। সদ্য সুপ্রতিষ্ঠিত মান-মর্যাদাসম্পন্ন্‌ এবং অর্থ-ঐশ্বর্যে ভরপুর রবীন অচিরেই ভুলে গেল ওর অতীতের ভাগ্যবিড়ম্বনা ও দারিদ্র্যপীড়িত গ্রাম্য জীবনের দুঃখ-দীনতার কথা। ভুলে গেল, জীবন ও জীবিকার তাগিদে ঘাত-প্রতিঘাতে ওকে যে কত কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেইসব দিনের কথা!

পিছন ফিরে আর তাকাতে হলোনা রবীনকে! নতুন উদ্যাম, উদ্দীপণায় এগিয়ে যেতে লাগল ওর আকাঙ্ক্ষিত জীবনের চরম সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে।



( দুই )



ব্যবসার নিমিত্তে প্রায় সারাবছরই দেশের বাইরে কাটাতে হয় রবীনকে। মা-বোনের সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ। ভিন্ন চরিত্রের মানুষ, মানুষের মন-মানসিকতা। যেখানকার পারপার্শ্বিকতার সাথে রবীনের ছিল বিস্তর ব্যবধান। ও’ কখনোই অভ্যস্ত ছিলনা। আর এভাবে ক্রমাণ্বয়ে চলতে চলতে একদিন কাজের অবসরে একাকী নিঃসঙ্গতার শূন্যতাবোধে মন-মানসিকতার অস্থিতিশীলতায় নিজের ঐতিহ্য, নৈতিকতা, সততা ও সভ্যতা ভুলে গিয়ে ভোগের কাছে বশ্যতা স্বীকার হয়ে পানীয় মাদকদ্রব্য থেকে শুরু করে নাইট ক্লাব, তাশের আড্ডা, শ্বেতাঙ্গ উর্বশী রমণীদের মধুর সান্নিধ্য, কোনটাই ওর বাদ যেতোনা। আবার কোনদিন ভবঘুরের মতো নেশায় চূড় হয়ে অচৈতন্যে ডুবে থাকতো মৌজ-মস্তির অতল গহ্বরে! যেখানে ছিলনা কেউ বাঁধা দেবার! তাড়া ছিলনা বাড়ি ফেরার! কিন্তু কতদিন! আপন গন্তব্যে তো ফিরে যেতেই হবে! তখন কি পারবে, হৃদয়হরিনী ভুবনমোহিনী শ্বেতাঙ্গ রমণীদের মুক্তঝরা হাসি ভুলে থাকতে! কখনো কি পারবে, লাস্যময়ী তরুণ রমণীদের রহস্যাবৃত ডাগর চোখের বিচিত্র ইশারায় প্রেমআহ্বানের মুহূর্তগুলি ভুলে থাকতে!



না, পারেনি! দেশে ফিরে এসে রবীন পারেনি, জার্মানের সেই উর্বশী শ্বেতাঙ্গ রমণীদের ভুলে থাকতে। ওর হৃদয় থেকে ওদের অপসারিত করতে! কিন্তু তাইবা কেমন করে সম্ভব! মাত্র বত্রিশ বছরের তরুণ যুবক রবীন! জীবনকে উপভোগ করবার, আরাম-আয়েশে কাটাবার এটাই ওর উপযুক্ত সময়! জীবনে প্রথম পর্দাপণ করেছে বিদেশের মাটিতে! ব্যতিক্রম একটু তো ঘটবেই! কিন্তু প্রভাবতীর সর্বদাই একমাত্র পুত্র রবীনের শরীর স্বাস্থ্য নিয়েই যতো চিন্তা! তার ধারণা, আহারাদি এবং বিবর্তন আবহাওয়াতেই শরীর অর্ধেক হয়ে গিয়েছে রবীনের। পরিশ্রমও তো কম হয় না! নাওয়া-খাওয়াও হয়তো সময় মতো হয়না!



উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দেয় প্রভাবতীর। নিশ্চিন্তে ঘুমোতেও পারেন না। রাতভোর মমতার ছায়ায় রবীনকে আলগে জেগে বসে থাকেন। কিন্তু রবীন যে বিদেশী পরী নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতো, তা কে জানতো!



প্রভাবতীর দৃষ্টিগোচর হয়, এবার জার্মান গিয়ে অনেক বদলে গিয়েছে রবীন! চুরুটের গন্ধ্যেই তিনি টের পান! সন্দেহ হয় মনে মনে, -পোলায় যে কিসের ব্যবসা-বাণিজ্য করে, তা ভগবানই জানে! মাদকদ্রব্যের নেশা অড় ভালো মতেই ধরছে!



ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় সারাঘর। গন্ধ্যে টেকা যায়না। দিন যায়, মাস যায় কোনো পরিবর্তন নেই রবীনের! অথচ বিদেশ যাত্রার সময় ঘনিয়ে এলে উচ্ছাসিত আনন্দে মন-প্রাণ ওর উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। উর্দ্ধঃশ্বাসে প্রস্তুস্তিপর্ব শুরু হয়ে যায়! ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।



প্রভাবতী ভাবলেন, মাইয়া বিয়া দিয়া ঘর একখান্‌ খাঁ খাঁ করে! মন টিকে না। এইবার একখান্‌ বৌ আইনা পোলারেও ঘর বাঁইন্দা দিতে হইব! নাতি-নাতনী আইব, আবার ভইর‌্যা যাইব গিয়া ঘর! তা না হইলে দ্যাশ-বিদ্যাশ ঘুইর‌্যা ঘুইর‌্যা পোলা যাইব গিয়া রসাতলে! সংসার-ধর্মে মনই আর লাগব না অড়!



অথচ ঘটে তার বিপরীত। চেয়েছিলেন, রবীনের সুখ, আনন্দ। প্রভাবতী যতই নিশ্চিন্ত হন, ততই সমস্যার সৃষ্টি হয়, চিন্তা বাড়ে। শখ্‌ করে ছেলের বৌ নিয়ে এসে প্রতিদিন শুরু হয় অশান্তি, চিৎকার চেঁচামিচি! প্রতিটি ব্যাপারে রবীনের অভিযোগ,-‘তড়কাড়িতে নুন কম, ঝাল বেশী! তোমার লাড্‌লি বৌ ভালো রান্না জানেনা! জামার ইস্ত্রিটা ঠিকমত হয় নি! বেরসিক, আন্‌স্মার্ট! হাই-সোসাইটিতে চলতে জানে না। ওপেন মাইন্ডে মিশতে জানে না। আরো কত কি, তার ইয়ত্তা নেই!’



প্রভাবত দেবী লেখাপড়া কম জানা সেকেলে মহিলা। তার সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা! তিনি হাই-সোসাইটির কথা শুনলে অতিরিক্ত চটে যান। আর চটে গেলে সাংঘাতিক অবস্থা হয় তার। মুখের পেশিগুলো ফুলে শক্ত হয়ে ওঠে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকেন! আর সেই সঙ্গে জিহ্বায় কথা জড়িয়ে তোতলাতে শুরু করেন, তা অজানা নয় রবীনের! অথচ খই ফোটার মতো সমানে চলছে ওর নালিশ, ওর অসন্তোষ্টির বিবরণ।



ইতিমধ্যে হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। প্রভাবতী ভ্রু উত্তোলন করে, কাপড়ের কোঁছা ধরে তীব্র গলায় গর্জে উঠলেন,-‘হাই-সোসাইটি দিয়া কি হইব! হেইগুলি বিলাসিতা! বেলেল্লাপণা করা! রঙ্গ-তামাশা করা! নিজেরে জাহির করা! হেগুলি আমাগো ঘরের বৌ-বেটিগোর কক্ষনো শোভা পায় না! ভুইল্যা গ্যাছস সব! বিউটি আমাগো গেরস্থের লক্ষী, কূলবধূ! অড়ে আমি কুত্থাও যাইতে দিমু না! এই আমার শ্যাষ কথা, কইয়া দিলাম!’



মায়ের কথা গায়েই মাখালো না রবীন। দরজার পাশে দাঁড়ানো লাবণীর আপাদমস্তক কটাক্ষ দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে রূঢ় গলায় বলে ওঠে, -“থাকো তুমি তোমার ওল্ড্‌ ফ্যাশান বৌ নিয়ে, আমি চললাম!”

বলে সেই যে অদৃশ্য হয়ে গেল, সারাদিনে আর পাত্তাই পাওয়া যায়নি। প্রায় মধ্যরাতে নেশাদ্রব্য পান করে অচৈতন্যে টলতে টলতে বাড়ি আসে। আবোল তাবোল বকতে বকতে বিছানায় শুয়ে পড়তেই নিদ্রাদেবীর বাহুমন্ডলে একেবারে বেহুঁশ। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যস, ঐ রাতটুকুই! প্রত্যুষে প্রভাতরবির উদয়ের সাথে সাথেই যথারীতি বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে। গতকাল কোথায় ছিল, কি করেছিল, সেখবর নেবারও আর প্রবৃত্তি হয়না কারো। ক্ষোভে, দুঃখে, গজ গজ করতে করতে প্রভাবতী চলে যান নিজের ঘরে। আর লাবণী সাশ্রুনয়নে বিনিদ্র রজনী পোহায়ে সারাদিন পড়ে থাকে রান্নাঘরে। এভাবেই রুটিরমাফিক চলতে থাকে, রবীন-লাবণীর সংসার। এ কি সহ্য হয় কখনো!



বৈবাহিক জীবনের শুরুতে এমন নিস্প্রেম নিরুচ্ছাস নির্দয় নিষ্ঠুর স্বামী কোনো মেয়েই কামনা করেনা! অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা, মধুর প্রেমালাপ, হাসি কলোতান তো দূর, লাবণীর মুখপানেও কোনদিন চোখ তুলে চেয়ে দ্যাখেনি! অথচ প্রভাবতীই প্রথম মুখদর্শণে সানন্দে পুত্রবধূর নাম রেখেছিলেন বিউটি! তিনি ঐনাম ধরেই ডাকেন! রবীন কি শোনেনি কোনদিন! নিশ্চয়ই শুনেছে! তাতে ওর কি! মতই তো ছিলনা বিয়ে করার! চেয়েছিল প্রত্যাক্ষ্যান করতে! বিয়ের প্রোপোজালটা রিফিউজ্‌ করতে! অথচ সে কথাও কি মুখফুটে বলতে পেরেছিল কোনদিন! না পারেনি! পারেনি হৃদয় নামক বিশাল সাম্রাজ্যের আধিপত্য লাবণীকে সঁপে দিতে। ওকে পূর্ণ মর্যাদায় স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে! পারেনি, স্বামী-স্ত্রীর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে! সংসারের মায়াজ্বালে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে! আর পারেনি বলেই লাবণীকে একান্ত করে কাছে পাওয়ার কোনো ইচ্ছানুভূতি কখনোই ওর ছিলনা! ছিলনা কোনো বন্ধন, হৃদয়ার্কষণ! রবীন ক্রমশ স্বার্থপর আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। শুধুই নিস্পৃহা, নিরাসক্তি আর বেপরোয়া মনোভাব!



কিন্তু কেন? নিজেকে প্রশ্ন করে লাবণী! -ও’কি উড়ে এসেছিল এ বাড়িতে? না কি জবরদস্তী চেপে বসেছিল রবীনের ঘাড়ে! রীতিমতো পুরোহিত এসে শাস্ত্র মতে মন্ত্র উচ্চারণেই পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল ওরা দুজনে! কি দোষ করেছিল লাবণী? ওর অপরাধটাই বা কি? ওকি সত্যিই রবীনের অযোগ্য? চোখের বালি? রবীণ চায় কি? ও’ কি পেলে প্রকৃত সুখী হবে জীবনে! লাবণী কি সত্যিই তাতে অক্ষম? কিন্তু সেভাবে তো রবীন কাছেই আসেনি কোনদিন! তা’ হলে কেন এমন দূরত্বের ব্যবধান! প্রতিটি বিষয়ে কেনইবা ওর এমন অনৈক্যতা, অসামঞ্জস্যতা, বিরোধতা!



তবু ধীর-স্থীর, ধৈর্য ও সহনশীলা লাবণী, মুখ ফুটে কিছুই বলেনা! কারো প্রতিও ওর অভিযোগ নেই! অসন্তোষ নেই! একেঘেয়ে অনাকাঙ্খিত বিরহ-বেদনাময় নিরানন্দের জীবনকেই ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল। সহে গিয়েছিল প্রভাবতীর মুখপানে চেয়ে! যে বিশ্বাস আর ভরসা করে লাবণীকে পুত্রবধূ হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন, অন্তত সেটুকুই অটুট থাকুক! রবীনকে প্রেমের ডোরে বাঁধতে না পারলেও, ওকে একান্তে নিবিড় করে কাছে না পেলেও হৃদয়ের নিঃসৃত ভালোবাসায় লাবণী ওর মনকে বেঁধে রেখেছিল এক অদৃশ্য বন্ধনে, এক অদৃশ্য অনুভূতিতে।



রবীণ যতো রাতেই ফিরুক, ওর পথ চেয়ে প্রহর গুনে বসে থাকতো! কখনো দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠতো। কোন কোনদিন বর্ষণমুখর সন্ধ্যে থেকেই একান্তে নিঃভৃতে অশ্রুসজল চোখে বিনিদ্র রজনীও কাটাতে হতো! অথচ তাতে কোনদিন কিছুই এসে যায়নি রবীনের!



( তিন )



ক’দিন যাবৎই রবীনের মতিগতি ভালো ঠেকছিল না লাবণীর। কেমন সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল! ভেবেছিল, হয়তো এ অবাঞ্ছিত সংসার থেকে মুক্তির পথই খুঁজজে বোধহয়! হয়তো বা অন্য কিছু!

লাবণী আশঙ্ক্ষায় থাকতো মনে মনে। ভয় হতো· রবীন বাড়ি ছেড়ে উধাও না হয়ে যায়! যাও মাঝেমধ্যে একটু আধটু এ্যাঁ উঁ শব্দ উচ্চারণে ওর মত প্রকাশ করতো, মত বিনিময় করতো, আজকাল সেটাও গিয়েছে একেবারে বন্ধ হয়ে। তা’হলে ওকি সত্যিই লাবণীর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চায়?



হ্যাঁ, ঠিক তাই! এই ভয়ই করেছিল লাবণী। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দ্যাখে, সদর দরজা খোলা। ক্লোজেটে্‌র সমস্ত জামা-কাপড়গুলো এলোমেলা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই নিজের গর্ভধারিনী মাতা ও নব বিবাহিতা স্ত্রী লাবণীর সুকোমল হৃদয়ে কঠিন আঘাত হেনে উচ্চাভিলাষী রবীন মরিয়া হয়ে শ্বেতাঙ্গ মনোমোহিনী তিলোত্তমার মাধুর্যে অবগাহনের জন্য নিজের ঘর-সংসার পরিত্যাগ করে ছুটে চলে যায় জার্মানে। বাঁধবে স্বপ্নের খেলাঘর। ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ। কিন্তু যে ঘরে খেলনাই নেই, তা সে খেলবে কেমন করে!



জার্মান পৌঁছেই রবীনের বোধগম্য হয় এবং মরমে মরমে উপলদ্ধি করে, এতদিন অন্ধের মতো আলো ছেড়ে শুধু আলেয়ার পিছনেই ছুটেছিল! আসলে সবই মায়ার মরীচিকা ছল্‌! শুভ্রপরীরা দেখতেই সুন্দর! বাঙালি মেয়েদের মতো মার্জিত রুচীশীল, ধৈর্যশীল, সহনশীল এবং আত্মত্যাগি ওরা নয়! যাদের ভালোবাসা এতোই ঠুনকো যে, সামান্য আঘাতে নোনামাটির মতো পলকেই ঝোরে যায়! যেখানে নির্ভরশীলতা নেই, বিশ্বস্থতা নেই! মন-মানসিকতার যাদের বিস্তর ব্যবধান। সেখানে মিলন হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই! তার জন্য একান্তভাবে প্রয়োজন, দু’টি সবুজ মনের একাত্ব হয়ে মিশে যাওয়া, লীন হয়ে যাওয়া এবং নিঃস্বার্থে প্রেম-শ্রদ্ধা-ভক্তি ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা উজার করে ঢেলে দেওয়া। যা লাবণী দিতে চেয়েছিল। অথচ প্রায় ন’মাস একই ছাদের নিচে একঘরে বাস করেও তা বোধগম্যই হয়নি রবীনের। অহেতুক নিজের গোড়ামী এবং জিদের বশীভূত হয়ে তিক্ততা সৃষ্টি করে স্বামীর ভালোবাসা থেকে লাবণীকে বঞ্চিত করেও ওর জ্বালা মেটেনি। নিষ্ঠুর স্বার্থপরের মতো স্ত্রীর ন্যায্য অধিকারটুকুও চেয়েছিল কেড়ে নিতে! কিন্তু কেন? নিজেও কি কখনো দিয়েছিল কিছু? না দিতে পেরেছিল? দেবার চেষ্টাও তো করেনি কোনদিন! আর তা’ ছাড়া ও’ দেবেই বা কি! দেবার মতোও তো ওর কিছুই নেই!



অবলীলায় ক্ষণিকের মোহজাল ছিন্ন করে ঝড়ের মুখে উড়ে যাওয়া দিশাহারা পাখীর মতো মুমূর্ষূ রবীন ওর বিবেকের দরবারে নিজেই অপদস্থ, জর্জরিত! অনুতাপে অনুতপ্ত এবং সর্বোপরি নিজের কাছে পরাস্ত হয়ে মহাপ্রলয় ঘটে যায় ওর অন্তরে। বিগতদিনগুলির অর্ন্তকলহ আর মতবিরোধের অনুশোচনায় ওর পাষাণ হৃদয়কে বিগলিত করে একেবারে ভিজিয়ে দেয়। মন-প্রাণ নতুন করে সিক্ত হয়ে ওঠে গভীর ভালোবাসায়। টের পায়, সে নিজেই নিষ্ঠুরের মতো নিরীহ, নির্দোষ, নিস্পাপ লাবণীর প্রতি বড়ই অন্যায় করেছে, অবিচার করেছে। অথচ স্বামীর দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালনের যে দৃঢ় অঙ্গীকারে লাবণীকে জীবন সঙ্গিনী রূপে গ্রহণ করে ছিল, তা অস্বীকার করার স্পর্ধাও ওর ছিলনা! কিন্তু লাবণী, ওকি ক্ষমা করবে কোনদিন? ওরওতো রক্তেমাংশে গড়া মানবীয় শরীর! ওরও মন বলে একটা জিনিস আছে! জীবনের সাধ-আহাল্লাদ আছে! চাহিদা আছে! যা কখনো পূরণ করতে পারেনি! পূরণ করার চেষ্টাওতো করেনি কোনদিন! আজ স্বামীত্বের দাবী নিয়ে লাবণীর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াবে কোন্‌ অধিকারে? কিসের জোরে? বিশ্বাস আর ভালোবাসা তো মরে কবে ছাই হয়ে গিয়েছে লাবণীর! তা’হলে!



দ্বিধা আর দ্বন্ধের সন্ধিক্ষণে প্রচন্ড উদ্বিগ্ন দেখা দিতে লাগল রবীনের। কিছুতেই স্বস্তি পায়না। মনযমুনার উত্তাল তরঙ্গে ক্রমশ যেন অতল তলে তলিয়ে যেতে থাকে। কিনারাই খুঁজে পায়না। একসময় রবীন মনস্থির করে, নিজেই লাবণীর সন্নিকটে গিয়ে ধরা দেবে! প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে মাকে কনভিন্স করবার চেষ্টা করে। আকার ইঙ্গিতে জানতে চায় লাবণীর মনের খবর। রবীনকে ঠাঁই দেবার মতো ওর হৃদয়ের স্থান কতটুকু!

শুধু একটাই আবেদন রবীনের,-“যত শীঘ্রই সম্ভব, তোমরা জার্মান চলে এসো! আমারও তো একটা নৈতিক দায়ীত্ব আছে! কর্তব্য আছে! অন্তত সেটা পালন করবার সুযোগ একবার আমায় দাও! জানি, যে অপরাধ আমি করেছি, তা ক্ষমার যোগ্য নয়। কখনোই ক্ষমা করা যায়না। লাবণীকে বুঝিয়ে বোলো। একমাত্র তুমিই কনভিন্স করতে পারো! ও’ তোমার আনুগত্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ও’ কখনো অমান্য করবে না! অতীতের ভুল-ভ্রান্তি যা কিছুই হোক, ওকে বলো, সব ভুলে গিয়ে এ্যমিডিয়েট আমার এখানে চলে আসতে!”



হুমঃ, বললেই হলো! বিনা নোটিশে যখন উধাও হয়ে গিয়েছিল, তখন কোথায় ছিল নৈতিক দায়ীত্ব, কর্তব্য! বিগত চৌদ্দমাস ওর বিবাহিতা স্ত্রী একেলা নিঃসঙ্গতায় নিরানন্দে কিভাবে দিন কাটিয়েছে, মনের কামনা-বাসনাগুলিকে অশ্রুজলে সলীল সমাধী দিয়ে কিভাবে নিজের সতীত্ব বজায় রেখেছে, বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, সেখবর একবারও কি নিয়েছিল? কখনো কি মনে পড়েছিল? লাবণী কেন কাঙ্গালের মতো ছুটে যাবে ওর কাছে? কিসের ঠেকা ওর? হায়ার এ্যডুকেটেড্‌ ও’! রূপে-গুণে, কাজে-কর্মে কোনো অংশেই কম নয়! ওকি পারতো না, আর পাঁচটা বৌএর মতো নানান রঙ্গে-ঢঙ্গে, বাকপটুতায়, ছলা-কলাকৌশলে রবীনকে বশ করে রাখতে! ওকে আঁচলে বেঁধে রাখতে! অবশ্যই পারতো! তবুও কি রবীনের হৃদয় নিংড়ানো অকৃত্রিম ভালোবাসা পেতো কোনদিন! কখনো কি একান্তে নিভৃতে নিবিড় করে ও’কে পেতো কোনদিন!



না পেতো না! আর পেতো না বলেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বাঁধন শক্তি ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছিল লাবণীর! তবুও অকুন্ঠিত হৃদয়ে মাতৃতুল্য শ্বাশুড়ী প্রভাবতীর সেবা-শুশ্রুষায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে শ্বশুড়ালয়ের মান-সম্ম্রম অটুট রাখার দায়িত্ব পালনের দৃঢ় অঙ্গীকারে বুকের পূঞ্জীভূত সমস্ত মান-অভিমান, বিরহ-বেদনাগুলিকে নীরব ও নির্বিকারে লুকিয়ে রেখেছিল ওর অনাবিল মুখের অনিন্দ্য সুন্দর হাসির আড়ালে! যা কখনো মলিন হতে দেয়নি! ওযে নিয়তির কাছেই আত্ম সমর্পিত, নিমজ্জিত এবং বিসর্জিত!



কিন্তু মুখে যাই বলুক, মনকে সায় দেয়নি। জেগে ওঠে এক অভিনব অনুভূতি। নারীর আপনসত্ত্বা বোধ, মূল্যবোধ। দ্বিধা-দ্বন্ধের উত্তাল তরঙ্গের সঞ্চালণে বিদ্যুতের শখের মতো ওর আপাদমস্তক এক অব্যক্ত আনন্দানুভূতিতে শিহরিত হয়। কাল্পনিক চেতনায় এক অদৃশ্য শক্তিতে গোধূলির নিরবিচ্ছিন্ন মনটা গভীর ভালোবাসার বন্ধনে রবীনকে নতুন করে প্রাণের ডোরে বেঁধে রাখে, ওর আবেগে-অনুভূতিতে, স্মৃতির গ্রন্থিতে। অপ্রত্যাশিত রবীনের মন-মানসিকতার অভাবনীয় রিবর্তনে ভিতরে ভিতরে অব্যক্ত আনন্দে আত্মাহারা হয়ে ওঠে। হৃদয়ের দুকূল প্লাবিত করে খুশীর বন্যা বয়ে যায়। মন-প্রাণ আনচান করে ওঠে। উন্মুক্ত অন্তর মেলে কল্পনায় দেখতে থাকে রবীনকে। নতুন করে জেগে ওঠে ওর অপূর্ণ সাধ, আশা-আকাঙ্খার আবেগ-ইচ্ছানুভূতি! কখনো ব্যাকুলতায় চোখদুটি ওর অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কখনো বিরহে, কখনো বেদনায়! কখনো মানে-অভিমানে! কখনো আবেগে, অনুরাগে!



( চার )



দেখতে দেখতে এসে গেল ভ্যালেন্টাইন ডে‌। ভালোবাসা দিবস। উষার প্রথম আলো ফুটে উঠতেই পাখীর কলোরবে খুব ভোরে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল লাবণীর। চোখ মেলতেই প্রকৃতির মনমাতানো রূপবৈচিত্র্যে ও উচ্ছাসের টানে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে ওর শরীর ও মন। আজ যেন প্রকৃতিতেই সম্পূর্ণ বিসর্জিত লাবণী। যেদিকে তাকায় সবই নতুন লাগে। পূর্ব দিগন্তবিস্তৃত হলুদ আর লালচে সোনালী রংএর অপূর্ব সংমিশ্রণে খড়দ্বীপ্ত রৌদ্রাজ্জ্বল আকাশ। ঝুরুঝুরু মিহিন বাতাস আমোদিত হয়ে আছে রং-বেরং এর ফুলের সৌরভে। ইচ্ছে হচ্ছে মুক্ত বিহঙ্গের মতো খুশীর ডানা মেলে দূর-নীলিমায় ভেসে বেড়াতে।



স্বভাবসুলভ চপলতায় লাবণী স্বপ্নাপ্লুত হয়ে সুরের মূর্ছণায় আপন মনে গুণগুণ করতে করতে গিয়ে দাঁড়ায় ছাদে। মনের অজান্তেই ক্ষণে ক্ষণে সন্ধানি চোখদু’টো ওর প্রজাপ্রতির মতো চারিদিকে ঘুরতে থাকে। সুস্থীর হয়ে দাঁড়াতেই পাচ্ছিল না। মনটা অকারণেই বিচলিত হয়ে উঠছিল।



লাবণী নেমে আসে নিচে। অথচ নিচে নেমে এসে কিছুতেই স্বস্তি পায়না। কাজের অবসরে বার বার অস্থির মনপাখীটা ওর ছুটে চলে যেতে চাইছিল ছাদে। কিন্তু কিসের টানে যে মতিভ্রম হচ্ছিল, তা নিজেও বুঝতে পাচ্ছিল না লাবণী। হঠাৎ গেটের ধারে কাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুকটা ওর ছ্যাঁৎ ওঠে! -‘লোকটা কে ওখানে দাঁড়িয়ে! রবীনের মতো লাগছে! কাকে যেন খুঁজজে মনে হচ্ছে!



বড় বড় চোখ পাকিয়ে তাকায় লাবণী। গলা টেনে উঁকি ঝুকি মেরে দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, হ্যাঁ রবীণই তো! কিন্তু এলো কখন ও’? আর ওখানেই বা দাঁড়িয়ে কেন! আশ্চর্য! নিজের বাড়িতে ঢুকতে ওর সংকোচ হচ্ছে বুঝি! কিন্তু কাকে যেন খুঁজজে মনে হচ্ছে!



আসলে রবীন যে ওকেই খুঁজছিল, তা লাবণীই বা জানবে কেমন করে! এ তো চিন্তারও অতীত। ভাবাই যায়না। চকিতে হৃদস্পন্দন ওর আরো দ্রুত গতীতে চলতে থাকে। বুক ধুক্‌ধুক্‌ করে। কিন্তু ততক্ষণে সবুর সয়না লাবণীর। খুশীর তুফান উড়িয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে। সিঁড়ির গোঁড়ায় এসে থমকে দাঁড়ায়। ওর চোখেমুখে অপার বিস্ময়। ভিতরে ভিতরে অভিমানে ফেটে পড়লেও পলকহীন নেত্রে অভিভূতের মতো হাঁ করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কখনো যা কল্পনাই করেনি!



ওদিকে রবীনের অবস্থাও তদ্রুপ! ক্ষণপূর্বে কত কিই না ভবিতব্য রচনা করেছিল, আসন্ন বিরূপ পরিস্থিতির অনুমানিক চিত্র কল্পনা করে। বিস্ফোরণ একটা ঘটবেই। লাবণীকে রোধ করা যাবেনা। অথচ দেখা গেল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এতকিছু ঘটে যাবার পরও লাবণীর নির্বিকার আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। যাকে স্পর্শই করেনি কোনদিন! ইচ্ছে হচ্ছিল, ছুটে গিয়ে লাবণীকে আলিঙ্গন করতে, ওর বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ে বেষ্টিন করে ওকে সাবেগে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সংকোচ আর সাহসের অভাবে এক পাও নড়েনা। আবেগে উথলে উঠলেও সলজ্জে অপরাধীর মতো নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বড়ই অসহায় ওর চাহনি।

তখনও বুক ধুক্‌ধুক্‌ করে কাঁপে লাবনীর। ঠোঁট কাঁপে। অথচ ওর চোখেমুখে অভিমান বা নালিশের একটুও ছাপ নেই কোথাও। অপ্রত্যাশিত রবীণকে একান্ত করে পাবার আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রণে শিশির বিন্দুর মতো অশ্রুকণায় সিক্ত হয়ে ওঠে ওর চোখদু’টো! তবু কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না নিজের চোখদু’টোকে।



ততক্ষণে দুহাত প্রসারিত করে ওর সন্নিকটে এসে দাঁড়ায় রবীন। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চোখের তারাদুটির অব্যক্ত ভাষায় জ্বলজ্বল করে ওঠে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ে থাকে। হঠাৎ ওর অস্ফুষ্ট কন্ঠস্বরে কেঁপে ওঠে লাবণী। -‘এসো বিউটি! আমার কাছে এসো! এতো কি ভাবছ বলো তো! কি হলো, এসো!’



চিন্তাই করা যায়না। এ যেন কল্পনার অতীত! অথচ সম্পূর্ণ বাস্তব সত্য। রবীন আজ স্বয়ং নিজে ওর সম্মুখে এসে ধরা দিয়েছে! মায়ের দেওয়া সেই নাম ধরে মিষ্টি স্বরে প্রেম-আহ্বান জানায়! এ যে পরম পাওয়া লাবণীর! আর কি চাই!



চকিতে পুঞ্জীভূত মনের সমস্ত গ্লানি, মান-অভিমান ভুলে গিয়ে রবীণের আবেগাপ্লুত কন্ঠস্বরে ঊষার প্রথম সূর্যেøর ঝলমলে লালচে সোনালী আভার মতো লাবণী উজ্জ্বল দীপ্তিময় হয়ে ওঠে। তড়তাজা হাসির একটা ঝিলিক দিয়ে উঠল ওর ওষ্ঠের ফাঁকে! ইচ্ছে হচ্ছিল, রবীনের উষ্ণ বক্ষপৃষ্ঠে আঁছড়ে পড়তে, ওর বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ের বন্ধনে পিষ্ঠ হয়ে যেতে, শরীরের প্রতিটি অনু-পরমানুতে রবীণের সঙ্গে লীন হয়ে যেতে, ওর পশমাবৃত প্রশস্ত বক্ষের মাঝে মুখ গুঁজে পুরুষালী দেহের উষ্ণ অনুভূতিতে বুদ হয়ে থাকতে!



রবীন তখনও বিস্ময়ে অভিভূতের মতো তাকিয়ে ছিল লাবণীর রূপরাশি ও বুদ্ধিদীপ্ত চোখের চাহনির দিকে! যা পূর্বে কখনো ওর দৃষ্টিগোচর হয়নি। অথচ ওরই বিবাহিতা স্ত্রী লাবণী। যাকে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তািচ্ছল্যে পরিত্যাক্ত করে দূরে সরে গিয়েছিল। অথচ আজ ও’ যেন এক অনন্যা, লাবণ্যা, প্রেমের মহিমায় দ্বীপ্ত মমতাময়ী এক বিদূষী রমণী!



রবীণ হঠাৎ আবেগোপ্লুত হয়ে লাবণীর হাতদুটো শক্ত করে চেপে ধরে। কিছু বলার ব্যকুলতায় উদগস্খীব হয়ে ওঠে। অপ্রস্তুত লাবণী চকিতে শ্বাশত লজ্জায় দিশেহারা হয়ে মুখ লুকাবার পথ খোঁজে। কিন্তু ও’ লুকোবে কোথায়! রবীণের আবেগাপ্লুত প্রেমস্পর্শে বিদ্যুতের শখের মতো এক পুলক জাগা শিহরণে শিহরিত হয় সারাশরীর। অনুভূত হয়, হৃদয় নিঃসৃত গভীর অনুরাগের ছোঁয়া। শুনতে পায় ওর প্রাণস্পন্দন।



পলকে রক্তেরাঙা সাশ্রু নয়নে মুখ তুলে তাকায় লাবণী। আনন্দে-উচ্ছাসে উতলা হয়ে ওঠে। ওর চোখমুখ থেকে ঝড়ে পড়ে খুশীর ঝর্ণা। নতুন করে জাগ্রত হয়, এক অভিনব তীব্র অনুভূতি, শ্রদ্ধা-ভক্তি, প্রেম-ভালোবাসা। যার ফল্‌গুধারায় সবুজ পাতার মতো হৃদয়পটভূমি থেকে তরতর করে যেন বেড়ে উঠল লাবণীর।



ততক্ষণে রবীণের সপ্রশংস দৃষ্টির বিনিময়ে শরমে দুহাতে মুখখানা ঢেকে ফেলে স্পর্শকাতর লাবণী। রবীন নিঃসংশয়ে ও নিঃসংকোচেই লাবণীর মসৃণ পৃষ্ঠদেশে প্রেমস্পর্শে মৃদু হস্ত সঞ্চালন করতেই লজ্জা আর খুশীর সংমিশ্রণে চোখের তারাদু’টি ওর জ্বলজ্বল করে উঠল। নিমেষে ভেঙ্গে গেল অভিমানীর মান। সড়ে গেল শরমের আবরণ। অচীরেই নূয়ে পড়ল রবীনের পেশীবহুল প্রশ্বস্ত বক্ষস্থলে।



রবীন বুকে টেনে নিয়ে প্রেমালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতেই লাবণী অবিলম্বে সঁপে দিলো নিজেকে। মুহূর্তেই এক অনবদ্য সুখানুভূতিতে শান্ত হয়ে আসে ওর শরীর আর মন। খুঁজে পায় নিজের অস্তিত্ব। নারীর আপনসত্ত্বা। একজন বিবাহিতা স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা, আধিপত্য! আজ যেন চাওয়া-পাওয়ার অন্ত নেই লাবণীর। অনুভব করে নিজস্ব মাটিতে দাঁড়িয়ে দাম্পত্য জীবনের পরিপূর্ণতা, সার্থকতা এবং প্রয়োজনীয়তা।



হঠাৎ রবীনের পুরুষালী দেহের গন্ধ্যে মনের মধ্যে একধরণের নেশা ছড়িয়ে পড়ল। লজ্জায় রাঙা হয়ে বড়বড় চোখ মেলে কিছু বলার ব্যাকুলতায় অপলকে চেয়ে থাকে। ওর মধ্যে দিয়েই প্রেরণ করে ভালোবাসার সংকেত! টের পেয়ে রবীন হঠাৎ বাজপাখীর মতো ছোঁ মেরে লাবণীর হাতটা ধরে টেনে নিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ল ওর ঘরে।



প্রভাবতী ছিলেন রান্নাঘরে। রবীনের গলা শুনে সানন্দে আত্মহারা হয়ে তৎক্ষণাৎ বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। রবীনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চোখ ফিরতেই দেখলেন, সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে লজ্জায় রাঙা লাবণীর অব্যক্ত আনন্দে শিশির বিন্দুর মতো চোখদু’টো অশ্রুকণায় চিক্‌চিক্‌ করে উঠলেও অনাবিল খুশীতে আর আহাল্লাদে ও’ যেন ফেটে পড়ছিল!



অবশেষে স্তস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন প্রভাবতী। মুখ টিপে নিঃশব্দে হেসে ঢুকে পড়ে ছিলেন রান্নাঘরে। হঠাৎ দরজার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন। গলা টেনে দেখলেন, রবীনের স্যুট্‌কেস আর লাগেজটা তখনও বারান্দার কোণায় পড়ে আছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে বলতে ধীর পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। রবীনের স্যুট্‌কেস আর লাগেজটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন,-“সুখী হ তোরা!ন”



লেখকঃ কানাডা প্রবাসী গল্পকার ও সঙ্গীত শিল্পী, ইমেইল, [email protected]

Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.