![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
'ঘাড় গুজে চলা অভ্যাসটা খুব খারাপ।'
বন্ধ জানালার ওপাশ থেকে চাপা হুঙ্কার দিয়ে কিশোরী কন্ঠের তিরস্কার। সচকিত হয়ে আশপাশে তাকাই, কেউ শুনে ফেলল কিনা। না, সবদিক ফাকা । পরানটা লাফিয়ে গলার কাছে এসে বসে আছে। হাটা বন্ধ। অপেক্ষা করছি পরবর্তী ঝাড়ির। এবার একটু মোলায়েম গলায় অস্ফুট আহবান।
-আমার প্রাকটিক্যাল খাতাটা কবে পাবো, পরীক্ষা তো নাকের ডগায়।
-আর দুটো দিন সময় দেও। কোন রকম ধরা গলায় বলি।
-ঠিকাছে, দেরি যেন না হয়। আম্মা ডাকছে যাই।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। এই ধরণের পরিস্থিতিতে নিজকে কন্ট্রোল রাখা কঠিন। সারাদিন বই আর ছবি আকা নিয়ে সময় পার হয় আমার। কদাচিৎ ক্রিকেট খেলতে যাই। আসলে আকাআকিই ভাল লাগে। আর অক্ষর দিয়ে ছবি বানাতে মজা পাই। দু'এক লাইন ছড়ার মত মিলিয়ে বাক্য তৈরিতেও মজা লাগে।
তার আর আমার বাড়ী পাশাপাশি। কিছুদিন আগেও আমাদের সামনের সবুজ মাঠটাতে রঙিন ফ্রক পড়ে তার হরিণ শিশুর মত ছোটাছুটি দেখেছি। এখন কদাচিৎ জানালা খুলে ভেংচি দেয় আমায়। আমার জানালাটা প্রায়স বন্ধ থাকে। মাঝে মধ্যে বৃষ্টি আর চাদনী দেখতে খুলি। সকালে অবশ্য আম্মা খুলে দেয়। সাথে ঝাড়ি দিয়ে বলেন, অন্ধকারে তুই পচে যাবিরে খোকা। আমি বাইরে যাবার আগে বন্ধ করি। আমার তেমন কোন বন্ধু নেই। হই-হুল্লোড় পছন্দ নয়। মেয়ে ঘটিত বিষয় তো নয়ই। মফস্বল শহরের নিস্তরঙ্গ জীবনে আপন ভুবনটাই সবটুকু নিজকে নিয়ে। ছবি আকা আর তিন গোয়েন্দা সিরিজ হচ্ছে আনন্দের উপলক্ষ।
আব্বার ইচ্ছা ঢাকায় পড়াশুনা করি। আমিও স্বপ্ন দেখি চারুকলায় ভর্তি হব, অনেক বড় শিল্পী হব। পরীক্ষা শেষ। এখন ছবি আকা আর ছবি আকা। অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে চারুকলার গাইড আর বই-পত্র জোগাড় করেছি। আব্বার ছবি আকা পছন্দ নয়। এতে নাকি ভাত নেই। আম্মাকে বলেন, তোমার খোকার মাথা থেকে চারুকলার ভুত নামাও। ওতো না খেয়ে মরবে। এসব বলেন আর রাগে গজ গজ করেন।
এর মধ্যে সে এসে মায়ের কাছে বায়না ধরেছে, সুন্দর করে পেচিয়ে শিকলের মত করে দুটো লাইন লিখে দিতে হবে। আম্মা আমাকে নির্দেশ দিলেন তা লিখে দেয়ার। অনিচ্ছায় কি আসে যায়.. বাটার পেপারে থ্রিবি পেন্সিল দিয়ে লিখে দিলাম। আপদ বিদায় হলে বাচি।
ঢাকায় যাবার জন্যে জোরে সোরে প্রস্তুতি চলছে। এখন হাটা চলার মধ্যেও চারুকলা। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আবার আম্মার নির্দেশ মোতাবেক বায়োলজি খাতা একে দেয়ার ফরমায়েস। কী..অবস্থা! একসপ্তাহ আগে খাতা আমার টেবিলে। ধরি নাই, আসলে মনে নাই। এখন ঝাড়ির পর মনে হল সবকিছু।
তাড়াহুড়ো করে খাতাটা শেষ করলাম। বর্গার জমি চাষ আর কত ভাল হবে। গত বছর তেরটা খাতা পেয়েছিলাম। খাতা প্রতি দু'শো টাকা। আর এটাতো অনুরোধে ঢেকি গেলা। যাইহোক সিদ্ধান্ত হলো জুম্মাবার সন্ধ্যার গাড়িতে ঢাকা যাবো। ঢাবি'র জসীম উদ্দিন হলে পাড়াতো ভাই আছে। মোবাইলে কথা হয়েছে, ওর কাছেই আপাতত গন্তব্য।
বাইরে হালকা টিপটিপ বৃষ্টি। একবার মনে হল জানালাটা খুলে আকাশ দেখি। আবার আবেশে চোখ ধরে আসছে। হাত-পা ছেড়ে শুয়ে আছি আর চারুকলার কথা ভাবছি। জানালায় হালকা টোকার শব্দ। দুই তিনবারের পর একটু জোরে আর ফিসফিসে গলায় আদেশ, এই জানালা খোলো!
বুঝলাম সে এসেছে। দরোজা তো খোলা আর আম্মা ও ঘরে সুর করে তেলাওয়াত করছেন। ওখানে না এসে জানালায় কেন! জানালা খুলে দিতেই বলল, শোনো, আমার তাড়া আছে, খাতাটা দেও!
আমি খাতা তার বাড়িয়ে দেয়া হাতে তুলে দিতেই অন্যহাতটা পেছন থেকে এনে বলল-এইটা তোমার জন্য।
সে হাতে একটা গাঢ় লাল কাপড়ের ঝালর দেয়া হাতপাখা। কিছুটা অবাক হলে বলি- বারে! এটা নেব কেন! আম্মাকে দিয়ে কাজ আদায় করা আর এখন আদিখ্যেতা!
হঠাৎ তার চাঁদমুখটা আষাঢ়ের মেঘ হয়ে গেল। আকুতি মেশানো কন্ঠে অস্ফুট স্বরে বলল- আমিতো দু'শো জোগাড় করতে পারিনি আর এটা তোমাকে নিতেই হবে।
এই বলে পাখাটা হাতে রেখেই একপ্রকার দৌড়ে পালিয়ে গেল। যাবার আগে হাতটা একটু চেপে ধরেছিল আর আমি হঠাৎ নেই হয়ে গেলাম। সম্বিৎ ফিরে চেয়ে দেখি লিখে দেয়া সেই কথা- এই কথাটি মনে রেখ, তোমার একটি পাখি ছিল!
কী আশ্চর্য! হলের জানালা দিয়ে মেঘলা আকাশে তাকিয়ে আছি। সেখানে যেন একটি লেখা ক্যালিগ্রাফি হয়ে ফুটে উঠছে- তোমার একটি পাখি ছিল! ধীরে ধীরে আমার চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে, আমি যেন সেই চাঁদমুখ দেখতে পাচ্ছি।
©somewhere in net ltd.