![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
-আনিকা, তোমার আব্বুকে বলো খেতে আসতে!
নাবিলার মন খারাপ। সকাল থেকে একটা না একটা ঝামেলা ঘটেই চলেছে। ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে গিয়ে দেখে সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ। কয়দিন ধরে বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেল। সিলিন্ডার আনার নাম নেই, উল্টো ঝাড়ি! আর দু’টো দিন চালিয়ে নেও..ঈদ বোনাসটা পেয়েই সিলিন্ডার আনবো। এদিকে কলেজ থেকে ফিরে দুদ্দাড় করে কাপড় বদলিয়ে, কাঠের গুড়ি দিয়ে মাটির চুলায় যে পাক করে সেই জানে... নারী জনমের মাহাত্ম। উনি অংকের মাস্টার এসবের কি বুঝবে!
আর গুড়ি যে এনেছে, তা আমকাঠের কাচা গুড়ি, কস ঝরে.. চুলায় শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া... একশ টাকার কেরোসিনে সপ্তাহ পার হতে চায় না, অথচ সময়মত টেবিলে খাবার চাই! আরে ভাই! দেড় ঘন্টার ইংরেজি লেকচার তারপর ছাত্রদের অবান্তর প্রশ্নের জবাব দিয়ে এমনি মেজাজ তিরিক্ষি থাকে, তারপর বাসায় এসে চুলো ঠেলা কি সোজা কাজ!
না, তিনি এসব কিছুই জানেন না। কী সংসারে যে এসে পড়ছি, আল্লাহ মালুম!
সকালের নাস্তার ভাজি পুড়ল বলে সবার ঝাড়ি, তারপর কলেজের বাস ফেল, বিস্টিতে সিএনজি যেতে চায় না, ভাড়া পঞ্চাশ টাকা বেশি দিয়ে আবার মাঝপথে রাস্তার পানিতে কয়েকবার কাশি দিয়ে গাড়ি বন্ধ হয়ে সময় নস্ট। ক্লাসে লেটে গিয়ে অধ্যক্ষের তেড়া কথা- ম্যাডাম, প্রায়ই আপনি দেরি করছেন আজকাল। নাদিমের সাথে ঝামেলা নাকি?
অধ্যক্ষের সরু চোখের দৃষ্টিতে অস্বস্থি বাড়ে নাবিলার। বলা যায়, চরম অমত সত্ত্বেও শুধু চাকরি বাচাতে অধ্যক্ষের ভাতিজা ও বাংলা পাঁচ মার্কা বদনের ঐ অংকের মাস্টারের সাথে বিয়ে বসেছে সে। স্ট্রোক করে বৃদ্ধ বাবা ঘরে পড়ে আছে, চার চারটি ভাইবোনের লেখাপড়া, সবদিক দেখতে হয় তাকে।
সন্ধ্যার পর আকাশ কালো করে মেঘ নামল আর টিউশনি থেকে নাদিম ভিজে চুপচুপা হয়ে বাসায় ঢুকেই চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল.. কী! ওনাকে ছাতি নেয়ার কথা বলা হয়নি কেন!
নাবিলাও তো ভিজে এসেছে। এখন আর মান-অভিমান তাকে ছোয় না। সংসারের চাপে অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে গেছে।
একটু গুড়ের চা খেতে ইচ্ছে হল নাবিলার। ফ্রিজে রাখা গুড়ের জারটা দেখে হঠাৎ মনে হল... শ্রাবণের আজ কত তারিখ!
মনে পড়তেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। আম্মা খেজুর গুড় আর নারকেল দিয়ে পায়েস করছেন, বাতাসে মাতাল করা তার ঘ্রাণ, নাবিলার খুব ইচ্ছে হল সেও পায়েস রান্না শিখবে। আম্মা বললেন পরীক্ষার পর শিখিয়ে দেবেন।
আব্বা তখন স্কুলের সাইন্সের শিক্ষক। ছাত্ররা বাসায় পড়তে আসে। আসিফের প্রাইভেট পড়ার সামর্থ নেই বলে, আব্বা তাকে দিয়ে এটা-সেটা করিয়ে নেন আর জুম্মাবার আছরের পর পড়াটা একটু দেখিয়ে দেন, তাও অনিয়মিত। আসিফের তাতে কোন আফসোস করতে সে দেখেনি। ভীষণ পরিশ্রমী আর মেধাবী ছিল সে। বরাবর প্রথম হত পরীক্ষায়, এজন্য আম্মা তার উদাহরণ দিয়ে বলতেন, এই ছেলেটা একদিন অনেক বড় হবে। তোরা ওকে দেখে শিখতে পারিস না।
আব্বার সাথে একদিন রাতে আম্মা বললেন, গরীবের ছেলে, আহা! কী মায়া ভরা চেহারা, লেখাপড়ায় যেমন, কাজে-কর্মে বিনয়ী। তুমি ছেলেটার দিকে একটু নজর রেখো। আব্বা খুব রসিক মানুষ, ফোড়ন কেটে বললেন, ব্যাপার কি, কোন মতলব আছে নাকি! আম্মা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, সালাম মাতবরের মাইয়া হইয়া তোমার সাথে প্রেম কইরা বিয়ে বসছি দেইখা মনে কইরো না, নাবিলারে গাঙ্গে ভাসাইয়া দিমু। আমার জামাই হবে সওদাগরের পোলা সওদাগর আর পিএইচডি ডিগ্রিধারী। আব্বা অবাক হয়ে বললেন, আরে! পিএইচডি করতে করতে ছেলের চান্দি ফাকা হয়ে যাবে! আইবুড়ো জামাই চাও নাকি! আম্মা বিরক্তি নিয়ে বললেন, টাকাওলা আর শিক্ষিত জামাই আমার সিদ্ধান্ত।
নাবিলা এসব কথায় কান দেয় না। সেও ক্লাসের ফাস্ট গার্ল। তবে মাঝে মধ্যে আসিফের কাছে সে অংক বুঝে নিত আগে। এখন আব্বা-আম্মার কথার পর তার ভেতর কেমন একটা বোধ হয়। এখন আর আসিফের সামনে তেমন আসে না। আম্মার গুড়ের পায়েস খুব প্রিয় আসিফের। পায়েস হলেই আব্বাকে বলেন- মা মরা ছেলেটাকে বাসায় আসতে বলো। আগে রান্নাঘরে ডেকে পায়েস খাওয়াতেন এখন ড্রয়িং রুমে নাবিলা এনে দেয়। আম্মা বলেন, ছেলেটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। হাজার হলেও পরের ছেলে..তারপর গরীবের.. ঘরের ভেতর না আনাই ভাল।
একদিন হল কি! বাসায় পায়েস রান্না হয়েছে। আব্বা বললেন, ছেলেটা জ্বরে পড়েছে শুনেছি, এখন একটু ভাল। ডেকে পাঠাবো? আম্মা ঝাড়ি দিয়ে বললেন, পরের ছেলেকে এত লাই দেয়া কেন! আশ-পাশে কানাকানি ভাল লাগে না। কিন্তু পরদিন আম্মাই তার হোমিও ওষূধ আনতে আসিফকে নতুন বাজার পাঠালেন। ড্রইং রুমে নাবিলা বীজগণিত করছিল। রাইট হ্যান্ড-লেফট হ্যান্ড অংক। শেষ একটা অংক মিলছেই না। এ সময় আসিফ অষুধ নিয়ে এল। কয়দিনের জ্বরে খুব কাহিল দেখাচ্ছিল তাকে। ভেতর থেকে ছোট বোন নাদিয়া অষুধ নিতে এসে হুট করে বলে ফেলল। -ভাইয়া, আমরা না কালকে পায়েস খেয়েছি। আসিফ হেসে বলল, আমার ভাগ কই? নাদিয়া হাত নেড়ে বলল, বারে! আম্মাই তো তোমাকে পায়েস দিতে নিষেধ করেছেন। তাই তোমার জন্য রাখা হয়নি। এই বলে অষুধ নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
ড্রইং রুমে তখন নিঃশব্দতা যেন জগদ্দল পাথর হয়ে আমাদের ওপর চেপে বসেছে। আসিফের মুখটা নিমেষে সন্ধ্যার জমাট আধারে ঢেকে গেছে। আমি অংকটা একটু দেখে নেব কি নিজের কাছে খুব অসহায় আর ছোটলোকি মনে হচ্ছে। আসিফ কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। মনে হল তার এতদিনের সব আনন্দ-ভাললাগা আজ বিষাদে ছেয়ে গেছে।
সে রাতে নাবিলার ঘুম আসছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল, কিছু যেন একটা গড়বড় হচ্ছে। আম্মা কেনই বা নিষেধ করবেন আর কেনই বা তার এত খারাপ লাগছে।
নাবিলার পরীক্ষা শেষ। আম্মা রান্না ঘরে তাকে ডেকে পাঠালেন পায়েস রান্না শেখাবেন বলে। নাবিলার ভাল লাগছিল না। তবু আম্মার ভয়ে রান্নাটা করল ফরমায়েস মত। ঠিকমত যাতে পায়েসটা হয় এজন্য বললেন, মনে রাখবা, নিজের জন্য এটা করছো না, প্রিয়জন যদি ভাল না বলে তাহলে সব মাটি হবে। নাবিলার তখন মনে হল, তার প্রিয়জনটা কে? যাহোক, সবাই পায়েস খেয়ে খুব প্রশংসা করল। নাবিলার খুব আনন্দ হল তাতে। কী মনে করে এক বাটি পায়েস আলাদা করে ফ্রিজে তুলে রাখল।
আব্বাই কথাটা খাবার টেবিলে ফিস ফিস করে আম্মাকে বললেন, আসিফকে তোমার কথামত টিসি দেয়া হয়েছে। আজ হয়ত ছেলেটা চলে যাবে। কাজটা হয়ত ভাল হল না। আম্মা চেহারা শক্ত করে বললেন, আমার মেয়ের দিকটা আমাকে দেখতে হবে, বুঝেছো।
শেষ বিকেলের দিকে আম্মা পাশের বাড়ি গল্প করতে গেছেন। নাবিলা বিছানা শুয়ে আছে মুখ গুজে। এসময় দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ। নাদিয়া আম্মার সাথে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরোজা খুলতে যেতে যেতে ভাবল, আব্বা হয়ত এসেছেন।
না, আসিফ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে সেখানে। -স্যার আছেন? একটু দরকার ছিল। খুব নিচু আর ধরা গলায় বলল।
নাবিলা কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিল না। হঠাৎ দুপুরের কথা মনে পড়ল, পায়েসের কথাও। মুখে বলল, একটু বসো, আমি আসছি বলে ভেতরে গেল সে। কিছুক্ষণের মধ্যে পায়েস এনে সামনে দিল।
- পায়েস খেতে পারছিনা বলে দুঃখিত। স্যারকে একটু ডেকে দাও। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল আসিফ।
-একটু খেয়েই দেখো না, কেমন হয়েছে? আমি না আজ প্রথম তৈরি করেছি এটা।
-সরি, আরেকদিন সময় করে এসে খেয়ে যাবো, আমার একটু তাড়া আছে। স্যার কি বাসায় নেই!
-তোমার এত তাড়া কিসের! এটা তোমার জন্য রেখেছিলাম আলাদা করে। একটু খেয়েই দেখো না। আর আব্বা ঘরে নেই তাকে কিছু বলার থাকলে আমাকে বলতে পারো।
-না, আমি শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি তো তাই স্যারকে সালাম জানাতে এসেছি।
-কেন চলে যাচ্ছ? নাবিলার হঠাৎ ভেতরটা কেমন করে ওঠে।
-আমাকে টিসি দেয়া হয়েছে আর হোস্টেল আজই ছাড়তে হচ্ছে।
-ও, তা কোথায় যাবে ঠিক করেছো কিছু? নাবিলার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
-না, তবে মনোয়ার স্যার একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন, ঢাকায় তার এক বন্ধুর কাছে হয়ত কিছু একটা হতে পারে। আমার সময় শেষ হয়ে এল। স্যারকে আমার সালাম দিও। চলি, ভাল থেকো। আসিফ বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াল।
-পায়েসটা একটু খাবে না? নাবিলার যেন কান্না পাচ্ছে।
-যদি আবার কখনও দেখা হয়, এমন মেঘলা দিনে, তোমার হাতের পায়েস খেতে আসবো।
দরোজা পেরিয়ে সামনে কাজল দিঘী, তার ওপার সরু পথ দিয়ে আসিফ চলে যাচ্ছে। নাবিলার শুধু মনে হচ্ছে তার চোখের লোনা জলে দিঘীটা থই থই করছে।
কত দিন কত বছর পেরিয়ে গেছে। শ্রাবণের সেই প্রহর আসে। নাবিলা পায়েস তৈরি করে, সারাদিন, ভরসন্ধ্যা অপেক্ষা করে।
©somewhere in net ltd.