![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাৎস্যায়নো মল্লনাগঃ কৌটিল্যশ্চ ণকাত্মজঃ। দ্রামিলঃ পক্ষিলস্বামী বিষ্ণুগুপ্তোহঙ্গুলশ্চ সঃ।।
সাহিত্যকে যদি আমরা সমাজ বাস্তবতার জলছবি মনে করি তবে সাহিত্য স্রষ্টা একজন চিত্রশিল্পী। তিনি তার কল্পনার রঙে ফুটিয়ে তুলেন সমাজের প্রতিচ্ছবি। আর সেই সাহিত্য যখন জীবন্ত হয়ে আমাদের জীবনকেই প্রতিফলিত করে তুলে তখন তা শুধু শিল্প নয় বরং সমাজের দর্পন হয়ে ওঠে প্রকৃতপক্ষে, সত্যিকারের সাহিত্যস্রষ্টারা তাদের সাহিত্যে জীবনকে এমনভাবে প্রকাশিত করেন, জীবনের মহত্তম সত্য যেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে প্রতিফলিত হয়।
বিশ্বসাহিত্যের রথী মহারথীর ভিড়ে এমন কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে অনেক। তবে সকল সৃষ্টির চেয়েও জীবন্ত করে জীবন ও সমাজকে যারা তুলে ধরেছেন তারা হচ্ছেন ফ্রান্সের ভিক্টর হুগো, রাশিয়ার তলস্তয় ও গোর্কি। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে হুগো তলস্তয় আর গোর্কিকেও ছাড়িয়ে গেছেন। আর সেটা হচ্ছে সমাজের প্রতিটি দিককে তুলে ধরার প্রতিভায়। তলস্তয়ের উচ্চ নৈতিক আদর্শ ও জীবনের মহান বোধ যেমন তার লেখায় ফুটে ওঠেছে, তেমনি বাস্তব জীবনের কুৎসিত দিকটাও তিনি তুলে ধরেছেন নির্দ্বিধায়। গোর্কির মতো নীচুতলার মানুষের জীবনচিত্র যেমন তিনি আঁকতে পেরেছেন, তেমনি অভিজাতশ্রেণির মানবিক দ্বন্দ্ব ও বিবেকের ঘাত প্রতিঘাতকেও বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন সমান্তরালভাবে। তারই অমর এক সৃষ্টি লা মিজারেবল।
লা মিজারেবলকে শুধু উপন্যাস বললে ভুল হবে। বরং তা একটি জাতীয় জীবনের উত্থান পতন, জয় পরাজয়, আনন্দ বেদনা ও আশা নিরাশার কাব্য। চরিত্র চিত্রণ, ভাব ও ভাষার গভীরতা, জীবন বাস্তবতা, চিত্রকল্পের উত্তুঙ্গতা কিংবা আয়তনের বিশালতা সব দিক থেকেই এই রচনা বিশ্বসাহিত্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক সৃষ্টি। তলস্তয়ের সমসাময়িক ও সমআয়তনিক উপন্যাস 'ওয়ার এন্ড পীস' এর সাথে তুলনীয় হলেও শিল্পের গভীরতা ও সৌকর্যে লা মিজারেবল অনেকটাই এগিয়ে।
ফরাসী ভাষায় লা মিজারেবল শব্দের অর্থ হতভাগারা। তবে তৎকালীন ফ্রান্সের হতভাগ্যরাই শুধু নয় বরং এই উপন্যাসে উঠে এসেছে সমগ্র ফ্রান্সের অষ্টাদশ শতকের শেষ এবং উনবিংশ প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত জন জীবনের বাস্তব চিত্র।
উপন্যাসের নায়ক জাঁ ভালজাঁ এক বিবর্তনধর্মী চরিত্র যা বিশ্বসাহিত্যে অদ্বিতীয়। অভাবের তাড়নায় সামান্য একটি রুটি চুরির দায়ে ১৯ বছর কারাদণ্ড ভোগের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার জীবনের উত্থান পতন। জীবনের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে তার চরিত্র মোড় নেয়। উদ্ভাসিত হতে থাকে নতুন এক দিগন্তে। তার কারামুক্তির পর সে যখন সমাজের নিষ্ঠুরতায় পতনের দ্বারপ্রান্তে, খ্রিস্টীয় চেতনা ও নীতিবোধের প্রতীক বিশপ মিরিয়েলের সংস্পর্শে ভালজাঁ হয়ে উঠে অন্য এক মানব। সময়ের স্রোতে হতে থাকে তার চরিত্রের ভাঙাগড়া। জাঁ ভালজাঁর পাশাপাশি এই উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্রই স্বমহিমায় ভাস্বর। প্রত্যেকেই প্রতিনিধিত্ব করছে ফরাসী সমাজের উপর থেকে নীচ প্রতিট অংশের। এখানে যেমন মহান নীতিবোধ নিয়ে আছেন বিশপ মিরিয়েল, তেমনি পাশবিক মনোবৃত্তি নিয়ে নীচমনা থেনার্দিয়ের। আছে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রজাতন্ত্রের পারস্পারিক দ্বন্দ্বের প্রতীকরূপী বৃদ্ধ গিলেনমার্দ ও তার যুবক দৌহিত্র মেরিয়াস।
ফ্রান্সের তৎকালীন সমাজের চিত্রের পাশাপাশি এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে ফরাসী বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারা। যার বিশাল অংশ জুড়ে বিরাজমান নেপোলিয়ন।
প্রজাতন্ত্রের উত্থানপতন, বিপ্লব প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে উপন্যাসটির প্রকৃত চরিত্র আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। লা মিজারেবলের হতভাগা প্রকৃত অর্থে ফ্রান্স। আর জাঁ ভালজাঁর জীবনের উত্থানপতন ফ্রান্সের ইতিহাসেরই উত্থানপতন। আর এর মধ্যেই চির উজ্জ্বল হয়ে থাকে বিপ্লবী বালক গাভ্রোশের চরিত্রটি। আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে যে জীবনকে জয়ী করে মৃত্যুর বিপরীতে। বিপ্লবের বৃক্ষের গোড়ায় ঢেলে যায় তাজা রক্ত জীবনের জয়গান গেয়ে আর অত্যাচারীকে বিদ্রুপ করতে করতে। অবশেষে বিপ্লব দমিত হয়। কিন্তু থেকে যায় আষা। আর জাঁ ভালজাঁর শেষ পরিণতির মাধ্যমে উপন্যাস পরিণতি লাভ করে। মৃত্যুর সুমহান স্বরূপ উন্মোচিত হয় আমাদের সামনে।
দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে ভিক্টর হুগো তার এই মহাকাব্যপ্রতিম রচনা সৃষ্টি করেন। ফ্রান্সকে বিমূর্ত রূপে তুলে ধরেন বিশ্বের সামনে। এই ফ্রান্স ভিভা লা ফ্রাঁস, লা ত্যুজুর ফ্রাঁস অর্থাৎ শিল্প সাহিত্যের কল্পিত স্বর্গ নয় বরং বাস্তব ফ্রান্স।
একজন সাহিত্যিক যখন তার সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরতে পারেন তখন নিজেই হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠান। আর একজন সাহিত্যিক যখন তার রচনায় জাতীয় জীবনের জীবন্ত প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করেন তখন তিনি নিজেই হয়ে যান জাতীয় জীবনের অংশ। ফরাসী জাতীয় জীবনের প্রতিনিধি 'লা মিজারেবলের' মাধ্যমে ভিক্টর হুগোও হয়ে ওঠেন একটি জাতীয় জীবনের আবহমানতার অংশ। ধন্য তিনি, ধন্য তার রচনা!
©somewhere in net ltd.