নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নিরপেক্ষ নই, আমি ভাল'র দলে

গালিগালাজ ও ক্যাচালমুক্ত ব্লগ

চিরতার রস

ভাল'র সাথে থাকি। ভাল'র মাঝে বাঁচিতে চাই ফেসবুকে বন্ধু হতে চাইলে- www.facebook.com/chiroter.rosh

চিরতার রস › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা আবৃত্তির কবিতা সংকলন - সংগ্রহে রাখুন

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:১০

আট বছর আগের এক দিন

- জীবনানন্দ দাশ



শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আধাঁরে



যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হল তার সাধ। বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল;

প্রেম ছিল,আশা ছিল-জোৎসনায়,-তবে সে দেখিল

কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।

এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!



রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি

আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;

কোনোদিন জাগিবেনা আর।



কোনোদিন জাগিবেনা আর।

জাগিবার গাঢ় বেদনার

অবিরাম - অবিরাম ভার

সহিবেনা আর -

এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদডুবে চ’লে গেলে - অদ্ভুদ আঁধারে

যেন তার জানালার ধারে

উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।



তবুও তো পেঁচা জাগে;

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।

আরেকটি প্রভাতের ইশারায় - অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে

টের পাই যুথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা

মশা তার অন্ধকার সংগ্রামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে



রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রোদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;

সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন - যেন কোন বির্কীন জীবন

অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;

চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে

একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা - একা,

যে জীবন ফড়িঙের,দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা

এই জেনে।



অশ্বথের শাখা

করেনি কি প্রতিবাদ ? জোনাকির ভিড় এসে

সোনালী ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে

করেনি কি মাখামাখি?

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে

বলেনি কি; ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে

চমৎকার !

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’

জানায়নি পেঁচা এসে এ-তুমুল গাড় সমাচার ?



জীবনের এই স্বাদ-সুপক্ক যবের ঘ্রান হেমন্তের বিকেলের-

তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;

মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো

মর্গে - গুমোটে-

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।

শোনো

তবু এ মৃতের গল্প; কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখেনি কোন খাদ,

সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধু

মধু-আর মননের মধু

দিয়েছে জানিতে;

হাড়হাবাতের গ্লানি বেদনার শীতে

এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।



জানি - তবু জানি

নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় -

আর এক বিপন্ন বিষ্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে,

ক্লান্ত - ক্লান্ত করে;

লাশকাটা ঘরে

সেই ক্লান্তি নাই;

তাই

লাশকাটা ঘরে

চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।



তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি,আহা,

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,

চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে ?’

চমৎকার !

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার-



হে প্রগাঢ় পিতামহী,আজো চমৎকার ?

আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো-বুড়ি চাঁদটারে আমি

ক’রে দিবো কালীদহে বেনোজলে পার;

আমরা দুজনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।



বনলতা সেন

- জীবনানন্দ দাশ



হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।



চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর

হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'

পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।



সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।



আবার আসিব ফিরে

- জীবনানন্দ দাশ



আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে - এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয় - হয়তো বা শাঁখচিল শালিকের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিঁকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।

হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর - ঘুঙুর রহিবে লাল পায়

সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে।

আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে

জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়।



হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।

হয়তো শুনিবে এক লক্ষীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে।

হয়তো খৈয়ের ধান সরাতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে।

রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে

ডিঙ্গা বায় - রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে,

দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে।



কান্ডারী হুশিয়ার!

- কাজী নজরুল ইসলাম



দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!



দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?

কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।

এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।



তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!

যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।

ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,

ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।



অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন

কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার



গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,

পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!

কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?

করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!



কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,

বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!

ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!

উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।



ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,

আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান

আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!



নিমন্ত্রণ

- জসীমউদ্দীন




তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,

গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;

মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি

মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,

মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,

তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,



ছোট গাঁওখানি - ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,

কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;

ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী

পারের খবর টানাটানি করি;

বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;

বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।



তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,

গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।

সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া

দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,

বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,

বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!



তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে - নরম ঘাসের পাতে

চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।

তেলাকুচা-লতা গলায় পরিয়া

মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,

হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,

তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।



তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি

নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।

মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া

তোর সনে দেই মিতালী করিয়া

ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,

সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।



তুমি যদি যাও - দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,

সীম আর সীম - হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।

তুমি যদি যাও সে - সব কুড়ায়ে

নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,

খাব আর যত গেঁঢো - চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,

হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।



তুমি যদি যাও - শালুক কুড়ায়ে, খুব - খুব বড় করে,

এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,

কারেও দেব না, তুমি যদি চাও

আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,

মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,

ও পাড়াব সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;



সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,

মতলব কিছু আঁটিব যাহাতে খুশী তারে করা যায়!

লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া

বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া

এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,

বলিব - কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।



খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,

কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে

রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে

ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;

কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে

সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।



ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,

কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।

ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।

গালি-ভরা মার অমনি আদর,

কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;

যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।



যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।

ঘন কালো বন - মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।

গাছের ছায়ায় বনের লতায়

মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!

আজি সে-সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,

যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।



তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে

লুকায়ে থাকিস্, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।

মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,

হারাইয়া যাস্ পথ নাহি পেয়ে;

অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,

সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।



প্রিয়তমাসু

- সুকান্ত ভট্টাচার্য




সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।

অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে

আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-

স্বদেশের সীমানায়।



দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,

স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে

নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো

দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;

- ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।



আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,

হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,

রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,

আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।

আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,

স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,

চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ

কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?

কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?

যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,

চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,

প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,

গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,

রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই।



তোমাকে ভেবেছি কতদিন,

কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,

কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।

কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে

কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে

তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।

তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে

ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,

ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে

বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।

আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র।

জানি না আজো, আছ কি নেই,

দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে

জানি না তাও।



তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায়

ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।

জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই

মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;

জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,

মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।

তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে

সে তোমার হৃদয়।

যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;

পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়

আর সামনে নয়,

এবার পেছনে ফেরার পালা।



পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,

এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।

প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক'রে পেলাম কী? উত্তর তার-

তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,

ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,

ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;

আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।



আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,

সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে

অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,

নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।





বাংলার মুখ

- জীবনানন্দ দাশ




বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ

খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতো ব্ড় পাতাটির নিচে বসে আছে

ভোরের দয়েলপাখি - চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ

জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের-অশথের করে আছে চুপ;

ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;

মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে

এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ



দেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে -

কৃষ্ণা-দ্বাদশীর জোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায় -

সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,

শ্যামার নরম গান শুনেছিল - একদিন অমরায় গিয়ে

ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়

বাংলার নদ-নদী-ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।





জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী

- সুকান্ত ভট্টাচার্য




কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে

জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী;

আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে

বজ্রের কানাকানি।

সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে

শান্তি পালাল আজ।

দিন ও রাত্রি হল অস্থির

কাজ, আর শুধু কাজ!

জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর

হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর

ওঠে তার গর্জন-

প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!



হাজার হাজার শহীদ ও বীর

স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর

ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন।

ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ

কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্;

প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার,

অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার

দ্বার ভাঙা আজ পণ;

এতদিন ধ'রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্।

ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,

ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে

গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে

আজো রোমাঞ্চকর;

ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়

কে আছে আজকে ওদের ফিরায়

কে ভাবে ওদের পর?

ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়!

নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে

ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে

ওদের ফিরাব কবে?

কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে

কোটি মানুষের দুর্বার চাপে

শৃঙ্খল গত হবে?

কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে

কোটি জনতার জোয়ারের জলে

ভেসে যাবে কারাগার।

কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার?

মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি;

ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,

বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে

গোপনে করেছে ঋণী।

মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!

হে খাতক নির্বোধ,

রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ!

শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,

শোনো স্বদেশের ভাই,

রক্তের বিনিময় হয় হোক

আমরা ওদের চাই।।



আনন্দময়ীর আগমনে

- কাজী নজরুল ইসলাম




আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?

স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।

দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,

ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?



মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি

খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।

ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,

মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।



তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে

রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-

অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,

আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।

দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা

দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..



'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!



১লা মে-র কবিতা

- সুকান্ত ভট্টাচার্য




লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে,

কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়?

কতদিন তুষ্ট থাকবে আর

অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে?

মনের কথা ব্যক্ত করবে

ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে?

ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন?

ঝুলে পড়া তোমার জিভ,

শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল?

মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে

কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে?

কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ?

তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো,

অস্বীকার করো বশ্যতাকে।

চলো, শুকনো হাড়ের বদলে

সন্ধান করি তাজা রক্তের,

তৈরী হোক লাল আগুনে ঝল্সানো আমাদের খাদ্য।

শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক

সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।।



ছাড়পত্র

- সুকান্ত ভট্টাচার্য




যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে

তার মুখে খবর পেলুম:

সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,

নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার

জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।

খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত

উত্তোলিত, উদ্ভাসিত

কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।

সে ভাষা বোঝে না কেউ,

কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।

আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা

পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-

পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর

অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি-

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে,

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।।



ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর




ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,

ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,

আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

রক্ত আলোর মদে মাতাল ভোরে

আজকে যে যা বলে বলুক তোরে,

সকল তর্ক হেলায় তুচ্ছ ক’রে

পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।

আয় দুরন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।



খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়;

আর তো কিছুই নড়ে না রে

ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়।

ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,

চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,

ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা

অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।

আয় জীবন্ত, আয় রে আমার কাঁচা।



বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,

দেখে না যে বাণ ডেকেছে

জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।

চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে

মাটির ‘পরে চরণ ফেলে ফেলে,

আছে অচল আসনখানা মেলে

যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,

আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।



তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।

হঠাৎ আলো দেখবে যখন

ভাববে এ কী বিষম কাণ্ডখানা।

সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে,

শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে,

সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে

লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়।

আয় প্রচণ্ড, আয় রে আমার কাঁচা।



শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী

চিরকাল কি রইবে খাড়া।

পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।

ঝড়ের মাতন, বিজয়-কেতন নেড়ে

অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে,

ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে

ভুলগুলো সব আন্ রে বাছা-বাছা।

আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা।



আন্ রে টেনে বাঁধা-পথের শেষে।

বিবাগী কর্ অবাধপানে,

পথ কেটে যাই অজানাদের দেশে।

আপদ আছে, জানি অঘাত আছে,

তাই জেনে তো বক্ষে পরান নাচে,

ঘুচিয়ে দে ভাই পুঁথি-পোড়োর কাছে

পথে চলার বিধিবিধান যাচা।

আয় প্রমুক্ত, আয় রে আমার কাঁচা।



চিরযুবা তুই যে চিরজীবী,

জীর্ণ জরা ঝরিয়ে দিয়ে

প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি।

সবুজ নেশায় ভোর করেছি ধরা,

ঝড়ের মেঘে তোরি তড়িৎ ভরা,

বসন্তেরে পরাস আকুল-করা

আপন গলার বকুল-মাল্যগাছা,

আয় রে অমর, আয় রে আমার কাঁচা।



কুলি-মজুর

- কাজী নজরুল ইসলাম




দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?

যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,

বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।

বেতন দিয়াছ?-চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল!

কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল্?

রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,

রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,

বল ত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা

কার খুনে রাঙা?-ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি হঁটে আছে লিখা।

তুমি জান না ক’, কিন- পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,

ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে!



আসিতেছে শুভদিন,

দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ!

হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়,

পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়,

তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি,

তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি;

তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান,

তাদেরি ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসে নব উত্থান!

তুমি শুয়ে র’বে তেতালার পরে আমরা রহিব নীচে,

অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে!

সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে

এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরি বশে!

তারি পদরজ অঞ্জলি করি’ মাথায় লইব তুলি’,

সকলের সাথে পথে চলি’ যার পায়ে লাগিয়াছে ধূলি!

আজ নিখিলের বেদনা -আর্ত পীড়িতের মাখি’ খুন,

লালে লাল হ’য়ে উদিছে নবীন প্রভাতের নবারুণ!

আজ হৃদয়ের জমা-ধরা যত কবাট ভাঙিয়া দাও,

রং-করা ঐ চামড়ার যত আবরণ খুলে নাও!

আকাশের আজ যত বায়ু আছে হইয়া জমাট নীল,

মাতামাতি ক’রে ঢুকুক্ এ বুকে, খুলে দাও যত খিল!

সকল আকাশ ভাঙিয়া পড়-ক আমাদের এই ঘরে,

মোদের মাথায় চন্দ্র সূর্য তারারা পড়-ক ঝ’রে।

সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি’

এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।

একজনে দিলে ব্যথা-

সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা।

একের অসম্মান

নিখিল মানব-জাতির লজ্জা-সকলের অপমান!

মহা-মানবের মহা-বেদনার আজি মহা-উত্থান,

উর্ধ্বে হাসিছে ভগবান, নীচে কাঁপিতেছে শয়তান!





অন্তর মম বিকশিত করো

- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর




অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তরতর হে।

নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,

সুন্দর কর হে।

জাগ্রত করো, উদ্যত করো,

নির্ভয় করো হে।

মঙ্গল করো, নরলস নিঃসংশয় করো হে।

অন্তর মম বিকশিত করো,

অন্তরতর হে।



যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,

মুক্ত করো হে বন্ধ,

সঞ্চার করো সকল মর্মে

শান্ত তোমার ছন্দ।

চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,

নন্দিত করো, নন্দিত করো,

নন্দিত করো হে।

অন্তর মম বিকশিত করো

অন্তরতর হে।



মুনাজাত

- কাজী নজরুল ইসলাম




আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে

বাঁচাও প্রভু উদার।

হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে

নীচ পাপ নাহি আর।



যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,

যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,

জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-

ক্ষমা নাহি নীচতার।।



ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার

হৃদয়ের পরিসর,

যেন সম ঠাঁই পায়

শত্রু-মিত্র-পর।



নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো

অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,

কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী

ক্ষুদ্র আত্মা তার।।



যাত্রা-ভঙ্গ

-নির্মলেন্দু গুণ




হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,

মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না

এক কে করি দুই৷





হেমের মাঝে শুই না যবে,

প্রেমের মাঝে শুই

তুই কেমন করে যাবি?

পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া

আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,

দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷

তখন আমি একটু ছোঁব,

হাত বাড়িয়ে জাড়াব তোর

বিদায় দুটি পায়ে,

তুই উঠবি আমার নায়ে,

আমার বৈতরনী নায়ে৷

নায়ের মাঝে বসব বটে,

না-এর মাঝে শোব৷

হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ,

দু:খ দিয়ে ছোঁব৷

তুই কেমন করে যাবি?

মন্তব্য ৩২ টি রেটিং +৮/-০

মন্তব্য (৩২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:১৬

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

বাহ দারুন পোস্ট অনেকগুলো প্রিয় কবিতা একসাথে পাওয়া গেল।

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:১৭

চিরতার রস বলেছেন: প্রিয় কবিতাগুলোর সংকলনে হাত দিলাম আরকি। ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে ইনশাল্লাহ্।।। :)

২| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:২০

আহমেদ নিশো বলেছেন: ধইন্না, আগায়া যান

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৫

চিরতার রস বলেছেন: আপনাকেও ধইন্না পাতা। সাথে থাকবেন আশা করছি।

৩| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:২০

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: সুন্দর সংকলনের কাজ
ধন্যবাদ প্রিয়তে

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৬

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই।

৪| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:২৬

আহমেদ নিশো বলেছেন: আমার অনেক প্রিয় একটি কবিতা


পল্লী-বর্ষা

-জসীমউদ্দিন

আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!
বাদলের জলে নাহিয়া সে মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।
কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জল-ধারা
তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া!
হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,
নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে না জানি সে কোন দিঠি!
চিঠির উপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন ঘাটে!
কোন্ সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী, -
হয়ত আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি!
দিকে দিগেনে- যতদূর চাহি, পাংশু মেঘের জাল
পায়ে জড়াইয়া পথে দাঁড়ায়েছে আজিকার মহাকাল।

গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়, -
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।
কেউ তুলিতেছে বাঁশের লাঠিতে সুন্দর করে ফুল
কেউবা গড়িছে সারিন্দা এক কাঠ কেটে নির্ভুল।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে,
আমীর সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।

লাঠির উপরে, ফুলের উপরে আঁকা হইতেছে ফুল,
কঠিন কাঠ সে সারিন্দা হয়ে বাজিতেছে নির্ভুল।
তারি সাথে সাথে গল্প চলেছে- আমীর সাধুর নাও,
বহুদেশ ঘুরে আজিকে আবার ফিরিয়াছে নিজ গাঁও।
ডাব্বা হুঁকাও চলিয়াছে ছুটি এর হতে ওর হাতে,
নানান রকম রসি বুনানও হইতেছে তার সাথে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘ ডাকে,
এ সবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপকথা আঁকে!
যেন ও বৃদ্ধ, গাঁয়ের চাষীরা, আর ওই রূপ-কথা,
বাদলের সাথে মিশিয়া গড়িছে আরেক কল্প-লতা।

বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রসি,
সমুদ্রকলি শিকা বুনাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।
কেউবা রঙিন কাঁথায় মেলিয়া বুকের স্বপনখানি,
তারে ভাষা দেয় দীঘল সূতার মায়াবী নকসা টানি।
বৈদেশী কোন্ বন্ধুর লাগি মন তার কেঁদে ফেরে,
মিঠে-সুরি-গান কাঁপিয়ে রঙিন ঠোঁটের বাঁধন ছেঁড়ে।

আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে,
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৬

চিরতার রস বলেছেন: স্কুলে পড়েছিলাম। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

৫| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩২

আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: বাহ দারুণ কাজ!!

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৭

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ। আচ্ছা আপনাকে কোথাও যাবার জন্য কি কেউ মানা করছে ? B:-/

৬| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৫০

মোঃ কবির হোসেন বলেছেন: অনেক সুন্দর আমার প্রিয় একজন কবির অনেক সুন্দর কবিতাগুলো এক সাথে তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ। পোস্টটি প্রিয়তে নিলাম মাঝে মাঝে পড়ার জন্য।

১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৫:৫২

চিরতার রস বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।

৭| ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:২৬

আফসিন তৃষা বলেছেন: বাহ! দারুণ একটা সংকলন। ভালো লাগা :)

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২১

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ তৃষা। আমার খালাতো বোনের নামও তৃষা।

৮| ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর।

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২১

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ রাজীব ভাই।

৯| ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:২০

মামুন রশিদ বলেছেন: সুন্দর পোস্ট । 'প্রিয়তমাষু' পেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ।

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২২

চিরতার রস বলেছেন: প্রিয়তামাষু আবৃত্তি শুনলে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়।

১০| ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:২৩

আরজু পনি বলেছেন:

প্লাস রইল।।
শেয়ার নিলাম।।

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২৩

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ আপি। ভাল থাকুন।

১১| ১৭ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:৪৬

sajidboss বলেছেন: কবিতা গুলোর আবৃত্তি শুনা গেলে বেপক লাগতো

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২৫

চিরতার রস বলেছেন: নিজের কন্ঠে কিছু আবৃত্তির রেকর্ড করছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই শেয়ার করতে পারবো।
পরবর্তী পোস্টে দেশ সেরা আবৃত্তিকারদের অডিও রাখার চেষ্টা করবো।

১২| ১৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ২:২৪

আশরাফুল ইসলাম দূর্জয় বলেছেন:
দারুন।
এমন পোস্ট আরো চাই।

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২৫

চিরতার রস বলেছেন: কথা দিলাম সামনে আরো এমন পোস্ট আসবে।

১৩| ১৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৩:০০

মায়াবী ছায়া বলেছেন: কবিতা গুলির অডিও দিলে আরও ভালো হতো...ধন্যবাদ ।।ভালো থাকুন ।।

১৮ ই জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২৬

চিরতার রস বলেছেন: নিজের কন্ঠে কিছু আবৃত্তির রেকর্ড করছি। আশা করছি খুব শীঘ্রই শেয়ার করতে পারবো।
পরবর্তী পোস্টে দেশ সেরা আবৃত্তিকারদের অডিও রাখার চেষ্টা করবো।

১৪| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৫৫

রনন বলেছেন: জেনে খুব খুশি হলাম আপনি নিজ কণ্ঠে কিছু আবৃত্তির রেকর্ড করেছেন। ভাইয়া আবৃতি গুলো শোনার খুব আগ্রহ প্রকাশ করছি। :) :) :)

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:১৩

চিরতার রস বলেছেন: যান্ত্রিক গোলোযোগের কারণে এখনও রেকর্ডিং কর্ম সাধন করতে পারিনি। তবে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। অতি দ্রুত বাজারে পাবেন। :)

১৫| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২৭

এহসান সাবির বলেছেন: চমৎকার পোস্ট এটাও......!!

ফাগুনের শুভেচ্ছা ভাই।

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৩৩

চিরতার রস বলেছেন: ধন্যবাদ সাবির ভাই ।।। ফাগুনের শুভেচ্ছা।

১৬| ০১ লা মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১২:৩০

বৃষ্টিধারা বলেছেন: শো কেইসে রাখলাম ।

১৭| ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৪ রাত ১০:৫৬

জোৎস্নাআলো বলেছেন: বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.