![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজ থেকে প্রায় দুমাস আগের কথা। রাত্রি তখন ১২ টার কাছাকাছি। ঘুমানোর প্রস্তুতি হিসেবে সবে মাত্র বালিশের উপর মাথা রেখেছি, এমন সময় মোবাইলে ম্যাসেস আসার সংকেত বেজে উঠলো। মোবাইল খুলে দেখতে পেলাম হোয়াটসঅ্যাপে একটি ম্যাসেস এসেছে; আমার মেয়ে পাঠিয়েছে। ম্যাসেসে বা়ংলা কথাগুলো ল্যাটিন অক্ষরে লেখা। " Papa shop bondo kore dibe, pronto ( জলদি )।" আমার মেয়েটি বেশ চাপা স্বভাবের, কিছু প্রয়োজন হলেও সহজে প্রকাশ করে না, বরঞ্চ তাকেই প্রশ্ন করে কি কি প্রয়োজন তা আমাদের জেনে নিতে হয়। যাহোক হঠাৎ মাঝরাতে ছোট ম্যাসেসটি পেয়ে বুঝতে বাকি রইল না যে আমার ফেরত আসা নিয়ে গোটা পরিবার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করছে । সিডিউল অনুযায়ী আমার ফেরত আসার তারিখ ২৪ মার্চ। পরিকল্পনা মাফিক সব গোছগাছ চলছিল, আচমকা মাঝপথে মেয়েটির পাঠানো ক্ষুদে বার্তা ও পরিস্থিতি নিয়ে সহধর্মিনীর সাথে আলাপ করার পর ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এদিকে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ লক ডাউনের কারণে অচল। সে তুলনায় ইউকের অবস্থা অনেকটা ভাল; সংক্রমণ বিস্তার এখনও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, এরপরও নাকি সরকার লক ডাউনের কথা ভাবছে এবং যে কোন সময় তা কার্যকার করার ঘোষণা আসবে। সাতপাঁচ ভেবে সেই রাতে আমার ঘুম হল না। মনস্থির করলাম সকালেই অফিসে ফোন দিয়ে ফ্লাইট সিডিউল এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য আপ্রান চেষ্টা করবো। পরদিন ১৯ মার্চ সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টা অবধি এমিরেটেস এর অফিসে ফোন দিলাম কিন্তু কেউই ফোন রিসিভ করলো না। আরেকটি কথা, গতরাতে টরেন্টো নিবাসী আমার ছোট ভাই বললো তাদের ওখানে অঘোষিত লক ডাউন চলছে এবং সে আমাকে ঢাকার বাসার জন্য ২/৩ মাস চলার মত খাদ্য সামগ্রী কিনে রাখার পরামর্শ দিল। ইতিমধ্যে বাজারের একটা লম্বা লিষ্টও আমার হাতে এসে গেল। সত্যি বলতে তখন আমার কি করা উচিত বা কি করব এই বিষয়ে মস্তিষ্ক কোন কাজ করছিল না। শেষমেষ দোদুল্যমান অবস্থায় থলে হাতে বাজারের দিকে হাঁটা দিলাম।
দুপুর ১২টার সময় আবার অফিসে ফোন দিলাম। এবার ভাগ্য আমার সুপ্রশন্ন হল। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে প্রত্যাশিত মানব কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তার নিকট আগামীকাল গন্তব্যস্থলে যাবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সব কিছু শুনে তিনি আমাকে পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে অফিসে আসতে বললেন। এমিরেটসের হেড অফিস ঢাকার গুলশানে অবস্থিত। সেদিন ঢাকার রাস্তাঘাটে জানজট না থাকায় দুপুর দেড়টার মধ্যে অফিসে পৌঁছে গেলাম। অফিসে যথেষ্ট ভীড় ছিল। আমার পালা অন্তত ৫০ জনের পেছনে থাকায় মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। যাহোক কুপনটি যথা স্থানে রেখে সম্ভাব্য সামাজিক দুরত্ব মেনে এককোনে বসে রইলাম। ঠিক ১ঘন্টা পর বড় পর্দায় আমার নম্বরটি প্রতিয়মান হল, আমি উঠে গিয়ে সেলস অফিসারের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসলাম। অফিসারটি সুদর্শন ইয়াং ম্যান; পাসপোর্ট ও টিকেট টেবিলে রেখে আগামীকাল ফ্লাইট কনফার্ম করে দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ জানালাম। ইয়াং ম্যান কাগজপত্র দেখে বেশ কিছুক্ষন কিবোর্ডে ঝড় তুলে আমাকে বলতে লাগলেন, এই টিকেটের কোন প্রকার পরিবর্তন ঢাকা অফিস থেকে করা যাবে না, কারণ সিস্টেম এ্যলাউ করছে না। টিকিট যে স্থান থেকে কেনা হয়েছে কেবলমাত্র তাঁরা পারবে পরিবর্তন করতে। আমি বললাম দেখুন ২ঘন্টা আগে আপনাদের অফিসের একজন কলিকের সাথে ফোনে কথা হয়েছে, তিনি টিকেট চেক করার পর আমাকে অফিসে আসতে বলেছেন, তাই আমি দুর থেকে এসেছি। দয়া করে আরও একটি বার দেখেন, আমার ভীষণ প্রয়োজন। ভদ্রলোক এমনভাব দেখালেন যেন তার মুখের কথাই আইন !?
অগত্যা বিফল মনোরথে ফিরে এলাম। পথিমধ্যে আমার কেবলই একটি চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো যে, ২৪ তারিখ অবধি আদৌ সময় পাব কিনা।
বাসায় পৌঁছে গোসল, লাঞ্চ শেষ করতে ৪টা বেজে গেল। লন্ডনে তখন সকাল ১০টা, যে ভদ্রলোক আমার টিকেট ইস্যু করেছিলেন প্রথমে তাকেই ফোন দিলাম। জবাবে তিনি যা বললেন সেটা আরও বেশী হতাশাজনক। উনাদের অফিস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে, এই মুহুর্তে আমার জন্য কিছুই করতে পারবেন না। ইতিমধ্যে লন্ডন থেকে কয়েক দফা ফোন এসেছে কাজের অগ্রগতি সম্যক জানার জন্য, তাদের আস্বস্ত করতে 'অপেক্ষা কর' বলা ছাড়া কোন পথ ছিল না। এভাবে ভাবতেই শেষে ট্রাভেল এজেন্সির বস এর কথা মনে পড়ে গেল এবং শেষ অবলম্বন হিসেবে তাকে ফোন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাকে আদ্যোপান্ত জানানোর পর তিনি সহানুভূতির সাথে বললেন, ভাই লন্ডনের এ্যমিরেটস এর অফিস বন্ধ, যেহেতু ঢাকা অফিস এখনও খোলা, ওঁরা পারবে আপনার সমস্যা সমাধান করতে। আপনি এখনই আবার যান, অন্য অফিসারের কাছে গিয়ে বুঝিয়ে বলেন। আর দেরি করবেন না, লন্ডন যে কোন সময় লক ডাউনে চলে যেতে পারে।
ঘড়ির কাঁটার দিকে লক্ষ করলাম, সময় সাড়ে চারটা, হাতে সর্বসাকুল্যে দেড় ঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। দ্রুত তৈরি হয়ে গুলশানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। গুলশান ১ং চৌরাস্তার কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন সময় ৫টা ২০ বাজে। শুরু হল ট্রাফিক জ্যামের বিড়ম্বনা, আরেক অনিশ্চিয়তা। সি এন জির জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামনে দেখি সারি সারি হরেক রকমের গড়ির বহর দাঁড়ানো। আবারও পরিবারের কথা ভেবে ও প্রতিকুল পরিস্থিতি দেখে মনটা ভারী হয়ে এল। মুহুর্তে ভাড়া চুকিয়ে সি এন জি থেকে নেমে এলাম। এখন পা দুটোই আমার আশা ভরসা। আমি হাঁটতে খুবই পছন্দ করি। প্রতিদিন কমবেশি ১ঘন্টা পদব্রজ করা আমার নিয়মিত শরীর চর্চার একটি অংশ। তাছাড়া আমার জোরে হাঁটারও অভ্যাস আছে। অভ্যাস সাফল্যের চাবিকাঠি হতে পারে সেটি আবারও প্রমান পেলাম যখন ঝড়ের বেগে মাত্র ১০ মিনিটে কোয়ার্টার কিমি দুরত্ব পেরিয়ে অফিসে চলে এলাম। এবার অফিসে লোকজনের সংখ্যা কম দেখতে পেলাম, আমার পালা মাত্র একজনের পর। আগের বার যে ভদ্রলোকের কাছে গিয়েছিলাম এবার তার পাশের টেবিলে আমার ডাক এল। অত্যান্ত বিনয়ের সাথে আমার সমস্যার কথা, পরিবারের অসাহায়ত্বের কথা তাকে জানালাম। ইয়াং ভদ্রলোক আগ্রহের সাথে আমার পাসপোর্ট টিকেট নিয়ে মনিটরের প্রতি মনোনিবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর মাথা নাড়িয়ে বললেন, আগামীকাল কোন সিট খালি নেই, বিজনেস ক্লাসও চেক করেছি সেখানেও সিট পাচ্ছি না। আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে দেখে তিনি আবার বললেন, পরদিন কি যেতে পারবেন, দেখব?
আমার যাওয়া জরুরি, সেটা যে কোন ক্লাসে হোক না কেন, পেমেন্ট নিয়েও অসুবিধা নেই। যখন ভার্চুয়াল টাকা তথা ক্রেডিট কার্ড পকেটে রয়েছে তখন দুশ্চিন্তা করার সুযোগ নেই। আমার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে ভদ্রলোক কাজে মনোযোগ দিলেন। মিনিট দশেক পরে ভদ্রলোককে তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতে দেখে নিশ্চিত হলাম, আমি সাকসেসফুল। প্রিন্টার থেকে টিকিট কপি বের করে এনে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। একটা তৃপ্তির হাসি দিয়ে কত টাকা দিতে হবে তা জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে ভদ্রলোক বললেন কোন টাকা দিতে হবে না। কর্তৃপক্ষ কোরোনা ভাইরাসের কারণে বিনামূল্যে একবার সিডিউল পরিবর্তন করার সুযোগ দিয়েছেন। আমি মনে মনে পুলকিত অনুভব করলাম; এ দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!! ভাগ্যের চাকা এইবার বুঝি ঘুরলো ! ভদ্রলোককে অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে ও সময়ে বিমান দুবাই এর উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে এল। বিমানে যাত্রী সংখ্যা খুবই কম ছিল, সর্বমোট একশ যাত্রী হবে না বলে আমার ধারণা। আমার বহু বছরের বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় এত বড় রুটে এত কম সংখ্যক যাত্রী নিয়ে ভ্রমণ করেছি কিনা মনে পড়ে না। যাইহোক এবার বিমান বদলের পালা, গন্তব্যস্থল দুবাই থেকে হিথ্রো বিমান বন্দর। বিমানে উঠে আসন গ্রহন করলাম। বিশাল বড় বিমান, ডাবল ডেকার, মডেল এ৩৮০। এই বিমানের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। পুরো বিমানটির যাত্রীর আসন ছিল পূর্ণ। একটি বিশেষ ক্রান্তিকালে আমি ভ্রমণে বেড়িয়েছি। যদি এই বিমানের পরিবেশ ও লোকজনের উপস্থিতির আলোকে বিচার করা হয় তাহলে তাকে গৃহমধ্যস্থ জনসমাবেশ বলা হলে অত্যুক্তি করা হবে না। অনেকেই স্বীকার করবেন পৃথিবীতে দ্রুত কোরোনা বালাই ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিমান পরিবহন অনেকাংশে দায়ী। মিডিয়া ও পত্র পত্রিকা পড়ে যা জেনেছি এই রোগটি আমার জন্যে উচ্চ ঝুঁকি পূর্ণ। বিমানের পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আমার ভেতরে কোরনা আতঙ্ক ও উদ্বেগ শুরু হয়ে গেল। অবশেষে শোরগোলের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্বের নিরানন্দ বিমান ভ্রমণের পরিসমাপ্তি ঘটলো।
বিমান বন্দরের বাহিরে আমার অপেক্ষায় থাকা গাড়ীতে উঠে বসলাম। আজকে বিমান বন্দরটি দেখে সেই চিরচেনা বিমান বন্দর বলে মনে হল না। পৃথিবীর ব্যস্ততম বিমান বন্দরটি আজ যাত্রী খড়ায় পড়ে তার প্রানচাঞ্চল্য হারিয়ে নির্জীব হয়ে গেছে। গাড়ী চলছে হাইওয়েতে, রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। শহরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় মনে হল অচেনা কোন স্থানে যাচ্ছি। গাড়ীর চালক বাংলাদেশী এক ভাই। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম কনটিনিউ জব করছেন কিনা; উত্তরে বললেন, ১০ দিন হল কাজ বন্ধ করেছেন, আজ কেউ একজনের অনুরোধে আমাকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
প্রায় ৭৫ মিনিট লাগলো বাসায় পৌঁছাতে। ঘরে ঢুকেই সোজা স্নানঘরে গিয়ে পুরো ফ্রেস হয়ে বের হলাম। সোফায় শরীর এলিয়ে বসেছি মাত্র তখন ফোনটি বেজে উঠলো। ফোনে আমার এক সুহৃদ ভ্রমণ কুশলাদি জানতে চাইলেন, একই সাথে জানালেন যে, আজ আমি এ্যমিরেটেস এর শেষ ফ্লাইটের যাত্রী ছিলাম। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার জানার বাহিরে ছিল। সংবাদটি জেনে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হল।
আজ দুমাস হতে চলেছে অনেকের মত আমরাও স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি হয়ে আছি। টিভি আর ফোন এখন নিত্য দিনের সঙ্গী। প্রতিদিন শত শত মৃত্যুর মিছিলের খবর শুনে বিমর্ষ ও মনমরা হয়ে পড়ে থাকি আর মুহু মুহু আ্যমবুল্যান্সের সাইরেনের শব্দে সংবিৎ ফিরে পাই। এরপরও করুনাময় আল্লাহ্ দরবারে হাজার শোকর যে আমরা বেঁচে আছি এবং সুস্থ আছি।
পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আগাম ঈদের শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই মে, ২০২০ রাত ১১:১০
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন।
বেঁচে আমরাও আছি। কিন্তু কতদিন এভাবে বেঁচে থাকবো?