বীরাঙ্গনা মা

১৩ ই মে, ২০১৪ দুপুর ১:০০

আমরা ‘থিয়েটার আর্ট নাট্যদল’ বেইলি রোডে অসাধারন একটা নাটক করতাম।নাটকের নাম ‘কোর্ট মার্শাল’। নাটকের রচয়িতার নাম স্বদেশ দীপক। নির্দেশকের নাম এস এম সোলায়মান। আমার দায়িত্ব ছিল নাটকের নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সে নির্দিষ্ট রেকর্ডেড মিউজিক প্লে করা। খুব কঠিন কাজ ছিল না সেটা। বারটা ক্যাসেটে বার টা সিকোয়েন্স এর মিউজিক ধারণ করা ছিল। নাটক দেখে দেখে সঠিক মুহুর্তে ক্যাসেট চালিয়ে দিলেই হল।

নাটক টা নিয়ে একটু কথা বলি।



আকবর একজন সামান্য সিপাহী। মুক্তিযুদ্ধে আকবরের মা কে পাকিস্তানী হানাদার রা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই সূত্রে তিনি বীরাঙ্গনা। পারিবারিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা কে ধারণ করা মেজর খান এর অর্ডার’লি ছিল আকবর। মেজর খান আকবরকে গালাগালি করার সময় তার মা কে যে পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল সেইটার ইঙ্গিত দিয়ে বলত- তুই বেশ্যার ছেলে।



আকবর সইতে পারেনি বীরাঙ্গনা মায়ের এই অপমান। একদিন সুযোগ পেয়ে গুলি করে বসে মেজর খান কে।গুলি খেয়েও মেজর খান বেঁচে যায়! সামান্য সিপাহী হয়ে মেজর কে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে সিপাহী আকবরের কোর্ট মার্শাল হয়। কোর্ট মার্শালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আকবর নিঃদ্বিধায় মেজর খান কে গুলি করার কথা স্বীকার করে।



আসামী নিজের মুখে অপরাধ(?) স্বীকার করেছে। কাজেই আকবর কে ফাঁসি দিয়ে কোর্ট মার্শাল তখন তখনি শেষ হতে পারত। কিন্তু ব্যাপার টা ওখানে শেষ হতে দিলেন না মেজর মাহমুদ। কোর্ট মার্শাল নাটকে মেজর মাহমুদ আসামী পক্ষের উকিল।



মেজর মাহমুদের কথা একটাই- আমি আকবর কে বাঁচাতে কোর্টে আসিনি। কাউকেই বাঁচাতে আসিনি। আমার উদ্যেশ্য সেই ‘সত্য’ টাকে উদ্ঘাটন করা যেই ‘সত্য’ আকবরের মত সৎ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ একজন সিপাহী কে হত্যাকান্ডের মত জঘন্য কাজে প্ররোচিত করেছিল।

নাটকের পুরোটা হচ্ছে মেজর মাহমুদের সেই সত্য উদ্ঘাটনের গল্প।



নাটকের শেষ দৃশ্যে আকবরের ফাঁসি হয়। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আকবরের গলার উপর ধিরে ধিরে নেমে আসে ফাঁসির দড়ি। আকবর ফাঁসির দড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! শেষ মুহুর্তে আকবর বলে- আমি এই মুহুর্তে গর্ববোধ করছি আমার বীরাঙ্গনা মায়ের জন্য।



আকবরের সংলাপ শেষ হলে ফাঁসির দড়ির অবনমনের সাথে সাথে বেজে উঠে লেপথ্য সঙ্গীত-



'মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে

মা কে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে।



সেই যে আমার মা

বিশ্ব ভুবন মাঝে যাহার নেই ক তুলনা।'



গানের বানী এবং সুরের বানী যে অপার্থিব জ্যোৎস্না লোক তৈরি করে সেই জ্যোৎস্নার মাঝে আকবর তার বীরাঙ্গনা মা কে দেখতে পায়। বীরাঙ্গনা মা ও নিশ্চয় আকবরকে দেখতে পান!





ফাঁসির দড়ি গলার খুব কাছে চলে এসেছে। আকবর এর পার্থিব কোন লোভ, লালসা, কোন অভিনয়ের প্রয়োজন আর থাকা সম্ভব নয়।

আকবর নিজেকে চিনতে পারে! আকবর একজন দ্বিধাহীন মুক্তিযোদ্ধা। আর কিছু নয়!



আমরা যেদিন সৎ এবং সাহসী মানুষ হয়ে ‘নিজে দূর্নীতি না করা এবং দূর্নীতির সাথে সমঝোতা না করার’ মত পরিস্থিতি দেশে তৈরি করতে পারব সেদিন আমরাও গর্ব বোধ করব আমাদের বীরাঙ্গনা মায়েদের জন্য। সেদিন আমাদেরও মনে হবে আমরা প্রত্যেকে একেকজন দ্বিধাহীন মুক্তিযোদ্ধা!



মনে মনে যেদিন অনুভব করব সেদিন কিছুই ধামাচাপা দেয়ার প্রয়োজন পড়বে না চিৎকারের আড়ালে। এই ‘নিরব পরিবর্তনে’র মাধ্যমেই হয়ত আমরা ‘বীরাঙ্গনা মা’ দের শ্রদ্ধা জানাব ভবিষ্যতের কোন মা দিবসে।

সেই মা দিবস টা যে কবে আসবে??

১০ টি +২/-০