![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উন্নয়ন, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চেহারা। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে বিলুপ্ত ছিটমহলের ঘরে ঘরে। নাগরিকত্বের সব সুযোগ-সুবিধা এখন তাদের হাতের নাগালে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোর উন্নয়নসহ সব ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এ ছাড়া কৃষি, মত্স্য ছাড়াও শিক্ষিত বেকারদের আত্মর্ভিরশীল করতে নানামুখী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল, স্বাবলম্বী হয়েছেন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সদরের অভ্যন্তরের বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার বাসিন্দারা। ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। প্রথম ভোটাধিকারও প্রয়োগ করেছেন ছিটমহলবাসী। এ ছাড়া একটি কলেজ, পাঁচটি বেসরকারি হাইস্কুল, একটি মাদ্রাসা এবং তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতে সরকারি বিনামূল্যের পাঠ্যবই এবং ঝরে পড়া রোধে উপবৃত্তি প্রদান, পোশাক, ব্যাগসহ সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী, দাশিয়ারছড়াসহ ভারতের ১১১টি ছিটমহল ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাত তথা ১ আগস্ট প্রথম প্রহর থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয়। ছিট বিনিময়ের ফলে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পান প্রায় ৩৭ হাজার বাসিন্দা। আজ সেই মুক্ত জীবনের দুই বছর পূর্তিতে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠবেন তারা। আয়োজন করা হবে বিজয় মিছিল, আলোচনা সভা ও মোমবাতি প্রজ্বালন। সর্ববৃহৎ বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়াসহ ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এর বাসিন্দারা ভুলে গেছে ৬৮ বছরের বঞ্চনার দুঃখ। বদলে গেছে মানুষের জীবন। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অবহেলা ও অন্ধকারের রজনী শেষে সেই দুঃখ ভুলে থাকার গল্প বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে। দাসিয়ারছড়ার ছোট কামাত গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছোবেয়া খাতুন (৫০) বলেন, ‘ভাবিনি কোনো দিন বাঁচার অবলম্বন পাব। প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়ে এখন নতুন করে জীবন পেয়েছি। ’ দৈনন্দিন রোজগারের অবলম্বন একটি ভ্যান পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে পারছেন কালিরহাটের জয়নাল (৪৫)। এত দিন কাজের অভাবে তার খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছিল। এখন বেজায় খুশি তিনি। আগে যেখানে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হতো, এবার গভীর নলকূপের আওতায় এক হাজার টাকা সেচ খরচে ইরি-বোরো চাষ করেছেন কামালপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রাজ্জাক ব্যাপারী, নজরুল ইসলাম ও ইসরাইল হোসেন। এ ছাড়া কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক ফলন পেয়েছেন। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জীবনের শেষ আশ্রয় একটি ঘর পেয়ে স্বস্তিতে আছেন আশ্রয়হীন ভবঘুরে বালাতাড়ি গ্রামের হাতেম আলী, জংলু চন্দ্র ও মংলু চন্দ্র। কামালপুর গ্রামের আবুবকর সিদ্দিক (৭৮) বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আপন করে নিয়েছেন। তার কাছে ছিটমহলবাসী সারা জীবন কৃতজ্ঞ। ’ জমি নিয়ে বহিরাগতদের নানা হুমকি-ধমকি ও দখল আতঙ্কে দিন কাটানোর পর জরিপ শেষে মাঠপরচা পেয়ে স্বস্তিতে আছেন ছোট কামাত গ্রামের মহেন্দ্র, কাদের আলী ও মজনু মিয়া। তারা বলেন, ‘এখন আমরা নিজের জমির কাগজপত্র পেয়েছি। আর ভয় নেই। ’ ভিক্ষাবৃত্তি করে দিন কাটছিল রাশমেলা গ্রামের জহিরন, জমিলা ও রাশেদার। বিধবাভাতা পেয়ে এখন তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়েছেন। তারা বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করি আর ভাতার টাকায় দিন চলে যায়। ’ পুষ্টি প্রোগ্রামের আওতায় সন্ত্মানসহ নিজের নানা পরামর্শ, ওষুধ ও খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন বালাতাড়ি গ্রামের মুক্তা বেগম, জহিরন ও তানিয়া। এর আগে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাসিয়ারছড়া সফরের সময় বিদ্যুৎ সংযোগের উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নির্মাণ করা হয়েছে ৩০ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন। সংযোগ দেওয়া হয়েছে শতভাগ (আড়াই হাজার) পরিবারকে। ৬৮ বছর নাগরিকত্বের সুযোগ-সুবিধাহীন জীবন যাপনের পর গত দুই বছরে দাসিয়ারছড়াবাসী পেয়েছেন হাসপাতাল (কমিউনিটি ক্লিনিক), বিদ্যুৎ, পাকা রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেন, হাট-বাজার, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ, ডিজিটাল সাব সেন্টার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, পুলিশ ফাঁড়ি ইত্যাদি।
এ ছাড়া বিধবা, বয়স্ক, প্রসূতি ও মাতৃ, প্রতিবন্ধী ভাতা; ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, কর্মসংস্থান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান ও শ্মশানঘাট, আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গৃহ; আধুনিক কৃষি ও মত্স্য চাষের জন্য প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার, সেচ ও পানীয় জলের জন্য গভীর-অগভীর নলকূপ, পাওয়ার টিলার, ধানমাড়াই যন্ত্র, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে সুষম সার ব্যবহার ও ফসল উৎপাদন পদ্ধতি, মত্স্য চাষ, রেণু পোনা উৎপাদন ও সম্প্রসারণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও সূপেয় পানির ব্যবস্থা, বেকার যুবক-যুবতীদের স্বাবলম্বী করতে কম্পিউটার, মত্স্য চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন এবং মোটাতাজাকরণ প্রশিক্ষণ। ফুলবাড়ী উপজেলা প্রকৌশলী শামসুল আরেফিন জানান, অধিকাংশ কাজ শেষের দিকে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা জানা গেছে, সদ্যবিলুপ্ত দাসিয়ারছড়া ছিটমহলে চলতি অর্থবছর (২০১৬-২০১৭) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) সাড়ে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা উন্নয়ন, ড্রেন, কালভার্ট, ল্যাট্রিন, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানঘাট নির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, নারকেলগাছের চারা সরবরাহ, উন্নত জাতের রেণু পোনা উৎপাদন ও বিতরণ, প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের সেলাই মেশিন সরবরাহ, শিক্ষার্থীদের বৃত্তিসহ শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, ভিডিও কনফারেন্স হলরুম উন্নয়ন, কমিউনিটি ক্লিনিকে উপকরণ সরবরাহসহ নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় এক কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি ব্রিজ, ১০৭ জনকে কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায়, এক হাজার পরিবারকে ভিজিএফ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত, প্রতি ঈদে এক হাজার পরিবারকে ১০ কেজি করে খয়রাতি চাল সহায়তা, চারটি মন্দির উন্নয়নে ৫০০ কেজি করে চাল এবং সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১০টি পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহিলাবিষয়ক অধিদফতর ৩ হাজার ৬৫০ জন নারীকে ভিজিডি কার্ডের আওতায় এনেছে। ৬৮৬ জন নারীকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান এবং ছয়জনকে দর্জি প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কৃষি বিভাগের অর্থায়নে ছিটমহলের ৭০০ কৃষককে প্রশিক্ষণ, ৯০ জনকে প্রদর্শনী খেত, তিনজন করে কৃষককে পাওয়ার টিলার, ধান মাড়াইয়ের শ্যালো মেশিন প্রদান এবং বিভিন্ন স্থানে ৫০০ গাছ লাগানো হয়েছে।
এদিকে তিনটি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। দাসিয়ারছড়ার মা ও শিশুদের বিশেষ পুষ্টি কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন অধিদফতরের (এলজিআরডি) বিশেষ বরাদ্দে স্থাপন করা হয়েছে ২২ হাজার বইসমৃদ্ধ একটি পাবলিক লাইব্রেরি-কাম-কমিউনিটি সেন্টার। এ ছাড়া একটি পুলিশফাঁড়িসহ কৃষি ও বিআরডিবির সাতটি, সমবায় অধিদফতরের ছয়টি এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ঋণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ৩৩ জন নারীকে যুব প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যেতে পারবেন। এ ছাড়া নীলকোমল নদীতে একটি সেতু ও একটি শ্মশানঘাট নির্মাণের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
©somewhere in net ltd.