![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি একজন নেহায়েতই সাধারণ মানুষ হিসেবে মাওলানা ভাসানীকে দেখতে পাই মিশ্র দৃষ্টিতে। তাঁর প্রায় আট দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুঃসাহসিক উপাখ্যানের পাশাপাশি বেশকিছু ভুলের অস্তিত্বও দেখা যায়। তিনি ছিলেন আজন্ম সরকারবিরোধী। এটা সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। তাঁর তেমনই একটি দুঃখজনক রাজনৈতিক ভুলের একটির দেখা পাই ১৯৫৪ সালে। সে বছর পূর্ববঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একজোট হয়ে মুসলিম লীগের নামনিশানা মুছে দেন। শের-ই-বাংলার নেতৃত্বে প্রাদেশিক সরকার ক্ষমতাসীন হলেও মাত্র তিনমাসের মধ্যেই এই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসন জারী করেন। এতদিন ঢালাওভাবে এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের দোষ দেয়া হলেও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পেছনে দায় ছিল খোদ মাওলানারই।
যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাসীন হতেই যেন তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। এই সরকারকে তিনি ন্যূনতম সময় দিতে পারছিলেন না। ভাবখানা এমন, যেন ফজলুল হক কোন জাদুর কাঠি দিয়ে আঘাত করে রাতারাতি সব সমস্যা দূর করে দেবেন। নতুন সরকার শপথ গ্রহণ করার আগে থেকেই সারা প্রদেশ থেকে ঢাকায় ভুখা মিছিল আসতে লাগলো। মাওলানা সেসবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে লাগলেন। মুসলিম লীগের পতন ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও মন্ত্রীসভার সদস্যরা হাজির ছিলেন এই সভায়। এই জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে অনলবর্ষী কণ্ঠে মাওলানা ভাসানী দাবী করলেন, অবিলম্বে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করতে হবে, সকল শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হবে।
তিনি যখন এ কথা বলছিলেন, তখন মঞ্চে এক লোকের আগমন ঘটে। তিনি মাওলানার হাতে একটি চাবুক তুলে দিলে মাওলানা সেই চাবুক সজোরে বাতাসে চালিয়ে হুঁশিয়ারি দেন, তাঁর কথামতো না চললে প্রাদেশিক সরকারের সদস্যদের তিনি চাবুক দিয়ে পেটাবেন। মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে উদ্দেশ্য করে মাওলানা অন্যায্যভাবে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী রিকশার বদলে বিলাসবহুল গাড়ীতে চেপে প্রতিদিন কে এম দাস লেনের বাড়ী থেকে নবাব আবদুল গণি রোডের সচিবালয়ে যাতায়াত করেন। অথচ ফজলুল হক একটি ঝরঝরে শেভ্রলে গাড়ী চালাতেন, যার হেডলাইটের অভাবে লণ্ঠন ঝুলিয়ে যাতায়াত করার কাহিনী আমরা অনেকেই জানি।
আর এভাবেই আওয়ামী মুসলিম লীগের ভুখা মিছিল, জোট সরকারের মধ্যকার কোন্দল, বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে করাচীতে বসে থাকা ব্যক্তিবর্গ সুযোগ পেয়ে যায়। এরই মধ্যে মাওলানা ভাসানী সুইডেন সফরে গমন করেন সোভিয়েত আশীর্বাদপুষ্ট সংগঠন বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে যোগ দিতে। এরই মধ্যে বাতিল হয়ে যায় যুক্তফ্রন্টের সরকার। বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে পূর্ববঙ্গের গভর্নর করে পাঠালেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে মীরজাফরের বংশধর মীর্জা হুংকার ছাড়লেন, “কোথায় ভাসানী? আমি তাকে গুলি করে মারবো!”
মাওলনার রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি বহুবার বুঝে বা না বুঝে কুচক্রীদের ক্রীড়নকে পরিণত। ১৯৫৪ সালে সম্ভবত তাঁর কতিপয় বামপন্থী সমর্থকের মারফতে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে তিনি যুক্তফ্রন্টের সরকারের সর্বনাশ করেন। মজলুমের দুঃখ তিনি সহ্য করতে পারতেন না। আর এর ছুতায় তাঁকে দিয়ে এমন কাজ করানো হয়েছে, যা সুদূরপ্রসারীভাবে দেশের ক্ষতি করেছে। তিনি ছিলেন মারাত্মক আবেগি। আর তাঁর আবেগকে অসৎ উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়ে তাঁকে বিপথে চালিত করার অনেক নজির দেখা যায়।
কিন্তু মানুষ ভাসানীর স্বরূপ উপলব্ধি করলে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে যেতে হয়। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নেতা হয়েও তিনি আমৃত্যু বাস করেছেন ছনের কুটিরে। তালের আঁশের টুপি, খদ্দরের কুর্তা আর তহবন্দে তাঁর চালচলন ছিল দেহাতী ফকীরের মতো। অথচ এই নিরাভরণ চলনবলনেও কি অসাধারণ রাজসিক আভিজাত্য ঠিকরে উঠত! বিস্ময়ে অভিভূত আবেগে চোখ আদ্র হয়ে আসে, যখন পড়ি সত্তুরোর্ধ্ব বৃদ্ধ মাওলনা কতৃক রান্নার লাকড়ির কাঠ চেরাই করার ঘটনার কথা। কেমন মানুষ ছিলেন এই ব্যক্তি, যিনি কিনা রমজান মাসে সেহরি খেতে উঠে আগে খবর নিতেন তাঁর আঙ্গিনায় বিচরণ করা কান পচা নেড়ি কুকুরটিকে ভাত দেয়া হয়েছে কিনা! কোন পৃথিবীর মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি ঈদের দিন নিজে গোসল সারার আগে রাখালদের বলতেন, গোয়ালের গাভীদের যেন ভালো করে গোসল দিয়ে তাজা ঘাস খেতে দেয়া হয়; কারণ আজ যে ঈদ! কিসের তাড়নায় তিনি প্রতি কোরবানির ঈদে কুকুরটিকে নিজ হাতে বড় এক টুকরা ভালো গোশত খেতে দিতেন? কেমন মানসিকতার মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি মাঝরাতে শিয়ালের আক্রমণে আহত হাঁসের পরিচর্যা করতে হলুদ বাটা নিয়ে বসে পড়েছিলেন জঙ্গলেই, যেখানে শিয়াল হাঁসটিকে ফেলে পালিয়েছিল! কেন তিনি সেবার সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষধর সাপের উপদ্রবের প্রেক্ষিতে ওঝা দিয়ে সাপ মারার বদলে মুক্তাগাছা থেকে শূকরের পাল আনিয়ে তাদের দ্বারা ক্যাম্পাসের উঁচু ঘাস খাইয়ে ক্যাম্পাস থেকে সাপ দূর করতে গেছিলেন? কেনইবা তিনি গামছার পুটুলিতে করে শূকরের অস্পৃশ্য রাখালদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন?
ভাসানীর মৃত্যুর কয়েকদিন আগের সেই ঘটনার কথা না বললেই নয়। সেদিন মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। মসজিদে সবাই লাল মাওলানার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিনি নিজের শয়নকক্ষে বিছানো শতরঞ্জিতে পেছনে দুই হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন। তিনি মাগরিবের নামাজটি ক্বাযা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তাঁর দুই হাত বরাবর পিঁপড়ারা লাইল করে ঘরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে। এখন জামাত ধরতে গেলে পিঁপড়াদের লাইন ভাঙ্গতে হবে, যা তাঁর হাতের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো।
মাওলানা নিসর্গ প্রেমিকও ছিলেন। নয়তো কেন সেবার নৌকায় রাত কাটানোর সময় পায়ে পড়া বৃষ্টির ছাট তিনি উপভোগ করছিলেন? কেনইবা তিনি যৌবনে বন্যার সময় নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রকৃতি দেখার জন্য? তাঁর নাকি ধারণা ছিল বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি পাঠশালায় পরিণত হয়।
আমার জানা ভাসান চরের লাল মাওলানা মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একজন রক্তমাংসের রাজনৈতিক হলেও, একজন মহান মানুষ ছিলেন। বিভাগপূর্ব আসামের এককালীন মুখ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ সা’দুল্লাহ পূর্ববঙ্গে এসে বসতি স্থাপন বা রাজনীতি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কারণ পূর্ববঙ্গে ভাসানী ছিলেন, যিনি পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলতে পারঙ্গম একজন ‘প্রোফেট অভ ভায়লেন্স’। সেটা হয়তো রাজনীতিজ্ঞ ভাসানীকে বলা। কিন্তু মানুষ ভাসানী অবশ্যই সমাজের জন্য একটা নেয়ামত, যিনি সত্যিকারের আশরাফুল মখলুকাত হিসেবে অধীনস্থ মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণীদের সাথে কেমন আচরণ করা উচিত তাঁর একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন..
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৫২
চাঁদগাজী বলেছেন:
প্রকৃতি তাঁকে সোস্যালিস্ট বানায়েছিল।