নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এখনও অন্ধকার রয়ে গেছে চারধারে

ধীবর চন্দন

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা

ধীবর চন্দন › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবিতা পাঠ - সমর সেনের "একটি বেকার প্রেমিক"

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:২৫

কবিতাটার নাম নিয়ে একটা উপলব্ধি আমি এড়াতে পারছি না। তাই সেটার কথা প্রথমে বলে নিই। ব্যক্তি বোঝাতে আমরা 'একজন' ব্যবহার করি, আর 'একটি' ব্যবহার করি বস্তু বোঝাতে। বস্তুর প্রাণ নেই, সে যেখানে থাকে সেখানেই থাকে। তাকে ঠেলে সরাতে হয়। তার স্বত্তার অভাব সর্বোচ্চ। কবি কি একটি বেকার প্রেমিক বলে বেকার প্রেমিককে ব্যঙ্গ করে নির্জীব বস্তুর কাতারে ফেলে দিলেন?

কবিতা শুরু হচ্ছে একটা লাইন দিয়ে। 'চোরাবাজারে দিনের পর দিন ঘুরি'।

চোরাবাজার, মানে চোরাই মাল যেখানে বিকোয়। কবিতার বেকার প্রেমিক চরিত্রটি সেখানে দিনের পর দিন ঘোরে। লাইনটায় হতাশা চিৎকার দিয়ে ওঠে। কিন্তু ঠিক কী বিষয়ে এই হতাশা সেটা পরিষ্কার হয় না। আবার, পরিষ্কার হতেই হবে এমন কথা নেই। ঋত-আশ মানুষেরা এমন হঠাৎ কথা বলেই ফেলতে পারেন। তাদের অন্য অনেক অপ্রাপ্তির মধ্যে বড় ছোট ভেদ থাকতে পারে। তারই মধ্যে কোনটাকে প্রথমে তুলে আনবেন প্রথম পরিচয়ের ধাক্কায়, সেটা তিথি নক্ষত্র মেনে উৎসারিত হয় না। কিছু দু:খ প্রকাশের জন্যে যুবক শোল মাছের মতো মনের জলের তলে ঘাই মারলেও বাতাস খাবার জন্যে পুঁটি মাছই মুখ ভাষায় আগে।

এরপর বেকার প্রেমিক মহাশয় একটু ধাতস্থ হন। তার নিত্যকর্মের বিবরণ আসতে থাকে-

"সকালে কলতলায়
ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে,
খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি;
মাঝে-মাঝে ক্লান্তভাবে কী যেন ভাবি--
হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;
আর শহরের রাস্তায় কখনো বা প্রাণপণে দেখি
ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।"


নিত্যকর্মের বিবরণ খুব দ্রুতই অনুভবের কোলাহলে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সারা রাত সেবা দিয়ে সকালে টিউব ওয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত বেশ্যারা বচসা করছে। বেকার প্রেমিকের অন্তরাত্মায় সে শব্দদূষণ আঘাত করে। সেই বচসার বাক্যাবলী হয়তো তার কানে ঢোকে না। কিন্তু দৃশ্যটা, এই যে রাতভর যারা মিথ্যে প্রেম বিক্রি করে সকাল বেলায় কথার খই ফোঁটাচ্ছে, বেকার প্রেমিক নিশ্চই তাদের চেয়েও নি:সঙ্গ এবং মূল্যহীন!

বেকার প্রেমিকের মন প্রকৃতির কোন এক নি:সঙ্গ ধ্বণির দিকে চলে যায়। খিদিরপুর ডকে রাতের বেলা জাহাজের শব্দ। কেমন শব্দ? হুইসেল? নোঙর তোলার ঘড়ঘড়ানি? খালাসিদের খিস্তি? অথবা সবকিছু মিলিয়ে একটা আদিভৌতিক আবহসঙ্গীত? জাহাজ একা, তাকে সমুদ্রের মধ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিতে হয়। জাহাজের শব্দ আর বেকার প্রেমিকের মনের মধ্যে দৌড়াতে থাকা কথাগুলো মনে হয় একইরকমের। অনেক কথা, কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে শুধু না-থাকার আর্তি!

ক্লান্তি আসে, কিন্তু ভাবনার স্থিরতা আসে না। প্রেমের দেবতার কাছে বেকার প্রেমিকের কোন চাওয়া নেই। কারণ, সে হয়তো বুঝে গেছে ঐসব প্রার্থনায় কোন ফল ফলে না। তবু, তার কিছু অভিযোগ আছে। অভিযোগটা তার ঘুম না আসার ব্যাপারে। কেন তার ঘুম আসে না? সে তো ক্লান্ত, নিয়ম বলে তার ঘুম আসা উচিৎ। সে সিগারেট টানে।

সে শহরের রাস্তায় তীব্র দৃষ্টিতে দেখে ইংরেজ মেয়েদের উদ্ধত নরম বুক। সে হীনতায় ভোগে। তার এক অপ্রাপ্তি অন্য অপ্রাপ্তির বদখত চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়।

এরপর সে আর থাকতে না পেরে প্রেমের দেবতার কাছে আর্জি জানায়:

"মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন।"


এইখানে মৃত্যুহীন প্রেম কথাটা খুব সুন্দর। বেকার প্রেমিক যে প্রেমে বসবাস করে, তার মৃত্যু নেই। সে প্রেম তার নিজের ভেতরই উত্তপ্ত ফেনার মতো ফুটতে থাকে। কিন্তু বাষ্পীভূত হয় না। যন্ত্রনাটা থেকেই যায়। ঐ রকম প্রেম সে চায় না। তার চেয়ে সেই প্রেম সে চায়, যে প্রেমের যে কোন মুহুর্তে মৃত্যু হতে পারে। যে কোন সময়েই সে প্রেম শেষ হয়ে যেতে পারে। মানুষের জীবনের মতো ক্ষণস্থায়ী বৈদ্যুতিক প্রেম। তার নতুন পৃথিবীর প্রয়োজন। তার ইস্পাতের মতো ঝকঝকে দিন প্রয়োজন। হৃদয়ের মধ্যে একটি উজ্জল আলোক রেখা যে বেকার প্রেমিকের আছে, সেটা এখানে বোঝা যায়।

এরপর সে ফিরে যায় সকালের কলতলার দৃশ্যে:

"সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূন্য মরুভূমি।"


এখানে একটা সুর বোঝা যায় স্পষ্টভাবে। বেকার প্রেমিকের একটি বিদ্রোহী রাজনৈতিক হৃদয় আছে। তার রক্তের দহন শুধু অপ্রাপ্তির বা হতাশার নয়। সভ্যতার ভেতরের যে জায়গাটা নষ্ট, সেটা যে মরুভূমির মতোই শূন্য, এবং অর্থহীন, সেটা সে আহতের মতো অনুভব করে। এখানে সবকিছু বিক্রি হতে পারে, ভালোবাসা-প্রেম? সেটাও।
---
সমর সেনের জন্ম ১৯১৬ সালে কোলকাতায়। স্কটিশ চার্চ কলেজের মেধাবী ছাত্র সমর সেন অধিকাংশ জীবন সাংবাদিকতায় ব্যয় করেছেন। ৭১ বছর জীবনের মাত্র ১২ বছর ব্যয় করেছেন কাব্য সাধনায়। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ (১৯৪০), নানা কথা (১৯৪২), খোলা চিঠি (১৯৪৩) এবং তিন পুরুষ (১৯৪৪)।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৪১

চাঁদগাজী বলেছেন:


তিনি জীবনকে কাছ থেকেই অনুভব করেছিলেন।

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ৮:৫৫

ধীবর চন্দন বলেছেন: হ্যাঁ। তা না হলে সার্থক কবি বা কবিতা হয় না। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.