![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বৃষ্টিটা নামার আর সময় পেল না,আসলেই আষাঢ়ের বৃষ্টির কোন সময়জ্ঞান নেই,সু্যোগ পেলেই আকাশ ভেঙ্গে নেম পড়তে চায়।আজও অথৈ এর রাগান্বিত চেহারাটা দেখতে হবে।না আর কখনো দেরী করে আসবে না সে।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বৃষ্টিতে আধ ভেজা হয়ে সুপার মার্কেটের দোতলায় ফাস্টফুডের দোকানটাতে ঢুকল শান্ত।কোনার টেবিলে বসা অথৈ এর দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে যেতে তাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই
একেবারে ভিজিয়ে দিছে,
ভাল হইছে,খুশী হইছি,আমারে এতক্ষন বসিয়ে রাখার শাস্তি এইটা।
ঠোটের কোণায় ছোট্ট একটা হাসি।আরে! ওর তো এখন রাগ করার কথা কিন্তু রাগ না করে হাসে ক্যান?
মেডিক্যালের ৩য় বর্ষের ছাত্রী অথৈ,কাল সকালে হোস্টেলে চলে যাবে।কিন্তু কাল তো শান্তর জন্মদিন।ওর জন্মদিনে তার পক্ষ থেকে কিছু না করলে তো সে নিজেই শান্তিতে থাকতে পারবে না।বারবার মনে হচ্ছিল কিছুই না করলে শান্ত নামের অশান্ত এই ছেলেটি তার উপর অনেক অভিমান করে থাকবে।এই কয়েকদিনে ছেলেটার এই নীরব অভিমানী স্বভাবটা সে ঠিকই ধরে ফেলেছে।অন্তত পক্ষে তার সাথে দেখা করতে হবে তাতেই সে অনেক খুশী।
আমরা যদি তোমার জন্মদিনটা আজকে পালণ করি তুমি কি রাগ করবা?
এই বুড়াবয়সে আবার আবার কিভাবে জন্মদিনপালন করবা?এইযে বসে আছি এটাই তো পালন করা হয়ে যাচ্ছে।
না একটু তো করতেই হবে।তোমার জন্য কেক আর মোমবাতি নিয়ে আসছি,কেকটা এখন তুমি আমার সামনে বসে কাটবা।বলতে বলতে পাশে রাখা ব্যাগ থেকে যাবতীয় সরঞ্জামাদী বের করতে লাগল অথৈ।
ওর জন্য কোন মেয়ে কেক সাজিয়ে বসে থাকতে পারে?ভাবতে একটু কেমন যেন লাগলেও চূড়ান্ত ভাললাগার একটা ঢেউ কাজ করছে সারা শরীরে।অনেক ভাললাগা আর একটু অপ্রস্তুত ভংগিতে অথৈকে দেখছিলসে।সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে নতুন করে কিছু ভাবনার স্নিগ্ধ বাতাস এসে মনের জানালায় উকি দিচ্ছে।
একটা ফাস্টফুডের দোকানে বসে কেক কাটতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল শান্তর।তাইতো মোমটা ধরিয়েই নিভিয়ে দিল,খেয়াল করেনি যে অথৈ তখন ব্যাগ থেকে চকলেট বের করছিল।
আমাকে না দেখিয়েই নিভিয়ে দিলা?
দাঁড়াও দাঁড়াও আবার ধরাই,আবার নিভাই(বুঝতে পারল কাজটা ঠিক হয় নাই)
থাক আর ধরাতে হবে না,এতক্ষনে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে অথৈ।
দোকানের মামা যে দেয়াশলাই দিয়ে গিয়েছিল তাতে কাঠি ছিল মাত্র দুইটা উপরন্তু একটু ভেজা ভেজা।একটা প্রথমবারেই শেষ,আরেকটা বাকী আছে।সেটিও কিছুক্ষন ঘষাঘষির পর অর্ধেক ভেঙ্গে গেল।
থাক আর কষ্ট করতে হবে না,এম্নি কেটে ফেল
কিন্তু শান্তর তো জালাতে হবেই,না হলে তো অথৈ এর মুখ থেকে মেঘ সরবে না।অবশেষে ভাগ্য দেবতার অশেষ দয়ায় অর্ধেক কাঠি দিয়েই মোম জালানো এবং কেক কাটা হল।অথৈ এর মুখ থেকে ততক্ষনে মেঘ সরে হাসিতে ঝলমল করছিল।ওর চেহারার এই ঝলমলে ভাবটা শান্ত সবসময় খুঁজে বেড়ায়।
শান্তকে কেক খাইয়ে দিচ্ছিল অথৈ।নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা আর বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল শান্তর।মনে হচ্ছিল এই মেয়েটি থাকলে তার জীবনের অনেক কাজই গুছিয়ে করা সম্ভব।শান্তকে খাইয়ে দিলেও অথৈকে এ যাত্রায় আর খাইয়ে দেয়া হল না।এই কাজগুলা কেন যেন শান্ত পারে না।ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবায়িত করতে পারে না।
অথৈ এর দিকে তাকাতে কখনোই লজ্জা বা অস্বস্তি বোধ করে নি শান্ত,কিন্তু আজ যেন অনেক কিছুই একটু আলাদা।কেমন যেন এক লজ্জা লজ্জা ভর করছে অথৈ এর মুখের দিকে তাকাতে।শান্ত লক্ষ করছে ওর বাঁকা হয়ে বসা নিয়ে বৃষ্টির মুখে এই মুহুর্তে মজা করে খোঁচা মারা কথা নেই বরং বিরক্তি এবং মনখারাপের চিহ্ন স্পষ্ট।অনেক্ষণ কথা বলার ইচ্ছা ছিল।কিন্তু বড় ভাই ফোন দিয়ে বাবার জন্য ওষুধ আনতে বলল। বাবার শরীরটা ভাল দেখে আসেনি।তাই আর দেরী করা যাবে না,উঠতে হবে।
অথৈকে এগিয়ে দিয়ে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত,মনের নদীটা আজ অনেক বেশী অশান্ত।আবার যেতে ইচ্ছে করছে,দু দন্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে,হাতটা ধরে টোকা দিতে ইচ্ছে করছে,কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু কি বলবে সে?আজকে দিনে তাকে এত ভাললাগা উপহার দেবার জন্য তো "ধন্যবাদ" শব্দটাও উচ্চারণ করতে পারে নি গাধা টা।বিকেলের শেষ আলোটুকু পশ্চিমাকাশকে আবীর রঙ্গে রাঙ্গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।কোমল,পবিত্র সেই আলোটিকে সাক্ষী রেখে মেয়েটির প্রেমের দুয়ারে পথিক হয়ে গেল অশান্ত সেই ছেলেটি।খুব তাড়াতাড়ি আবার বাস্তবে ফিরতে হল,বাবার জন্য ওষুধ কিনতে হবে।
রাত ১.১৫ তে শান্তর ফ্লাইট।২৩ দিনের ছুটিটা কোন দিক দিয়ে গেল কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি সে।অনেক ভাললাগা আর ভালবাসার সাক্ষী হয়ে রইল ছুটিটা।এই ছুটিতেই অথৈ এর সাথে প্রথম দেখা।এরপর খুব কম সময়েই অনেক কাছাকাছি চলে আসা।যদিও শান্তর ভালবাসার কথাটা এখন পর্যন্তও “না বলা কথা” হিসেবেই রয়ে গেল।
বাসা থেকে বের হবার আগে অথৈ এর সাথে কথা হচ্ছিল।
মন খারাপ কর না।আবার তো কয়েকদিন পর আসবা।দেখবা সবাই আগের মতই থাকবে।
তাই যেন থাকে,এখন রেডী হব একটু পর ফোন দিচ্ছি।এবার যেন অথৈ এর মুখ দিয়ে অভিমানের বৃষ্টি ঝড়তে লাগল।
প্রথম দিন থেকেই এই একটি কথা কমন বলে যাচ্ছ “একটু পর ফোন দিচ্ছি”।কেন?আমার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগে?লাগলেও আমি জানি না,এখন আমার সাথে কথা বলতে হবে,আমি যতক্ষন বলব ঠিক ততক্ষন।
অথৈ এর সেদিনের পাগলামিটা ভালই লাগছিল,কারন শান্ত জানে কোন এক অধীকার থেকেই সে এই কথাগুলো বলতে পারছে।
আবার সেই ব্যাস্ত জীবণ।কিন্তু ব্যাস্ততার মাঝেও মনটা পড়ে থাকে দেশের সেই মফস্বল শহরটাতে,ক্লাশের মধ্যে বসেও ফেসবুকিং আর মেসেজের অপেক্ষা।সারাক্ষণ মেসেজ চালাচালি।মনে কিছু আসলেই একজন আরেকজনের সাথে শেয়ার না করলে ভাল লাগত না ওদের।কথা বলতে বলতে ঘুমাতে যাওয়া,কথা বলতে বলতে ঘুম থেকে উঠা ।ইনবক্স খালি থাকলেই শুরু হয় মানভিমানের পালা,সেই থেকে ঝগড়া,কথা বন্ধ।সেই অভিমানের পালা শেষ যদিও সময় বেশী নেয় না,পরক্ষণেই সব ঠিকঠাক।দিনগুলো যেন রঙ্গীণ ভেলায় চড়ে ভালই যাচ্ছিল।এরপর একদিন অনেকটা আচমকা অথৈ জানান দিল,
শান্ত আমরা কিন্তু শুধুই বন্ধু,আর কিছু না।
সেদিন আরো অনেক কথা হয়েছিল ওদের।কিন্তু কথা শেষে অথৈকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা না বরং স্বপ্ন ভঙ্গের সূচণা হয়েছিল সেদিন্টাতে।শান্তর মনের আকাশে সেদিন ঈষাণকোণের মেঘ জমেছিল।এভাবে কথাগুলো শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না শান্ত।অথৈ তার পরিবারের বাইরে কিছুই করতে পারবে না এবং তার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে সেটা নাকি আবার মোটামুটি ঠিকের পথে।সদ্য মেডিক্যাল থেকে পাশ করা কোন এক ইন্টার্নী ডাক্তারকে অথৈ এর জীবনসঙ্গী করে দেবার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী নাকি যথাযথ ব্যাবস্থাগ্রহণও সমানতালে এগিয়ে চলেছে।কথাগুলো অনেক শান্ত ভঙ্গীতেই বলে চলছিল অথৈ,এদিকে শান্তর মনে তখন সাইক্লোণ বয়ে যাচ্ছিল সেই খোজটা হয়ত অথৈ সেদিন নেয়নি।কোন কথা চিন্তা করার মত অবস্থা হয়তো তখন শান্তর ছিল না।তাইতো অথৈ এর এইসব কথাবার্তার মধ্যেও সেদিন সে বলে দিল তার ভালবাসার কথা।তাকে নিয়ে গল্প সাজানোর কথা,যে গল্পের একটা নাম দিতে চায় সে।
শান্তর পাগলামিতে কিছুই বলে না অথৈ।হয়ত বলতে চায় না বা কিছু বলে চাইলেও বলতে পারে না।তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।ছেলেও তাদের পূর্ব পরিচিত।শো-কেসে সাজিয়ে রাখার মত ভাল ছেলে।তার উপর আবার তার সচিব কাকার পছন্দ করা তার বন্ধুর ছেলে।কিন্তু শান্ত ছেলেটাকে সে কিভাবে বুঝাবে পরিবারে অমতে সে কিছুই করবে না বা করতে পারবে না।এখন থেকেই দুরত্ব বাড়াতে হবে।না হলে শুধু কষ্টই বাড়বে আর কিছু হবে না।
ফেইসবুকে লগইন করেই লালরঙা মেসেজটা খুলতেই দেখতে পেল অথৈ এর আইডিটা ডীএকটিভেট করা এবং তার জন্য রেখে যাওয়া মেসেজ “শান্ত তুমি আমার জীবনে অনেক সুন্দর মেমোরি হয়ে থাকবা,নিজের যত্ন নিও, ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবা আর আমাকে প্লীজ কখনো ভুল বুঝনা”।কোন নম্বরেই ফোন করেই পাওয়া গেল না।কেন এমন করল সে?নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল?এত সহজেই সবকিছু করে ফেলতে পারল?ঠিক আছে সে যদি এত সহজে করতে পারে তাহলে শান্ত পারবে না কেন?চলে যাক দূরে,কোন দরকার নাই।কিন্তু মন বলে তো কথা। একটু পরেই আবার যথারীতি হাত চলে যায় ফোনের দিকে আর চোখ ফেইসবুকের পর্দায়।নিজেকে আর কেন যেন শান্ত রাখতে পারছে না সে।মনের আকাশটা ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে আজ।
রাত প্রায় ১১টার দিকে ফেইসবুকে ঢুকে একটা মেসেজ দেখতে পায় শান্ত “বাবু তোমাকে অনেক মিস করছি,কি কর তুমি?রাতে খাইছ?”
সাথে সাথে ফিরতি মেসেজ দেয় শান্ত “কই ছিলা তুমি?কেন আস নাই সারাদিন?”
“এইযে আমি,আমি তো তোমার সাথেই ছিলাম।কথা বলতে চাই”।এরপর আবার সব ভুলে শুরু হয় তাদের স্বপ্ন সাজানোর গল্প।ঠিক যেন সেই আগের মতই একটি নায়ে দুটি পাখি প্রেম যমুনার কূলে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসছে দুজন দুঃখ ব্যাথা ভুলে।
এরপর থেকে এরকম কাহিনী ওদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দাড়ায়।মাঝে মাঝেই আইডি ডিএক্টিভেট এবং ফোন বন্ধ করা সহ ফোন নম্বর বদলও করে ফেলে অথৈ।আবার ফিরে আসে না থাকতে পেরে।আসার পর শান্ত অভিমান করে বলে একদিন দেখবা তুমি আমিই ডিএক্টিভেট করে দিব,আমাকে আর পাবা না,ফোনেও পাবা না।মাঝে মাঝে এসবের জন্য অথৈকে অনেক বকাঝকাও করত সে।অথৈ চুপ করে থাকে,কারন এতদিনে এই ছেলেটিকে পুরোপুরি বুঝে নিয়েছে সে।জানে কিছুক্ষন পরে একাই শান্ত হবে এবং তাকে অনেক ভালবাসার কথা শুনাবে।তখন তার চান্স আসবে।সে তখন অভিমান করে থাকবে,শান্ত রাগ ভাঙ্গাবে।
শুধু মুখে বললেই যে ভালবাসা হয়ে গেল আর না বললেই হল না এমন কোন কথা নেই সেটা জানে শান্ত।কিন্তু অথৈ যখন এত কিছুর পরেও মাঝে মাঝে বলে সে তাকে অনেক পছন্দ করে কিন্তু ভালবাসে না তখন আরেকবার ছন্দপতন ঘটে তার জীবনের।কোন কিছুকেই তখন আর অর্থবহ মনে হয় না।জলন্ত সিগারেটে সুখটান দিয়ে ধোয়া হিসেবে বের করে দিতে চায় মনের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলোকে।ব্যর্থ হয় আবার চেষ্টা করে,আবার ব্যার্থতা আবার চেষ্টা চলতেই থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা,সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত।
সময় তার স্বাভাবিক নিয়মে চলে যায়,এভাবে সময় চলতে চলতে সেমিস্টার শেষ করে দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় শান্ত।বেশ অনেকদিন পর আবার দেশে ফেরা।বেশ লম্বা ছুটিতেই এসেছে এইবার।অনেকদিন পর অনেকগুলো প্রিয় মুখগুলোকে কাছে পাওয়ার আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে শান্তর পৃথিবী।কালকে অথৈ এর সাথে দেখা হবে।তার বিয়েটা আপাতত হচ্ছে না।মেয়ের ডাক্তারী পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে অথৈ এর কাকার বন্ধুর ছেলেকে এমন্টাই বলে দিয়েছে অথৈ এর বাবা।যদিও দুই পরিবারের মধ্যে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়ে আছে।কিন্তু বিয়ে তো আর হয়নি।দেখা যাক সুযোগ পেলে সে অথৈ কে নিয়ে পালাবে।মাঝে মাঝে চিন্তা করে অথৈ রাজি না হলেও তাকে জোর করে বিয়ে করবে শান্ত।এসব কত অগোছালো ভাবনা ভাবে এখন শান্ত!শেষ যখন দেখা হয়েছিল তখন কোন এক বিষয় নিয়ে শান্তর উপর রাগ করেছিল অথৈ বিদায়ের ঠিক আগের মুহুর্তে।মাঝে মাঝে এটা নিয়ে ওরা অনেক হাসাহাসি করে এখন।তবে অথৈ এর সেদিনের সেই রাগী চেহারাটাতে কিছু একটা খুজে পেয়েছিল শান্ত।সেই রাগী চেহারাটাতে যতটা না কাঠিন্য ছিল তার থেকে বেশী ছিল অধিকার মেশানো অভিমান।যেটা দেখলেই বুকের ভিতর একটা সুখের মত ব্যাথা অনুভূত হয়েছিল।মনে হয়েছিল সারা জীবণ পার করে দেয়া যাবে এই অভিমানী চেহারার মেয়েটিকে ভালবেসে।
শান্ত এবং অথৈ মুখোমুখি বসে আছে।দুজনের সামনেই একটি করে কফির মগ রাখা।শান্ত কফি অনেক পছন্দ করে।অথৈ পছন্দ না করলেও গত কয়েক্ মাসে কফি খাওয়াটা বেশ ভালই রপ্ত করে নিয়েছে সে।কফিতে চুমুক দিতে দিতে দুজন দুজনের দিকে তাকাচ্ছে, ছোট্ট করে হাসি দিচ্ছে,চোখে চোখ পড়তেই অথৈ চোখটা সরিয়ে নিচ্ছে।অথৈ এর লাজুক চেহারাটা গরম ধোয়া তোলা কফিতে চুমুক দিতে দিতে বেশ ভালই উপভোগ করছিল সেদিন শান্ত।পুরোটা সময় বলতে গেলে চুপ করে ছিল ওরা দুজন।কথা হয়েছিল চোখে চোখে আর মন দুটো যেন একেঅপরের সাথে মিলেমিশে চুপচাপ একজন আরেকজনকে ভালবাসায় ব্যাস্ত ছিল।
এভাবে দিনগুলো বেশ ভালই রঙ্গীনভাবে কেটে যাচ্ছিল।মাঝে মাঝেই অনেক মানঅভিমানের পালা চলত বেশ লম্বা সময় নিয়েই।এসবের মধ্যে সামনাসামনি “ভালবাসি” কথাটা বলাই হয়নি।সত্যি কথা বলতে কি কয়েকবার বলতে যেয়েও বলেনি শান্ত। বললেই যদি তাকে না করে দিয়ে চলে যায়,আর না আসে?তার থেকে যেমন চলছে সেটাই ভাল।কিন্তু যাবার আগে বলতেই হবে তাকে,যা হবার হবে।কি আছে জীবনে?
আগামীকাল রাতের ফ্লাইটে চলে যাচ্ছে শান্ত।সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে সুখের কিছু স্মৃতি আর কিছু মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা।মনটা অনেক বেশী খারাপ আজকে সেই সাথে উত্তেজিত।আজকে সে অথৈকে সামনাসামনি তার ভালবাসার কথা জানাবে।যদিও সে বিশ্বাস করে তাদের মধ্যে শুধু ভালবাসা না অনেক কঠিন ভালবাসা আছে তারপরও একবার সামনাসামনি শুনতে চায় সে।
অথৈ, একটা কথা বলতে চাইছিলাম
হ্যা বল
আমি তোমাকে ভালবাসি(আবেগের লেশমাত্র নেই)
এভাবে কেউ ভালবাসি বলে?
জানিনা কিভাবে বলে,তবে যেটা বললাম সেটা অনেক সত্য কথা
শান্ত আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি কিন্তু ভালবাসি না।বিশ্বাস কর।আমি এ কথা তোমাকে আগেও বলেছি।এভাবে তুমি আর কখনো বলো না প্লীজ।আমার কষ্ট লাগে।
তাহলে পছন্দও করতে হবে না।যদি পার ভালবাস না হলে কিচ্ছু দরকার নাই।বলেই উঠে চলে এল শান্ত।মনের মেজাজ আজ চূড়ান্তের থেকেও বেশী খারাপা।আরকিছুক্ষণ থাকলে দেখা যাবে কি দিয়ে কি বলা শুরু করবে তার কোন ঠিকঠিকানা নাই।
এক্টার পর একটা সিগারেট পুড়াচ্ছে শান্ত।প্রত্যাখ্যান আর না পাওয়ার যন্ত্রণা সব মুছে ফেলার এক ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে চালাতে রিকশায় চড়ে যাচ্ছিল।দুনিয়াটা শব্দহীন মনে হচ্ছে।অথৈ এখনো একটা ফোনও দিল না!থাক কি হবে আর এসব ভেবে?যে আমাকে নিয়ে একটুও ভাবে না তাকে নিয়ে কেন আমি সারাক্ষন ভাবি?সব ভুলে যাব,সব।এসব ভাবতে ভাবতে রিকশা থেকে নেমে তার অনেক প্রিয় ছাদের দিকে চলা শুরু করল ।এখানে সবাই আছে বন্ধুরা।যাদের সে জীবনের সবক্ষেত্রেই নিজের মনের মত করে পাশে পেয়েছে।ওদের মাঝে গিয়েই খুব হাসতে হাসতে বলছিল তার ব্যার্থতার কথা।এই একটা গুণ আছে ছেলেটার অনেক কষ্টের মাঝেও সুন্দর করে হাসতে পারে।খুব গভীরভাবে না দেখলে সেই হাসির আসল অর্থটা কেউ বুঝত না।ওর বলার ভঙ্গীতে সবাই হাসছিল একসাথে।পাশ থেকে কাধের উপর হাত রেখে রবিন বলল,দোস্ত মনটা কি বেশী খারাপ নাকি রে?ধরা খেয়ে যায় শান্ত।
হাসিটা ততক্ষনে অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে শান্তর,হয়তো ধরা পড়ে যাবার লজ্জাতেই।ঘুরতে যাবি আমার সাথে?শান্ত ভঙ্গীতে রবিনকে জিজ্ঞেস করে সে।
কই যাবি?চল যাই।
যমুনার রোডটাতে যাই চল।আমি চালামু এখন,চাবি দে।
আজকের পরিবেশটা পুরোটাই ভিন্ন।প্রকৃতি মনে হয় তাকে একটু বেশী ই ভালবাসে তাইতো সব যেন নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে।সন্ধ্যার পরপরই পূর্বাকাশে বিশাল থালার মত চাঁদটা নিজের আগমনীবার্তা বেশ ভালই জানান দিচ্ছে।এরকম পরিবেশে যমুনার হাইওয়েতে মটরসাইকেল নিয়ে ছুটে চললে পৃথিবীর কোন মানুষেরই মন খারাপ থাকতে পারে না।এই বিষয়ে যে কোন বাজি লাগতে পারে শান্ত।একটু পরেই ঝুপ করে রাত নেমে গেল।অবাক চাঁদের উথালপাতাল জোছনায় যেন পুরো পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে।রাস্তাটিকে যেন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবির মত মনে হচ্ছিল তখন।এরকম পরিবেশে বাতাসের সমুদ্র কেটে বীরদাপটে এগিয়ে চলেছে দুই বন্ধু।মনে হচ্ছে আজ সারারাত এভাবেই ভাসবে।মনের দুঃখ যন্ত্রণা সব এখানেই বিসর্জন দিয়ে যাবে সে।
মেসেজটোন বাজছে।অথৈ এর কোন মেসেজ না তো?চলন্ত অবস্থাতেই মেসেজটা দেখে শান্ত “ফেইসবুকের ইনবক্স দেখ”।
শান্ত ছেলেটা সারাজীবনে খুব কম কাজই চিন্তাভাবনে করে করেছে।আজও অদূরে বিপরীত পাশ থেকে আসা হেডলাইটের আলোটা দেখেও মেসেজটোনের শব্দে দিগ্বিদিক বেমালুম ভুলে মেসেজ পড়ায় মন দিল।এতক্ষন তো সে এর জন্যই অপেক্ষা করছিল।অপেক্ষার প্রহর পুরোটা শেষ না হতেই অপর পাশ থেকে আসা বিশালাকৃতির বাসটি এই অমনোযোগী চালককে বিন্দু মাত্র ক্ষমা বা প্রশ্রয় না দিয়ে নিজের বিশালত্বের গাম্ভীর্য বজায় রেখে সোজা চলে গেল।রাস্তার পাশে হেটে যাওয়া কিছু মানুষ একটা শব্দ শুনতে পেল এবং দেখল কিছু একটা ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপাশটাতে।
মহাসড়কের পাশে কিছু লোকের ভিড় চোখে পড়ছে।পুলিশের একটি পিকাপভ্যান লালরঙ্গা বাতি জ্বালিয়ে কেবলমাত্র ঘটনাস্থলে পৌছল।বাসটিকে এখনো সনাক্ত করা যায় নি।পিছনে বসে থাকা ছেলেটি বাসের ধাক্কায় ছিটকে রাস্তার পাশে যেয়ে পড়ে।তাকে হালকা যখম অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।কিন্তু যে চালাচ্ছিল তার বুকের উপর দিয়ে বাসের চাকা গেছে।স্পট ডেড।ছেলেটিকে এখনো সনাক্ত করা যায়নি।এভাবেই পুলিশের সেকেন্ড অফিসারকে রিপোর্ট দিচ্ছিল এক কন্সটেবল।এক প্রত্যক্ষদর্শী পথচারীর সহায়তায় রিপোর্টটি খুব তাড়াতাড়িই তৈরী করতে পেরে তাকে বেশ উতফুল্লই দেখাচ্ছিল।
তাজা রক্তে রাস্তার খানিকটা অংশ এখনো ভিজে আছে।চাঁদের আলোতে জায়গাটিকে অনেক ভয়ঙ্কর লাগছিল।মুখটাতে একটা আচড়ও লাগেনি,যদিও এতক্ষণে অনেকটা হলুদাভ বর্ণের হয়ে গেছে।মুখটা অনেক শান্ত আর নির্মল হয়ে আছে।সবার এত আদরের,এত ভালবাসার শান্তর মৃত দেহটা এখনো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে রাস্তার উপরেই।প্রিয়জনেরা এখনো জানেনা তার এই অকালে চলে যাওয়ার খবরটা।
কোনদিন আর ফেইসবুকে লগইন করা হবে না শান্তর।কারন ততক্ষণে অনেক অভীমান বুকে নিয়ে বাস্তব জীবন থেকে সে লগআউট করে জীবনের আইডিটাকে ডিএক্টিভেট করে দিয়েছে।সে দেখে যেতে পারল না তার জন্য অথৈ এর অধীর আগ্রহ আর বুক ভরা নিটোল ভালবাসা।সে জানে না অথৈ বাসায় ফিরে এসেই শান্ত নামের ছেলেটির প্রোফাইল খুলে বসে আছে আর মেসেজের অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষন আগে শান্তর দেয়া “তোমাকে নিয়ে একটি গল্প সাজাবো,যে গল্পের কোন নাম থাকবে না” স্ট্যাটাসটিতে এতক্ষনে সে অনেকগুলো কমেন্ট দিয়ে ফেলেছ।সে জানে তার ফেইসবুকের মেসেজটি দেখলেই শান্ত সাথে সাথে তাকে ফোন দিবে।ফোনটা ধরেই অথৈ বলবে,
তুমি আমাকে একটুও ভালবাস না।
কি বল তুমি এইসব?অনেক ভালবাসি তোমাকে
কচু বাস,ভালবাসলে তো তোমার সাজানো গল্পটার নাম থাকত,থাক আমি বুঝে গেছি তুমি আমাকে আসলেই দেখতে পার না।
তুমি চাইলেই তো নাম হয়
আমি চাই তুমি এটা বোঝ না?সব কথা কি মুখে বলতে হবে?আমাদের গল্পটার নাম হবে “ভালবাসা”।ঠিক আছে বাবু?আরেকটা কথা আমি আরো দুইটা চরিত্র চাই আমাদের গল্পটাতে,তাদের নাম হবে হিয়া আর অর্ক।(সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিবে।গাল দুটো ততক্ষণে লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে গেছে অথৈ এর…).
©somewhere in net ltd.