![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহীদুল ইসলাম
বাংলাদেশে একসময় আবাহনী-মোহামেডানের জোরালো সমর্থক ছিল। স্টেডিয়ামে মারদাঙ্গা হতো। এখন তা ইতিহাস। ফুটবল গর্তে ঢুকে গেছে। আর উঠে এসেছে ক্রিকেট। বাংলাদেশ যখন ব্যাটে বা বলে থাকে তখন সারা দেশের মানুষ ক্রিকেট জ্বরে আক্রান্ত হন। শরীরে অন্যরকম এক উত্তেজনা তৈরি হয়। বাংলাদেশ যখন জেতে তখন আমরা আনন্দ-উন্মাদনায় মেতে উঠি। এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ক্রিকেট জেগেছে। কিন্তু খেলা যে একটি সংস্কৃতি তা আমরা বেলালুম ভুলতে বসেছি। অথচ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল খেলার মাধ্যমে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিল।
আজকের এই যে ক্রিকেট খেলা, এর মাধ্যমে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু ক্রিকেট সমর্থক হিসাবে আমরা কিন্তু সেই ফুটবলের গর্তের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। যে কোনো সময় ঢুকে পড়বো। আমরা ভারতের সমর্থকদেরই নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকে অনুসরণ করছি। তারা ‘মওকা মওকা’ বলে চিৎকার করলে আমরা সেই বিজাতীয় সংস্কৃতির দ্বিগুণ করছি। কিন্তু কেন?
ক্রিকেট তো অনেকগুলো দেশ খেলে। সবাই কী জয়ী হয়? চ্যাম্পিয়ন হয় একটি দেশ। এটাই সংস্কৃতি। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধকে টেনে আনি। পুরো পাকিস্তানকে নিকুচি করে ছাড়ি আমরা ফেসবুকে। এমনকি আমাদের নেতারা খেলার প্রসঙ্গ টেনে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে ভুল করেন না। অথচ যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি যে দেশটি সেই পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল আছে। সার্ক সম্মেলনে দুই দেশের নেতারা পাশাপাশি বসেন। অভিন্ন অনেক ইস্যুতে কথা বলেন। করমর্দন করেন। বাণিজ্য চুক্তিও আছে দেশটির সঙ্গে। ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের সমর্থক হিসাবে পাকিস্তানের পরাজয় চাই। অথচ মুক্তিযুদ্ধকে টেনে এনে আমরা আমাদের অর্জনগুলোকে ছোট করে ফেলি। পাকিস্তানের সঙ্গে যখন হেরে যাই তখন আমরা আবার গর্তে মুখ লুকাই। এ ধরনের উগ্র সমর্থন নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সর্বত্র। খোদ আমাদের ক্যাপ্টেন মাশরাফিও নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন খেলায় মুক্তিযুদ্ধকে টেনে না আনতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
এবার আসি ভারত প্রসঙ্গ। বাংলাদেশে রাজনীতির দুটি ধারা। বাঙালী ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। যারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তারা ভারতের বিরোধিতা করেন অজস্র কারণে। আমার মতে, তাদের ভারত বিরোধিতার অন্যতম কারণ- একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত কেন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল? পাকিস্তানের বিপক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল? অথচ আমরা সবাই জানি এবং অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই সময় ভারতের সহায়তা না পেলে মুক্তিযুদ্ধ ৯ মাসের পরিবর্তে আরো দীর্ঘ হতো; শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের পরিবর্তে ৭ কোটি হতে পারতো। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করি। এই যুদ্ধে ১৫২৬ জন ভারতীয় সেনা শহীদ হন। তাদের আত্মত্যাগ অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের ভৌগলিক বর্ণনায় দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মায়ানমার ছাড়া চারপাশে ভারত। লক্ষ্য করে দেখবেন, কেউ ভারতের মানচিত্র আঁকলে তার বাংলাদেশের মানচিত্রও আঁকা হয়ে যায়। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বন্ধু রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের কাছে আমাদের প্রত্যাশা হয়তো বেশী। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতের সঙ্গে আমাদের অসম বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। শুধু ভারত নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অসম বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। অথচ কখনো শুনিনা এসব নিয়ে কাউকে কথা বলতে। অথচ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা ঘুম থেকে উঠে এবং ঘুমোতে যাবার আগ পর্যন্ত ভারত বিরোধিতায় ব্যস্ত থাকেন। এটা তাদের রক্তে মিশে গেছে। অথচ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের বাজারে পরিণত হয় বাংলাদেশ। অবাধ বাণিজ্য সুবিধা পায় ভারত। তাহলে- মুখে ভারতবিরোধিতা করে তারা কী পাকিস্তানের সহানুভূতি পেতে চান?
অহেতুক এই ভারত বিরোধিতার রেশ পড়েছে এখন ক্রিকেটে। আইসিসি পরিচালনা নিয়ে ভারতের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তাই বলে ভারত বার বার তো চ্যাম্পিয়ন ট্রফি নিয়ে ঘরে ফেরে না। ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষমতাধর দেশ ক্রিকেট খেলছে। আইসিসির ভূমিকা নিশ্চয় একদিন তাদের চোখেও ধরা পড়বে। আমি অস্বীকার করছি না যে দুর্বলের দিকেই সবলের অত্যাচার বাড়ে। কিন্তু তারপরও কী আমরা এগিয়ে নেই? আমেরা তো খেলেই এ পর্যন্ত এসেছি। একদিন চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয় করবো। কিন্তু দর্শক বা সমর্থক হিসাবে আমরা কী এগোতে পারছি?
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বিদায় নেবার পর আমি আর এই খেলা দেখি না। আমি সেরকম ক্রিকেটপ্রেমী নই। তবে বাংলাদেশ যখন খেলে আমার চেয়ে বড় ক্রিকেটপ্রেমী বোধহয় আর কেউ নেই। ভারতের সঙ্গে যেদিন শ্বাসরুদ্ধকর পরাজয় হলো, সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছি। হারার চেয়ে কষ্ট পেয়েছি আমাদের যে ১১জন খেলোয়াড় মাঠে ছিলেন তাদের জন্য। তাদের কষ্টটা অনুভব করার চেষ্টা করেছি। অথচ একটু পরে তাদের নিয়ে ফেসবুকে যে কটুক্তি দেখেছি তা দেখে আমার কষ্টের বদলে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা তৈরি হয়েছে। এই আমাদের সংস্কৃতি। এই আমাদের শিক্ষা। শিক্ষিত-অশিক্ষিত আর গণ্ডমুর্খরাও গালিগালাজ করেছেন আমাদের খেলোয়াড়দের। মুশফিকুর রহিম ক্ষমা চেয়েও পাননি। মাহমুদুল্লাহ তার ভায়রা। দুজনকে জড়িয়ে কথা নেতিবাচক কথা। সঙ্গে ভারতবিরোধিতার কথা না-ই বা বললাম।
যাই হোক, আজকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারতের সেমিফাইনাল খেলা আমি দেখিনি। সকালে পত্রিকার খবরে জানলাম ভারত হেরে গেছে। ঢুকলাম ফেসবুকে। সে কী অবস্থা! ফেসবুকে শিক্ষিত-অশিক্ষিত আর গণ্ডমুর্খদের গালিগালাজের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে যদি উন্মত্ততা দেখানো যেতো তাহলে সেটিও তারা করতো। কী ভাষার ব্যবহার। ধরে নিলাম- পুরো বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সমর্থক। দেশজুড়ে উৎসব হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ভারতবিরোধিতা কেন? অসভ্য উচ্ছৃঙ্ক্ষল ভাষা কেনো ব্যবহার করতে হবে?
মনে রাখবেন- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এখন অনেক, অনেক বেশী শক্তিশালী। ক্রিকেট নিয়ে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করছি তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। আপনি যে ভাষায় লিখুন না কেনো তা ফেসবুকেই এক ক্লিকেই অনুবাদ হয়ে যায়। অনেকেই কৌতুহলবশত: তা দেখেন আর আমাদের রুচির পরিচয় অনুভব করেন।
এখানে কিছু স্ট্যাটাস তুলে ধরতে পারতাম। ঘৃণায় যে কোরো গা শিরিশির করবে। তবে খারাপ জিনিস পরিত্যায্য। তাই সেগুলো এখানে পুনরায় তুলে ধরে নিজেকে সমান সমান করতে চাই না।
তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়-
আমার ফেসবুক বন্ধু ভয়েস অব আমেরিকার সিনিয়র সাংবাদিক আহসানুল হক (Ahsanul Huq ) তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘ভারত আজ ভালো খেলে হেরেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অসাধারন খেলে জিতেছে। সবাইকে অভিনন্দন। ভুলে যাবেন না, এককালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পৃথিবীর সেরা দল ছিল। সেটা এখনও তাদের রক্তে আছে।’ আমাদের মনোভাব ঠিক এমনই হওয়া উচিত!
এমন স্ট্যাটাসও হতে পারে, যেমনটি সাংবাদিক বন্ধু মাহবুব স্মারক ( Mahboob Smarak ) তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘ক্রিকেটে বাংলাদেশ ছাড়া আমি আর অন্য কোন দলকে সাপোর্ট করিনা! আমার দেশের সোনার ছেলেরাই বিশ্বসেরা! অন্য দলের খেলা বা তাদের হারজিত দেখে তৃপ্ত হতে আর রাজি নই! বহু বছর অন্য দেশ অন্য দলকে সাপোর্ট করেছি। আর নয়...!!’
আবার এমন স্ট্যাটাসও দোষের কিছু নয়, যেমনটি লিখেছেন আমার সাবেক সহকর্মী, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক প্রভাষ আমিন ( Probhash Amin ) `পাকিস্তানের বিপক্ষে সৌম্য সরকারের ক্যাচটা দেখেই মনে হয় গত কদিন ভারতীয়রা ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করেছে। কিন্তু সৌম্য একা যেটিকে ক্যাচ বানিয়েছে, ভারতের দুজন মিলেও তা পারেনি। উল্টো ছক্কা হয়েছে। আহারে বেচারা ভারতীয়রা অনুসরনটাও ঠিকমত করতে পারলো না। তবে মনে রাখতে হবে প্র্যাকটিস মেইক অ্যা ম্যান পারফেক্ট। একবার না পারিলে দেখো শতবার। মন খারাপ করো না। সৌম্যর ক্যাচের ভিডিওটা বারবার দেখলে একদিন না একদিন তোমরা ঠিকই পারবে, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গুড ট্রাই, ভেরি গুড ট্রাই।'
আরেক সাবেক সহকর্মী, সাংবাদিক সুব্রত আচার্য্য ( Subrata Acharjee ) লিখেছেন অল্পকথায় দারুণ কিছু- `খেলা খেলাই। ভারত বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ক্রিকেট খেলার কারণে দুই দেশের বিদ্বেষী হয়ে উঠছে। এখনই বিষয়টি নিয়ে সচেতন হতে হবে। নইলে মারাত্মক বিপদ ঘটবে।'
[ পাদটীকা: খেলা খেলাই। খেলা হোক শুদ্ধ সংস্কৃতি ও বিশ্বশান্তির মেলবন্ধন ]
©somewhere in net ltd.