![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার উড়ার আকাশ; আজ আমি পেয়েছি আমার ছোট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি । কিন্তু আমার আকাশও রইল ।“ _ রবি ঠাকুর
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে মানবের তরে বাচিবার চাই” ।
কবির এই আকুতি যেন আরও স্পষ্ট হয়ে বাজে আমাদের কানে । হা, বাঁচিবার স্বাদ আমাদের জন্ম জন্মান্তরের । আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই । এই পৃথিবীর মুক্ত স্বাধীন বাতাসে স্বস্থির নিঃশ্বাস নিতে চাই । প্রাণভরে গ্রহণ করতে চাই পৃথিবীর টাটকা ফল-মূল আর নির্ভেজাল সব খাবার । রেখে যেতে চাই সুস্থ সুন্দর ও জ্ঞানী প্রজন্ম । যারা তাঁদের মেধা আর মনন দিয়ে পৃথিবীটাকে স্বর্গময় করে তুলবে ।
আগে প্রায়ই শুনা যেত বিষ পান করে আত্মঘাতী হওয়ার কথা । কিন্তু আজকাল নাকি বিষ পান করে কেউ আর সফল আত্মঘাতী হতে পারছে না । তাহলে বিষের বিষক্রিয়া গেল কোথায় ? ছোটবেলা দাদা-দাদির কাছে শুনতাম আগের দিনে নাকি ভূত-প্রেত আর দৈত্য-দানবেরাও থাকতো এই পৃথিবীতে । তারা যখন এই পৃথিবীতে বিচরণ করত তখন মানুষজন ভয়ে ঘরের কোনে লুকিয়ে থাকত । আমি একবার জিজ্ঞ্যেস করেছিলাম, দাদু ভূতপ্রেতরা এখন কোথায় ? সঙ্গে সঙ্গে দাদুর মুখটা কাল হয়ে গেল । ঘৃণা আর ক্ষোভ মিশ্রিত গলায় বললেন, ওরা এখন মানুষের ভেতরে । ততোটা বুঝতাম না তখন । এখন বুঝি । বিষ যে মানুষের মনে ।
সারাদিন অফিস করে বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলেন । চোখ পড়ল রাস্থার পাশেই ছোট্ট একটি দোকানে । চমৎকার সুন্দর করে সাজানো লিচুগুলি দেখতে ভীষণ লোভনীয় মনে হচ্ছে । সাথে সাথে মনে পড়ল, ছোট মেয়েটা গতকাল লিচু খেতে চেয়েছিল । দাম-দর করে দেখলেন হাতের নাগালেই আছে । নিয়ে নিলেন ভাল দেখে দুই আঁঠি লিচু । নিশঃসন্দেহে সন্তানের প্রতি ভালবাসার প্রকাশ পেয়েছে আপনার । কিন্তু এটাও তো হতে পারে নিজের অজান্তেই প্রিয় সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিষাক্ত ফরমালিন ।
কিবা করার আছে আমাদের । আমাদের দেশে এত এত সমস্যা যে আমরা মাথা তুলে দাড়াতেই পারি না । প্রতিবাদ করব কি দিয়ে । আমাদের গড়ে তুলা হয়েছে এই ভাবে । বুকে সাহস নেই শরীরে আছে বল ।
বাংলা চলচিত্রের সর্বকালের সেরা চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় । তার “হীরক রাজার দেশে” নিশ্চয় সবার দেখা আছে । হীরকের অত্যাচারী রাজা সবসময় চাইতেন প্রজারা যাতে জ্ঞানী হতে না পারে । সে বলত, “তারা যত বেশী পড়ে, তত বেশী জানে । আর যত বেশী জানে, তত কম মানে” । এই জন্য রাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল । তাহলে এই ফরমালিন থেকে রক্ষা করতে সরকার কেন বড় কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন ? নাকি পুরো জাতী ততা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রুগ্ন ও মেধাশূন্য করে রাখতে চান এই ফরমালিনের বিষক্রিয়ায় ?
আমরাও হয়ত কোন হীরক রাজার দেশে বাস করছি । নয়ত ফরমালিন ব্যাবহার আইন করার নামে সরকার এত গড়িমসি করছে কেন ? ঐ সব দুষ্ট অধিক মুনাফা লোভীরা যদি আমাদের মৃতূর মুখে ফেলে দিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ না করে, তবে কেন তাঁদের মৃতূদণ্ড দেওয়া হবে না ?
দৈনন্দিন জিবনে আমাদেরকে একে অপরের উপর নির্ভরশীল হতে হয় । কৃষক কামারের উপর নির্ভরশীল, কামার দর্জির উপর নির্ভরশীল, দর্জি মুচির উপর নির্ভরশীল । ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের উপর নির্ভরশীল আবার ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল । ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারকে ঠকালে যেমন সাথে সাথে বোঝতে পারেন না ডাক্তার মশাই, ঠিক তেমনটি হয় ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষেত্রেও । তার পরও আমরা বিশ্বাস করি । মানুষ বলেই বিশ্বাস করি । সৃষ্টির সেরা জীব বলেই বিশ্বাস করি । ঠিক তেমনি ভাবে আমরা একেকজন ফল বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, সবজি বিক্রেতার উপর নির্ভরশীল এবং তাঁদের বিশ্বাস করে বা করতে হয় । আর এই নির্ভরশীলতাকে ও বিশ্বাসকে দুর্বলতা ভেবে কিছু দুষ্ট লোক ফল-মুল সহ ভোজ্য পন্য টাটকা রাখার নামে মিশিয়ে দেয় মরন ঘাতী বিষ, ফরমালিন । তাহলে নির্ভরতার জায়গাটা রইল কোথায় । তাহলে মানুষের মনুষত্য মানবিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে । ভাবাই যায় না ।
কি সেই ফরমালিন ? চলুন একটু জেনে নেয়া যাক ।
ফরমালডিহাইড বা মিথান্যাল এক প্রকার জৈব যৌগ । বর্ণহীন ও দুর্গন্ধযুক্ত গ্যাস হিসেবে পরিচিত । রাসায়নিক সংকেত CH20 । বাণিজ্যিক উদ্যেশ্যে ফরমালডিহাইড পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় সচরাচর ফরমালিন নামেই পরিচিত । এটি মূলত রং তৈরি, বস্ত্রখাতে কাপড় কুঞ্চিত হতে না দেয়া, সংরক্ষণ, বিস্ফোরণ এবং পলিমার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ।
কিন্তু আজকাল এটি তার নিজস্ব ক্ষেত্র ছড়িয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পন্যে পচন নিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । অতচ ২০১১ সালের ১০ই জুন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম কর্তৃক গবেষণায় ফরমালিনকে মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায় । এছাড়াও এটি পাকস্থলীতে প্রদাহ, লিভারের ক্ষতি, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার, চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগের কারন । ধীরে ধীরে এসব রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয় । লিভার ও কিডনি অকেজো করে দিতে পারে । হার্টকে দুর্বল করে দেয় । স্মৃতিশক্তি কমে যায় । অস্থিমজ্জা আক্রান্ত হওয়ার ফলে রক্তশূন্যতাসহ অন্যান্য রক্তের রোগ, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে । এতে মৃত্যু অনিবার্য । তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে । ফরমালিনযুক্ত দুধ, মাছ, ফলমূল এবং বিষাক্ত খাবার খেয়ে দিন দিন শিশুদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে । কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট, বিকলাঙ্গতা, এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে শিশু-কিশোররা । শিশুদের বুদ্ধিমত্তা দিন দিন কমছে ।
এই ফরমালিন তিলে তিলে নিশ্বেস করে দিচ্ছে আমাদের । মাছ সবজি মাংস থেকে শুরু করে তাজা ফলমূল পর্যন্ত সব কিছুই আজ বিষাক্ত ফরমালিনের স্পর্শে প্রাণঘাতী রূপ ধারন করছে । এই বেজাল রোধে সরকারের অভিযান একমাত্র ঢাকা শহরে ছাড়া দেশের অন্যত্র তেমন একটা পরিচালিত হয় না । এ অবস্থায় মরণব্যাধির জীবাণুবাহী ফরমালিনের ব্যবহার অপ্রতিরোধ্যভাবেই বেড়েই চলেছে ।
পোল্ট্রি ও হ্যাচারিতে বছরে ফরমালিন প্রয়োজন হয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার লিটার । অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৫ লাখ লিটার ফরমালিন আমদানির অনুমতি দিয়েছে । চামড়া খাতে প্রয়োজন ২০ থেকে ২৫ হাজার লিটার । সেখানে অনুমতি দেয়া দুই লাখ লিটার । একই ভাবে অন্যান্য সেক্টরে প্রয়োজনের অনেক বেশি পরিমাণ ফরমালিন বৈধপথেই আমদানি করা হয় । বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কার্যালয়ের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই বিপুল পরিমাণে ফরমালিন আমদানি সম্ভব হচ্ছে। আমদানি করা ফরমালিন কোথায় কি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা কখনও খতিয়ে দেখে না । ফলস্বরূপ আমদানিকারকরা নির্বিঘ্নে আমদানি করা ফরমালিনের অবৈধ ব্যবহার করতে পারছে ।
জীবন মৃতূর দ্বার প্রান্তে দাড়িয়ে আজ এই বিষাক্ত ফরমালিনের বিষক্রিয়া হতে পরিত্রাণের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি সর্বক্ষণ । আমরা নিতান্তই অসহায়, ঐ সব লোভী মুনাফাদ্বারী অমানুষ দের কাছে । যারা অধিক মুনাফা লাভের আশায় আমাদের জীবনকে এক এক করে মৃতুর দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে । সরকারেরও বিশেষ কোন হস্তক্ষেপ লক্ষ করছি না । এ অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে সরকার আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েও তা মাঝপথে থামিয়ে রাখা হয়েছে। বর্তমানে ফরমালিন আমদানির অনুমতি দেয়ার জন্য কোন অথরিটি নেই। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের প্রজন্ম ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বড় একটি অংশ আলসার ক্যান্সার সহ প্রান-ঘাতী রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে । কিংবা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে পারে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধি শিশুর সংখ্যা ।
কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে করজোড়ে আবেদন করছি । আমাদের ততা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন এভাবে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিবেন না । আপনারা হয়ত বাসায় ল্যাবরেটরি বানিয়ে রেখেছেন । পরীক্ষা ছাড়া এক গ্লাস পানি ও খান না । কিন্তু আমাদের সেই সামরথ নেই । তার পরও বলি । আমরাও কিন্তু মানুষ । আমাদের জীবনেরও মুল্য আছে ।
©somewhere in net ltd.