নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার চোখে তো সকলই শোভন/সকলই নবীন,সকলই বিমল/ সুনীল আকাশ,শ্যামল কানন/বিশদ জোছনা,কুসুম কোমল/সকলই আমার মত
কেউ ক্লাসরুমে বসেই গল্প করছিল। কেউ বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিল। কেউ এই ফাঁকে ক্যান্টিনে চলে গেছে কিছু খেতে।একটু পরেই আরেকটা ক্লাস শুরু হবে। পরবর্তী ক্লাসের জন্য এভাবেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।এমন সময় একজন লোক এলো, তার হাতে কতগুলো কাগজ ফটোকপি করা। এগুলোতে বাচচাদের জন্য তার লেখা ছড়া, রাইম রয়েছে। মানুষের কাছে ২/১টাকায় কাগজগুলো বিক্রি করতে করতেই আমাদের ডিপার্টমেন্টে চলে এসেছেন। ক্লাস শুরু হতে এখনো কিছু সময় বাকি আছে।লোকটা কি করেন না করেন সেসব নিয়ে আমরা কয়েকজন তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম।লোকটার মুখে যেন খই ফুটতে শুরু করল…
‘’এই যে দেখেন, আমি নতুন করে বাংলা অক্ষর তৈরি করছি।অনেক গবেষণা করে তৈরি করছি। এতে আছে মাত্র ২০টা অক্ষর। মাত্র ২০টা অক্ষর দিয়েই সব কিছু লেখা সম্ভব। আমাদের আর কষ্ট করে ৫২টা অক্ষর শিখতে হবে না, আ-কার, ই-কার শিখতে হবে না।বাচচাদের পড়ার চাপ কমে যাবে। আমাদের মস্তিষ্কের উপরেও চাপ কমবে।এই যে দেখুন, এ অক্ষরগুলো বাংলা আর এগুলো ইংরেজি।‘’
দেখলাম কাগজে কিছু অদ্ভুত সংকেত আঁকা।লোকটা কি বর্ণমালা ধবংস করে দিতে চায় নাকি? এদিকে লোকটা কথা বলেই যাচ্ছে।অনেকদিন পরে হয়ত তার মনের কথাগুলো বলার মত মনোযোগী শ্রোতা পেয়েছে আজ, ‘’আমি ‘’না’’ শব্দটাই ভাষা থেকে বাদ দিয়ে দিতে চাই।‘’না’’ ছাড়াই কথা বলা সম্ভব।এই ‘’না’’এর জন্যই আমাদের মধ্যে এত সমস্যা। আমি সেদিন অমুক ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে স্যারদেরকে আমার এই কথাগুলো বলছিলাম।তিনি তো সাথে সাথেই বুঝতে পারলেন, আমি কি বলতে চাইছি। উনি আমাকে চিনে ফেললেন। আমাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে চলে যেতে বললেন।সেজন্যই আর ওখানে আমি যাই না। তারপর আরেকদিন…।‘’
লোকটার গল্প আর শেষ হয় না। আমরা ঝটপট তার হাতের কয়েকটা কাগজ ২টাকায় কিনে ক্লাসে চলে এলাম।বন্ধুরা বলাবলি করছিল, ‘’কি এক পাগলের পাল্লায়ই না পড়েছিলাম!’’ হুম, পাগলই বটে! মানুষের মুখের ভাষা থেকে ‘’না’’ শব্দটাই গায়েব করে দিতে চায়! মনের অনুভূতি, ভাব বোঝাতে তখন কতটা বেগ পেতে হবে, ভাষা কতখানি সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে, এসব নিয়ে একটু যে ভাবনার জাল বিস্তার করব, সে ফুরসত আর পেলাম না। ক্লাসে স্যার চলে এসেছেন।
বছরের নতুন রুটিনে আমাকে বিজ্ঞানের ক্লাস না দিয়ে ‘’কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা’’র একটি ক্লাস দেওয়াতে মন-মেজাজ গরম হয়ে উঠেছিল। ক্লাসে গিয়ে বইটা হাতে নিয়ে মনে হল, নাহ, আমার অনেক কথা বলার আছে শিক্ষার্থীদের কাছে। তেমনি সেকথাগুলো বলার তেমন সময়-সুযোগ তো হয় না। এই ক্লাসের সুবাদে সেগুলো হয়ত বলার সুযোগ পাবো।ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আমি নিলাম। জানতে চাইছিলাম ওদের কাছেই, এই নতুন বিষয়টি কি ওদের জন্য আদৌ দরকার আছে কি না।বেশির ভাগ-ই বলছিল, দরকার আছে। দু-একজন দ্বিমত প্রকাশ করে বলল, দরকার নেই। কিন্তু যুক্তি দিতে গিয়ে ‘’দরকার আছে’’র পক্ষেই কথা বলে ফেলল।বেশ চলছিল বিতর্ক, এর মধ্যেই একজন বলে বসল ইন্টারেস্টিং একটা কথা, ‘’নম্বর তোলা আমাদের জন্য সহজ হবে, তাই এই বিষয়টির দরকার আছে।‘’
এবার পড়ার ও পড়ানোর পালা। শিক্ষার্থীদের বললাম একটা করে মানবিক গুণের নাম লিখতে।একগাদা মানবিকগুণের কথা ওরা আমাকে শোনাল। ওদের বলার ধরন অনেকটা এইরকম…
*অন্যের নিন্দা না করা
*মিথ্যা কথা না বলা
*মারামারি না করা……
ওদের কথাগুলো শুনতে শুনতে অনেক কথা মনের মাঝে ঘুরপাক করছিল। মনে হচ্ছিল, ওরা কথাগুলো এভাবেও তো বলতে পারতো…
*অন্যের প্রশংসা করা
*সত্য কথা বলা
*মিলেমিশে থাকা…
আমরা কেবলি শুনে আসছি উঠতে ‘’না’’, বসতে ‘’না’’, সব কিছুতেই ‘’না’’, ‘’না’’ আর ‘’না’’।
‘’যেন এক নেই রাজ্যের বাসিন্দে’’
এ বড় কুৎসিত ‘’না’’। এর প্রভাবেই হয়ত আমাদের মধ্যকার ইতিবাচক মনোভাবের মধ্যেও উঁকি দিয়ে যায় প্রচণ্ড নেতিবাচক মানসিকতা। এমন কুৎসিত, বিভৎস, নিষ্ঠুর, ভয়ংকর, ধবংসাত্নক ‘’না’’ শুনতে আপনি নিজেই কি চান?
আমরা শিক্ষার্থীদের বলে থাকি, পরীক্ষার সময় দেখাদেখি করবে না। এই কথাটা বলেই কিন্তু আমরা ওদের শিখিয়ে দিচ্ছি, পরীক্ষার সময় দেখাদেখি করেও লেখার একটা উপায় আছে।তারচেয়ে ভাষাটা যদি হয় এমন, ‘’নিজে নিজে ভেবে লেখো, নিজের কাছে সবচেয়ে যা ভালো মনে হয় তা লেখো’’ তবে কেমন হয়? আবার প্রায়শই এমন বলা থাকে, ‘’ ক্লাসের উপস্থিতি ৬০% না থাকলে অমুক পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে না।‘’ এমন নোটিশ শুনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের দুশ্চিন্তা, ভীতি, কাজ করে, এমন কি যে ৮০% ক্লাসে উপস্থিত থাকে তার মনের মধ্যেও।ওদেরকে এভাবে মানসিক চাপের মধ্যে না ফেলে আমরা এভাবেও তো বলতে পারি, ‘’ ক্লাসের উপস্থিতি ৬০% থাকলে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হবে।‘’
সেই পাগল (???)টার কথা খুব মনে পড়ে যায় আমার। মনে হয়, পারতাম যদি সব মানুষের মুখের ভাষা থেকে, মন থেকে ঐ কুৎসিত ‘’না’’টাকে মুছে দিতে, আর রেখে দিতাম শুধু ‘’না’’ এর সৌন্দর্য্টাকে।
©somewhere in net ltd.