নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার চোখে তো সকলই শোভন/সকলই নবীন,সকলই বিমল/ সুনীল আকাশ,শ্যামল কানন/বিশদ জোছনা,কুসুম কোমল/সকলই আমার মত
‘’বাবার পরিবারে যেন মেয়েটির শেকড় না জন্মায় বা কোন অধিকারবোধ যেন তৈরি না হয়, এমনভাবেই শৈশব থেকে একটি মেয়েকে গড়ে তোলা হয়।অনেক পরিবারে মেয়েটির শিক্ষার অধিকারও গ্রাহ্য করা হয় না। আমার নিজের পরিবারে দেখেছি, মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা, খাবার, পোশাক বা অন্য কোন কিছুতে কখনোই ভাই-বোনদের মধ্যে বৈষম্য করা হয় নি। কিন্তু, ঐ যে বললাম অধিকারবোধের কথা, বোনদের মধ্যে এ জিনিসটি যেন তৈরি না হয়, সেদিকেই যেন বেশি খেয়াল রাখা হত।মেয়েদের মানসিকতাটাই এমনভাবে গড়ে তোলা হয়।‘’-- বলছিলেন লাবণ্য (ছদ্মনাম)।
লাবণ্যরা তিন বোন ও এক ভাই। মুসলিম আইন অনুযায়ী বাবার সম্পত্তিতে যার যতখানি ভাগ পাবার কথা, সেভাবে বোনেরা পান নি কেউই। লাবন্য নিজেই বললেন, ‘’আমাদের বোনেদের ঠকানো হয়েছে।‘’ সম্পত্তি নিয়ে লাবন্যর বাবা বড় বোনদের বাদ রেখেই সব সময় ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতেন।এসব আলোচনায় বোনেদের কখনো অংশগ্রহণ হয় নি।তাই বোনেরাও অনেকটা সময় বাবার বিভিন্ন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে অন্ধকারেই ছিলেন।তারা এতদিন জানতেনই না কোথায় কোন সম্পত্তি কী পরিমাণে আছে। পরে এক সময় তারা অধিকার সচেতন হলেও বাবা তার ছেলের প্রতিই যেন বেশি দূর্বল ছিলেন। মেয়েদের অধিকার খর্ব করে হলেও ছেলেকে বেশি সম্পত্তি দিতে বাবা বেশি আগ্রহী। অনেক ক্ষেত্রে অন্য পরিবারের মেয়েদের সাথে তুলনা করে নিজের মেয়েদের বলতেন, ‘’তোমরা দেখো তো, অমুক পরিবারের কেউ তাদের মেয়েকে এভাবে সম্পত্তি দিয়েছে কি না!’’ বাবার কাছ থেকে এমন দায়িত্বহীন ও অবহেলা ভরা মন্তব্য লাবণ্য ও তার বোনেদের অনেক কষ্ট দেয়।
বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল কবি মারুফ রায়হানের সাথে। তিনি বললেন, ‘’আমার জন্মের আগ পর্যন্তও কেউ জানত না আমি পুরুষ হয়ে জন্মাবো নাকি নারী। কিন্তু যেই আমি পুরুষ হয়ে জন্মালাম, অমনি বাবার সম্পত্তিতে আমার এক রকম অংশীদার আর আমার বোনের আরেক রকম অংশীদার।একই বাবা-মায়ের সন্তান হয়েও এমন কেন হবে?’’
মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন পুরুষ তার স্ত্রী-সন্তান সন্ততিসহ পুরো পরিবারের দায়িত্ব বহন করতে বাধ্য। অথচ এ ব্যাপারে একজন নারীর কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তার উপর সেই নারী স্বামীর সম্পত্তিতে ভাগ পাচ্ছে, দেনমোহর পাচ্ছে (আদৌ তারা এসব পান কি?) ইত্যাদি কারণে বাবার সম্পত্তিতে কন্যা সব সময় তার ভাইয়ের অর্ধেক পাবেন। সময় পাল্টেছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরাও এখন উপার্জন করছেন। তারাও অনেকেই পুরুষদের পাশাপাশি পরিবারের দায়িত্ব, বাবা-মায়ের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করছেন। সেক্ষেত্রেও কি ঐ নারী তার বাবার সম্পত্তিতে ভাইয়ের সমান ভাগ পাবেন না?
এই প্রসংগ নিয়েই কথা হচ্ছিল লাবণ্যের সাথে। তার অভিজ্ঞতা বলে, মেয়ের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করা যেন বাবার পরিবারের কাছে খুবই লজ্জার একটি বিষয়। তারা নানাভাবে মেয়েটিকে এই দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন, নিরুৎসাহিতও করেন। কিন্তু ছেলের কাছ থেকে কিছু নেবার ব্যাপারে এসব কমপেক্স কাজ করে না। দেখা যায় মেয়েটি যদি বাবার পরিবারে ১টাকা খরচ করে তখন হয়ত প্রতিদান হিসেবে বাবা উলটো আরো ২টাকা পাঠিয়ে দেন। তবুও সম্পত্তিতে মেয়েকে নয়, ছেলের অধিকারটাই প্রতিষ্ঠিত করেন।এসব লাবন্যকে কষ্ট দেয়। বাবা-মায়ের জন্য খুব বেশি কিছু করতে পারেন না ভেবে এমনিতেই আত্নগ্লানিতে ভোগেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যাও সামান্য কিছু করার চেষ্টা করেন, সেটাও যখন আবার পরোক্ষভাবে ফেরত চলে আসে, তখন নিজেকে খুব অবহেলিত মনে হয়।
লাবন্য বলেন, ‘’আমি বাবার সম্পত্তিতে ভাই-বোনের সমান অধিকার তো চাচ্ছি না। মুসলিম আইন অনুযায়ী আমার যতখানি প্রাপ্য সেটুকুও তো আমি পাচ্ছি না!আমি আমার প্রাপ্য অংশটুকু বুঝে নিতে চাই।আসলে কিতাবের গরু শুধু খাতা আর কলমে। মেয়েরা শেষপর্যন্ত তার প্রাপ্যটুকু পায় না।কোনমতে একটা কিছু তাকে বুঝ দেওয়া হয় শুধু।‘’
অন্যদিকে আফিয়া আক্তার (ছদ্মনাম) বললেন অন্য কথা। তিনি বেশ গর্ব করেই বললেন, ‘’আমি কখনো আমার বাবার সম্পত্তিতে ভাগ চাই নি।‘’ শুধু আফিয়া আক্তারই নন, তার মত আরো অনেক নারীই মনে করেন বাবার সম্পত্তিতে ভাগ চাওয়া লজ্জার বিষয়। তাই তারা তাদের দাবি ছেড়ে দেন। আর এই সমাজ ব্যবস্থাও এমন একটি ট্র্যাডিশন তৈরি করেছে যাতে, বাবার সম্পত্তিতে একজন নারী তার অধিকার চাইতে গেলে তা অত্যন্ত নেতিবাচক চোখে দেখা হয়। বাবার সম্পত্তি ভাইদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হলেও তাদের সবার একই সাথে থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু কন্যাটি যেহেতু বিয়ের পরে অন্য বাড়ির হয়ে যায়, তাই অখণ্ড সম্পত্তি ভাগ করে অন্য পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে নিজের সম্পত্তি ‘বেহাত’ করতে চান না কেউই।হয়ত এ কারণেই বাবার সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার চাওয়ার বিষয়টি এ সমাজে এত নেতিবাচক চোখে দেখার ট্র্যাডিশন তৈরি করা হয়েছে। আর এভাবেই সম্পত্তি ও সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত থেকে যাচ্ছে পুরুষতন্ত্রের হাতে। নারী থাকছে সম্পদহীন, সম্পত্তির উপর অধিকারবোধহীন, অসচেতন। নিজের সম্পত্তি থাকা স্বত্ত্বেও নারীকে তা রক্ষণাবেক্ষণও করতে দেওয়া হয় না। ফলে নারী আটকে যাচ্ছে একটি বৃত্তে। তাকে থাকতে হচ্ছে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পরনির্ভরশীল হয়ে।নিজ পরিবারেই হচ্ছে না নারীর ক্ষমতায়ন।
আফিয়া আক্তারের মত অনেকেই তার বাবা সম্পত্তিতে দাবি ছেড়ে দিলেও, অনেকেই আবার ছাড়েন না।বাবার সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার রক্ষায় কখনো কখনো দেখা যায় স্বামীদের ভীষণ তোড়জোড়।এর পেছনে কারণ হিসেবে সব সময়ই যে স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর সুযোগ নেবার মানসিকতা থাকে, তা বলা যাবে না।
কথা হচ্ছিল স্কুল শিক্ষক আবু হোসেন মণ্ডলের সাথে।তিন বোনের একমাত্র ভাই এই আবু হোসেন।তাদের বাবা এখনো জীবিত। সম্পত্তি নিয়ে ভাই-বোন বা বাবার সাথে কখনো তেমন আলাপ আলোচনা হয় নি।মুসলিম আইন অনুযায়ী যার যতটুকু ওয়ারিস সে ততটুকুই পাবে। অবশ্য আবু হোসেনের পরিবারে বাবার সম্পত্তি সাধারণত বোনে্রা নেন না।আর এ বিষয়টি তিনি ভালভাবেই দেখেন। তার মতে, ‘’ ভাইয়ের জন্য ভালবাসা, মমতা ও টান থাকার কারণেই বোনেরা সম্পত্তিতে তাদের দাবি ছেড়ে দেন।‘’
--কিন্তু এতে কি তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হল না? ভাই হিসেবে বোনেদের প্রতি ভালবাসা আপনারও তো দেখানো দরকার।
--তারা দাবি করলে আইন অনুযায়ী যতটুকু সম্পত্তি পাবার পাবে। বোনেদের সম্পত্তির ভাগ দিতে আমার কোন সমস্যা নেই।
--আপনার কয় ছেলে মেয়ে?
--দুই মেয়ে, এক ছেলে।
--তাদের সাথে কি কখনো আপনার স্থাবক অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন? কে কতটুকু পাবে তা জানিয়েছেন?
--না, জানাই নি।
--কেন?
--ভাইবোনের মধ্যে সুন্দর ও ভালবাসাময় একটা সম্পর্ক থাকে।এসব বিষয় আশয় নিয়ে ওদের সাথে আলোচনা করে তাদের মধ্যে আমি স্বার্থচিন্তা, বিদ্বেষ ঢোকাতে চাই না। ওরা সবাই মিলেমিশে থাকুক।
--কিন্তু, ধরুন, আপনার অবর্তমানে আপনার কোনখানে কতটুকু সম্পত্তি আছে তা আপনার সন্তানেরা জানতে পারলো না। এতে পরে ভুল বোঝাবুঝি থেকে সম্পর্কের তো অবনতি হতে পারে। এমন কি, কেউ কাউকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিতও করতে পারে!
--হ্যাঁ, ওদেরকে আগে থেকেই এসব ব্যাপারে বুঝিয়ে দিয়ে গেলে একদিক থেকে ভালই হয়। তবে সন্তানদের সাথে এসব নিয়ে কখনো কথা না হলেও আমার স্ত্রীর সাথে একাধিকবার আলোচনা করেছি। কোন সন্তান কতটুকু পাবে সব তাকেই বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আমার কোন সম্পত্তি নিজের নামে রাখি নি, সব স্ত্রীর নামে করেছি।
-- এমনটা কেন করলেন?
--আমাদে দেশে সাধারণত দেখা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীরা এই সন্তান ঐ সন্তানের কাছে অনেকটা আশ্রিতা হিসেবেই থাকে। আমি আমার স্ত্রীর চেয়ে বয়সে ১২/১৩ বছরের বড়। ধারণা করি, তার আগেই আমার মৃত্যু হবে।আমার মৃত্যুর পরে আমার স্ত্রী যেন সসম্মানে, সগৌরবে সন্তানদের নিয়ে ভালো থাকে, এ কথা ভেবেই আমি তার নামে সব লিখে দিয়েছি।
বাবার সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার যেন এক শুভংকরের ফাঁকি। ১৯৩৭ সালের পরে সম্পত্তিতে হিন্দু নারীদের অধিকার সংক্রান্ত কোন আইন পরিবর্তন হয় নি।পুরাতন ধ্যানধারণা থাকার কারণে হিন্দু নারীরাও সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
(লেখাটি সাপ্তাহিক ২০০০, ৩০ মে ২০১৪ এ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে)
©somewhere in net ltd.