নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

প দা তি ক

০২ রা আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ২:১৫


লিংক---প দা তি ক


সকালে স্টেশনের কাছে এক জায়গায় বাজার বসে। ঊর্মিলার জায়গা আছে সেখানে। সকালেই যেতে হয় দোকান সাজাতে। অফিস বাবুদের বাজার সকালে। ঘণ্টা দুই তিনেকের বাজার।আজ যাওয়ার সময় দেখে যায় সুবোধ গভীর ঘুমে। তার বাচ্চাদের নিয়ে ভাবনা নেই । ঘুম থেকে উঠে পড়লে তারা ইচ্ছে হলে মায়ের রেখে যাওয়া মুড়ি চিবোবে। জানে, মা আসতে বেশি দেরি হবেনা। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে সুবোধ ঊর্মিলাকে না দেখলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়তে পারে। তাই জাহানারাকে বলে গেছে যেন একটু খোঁজ রাখে। কিন্তু তার কিছুই ঘটল না। সুবোধ ঘুম থেকে উঠে দেখে ঘরে ঊর্মিলা নেই। বাচ্চারা তখনও ঘুমে । সে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট পরে দরজা টেনে বেরিয়ে পড়লো। দিনের আলো যে কতটা তফাৎ করতে পারে রাত্রির সঙ্গে আজ এই সকালে সুবোধ ভীষণ ভাবে অনুভব করলো।
বস্তির ব্যস্ততা আর কলরোলে জায়গাটা রীতিমত এই সকালেই জমজমাট। ঘন্টাখানিক এদিক ওদিক হেঁটে সুবোধ ঘরে ফেরার পথ ধরে। মফস্বল শহর । এ দিকটা বেশ পড়ো জায়গা। বোধ হয় সেই কারণে বস্তির পত্তন সম্ভব হয়েছে। কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা সে মনে মনে পরিত্যাগ করতে শুরু করে। আত্মগোপনে থাকার জন্য এখানেই যাহোক একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে।

ভেজানো দরজাটা খোলা। ঘরে ফিরে দেখে বাচ্চা সবকটা ঘুম থেকে ওঠেনি। দু’একজন জেগেছে। তার চারপাইয়ের উপর একটা চায়ের কাপ ঢাকা অবস্থায় আছে। সে কাপটা যখন তুলতে যাবে তখনি পেছন থেকে এক সরু নারী কণ্ঠ—মুখে দিয়েন না,মুখে দিয়েন না—গরম করে আনি—ঠান্ডা হয়ে গেছে বোধ হয়। পেছন ফিরে দেখলো শীর্ণ চেহারার এক নারী। নারীতো নয়, যেন নারীর এক ছায়া। বেশ কুণ্ঠিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। সুবোধ তার সামনেই চা মুখে দিল। দিয়ে বললো—না ঠিক আছে। ঈষদুষ্ণ আছে। চলবে। নারীটি আর কোন কথা বললো না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। চা খাওয়া শেষ হলে কাপ নিয়ে চলে গেল।

ঊর্মিলা সময়মতো ঘরে ফিরলো। এবার শুরু হলো তার সংসারের আসল কাজ। প্রায় দশ হাতে সে শুরু করলো তার সাংসারিকতা। চারপাইতে বসে বসে সুবোধ দেখতে লাগলো। এক ঝটকায় সব কটা বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে মুখ ধোয়ার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিল। বাইরে একটা কুয়ো আছে। সরকারী। সবার ব্যবহারের জন্য। বড়টি ছেলে । কত হবে বয়স, নয় দশ। সে হাতে একটা দড়ি লাগানো বালতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গুটি গুটি বাকিগুলোও তাকে অনুসরণ করলো। ঊর্মিলা শতচ্ছিন্ন কাঁথা চাদর বালিশ সমেত এক গাদা কাপড়চোপড় টেনে টুনে এদিক ওদিক ঝেড়েঝুড়ে একরকম গুছিয়ে ফেললো বিছানা। পাশাপাশি সুবোধের সঙ্গে টুকটাক কথাও চালাতে লাগলো। একবার বললো যে অসুবিধা না হলে দু এক দিন থেকে যেতে। এ কথা অতিথিকে বলতে হয়, তাই বলা । বলার পরই ভাবলো, ঠিক হলো কি বলাটা? আঃ এত প্রশ্নের খোঁচা খেতে হচ্ছে কেন, কে জানে। এর মধ্যেই সুবোধ জিজ্ঞেস করলো আপনার বাচ্চারা ইস্কুলে যায়-তো? কাছেই-তো একটা ইস্কুল দেখলাম। উত্তরে ঊর্মিলা বললো—না এখন আর যায় কই, বড়টারে দিছিলাম। আমি থাকিনা ঘরে, ছোটগুলারে দেখন লাগে। আমাদের এই সব হয় না। আর বছর খানিক পর বড় ছেলেডারে আমার সঙ্গেই দোকানে বসাবো ভাবতাছি। টিকে থাকার জন্য ঊর্মিলার পরিকল্পনা ঠিক আছে। কিন্তু সুবোধের যুক্তিবাদী শিক্ষিত মন অবাক। চেষ্টা করছে এর পেছনের অসহায়তার কথাটা বুঝতে। কিছুটা বিষন্ন বোধও হচ্ছে তার। ঊর্মিলার ঘর ঝাড় পোছ করে ফেলেছে । এবার মনে হচ্ছে রান্না বসাবে।

সুবোধ আবার বাইরে বের হলো। বস্তির সামনেই চায়ের দোকান। সকালে চা খাওয়া হয় নি। ঊর্মিলার ঘরে চা’এর পাট নেই বোধ হয়। দোকানে বসে চা খেতে খেতে হাতে পেয়ে গেল একটা বাসি খবরের কাগজ। সিগারেট ধরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে একটাও বাংলাদেশের খবর দেখলো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকের মিডিয়ার বোধ হয় বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহ কম। অথচ দেশটা বিক্ষোভের বারুদের উপর দাঁড়িয়ে। ছাত্রদের আর মিলিটারী শাসকরা সহ্য করতে পারছে না। আসলে ছাত্রদের দমানো যে বাংলাদেশে অসম্ভব, এটা এই শাসকশ্রেণী মানতে চাইছে না।পাকিস্তান আমলেইতো সেই পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই সত্য বর্তমান শাসকরা কবে বুঝবে কে জানে! কিছুটা বিরক্ত মনেই সুবোধ দোকান থেকে বেড়িয়ে পড়লো। এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে দু’একজন কে জিজ্ঞেস করে ঠিক জেনে নিল মাছ বাজারটা কোন দিকে। বেশ গোছানো বাজার। দুটো বাজারের ব্যাগ কিনে সুবোধ একটায় কিনে নিয়ে রাখলো মাছ। আরেকটায় কিছু সবজি। ঘরে ফেরার পথে মিষ্টির দোকান থেকে কিনে নিল গোটা দশেক ভালো মিষ্টি ।

ঘরে ঢুকতেই সুবোধকে দেখে ঊর্মিলা কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু হাতে বাজারের থলি দেখে কথা হারিয়ে ফেললো। ঊর্মিলাকে নির্বাক দেখে সুবোধই বললো, এই একটু বাজার করলাম। আত্মীয় যখন সাজিয়েছো,তখন একটু বাজার ঘাট করতেই হয়। আর এই নাও মিষ্টি, বাচ্চাদের দিও । সুবোধ খেয়াল করেনি ঊর্মিলা শুধু নির্বাকই না। তার চোখও ছল ছল করছে। বাজার ঘাটতো তাদের জীবনে নেই। শুধু কিছুটা সস্তার চাল আর নিজের বাড়তি অবিক্রিত সবজি আর সঙ্গে নুন লংকা ।এইতো তাদের আহার্য্য। কালে ভদ্রে ডাল। আবার কদাচিৎ কখনো পেলে অর্ধেক অর্ধেক ডিম । মাছমাংস তারা বছরে কখনো সখনো চেখে দেখে। সেটা শুধু দামের জন্য নয়। সেটা মাছ রান্নার তেলের জন্য। মাছ রান্নায় যা তেল লাগে তা তাদের ঘরে থাকে না। সুবোধ এই কান্ডটা করে একটু গোলমালই করে ফেললো। চারপাইতে বসে সুবোধ লক্ষ্য করছে ঊর্মিলা ব্যাগ থেকে বের করে করে সব দেখছে। একসময় উঠে দাঁড়িয়ে সুবোধের উদ্দেশ্যে বললো –আপনি বসেন— একটু আসি, বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে হাতে বেশ কিছু টুকিটাকি জিনিষ আর এক শিশি সরষের তেল নিয়ে ফিরে আসলো। সুবোধ দেখে লজ্জা পেয়ে গেল। মনে মনে ভাবলো এটাতো মাথায় ঢোকে নি যে মাছ রান্নার জন্য তেল লাগে। ওটাও আনা উচিত ছিল। কথাটা ঊর্মিলাকে বলতে গিয়ে বললো না। পাছে সে লজ্জা পায়।

জাহানারা এখানে এসে শিবানী হয়ে গেছে। এটা ঘরের বাইরে জানে শুধু ঊর্মিলা। সুবোধ জেনেছে অনেক পরে। সুবোধের এখানে এমন অনেক কিছু জানার আছে। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে বাঁচা আর এই খোলা সমুদ্রে ভেসে ভেসে বাঁচার পার্থক্যটা তার উপলব্ধিতে হানা দিচ্ছে বার বার। সুবোধ ঊর্মিলার কথা অনুযায়ী ‘আরো দু’একদিন’ পার করে ফেলেছে বেশ কিছুদিন আগে। এরমধ্যে মাঝে মাঝে সে বাবুদের মতো বাজার করেছে। কিছু বিছানাপত্র,বাচ্চাদের জন্য কিছু সস্তা জামাকাপড়,এই সব কিনেছে। শুনেছে জায়গাটা ম্যালেরিয়াপ্রবন। তাই মশারিও কিনেছে। যেটা সবচেয়ে অবাক করা কাজ সে করে যাচ্ছে তা হলো বড় দুটো বাচ্চার জন্য বই খাতা শ্লেট পেন্সিল কিনে তাদের পড়াশোনা করাচ্ছে ঘরে। ভাবছে কিছুদিন পর থেকে ও-গুলোকে ইস্কুলেও পাঠাবে। বাচ্চারা হঠাৎ করে তাদের এই মামাটি পেয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা। কিছুটা বদলাতেও শুরু করেছে। এই সব একপ্রকার ভালো লাগলেও ঊর্মিলা প্রথম প্রথম এই সব খরচ পত্রে ভয় পেয়েছিল। সুবোধ হাত তুলে জানিয়েছিল চিন্তা করোনা, টাকা কিছু আছে এখনও। সব শেষ করে ফেলিনি।

সুবোধের সরে পড়ার লক্ষণ দেখা গেল না। কেমন যেন ক্রমশঃ সেঁধিয়ে পড়ছে। কম কথা, কম উপস্থিতি, কিন্তু আছে। দিনের বেলা বাইরে কম যায়। বেরোয় রাতে। অনুযোগ তৈরির সুযোগ দেয় না। বরং এক আত্মীয়তার বানানো গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুবোধ থেকে যাচ্ছে এক দূর সম্পর্কের ভাই হয়ে। কাজ কর্মের ধান্দায় এসেছে। কোথা থেকে এসেছে—এসব প্রশ্ন এখানে ঠাঁই পায় না। কে বাংলাদেশ, কে নেপাল, কে বিহার—দেশ বা জাতীয়তার চলতি ধারণা গুলো এখানে জীবন জীবিকার কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ সবাই এখানে বাইরের থেকেই আসে। কেউ এখানে গজায় না।

অসুবিধা প্রথম প্রথম ছিল না যে তা নয়। ছিল চেহারাটা নিয়ে। যদিও সেটা অল্প সময়ের জন্য। ক্রমশঃ পরিবেশ আর নিজস্ব চাপা আতংকের দৌলতে অনেকটা স্থানীয় হয়ে পড়েছে। এখন আর সাদা চোখে এটা ধরা পড়বে না যে সুবোধ একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো, সমসাময়িক রাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কাজে তার ওতপ্রোততা ছিল। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষার লড়াইয়ে যুক্ত থাকার দায়ে তাকেও অনেকের মতোই আত্মগোপন করতে হয়েছে।

সুবোধের এই উপস্থিতি ঊর্মিলার ব্যবহারিক জীবনের ভার কিছুটা লাগব করে দিয়েছে। সপ্তাহে দুই/তিনদিন ঊর্মিলার সবজি লোকালে সকাল বিকেল আসা যাওয়া চলতে লাগলো। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে সুবোধ এখন দুপুরের ভাত রাঁধে, দিনভর বাচ্চা সামলায়। কিন্তু তাতে যে জাহানারার খাঁচা থেকে বেরোনোর সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল। এই অভিযোগ ঊর্মিলার কানেও পৌঁছেছে। ঊর্মিলা কপট হেসে বলেছে—ক্যান, আমিতো শুনি সারা দুপুর তুই আমার ভাইয়ের লগে গপ্পো করস। জাহানারা রাগ করে চোখে জল নিয়ে ঘরে চলে যায়। পরে ঊর্মিলা সেই রাগ ভাঙ্গাতে গিয়ে জাহানারার ঘরে বসে গল্প করে। তার ভেতর ক্রমে শোনা হয়ে যায় জাহানারার শিবানী হওয়ার গল্প। হায়, জাহানারার গল্পতো আর গল্প নয়। শুধুই রক্তক্ষরণ। ঊর্মিলা থমথমে মুখ নিয়ে একসময় ঘরে ফেরে। আবার একদিন শুনতে যায়।

ঊর্মিলার সঙ্গে সুবোধের কথা হলে তা রাতের দিকেই হয়। ক্রমে রাত আর দিনের পরস্পর সম্বোধনের পার্থক্যটা মুছে গিয়ে দিনেরটাই স্থায়ী হয়ে গেছে। প্রথম দিনের সম্বোধনের পাঠ আর নেই। আসলে এটা তাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ ভাবেই ঠিক হয়ে গেছে একসময়। দিদি হিসেবে ঊর্মিলা পেয়েছে ‘তুমি’সম্বোধন। আর ঊর্মিলা এখন ভাই হিসেবে সুবোধকে ‘তুই তোকারি’ করে। এটা যেন সুবোধের প্রতি দূরত্ব-সূচক সম্ভ্রমের পর্দাটা খুলে ফেলা। কারণ ঊর্মিলার পক্ষে দিনভর পরিশ্রমের ধকল সামলে একই ঘরে এতো দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ছোঁড়াটার ভবিষৎ কী--এভাবেই কি ওর দিন কাটবে—কাটলেও কতদিন? তেমন ভাবে চাপ না দিলেও ঊর্মিলা কাজকর্মের ব্যাপারে মাঝে মাঝে সুবোধকে স্মরণ করায়। যেন একটা কাজ কম্ম পেয়ে গেলে সুবোধ চাইলে এ তল্লাটেই একটা আলাদা ঘর নিয়ে থাকতে পারে। স্থিতি চায় ঊর্মিলা। ভাসমান সুবোধকে নিয়ে তার ভয়। তার ধারণা ওপার থেকে মানুষ যে কারণে আসে সুবোধও সেই রকম কোনো কারণে এসেছে। এতদিন হয়ে গেলেও ঊর্মিলা সুবোধের এই অভিযাত্রার মূল কারণ সম্বন্ধে অন্ধকারে। কোন তথ্যাদিই তার কাছে নেই। জানতে চাইলে সুবোধ হেয়ালী করে। বলে তাড়িয়ে দিয়েছে। সে আর বেশি জানতেও চায় নি বা খোঁজও করেনি কখনো। সে না জানলেও তার ভেতর সম্পর্ক গড়ার একটা সুপ্ত কামনা হয়তো ছিলই। ফলে এই কতদিনে শুধু একপ্রকার মায়া আর বিশ্বাস দিয়ে যেন এই সুবোধকে সে গড়ে নিয়েছে। আর এই গড়ার গৌরবে জীবনে প্রথম নিজেকে যেন কিছুটা গর্বিতও ভাবতে পারছে । (ক্রমশ:)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.