নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০

রাজা সরকার

আমি একজন সামান্য লেখক।

রাজা সরকার › বিস্তারিত পোস্টঃ

প দা তি ক

১১ ই আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:১৯


লিংক--পদাতিক/১৫,১৬


১৭
ঊর্মিলা বাজার করে ঘরে ফিরে এলো। বাচ্চারা মহা আনন্দে ঠোঙার খাবার ইচ্ছে মতো খেয়ে চলেছে। ঊর্মিলা খাবার দেখে অবাক। বাচ্চারা বললো—‘মামায় আনছে’। শুনে ঊর্মিলা শুধু ‘অ’ বলেই ঘরের এককোণে নামিয়ে রাখলও আলু পেঁয়াজের সঙ্গে আরও টুকিটাকি ভর্তি দুটো ব্যাগ। পরিশ্রম হয়েছে তার । ভারি শরীর নিয়ে সে বাচ্চাদের পাশে বসে পড়লো। ভাবতে লাগলো সুবোধ দোকানের খাবার আনতে গেল কেন? বাচ্চারা কি কিছু খেতে চেয়েছিলও? নাকি ওর নিজেরই খিদে লেগেছিল?—হতে পারে—সেই কোন সকালে শ্মশানে গিয়েছিল—ঘরে ঢোকার আগে স্নান টান করেছিল কিনা কে জানে—যা উড়নচণ্ডী ছেলে। কি যে মতি গতি তার কিছুই বুঝি না।

ঠিক রাত আটটায় ঘটনাটি ঠিকই ঘটলো। ঊর্মিলা তখন তপ্ত কড়াইয়ের সামনে। সামনে জম জমাট ভিড়। ঊর্মিলার জানার কথা নয় যে তার আগে সারাদিন সুবোধের মনে বয়ে গেছে ঝড়। নিজেরই মুখ নিঃসৃত কথা যে প্রতিমুহূর্তে এভাবে তাকেই প্রণোদিত করে যাবে এটা সুবোধ ভাবতে পারে নি। জীবনে এই প্রথম কথা-শব্দের শক্তি সুবোধ অনুভব করতে পারলো।

একটু আগেই ঘটনা স্থলের কাছাকাছি সুবোধ চলে যায়। কিন্তু সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি যে জাহানারা শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসবে। এটা বস্তির পেছন দিক। জায়গাটা অপরিষ্কার। লোকজন বিশেষ আসেনা। তার মধ্য দিয়ে ঠিক সময়ই দেখা গেল সন্তর্পণে বেরিয়ে আসছে জাহানারা। এতোটা ঝুঁকি জাহানারা নিতে পারলো? সুবোধ মনে মনে বুঝতে পারছে এর বিপদ কতটুকু। তাই জাহানারাকে নিয়ে সে দ্রুত মিলিয়ে গেল। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা রিক্সায়, ইচ্ছাকৃত ভাবে এলোমেলো পথে সে নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে পৌঁছে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে দুটো শিয়ালদার টিকিট কেটে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে মিশে থাকার চেষ্টা করলো। কমল ঘরে না ফেরা অবধি জাহানারার অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ ভাববে না।

সুবোধ হয়তো এই চিন্তাটা করার এখনও সময় পায় নি যে তার এই অজ্ঞাতবাসের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গেল আজ কিছুক্ষণ আগে। ঊর্মিলা, ঊর্মিলার বাচ্চারা, রেল-বস্তির জীবন-নামা—সুবলের পান সিগারেটের দোকান, মন্টুর চা’এর দোকান, বা দেবেন বা দেবেনের মতো অনেকের, দিনের বেলার ভাতের হোটেল, রাতের বেলায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া মদের দোকান—সব তার থেকে ক্রমশ: বাস্তবিক দূরে দূরে সরে যেতে থাকলো। ট্রেন চলছে। ট্রেন চলুক। পার হয়ে যাক মাইলের পর মাইল । তারা এখন অনেক অনেক দূরত্ব চাইছে শুধু। ট্রেনের গতি ও দোলায় একটু পরেই হয়তো তাদের মস্তিষ্ক আর দুশ্চিন্তার ভার বইতে চাইবে না। বরং চাইবে ঘুম, ঘুমের মধ্যে একটু বিশ্রাম।

দোকান বন্ধ করে ঊর্মিলা হয়তো এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজবে সুবোধ কোথায়। একসময় না পেয়ে হয়তো ভাববে বাবু আজ আবার মদ গিলছে হয়তো কোথাও বসে। কিছুটা রাগ হবে। হবে কিছুটা অভিমানও। কিন্তু ততক্ষণে সে গুছিয়ে তুলে নেবে দোকান। ফিরেও যাবে ঘরে। হয়তো এক সময় অনেক রাতেও সুবোধের না-ফেরার দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে শুয়েও পড়বে। মেয়েমানুষ, রাত বিরেতে কোথায় খুঁজতে যাবে সে?
১৮
দু’দিন পরের সন্ধ্যে। সমীর, মানস, অরিন্দমরা এসে দেখলও জায়গাটা বেশ থম্‌থমে। এখানে ওখানে ভিড়, জটলা। দোকান পাট ঠিক খোলা অথচ খোলা নয়। দেবেনের দোকান খোলা।কিন্তু খদ্দের নেই।বোধ হয় মদ বেচা বন্ধ। কাছে যেতেই দেবেন নিচু স্বরে জানিয়ে দিল—চলে যান, আজ ঝামেলা আছে।

খবর পাওয়া গেল ঊর্মিলাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেই সুত্রে শহরের কোনো মহিলা সংগঠন একটু আগে এখানে মিটিং করে গেছে। তাদের সঙ্গে পুলিশও ছিল। তাদের বক্তব্য ছিল গ্রেপ্তারের নামে ঊর্মিলার উপর শারীরিক লাঞ্ছনা করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় মহিলা পুলিশ ছিলো না,--ইত্যাদি ইত্যাদি । মিটিং এ বস্তির উলঙ্গ ও অর্ধ-উলঙ্গ বাচ্চারাই ভিড় করেছিল বেশি। বস্তির পুরুষেরা দূরে দাঁড়িয়ে মহিলাদের বক্তৃতা-শ্রম উপভোগ করছিল। স্ত্রীলোকেরা মরদদের দাঁত খিঁচুনী খেয়ে বেড়ার আড়াল থেকে দেখছিল ভয়ে ভয়ে। এ ছাড়া পথ চলতি আমোদপ্রিয় মানুষেরা-তো ছিলই। সংক্ষিপ্ত মিটিং। কিন্তু তাতে এই অঞ্চলের সন্ধ্যেবেলাকার জীবন জীবিকা যেন কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল।

ঘটনা হলো, সুবোধ আর জাহানারা উধাও। অতঃপর কমল কর্তৃক পুলিশে ডায়েরি। অভিযোগ; ‘মেয়ে চালান’। সুবোধ এবং উর্মিলার বিরুদ্ধে। সে দিন রাত দুটো নাগাদ বাড়ি ফিরে কমল দেখতে পায় জাহানারা ঘরে নেই। দরজা বাইরের দিক দিয়ে টানা। কমল সাড়া না পেয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে ঘর খালি। অভিজ্ঞ কমল ঘটনা নিয়ে রাতে আর কিছু না করে শুয়ে পড়ে। ভোরবেলা উঠে সে প্রথমে ঊর্মিলার কাছে খোঁজ করে জাহানারার । ঊর্মিলা শুনেতো অবাক। যে মেয়ে বস্তির বাইরে কখনো পা দেয় না, সে কিনা রাতে ঘরে নেই! চিন্তিত কমলের প্রতি সহমর্মিতায় সেও বেশ চিন্তান্বিত হয়ে পড়ল। কম-কথা বলা কমলের সঙ্গে সে-ই বেশি কথা বলল এবং আফশোষ করল। শেষে কথা প্রসঙ্গে বলল যে সুবোধও কোথায় যে গেল—কাল রাতে সেও ঘরে ফেরেনি।

কমল আর বেশি দাঁড়ায়নি। ঊর্মিলার শেষের কথাটি তুলে নিয়ে মাথা নিচু করে সে চলে গেল। মনে মনে ‘সুবোধ’ নামটি নিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে কিছুক্ষণ ভাবলও। সন্দেহ জমাট বাঁধতে খুব বেশি সময় লাগে নি। দেখতে শুনতে-তো মনে হতো ভদ্র ঘরের ছেলে। অবশ্য টাকা আর মেয়েছেলের লোভের সামনে সব শালা সমান। চোরের উপর বাটপারি! মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার শোধ তুলতে কমল একদম চেঁচামিচি করলও না। আরও কিছুক্ষণ ঘরে কাটিয়ে একসময় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পুলিশের খাতায় জাহানারার বস্তির নামটাই দেয়া হল। শিবানী। দেখানো হলও কমলের বিবাহিতা স্ত্রী। থানার বড়বাবু গোঁফের তলায় সরু করে হাসলেন। হেসে বললেন—ঠিক আছে, ঠিক আছে, যা দেখছি ।

সুবোধকে পাওয়া যায়নি। তাই ঊর্মিলাকে তোলা হয়েছে। যারা টেনে হিঁচড়ে ঊর্মিলাকে ভ্যানে তুললো, তাদের কেউ কেউ ঊর্মিলার তেলে-ভাজা’র খদ্দের। পারলে প্রায় পাঁজা কোলে করে তুলে নেয় আর কি। মেয়ে পুলিশ ছাড়া ঊর্মিলাকে এরকম হেনস্থা হতে দেখে সরকারি কুয়োর পাড়ে ভিড় করে থাকা বস্তির মহিলারা চীৎকার করে পুলিশের উদ্দেশ্যে নিজস্ব ভাষায় গালাগাল করতে লাগলো। গালাগাল শুনে কোন কোন পুলিশ মুচকি হাসলও। অবশ্য ভ্যান চলে যেতেই গালাগাল এবার কমলের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হতে লাগলো। তাদের কারো কারোর ইচ্ছে ছিল কমলের ঘর দুয়ার ভেঙে ফেলার। কিন্তু দু’একজন মাতব্বর গোছের বস্তিবাসী এই কাজ থেকে তাদের নিবৃতও করল। কারণ, তারা কমলের ক্ষমতা সম্পর্কে বিলক্ষণ জানে।
ঊর্মিলার বাচ্চারা গোলমালের মধ্যে আতংকে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে ফাঁকফোকড় খুঁজছিল মা’কে ধরার জন্য। কিন্তু পুলিশের বেষ্টনী তারা ভেদ করতে পারলো না। শেষে যখন মা’কে নিয়ে ভ্যান-গাড়িটা চলে গেল, তখন তারা উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করল।

এই সব হৈ চৈ গোলমালের ভেতর কখন যে রিপোর্টার এসেছিলো—তা কেউ টের পায় নি। টের পাওয়া গেল পরদিন সকালে। যখন স্থানীয় খবরের কাগজে বেরোল সচিত্র রিপোর্ট। ছবিতে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে ভ্যানে তোলার আগে ঊর্মিলাকে—কাপড় চোপড় ঠিক নেই—হাত ধরে আছে দু’দিকে দু’জন পুলিশ।

মহিলা সংগঠনের মিটিং এ গ্রেফতারের সময় ‘মেয়ে পুলিশ’কেন আসেনি—জোর ছিল এ-টাতেই। পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণাতে জানানো হল যে আগামী কাল এই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মহকুমা শাসকের অফিসের সামনে ধর্ণা, বেলা ১ টায়। মাইক, প্যান্ডেল—ইত্যাদি নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে সেখানে। কেউ কেউ ভাবলো—যাক, বাঁচা গেল। ধর্মঘট ডাকেনি—এই রক্ষে। (ক্রমশঃ)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.