নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি । আগে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম আর এখন জেগে জেগেই দেখি

স্বপ্নাতুর পুরব

চাই মিথ্যার নাশ, চাই সত্যের উন্মেষ, চাই শান্তির পৃথিবী

স্বপ্নাতুর পুরব › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি পেট্রোল বোমার আত্মকথা

২৫ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:৫২

আমি পেট্রোল বোমা, শান্তিকামী মানুষের কাছে চরম ঘৃণ্য এক বস্তু । জানি এ ঘৃণা নিয়েই আমাকে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে । একটু আগেও আমি নিরাশ বা হতাশাগ্রস্থ ছিলামনা এই ভেবে যে, একটা পক্ষ আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে । ভালোবাসে তারা আমাকে প্যান্টের পিছনের পকেটে রাখে । যে পকেটে মানিব্যাগ, প্রিয়তমার উপহার রুমাল-ফুলের মতো দামি দামি জিনিসের ঠাঁয়, সেখানে আমার আজকে অতিসাবধানী অবস্থান । তবুও আজকে আমি আমার সকল অহমিকা মাটিতে ধূলিস্মাত করে আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি । বলতে খুব লজ্জা লাগলেও তবু বলতে হচ্ছে- যে পেট্রোল বোমা রাতের আঁধারে যানবাহনের উপর নিক্ষিপ্ত হয়ে সব জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয়, আকাশে-বাতাসে ধ্বংসলীলা চালায়, যার বিস্ফোরণে বাংলার আকাশ ২৫ শে মার্চের ন্যায় লাল-আঁধারিয়ার রূপ নেয়, যার ঔদ্ধ্যতায় বার্ণ ইউনিটে চলে শোকের মাতম, একেকটা মানবদেহের উপর জারি হয় সমন, সেই পেট্রোল বোমাই কিনা আজ ভয়ে দিনকাল কাটাচ্ছে ! জানি, আমার মতো পিশাচের মুখে এমনটি মানায় না । হয়তো আপনাদের খুব হাসি পাচ্ছে । না, এ আমার কোনো ছল-চাতুরী নয়, নয় প্রতারণা, উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য । সত্যিই আমি আজ খুব ভীত । হে বিশ্বমানব, আমি মোটেই এমনটি ছিলাম না । কালের গর্ভে আমাকেও একদিন চলে যেতে হবে । তাই চলে যাবার আগে আপনাদেরকে সত্যটা জানিয়ে যেতেই হবে । নইলে পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় আমার নামটা যতোটা না ঘৃণার সাথে উচ্চারণ করা হবে, তারচেয়ে শতগুণ আমাকে অভিশাপ পেতে হবে আপনাদের কাছ থেকে । আজ শোনাতেই হবে আমার জীবনের আত্মকথা ।



চিত্র: পেট্রোল বোমা


প্রাগৈতিহাসিক হওয়ার পরেও পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই আমাদের অস্তিত্ব। ভূগর্ভস্থে বেশ সুখে শান্তিতে পরিবারস্থ সবাই মিলে অবসর জীবনযাপন করছিলাম । তখনও পৃথিবীর মানুষ আমাদের নামকরণ করেনি । করবে কী করে? তখনো তো আমাদেরকে তারা আবিষ্কারই করতে পারেনি । বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের চিন্তাভাবনা, বুদ্ধি-বিবেক, আবিষ্কার ও প্রায়োগিক ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার পর যান্ত্রিক সভ্যতার সূচনালগ্ন হিসেব তারা প্রথমে আবিষ্কার করে চাকা । অতঃপর কোনো এক রৌদ্রময় দুপুরে বিশ্বসভ্যতায় হাজির হয় ইঞ্জিন নিয়ে । সময়ের প্রেক্ষিতে সেই ইঞ্জিনের মধ্যেও বেশ পরিবর্তন আসে । যখন ভূগর্ভস্থ ভেদ করে আমাদেরকে বের করে এনে আবিষ্কার করলো আমরা দাহ্য এবং ইঞ্জিনের জন্য উত্তম এক জ্বালানি, সেদিন থেকেই পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে আমরা সুন্দর একটা নাম পেলাম- ‘পেট্রোল’ । আপনাদেরকে বুঝাতে পারবোনা সেদিন আমরা কতটা খুশি হয়েছিলাম । একে তো, মহান স্রষ্টা আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে আমাদের অলসতা থেকে রক্ষা করেছেন, তার উপর সুন্দর একটা নাম পাওয়া, চারটি খানি কথা নয় । এ আনন্দে কয়েক শতাব্দী ধরে আমরাসহ আমাদের স্বজাতিরা সবাই একনিষ্ঠভাবে মানুষের গোলামি করে চললাম । দিন নেই, রাত নেই, ইঞ্জিনে পিষে, পুড়ে আমাদের যৌবন নিঃশেষ করে দিচ্ছি । মানবতার কল্যাণে স্বার্থত্যাগের দৃষ্টান্তদের মধ্যে আমরাও ছিলাম, যদিও সে স্বীকারোক্তি করে পৃথিবীর ইতিহাস কাগজ-কলম খরচ করার সাহস রাখেনা । তবুও আমাদের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই, নেই কোনো ক্ষোভ কিংবা প্রতিদান পাবার খায়েশ। কারণ স্রষ্টার আদেশে আমরা যে, তার এক সৃষ্টির দাস হয়েছি। তাই আপাতত মনিব বলতে এই মানুষই আমাদের প্রভূ । স্বার্থত্যাগ আর নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার গল্পগুলো এভাবে চলছিলো । কিন্তু আমাদের এই প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় হঠাৎ এক অভাবনীয় পরিবর্তন আসলো । এরকমটি করতে আমরা একরকম বাধ্য হলাম । যে সিদ্ধান্ত আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হলো এটা উপরতলা থেকে আসেনি । আমাদের আপাত মনিব খোদ মানুষগুলো অদ্ভূতভাবে আমাদের উপর এক অন্যায় চাপিয়ে দিলো । যাদেরকে এতো বুদ্ধিমান মনে করতাম, স্রষ্টার ঘোষিত ‘সৃষ্টির সেরা জীব’ পদবীতে ভূষিত মানুষগুলো আমাদেরকে যে কাজে ব্যবহৃত করার সিদ্ধান্ত নিলো তার জন্য আমরা বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না । পেট্রোলের পরিবর্তে আমাদেরকে ‘পেট্রোল বোমা’ হয়ে কাজ করতে হবে । অমানবিক সিদ্ধান্ত দেখে আমাদের পরিবারস্থ সবাই খুব আশ্চর্য্য হলো । কিন্তু কিছুই করার ছিলোনা ।



চিত্র: পুলিশের দিকে নিক্ষিপ্ত পেট্রোল বোমা


আমার জন্মটা ঠিক কখন সেটা আজও ঠাওর করে উঠতে পারিনি । তবে প্রথম দিকের অনেক কিছুই আজও চোখে ভাসছে । সময়টা ১৯৩৬-৩৯ সাল । স্পেনে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা এতোদূরেই চলে গিয়েছে যে, ন্যাশনালিস্ট আর রিপাবলিকানদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব-বিরোধ । তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে এসে গড়ায় । ইতিহাসে যেটাকে ‘স্প্যানিশ সিভিলিয়ান যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করে । সর্বপ্রথম এ যুদ্ধে মানুষ প্রায়োগিক জন্ম দেয় আমার অর্থ্যাৎ পেট্রোলবোমার । এ যুদ্ধে ন্যাশনালিস্ট আর রিপাবলিকান দুপক্ষই পেট্রোলবোমার ব্যবহার করে । যখন ব্যবহারকারীরা দেখলো আমি দামে সস্তা, আমাকে বানাতে সহজ অথচ খুবই কার্যকরী তখন থেকেই আমার কদর ক্রমশ বেড়ে যায় । তাই আমি বারবার বিস্ফোরিত হয়ে বার বার জন্ম নিই । আমার এ পূনর্জন্মে কতক মানুষ খুবই সুখী আর বেশির ভাগই মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । ১৯৩৯ সালে মঙ্গোলিয়া আর মাঞ্চুকোদের মধ্যে যখন সীমান্ত নিয় সমস্যা হচ্ছিলো তখন আবার আমাকে জন্ম নিতে হয় পেট্রোল বোমা হয়ে । ঐ একই সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ বাহিনীরা যখন ট্যাংক নিয়ে ফিনল্যান্ডের অভিমুখে আসছিলো তখন ফিনল্যান্ডের সৈন্যরা নিরুপায় হয়ে আমাকে পূণর্জন্ম দিলো । কারণ ঐ ট্যাংকগুলো ধ্বংস করার আপাত এরচেয়ে ভালো বুদ্ধি তখন ছিলোনা । ফের আমাকে যুদ্ধে ব্যবহার করা হয় । তবে এ যুদ্ধের নাম 'Winter War'. যখন দেখলো ফিনল্যান্ডের সৈন্যরা আমার যথার্থ ব্যবহারে সোভিয়েতের ট্যাংকগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হলো, তখন আমার নাম-ডাক বাতাসের সাথে পৃথিবীর ওপার থেকে এ পারে ভেসে যেতে লাগলো । যার ফলে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশরা আমাকে নিয়ে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করলো । অর্থ্যাৎ আমি পেতে চললাম ইংল্যান্ডের রাজকীয় সম্মান । এর পরে আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি । ১৯৫০-৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে লাল বাহিনী অর্থ্যাৎ কমিউনিস্ট সৈন্যদের বিরুদ্ধে অ্যান্টি কমিউনিস্টরা আমাকে ব্যবহার করলো ।




চিত্র: Winter War- এ ব্যবহৃত পেট্রোল বোমা


অর্ধপৃথিবীর বেশি জায়গা জুড়ে যখন সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদি তন্ত্রমন্ত্রের ধ্বস নামে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, ঠিক তখন থেকে আমার প্রয়োজনীয়তা কমতে শুরু করে । আমি তো ভেবেই বসেছিলাম, আমার বোধহয় আর পূণর্জন্ম হবেনা, ফিরে যেতে হবে আদি অবস্থায় । সেই কলকারখানা, সেই ইঞ্জিন । কিছুদিন পরে দেখলাম, আমার ধারণা ভুল । বাংলাদেশের মতো যেসব অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সে দেশগুলোতে কয়েক বছর পরেই সৃষ্টি হয় জাতীয়গত বিভাজন । এ বিভজান গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে । একসময়ের ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালি জাতিটি গণতন্ত্রের ফাঁদে পড়ে বহুদলীয় দলে-উপদলে বিভক্ত জাতিতে পরিণত হয় । রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, হিংসা, ক্ষমতার লোভে শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমানের মতো দেশের অন্যতম দেশপ্রেমিক নেতা-নেত্রীদের হত্যা করা হয় । একের পর এক নির্বাচন শেষে দেশ আদর্শিক চেতনায় বহুভাগে বিভাজিত সৃষ্টি হতে শুরু করলো । গত ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে পর থেকেই এদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা ক্রমশ খারাপের দিকে অগ্রসর হওয়ায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা ষোলো কোটি মানুষ, কিন্তু প্রস্তুত ছিলাম আমি পেট্রোল বোমা । কারণ আমি কালের সাক্ষী । আমি দেখেছি একটা জাতি কী করে অন্যজাতির বিরুদ্ধে কত নিষ্ঠুর হয় ! কী করে পারে বিপক্ষের সৈন্যসামন্তকে । কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি যথেষ্ট আশ্চর্য্যবোধ করছি । আশ্চর্য্য হয়েছি এ কারণেই যে, একই দেশে বসবাস করে, একই পাড়ায় দিনরাত্রি যাপন করে । অথচ কেবলমাত্র আদর্শিক দ্বন্দ্ব-বিরোধিতার সূত্র ধরে এরা একে অন্যের কী সর্বনাশটাই না করছে ! গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে প্রতিটা দলই হরতাল-বিক্ষোভ-পিকেটিং করে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করেছে আর এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে । কেউ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে, কেউ ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে সাধারণ মানুষের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে । রেহায় পাচ্ছেনা দুধশিশু থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধমৃত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা । দেশে রাজনৈতিক ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছুদিন আগে আমার দুঃসম্পর্কের আরেক জাত ভাই ‘ককটেল’ ব্যবহার করা হয়েছিলো । কিন্তু আন্দোলনে তৃপ্তি না পাওয়ায় অবশেষে ইতিহাস থেকে বাছাই করে আমাকে আবারো আমন্ত্রণ জানানো হলো ।




আমন্ত্রণ জানানোর আগ পর্যন্ত আমিও অন্যসব পেট্রোলের মতো নিরীহ, মানবতাবাদী, স্বার্থত্যাগী দাহ্য, তৈল ছিলাম । কিন্তু আজ রাতে মনিব আমাকে বলে গিয়েছে, আজকের পেট্রোল আগামীকাল ভোররাতে পেট্রোলবোমায় পরিণত হবে । মনিবের এমন কথায় প্রতিদিনের মতো আমার মনে প্রফুল্ল লাগছিলোনা । ভেবে খারাপ লাগছিলো এ কারণে যে, এতোদিন তো মানবকল্যাণে কাজ করেছি । আর আজকের এই ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে আমি জড়িত হবো? মনিব হয়তো আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছিলো । তাই অতি সুকৌশলী হয়ে আমাকে বলেছিলো,





-তুইতো দেখছি আস্ত বোকা ! আরে এটাও তো মানবকল্যাণ মূলক কাজ । বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্রত্যাগ ।


-মনিব, আমি ঠিক বুঝলামনা?


-আমরা যদি ক্ষমতায় যাই, তবে দেশের মানুষ সুখী হবে । বুঝলি? যে করেই হোক, এই জুলুমবাজ সরকারকে, দলকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া যাবেনা । পেট্রোল বোমার আঘাতে যদি গুটি কয়েক মানুষ মরে তো মরুক । হরতাল-পিকেটিং করে, ককটেল বোমায় আতংক সৃষ্টি করে, পেট্রোল বোমায় মানে তোকে দিয়ে মানুষ হত্যা করে যদি দেশে আমরা ক্ষমতায় গিয়ে শান্তি স্থাপন করতে পারি তবে ক্ষতি কী? তাছাড়া, তুইতো এতদিন কারখানায়, ইঞ্জিনে জ্বলে-পুড়ে কয়লা হয়েছিস । আজ সুযোগ এসেছে নিজের শক্তিমত্তাকে প্রকাশ করার । আজ সুযোগ এসেছে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করার । যে মানুষগুলো তোকে নিযে এতোদিন খেলেছে, পিষ্ট করে মেরেছে তার প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে । তুই আজ থেকে ধ্বংসের আরেক নাম । মহাপ্রলয়ের অঙ্গীকার ।



মনিবের এমন জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে আমি সেদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি । এরকম ভাষণ তো এর আগে কেউ দিতে পারেনি ! লাল চামড়ার স্প্যানিশ, ফিনিশদের খাকী পোষাকধারীরা কেউ পারেনি ! অথচ বাংলাদেশের মনিব এ কি শোনালো আমায় ! বুকের ভিতরে তখন থেকেই বিদ্রোহের আগুণ জ্বলতে শুরু করছে। মনের ভিতর সুপ্ত পশুত্ব সেদিন জেগে উঠে আমার হিতাহিতবোধ লোপ পাইয়ে দিয়েছিলো । মনিব একটা কাঁচের বোতলের মুখ খুলে অপেক্ষা করার আগেই আমি অতি সোৎসাহে ঢুকে গেলাম । তারপর সেই বোতলে অনেকগুরো ভগ্ন মার্বেল ও আরও কী কী জানি রাখলো । মুখে একটা সলতে ঢুকিয়ে দিয়ে বেশিরভাগ অংশটা বের করে রাখলো যাতে সেখানে আগুন জ্বালানোর সাথে সাথে আমি বিস্ফোরিত হই অহংকারে ।


আজকের রাতটা যেনো পারই হচ্ছেনা । আমি উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি কখন মনিব এসে আমাকে বিস্ফোরিত করে । অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষ হলো । শেষ রাতের দিকে । তখনও ফজরের আযান দেয়া হয়নি । পাকা রাস্তার লাইট পোষ্ট গুলোতে আলো জ্বলছে । রাতের আকাশের তারাগুলো মিটমিট করে কী যেনো ভিডিও করছে । ইতোমধ্যে আমার মনিব আরো কয়েকজন স্বজাতি মনিবকে নিয়ে এসে হাজির । তারাও আমার মতো আরো অনেকগুলো পেট্রোল বোমা নিয়ে এসেছে । এদের কতকগুলো আকারে আমার মতো, কতকগুলো আবার আমার চাইতেও বড় ।

রাস্তার পাশে একটা বড় আমগাছ । আমিসহ সবাই এটার আড়ালে উৎ পেতে রয়েছি । দূরপাল্লার বাসটি এদিকেই আসছে । রাস্তার ঝোপের অদূরেই একটা শিয়াল লাগাতার হুক্কা-হুয়া ডেকেই চলেছে । হয়তো সে যাত্রীবাহী বাসের ড্রাইভারকে সতর্ক করার জন্য বারবার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আমার খুব রাগ হচ্ছিল শিয়ালটির প্রতি। ইচ্ছে করছিলো এখনই ওটার উপরই গিয়ে বিস্ফোরিত হই ।




চিত্র: বাসে নিক্ষিপ্ত পেট্রোল বোমায় আগুণ ধরে যায়




না, আমি শুধু শুধুই দুঃশ্চিন্তা করছিলাম । বাসটা এখন একেবারেই আমাদের সামনে । আমি বুঝে উঠার আগেই কে যেনো পিছন দিকে আমাকে জোড়ে বাসটিকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করলো । কখন যে মনিব আমার সলতেতে আগুণ লাগিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো, বুঝতেই পারিনি । আমি আজ চরম ক্ষ্রিপ্ত, চরম উন্মাদ ! আমার সলতেতে দ্রোহের আগুণ লেগেছে ! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বিস্ফোরিত! আমি অহংকারে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ক্ষণিকের মধ্যেই এক গগনবিদারী আর্তনাদের সৃষ্টি করি । আমি একা নই, আমার সাথে আরো অনেকগুলো পেট্রোল বোমা ঝাঁপিয়ে পড়লো শিকারের উপর, ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়াবতী হরিণের উপর । আমাদের ধ্বংসাত্মক নৃ-উল্লাসে চরমভাবে শিকার হলো যাত্রীসমেত সমস্ত বাস । বাসের ভিতরে-বাইরে নিমিষেই আগুণ ধরে গিয়েছে । আমি সর্বশেষ পড়লাম গিয়ে ঐ সিটটাতে যেখানে স্বামী-স্ত্রী তাদের পাঁচ বছরের আদরের সন্তানটিকে নিয়ে দুটো সিটে পাশাপাশি বসে ঘুমোচ্ছিলো । বেচারা, দুজনই হয়তো ঘুমের ঘোরে বুঁদ হয়ে আছে । বাচ্চাটি কী ফুটফুটে সুন্দরই না দেখতে । ঐ মূহুর্তে আমার পাষাণ মনটাও চাইছিলোনা ওদের উপর গিয়ে পড়ি । কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে । ভাবতে ভাবতেই আমি ঠিক তাদের মাঝখানে পড়লাম । মুহুর্তেই টুকরো টুকরো মাংসগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো । আমার নাকে তখন দগ্ধ পোড়া মাংসের গন্ধ ছাড়া আর কিছুই আসছিলোনা । আমি চমকে গেলাম ! আচ্ছা, একটু আগেই না এখানে একটা ফুটফুটে শিশু অতি নিশ্চিন্তে তার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখছিলো আর তার পাশে তার মা স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিলো? ওরা কোথায়? আমি বাসের ভিতরে তাদেরকে খুঁজতে খুঁজতে যা দেখলাম তার জন্য শুধু আমি কেনো, পৃথিবীর কেউই প্রস্তুত থাকবেনা । দশ-বারোজনকে চেনাই যাচ্ছে না, এর মানুষ নাকি অন্য কোনো প্রাণী ! অনেকক্ষণ পরে কে যেনো চিৎকার দিয়ে উঠলো, “ভাইয়া রে, আমাদের এ কি হয়ে গেলো রে !” এতোক্ষণ ধরে কেউ টু শব্দটুকুন পর্যন্ত করেনি । আসলে সবাই শ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলো । অর্ধনগ্ন ঝলসে যাওয়া এক তরুণীর এই চিৎকারের পরপরই হঠাৎ করে অনেকগুলো গগনবিদারী আর্তনাদের সৃষ্টি হলো- আল্লাহ ! গভীর রাতে এ আর্তনাদ সাত আসমান ভেদ করে দ্বিগুণ-তিনগুণ প্রতিধ্বনিত হয়ে বার বার ফিরে আসছে । বেশিক্ষণ লাগলোনা, পাশ্ববর্তী গ্রামের শতশত মানুষ এসে জড়ো হয়েছে । গ্রামবাসীদের কেউ এই দগ্ধ, মৃত-অর্ধমৃত মানুষগুলো কাছের বা দূরসম্পর্কের আত্মীয় নয় । তবু কেউ চোখের জল আটকিয়ে রাখতে পারেনি । শোকের মাতমে চারদিকটায় থমথম হয়ে গেলো । অথচ অ্যাম্বুলেন্সের হর্ণ, মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার, আফসোস, ধিক্কার সমানতালে চলছিলো । কে যেনো ডুকরে কেঁদে বললো, “আল্লাহয় জানে, কার বুক খালি করলো ! আহারে, এই মানুষটার দুই চোখই পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে । নাক-মুখ কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা । আর ঐ যে ঐ মহিলার হাড়-মাংস সব পুড়ে ঝলসে গেছে !” বাসের ওপাশে একজন মধ্যবয়সের লোক চিৎকার দিযে উঠেছে, “অ্যাম্বুলেন্স এদিকে নিয়ে আসো, এই লোকটা মনে হয় আর হাসপাতালে যেতে পারবেনা ! হায় আল্লাহ, মানুষগুলো এতো নিষ্ঠুর হয় কেমনে?” এতোক্ষণে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম- আমি আর সেই সলতে ভরা সুন্দর বোতলে নেই । বোতলের টুকরা যেখানে সেখানে পড়ে আছে । আমি আর আমাতে নেই, বাসের ভিতরে-বাইরে, যেখানে সেখানে লেপ্টে আছে পেট্রোল । আরো দেখলাম, যে মানুষগুলো পুড়ে ঝলসে গিয়েছে তাদের শরীর ভেদ করে আমি তাদের হাড় স্পর্শ করে ফেলেছি । ঝলসে যাওয়া মাংসে পেট্রোল আর পোড়ার গন্ধ সমানতালে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো ।




চিত্র: পেট্রোল বোমায় ঝলসে যাওয়া মা ও শিশু




ভোর হতে না হতেই একে একে বাসের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো নিকটস্থ হাসপাতালে । যেতে যেতে অনেকেই চলে গেলো ওপারে । আর যারা কোনো রকম বেঁচে ছিলো তাদেরকে নেয়া হলো বার্ণ ইউনিটে । অবস্থা খুব ভয়াবহ । শুধু আমি রইলাম বাসের সিটে, মানুষের মাংসে লেপ্টে। ঘটনাস্থলে আমার আয়ু শেষের দিকে চলে আসছে । আমি ক্রমশ ঝাপসা দেখছি । তবে মাথাটায় বেশ ঝিম ধরেছে । ঐ শিশুটা কি বেঁচে আছে? নাহ, কিছু ভাবতে পারছিনা । আমি বুঝতে পারছি আমি মৃত্যুর দিকে অগ্রসর মান । মৃত্যুর আগে পূর্বজনমের কথা মনে পড়ছে । ঐ যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটা বাসের দিকে লক্ষ্য করে আমাকে দুর্বৃত্তরা ছুঁড়ে মেরেছিলো । হ্যা, এইতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেই বাসে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া যশোরের নুরুজ্জামান পপলু ও তাঁর মেয়ে মাইশা তাসনিমকে, তাসনিমের মা মিতা মাহফুজা কোনে রকম বাস থেকে লাফিয়ে বেঁচে গিয়েছিলো । ঐতো দেখা যাচ্ছে কক্সবাজারের আবু তাহের, আবু ইউসুফকে, নরসিংদীর আসমা বেগম ও তাঁর ছেলে শান্তকে । ঢাকার ওয়াসিমের ঝলসে যাওয়া লাশটাও আজ খুব স্পষ্ট দেখাচ্ছে।




বরিশালের সোহাগের অঙ্গার দেহটি দেখে আমি নিজেও চমকে যাচ্ছি । ট্রাকের হেলপার ছিলো । বেচারা পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলো । মাগুরার রাস্তা ধরে যাওয়া একটা ট্রাকে আমার বিস্ফোরণে মৃত শ্রমজীবি রওশন বিশ্বাস, তাঁর ভাতিজা মতিন বিশ্বাস, শাকিল মোল্লা । মতিনের জীবনকাহিনীটা কি আপনাদের জানা আছে? মতিন ও তাঁর স্ত্রী রাহেদা বেগম বেশ সুখে শান্তিতেই দিন কাটাচ্ছিলেন । একসময় তাঁদের যমজ সন্তান হয় । অতি আদর করে নাম রাখেন- নিহা, নিশাদ । দুজনের বয়স ৫ বছর । মতিন বিশ্বাসের মারা যাওয়ার ৯ মাস আগে আরেকটা সন্তান হয় । নাম নিরব । সোনার সাজানো সংসারটুুকু একনিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার । চাঁদপুরের ট্রাক মালিক খন্দকার শরীফ উদ্দিন যে কিনা দুর্বৃত্তদের ছুঁড়া পেট্রোল বোমায় নিজের ট্রাকেই পুড়ে মরেছে আজকে তাদের মুখচ্ছবি আমাকে তাড়া করছে ।

আচ্ছা আজকে আমি তাড়াতাড়ি মরছিনা কেনো? একের পর এক কষ্ট দিয়ে চলেছে । এর আগে পৃথিবীর অন্য দেশে আমি মৃত্যুর আগে এমনটি দেখিনি, আমার চোখে এমনটি ভাসেনি । আজ চোখে ভেসে চলেছে একের পর এক পেট্রোল বোমায় ঝলসে যাওয়া মানুষগুলোর মুখ । কারণ এ পর্যন্ত পেট্রোল বোমায় যে ৭৪ জন মারা গিয়েছে তাদের সবাই সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষ ।




চিত্র: পেট্রোল বোমায় মৃতদের আত্মীয় স্বজনদের আহাজারি আর অভিশাপ



হে কাপুরুষের দল, হে অনাচারী, হে ভন্ড প্রতারক, ধর্মের ধ্বজাধারী, তুমি কি এখনো শুনোনি মাগুরার রকিব বিশ্বাসের অভিশপ্তবাণী, যাঁর ভাই রওশন আলী তোমার ছুঁড়া পেট্রোল বোমায় পরপারে চলে গিয়েছে? যারা তোমার দেয়া পেট্রোল বোমায় মারা গিয়েছে, পঙ্গু অবস্থায় অসহনীয় জীবনযাত্রা করছে তাঁদের আর তাঁদের আত্মীয় স্বজনের সবার মুখে আজ শুধু রকিবের মতো অভিশাপবাণী শোভা পায়, “আমরা তো ভাই রাজনীতি করি নে । তাইলে আমাগের ক্যান পুড়ে মরতি হবি? যারা রাজনীতি করে তাগের সাথে দ্ব›দ্ব না করে আমাগের মতো গরিবগেরে ক্যান পুড়ায়ে মারতিছে? আল্লা তাগের ওপর এহনো গজব দেয় না ক্যান?”





এই সেই রাস্তা, যেখানে আমাকে নিক্ষিপ্ত করে পালিয়েছিলো কাপুরুষ মনিব । যে আমাকে তার ভাষণে উত্তেজিত করে বলেছিলো, আমার বিস্ফোরণ নাকি বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র ত্যাগ ! হায় রে কাপুরুষ, চন্ডাল, পাষন্ড, নির্দয়, অমানুষ ! যে একটা ফুটফুটে শিশুর শরীর ঝলসে দিয়ে মেরে ফেলতে এতোটুকুনও গ্লানিবোধ করেনা, একের পর এক সাজানো সংসারগুলো নষ্ট করতে যার হাত এতোটুকুনও কাঁপেনা, সে ক্ষমতায় গেলে মানুষের জন্য কী করবে তা আজ পরিষ্কার । আফসোস ! একটু আগে যদি আমি এটা বুঝতাম । বুঝেই বা কী করবো ! আমার যে প্রাণ নেই, আমি নিষ্প্রাণ পেট্রোল বোমা । আমাকে যে যেভাবে ব্যবহার করে সেভাবেই ব্যবহৃত হই । আমি তো নিজে থেকে পেট্রোল বোমা হইনি । আমার শরীর আজ থরথর করে কাঁপছে ভয়ে, না জানি মহান স্রষ্টা আমার প্রতি রাগান্বিত !




হে শান্তিকামী মানবজাতি, আমি পেট্রোল বোমার জীবন চাইনা । আমি ফিরে যেতে চাই আমার চিরায়ত, মানবতার কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে । আমি পেট্রোল বোমা হয়ে বারবার জন্ম নিতে চাই না । আমাকে তোমরা সৃষ্টি করোনা । আমি যে পাপের ভার আর বইতে পারছিনা । আমি আজ ভীত অভিশাপ, ঘৃণায় ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.