![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অর্জুনকে মহাভারত লিপিকাররা নানাবিধ বৈশিষ্ট্যে উজ্জল করে
ফুটিয়ে তুললেও নিদারুন অবহেলায় যিনি আপন মহিমায় শ্রেষ্ঠত্বের
উচ্চশিখরে মহিমান্বিত হয়েছেন, তার নাম কর্ণ।
জন্ম থেকেই বঞ্চিত একজন অভিমানী এতিম অথচ ধীরে ধীরে সে
নিজেকে তৈরি করেছে একজন তেজস্বী বীর যোদ্ধা হিসেবে।
বার বার প্রতারিত,
অপমানিত হতে হয়েছে অভিমানী বীর কর্ণকে।
মহাভারতের
যে দুটি চরিত্রকে বিনাদোষে সর্বাধিক
অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে, তাঁরা হলেন
কর্ণ এবং কৃষ্ণা দ্রৌপদী।
একসময়
দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে কর্ণের কৌন্তেয়
পরিচয় জানার পর এর জন্য আক্ষেপ
করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে,
পঞ্চপাণ্ডবকে বিবাহ না করে কর্ণকে বিবাহ
করলে অন্ততঃ ভরা সভায়
তাঁকে বারবনিতা নামে ধিক্কৃত হতে হত না...
শ্রীকৃষ্ণের পর, তাঁর বীর
পঞ্চস্বামী নন, একমাত্র কর্ণই
সুরক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণাকে। কৃতজ্ঞ
নারী পাদস্পর্শ করে প্রণাম করেছেন কর্ণকে।
পরস্পর পস্পরের কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার
করে নিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন।
দ্রৌপদী সারাজীবন অর্জুনকে ভালবেসেছেন
সর্বাধিক, কিন্তু, হায়!! আর্জুন নিজ
জয়লব্ধ পুরস্কার অপর চার ভ্রাতার
সঙ্গে বিভক্ত করে নেওয়ায় বিশেষ খুশী হন
নি। বরঞ্চ, সুভদ্রাকে আর্জুন সেই কারণেই
প্রচ্ছন্ন ভাবে অধিক প্রশ্রয় দিয়েছেন, কারণ
তিনিই ছিলেন সুভদ্রার একতম স্বামী।
বিদগ্ধা রমনী দ্রৌপদীর অর্জুনের এই
সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব বুঝতে বিন্দুমাত্র
অসুবিধে হয় নি। আর সেই কারণেই
ক্রমে কর্ণের প্রতি পাঞ্চালীর হৃদয় তীব্র
অথচ প্রচ্ছন্ন এক কোমলতায় আর্দ্র
হয়ে উঠেছে; এক সময় ভরা সভায়
যাঁকে ধিক্কার দিয়েছেন, তাঁকেই শ্রদ্ধার
আসনে বসাতে দ্বিধা করেন
নি কুরুকুললক্ষ্মী।।
শিশুকাল থেকেই জন্মের নিগূঢ় অভিমান যেন
বহন করে চলেছেন বসুষেণ কর্ণ।
প্রতি পলে পলে অকারণ বঞ্চনা, অবজ্ঞা ও
অপমান তাঁকে করে তুলেছে অসম্ভব
অভিমানী, দুর্বিনীত ও অসহিষ্ণু। সমস্ত দিক
দিয়ে যোগ্যতর হওয়া সত্ত্বেও
অর্জুনকে অতিক্রম করতে না পারার প্রবল
অন্তর্দহন তাঁকে প্রতিহিংসা পরায়ণ
করে তুলেছে। অন্যয়, অধর্ম জেনেও
দুর্যোধনের সঙ্গে তিনি মিলিত হয়েছেন।
জতুগৃহে পাণ্ডব নিধন প্রচেষ্টার
ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন শকুনির সঙ্গে।
কুরুকুললক্ষ্মী দ্রৌপদীকেও কুরুরাজসভায়
লাঞ্ছিত করেছেন তিনি।
যুদ্ধের একাদশ থেকে পঞ্চদশ দিবস, এই
সময়সীমার মধ্যে অঙ্গরাজ কর্ণ
যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব, সকলকেই
নিধন করার সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ
করেননি। কেননা, তিনি কুন্তীর
কাছে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ঃ শেষ পর্যন্ত
কুন্তী পঞ্চপুত্রের জননীই থাকবেন; একমাত্র
তিনি পরাস্ত্র ও নিহত করতে চেয়েছিলেন
অর্জুনকে। যুদ্ধের ষষ্ঠদশ দিবসান্তে সেই অর্জুনকেও তিনি নিরস্ত্র
অবস্থায় পেয়েছেন।
কিন্তু সেই মুহূর্তে সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ায়
কর্ণ তাঁকেও ছেড়ে দিয়েছেন।
সূর্যপুত্র মহামতি কর্ণ তাঁর
সৈনাধিপত্যে যুদ্ধের কোনও নিয়মই লঙ্ঘিত
হতে দেননি আর। ভীষ্মের পর তিনিই
একমাত্র ও একাকী বীর যোদ্ধা,
যিনি একান্ত নিজস্ব কোনো জাগতিক
অভীষ্ট লাভের
আকাঙ্ক্ষা ব্যতিরেকে অপ্রতিরোধ্য জেনেও
শুধুমাত্র বীরগতি লাভের নিমিত্তই যুদ্ধ
করে গেছেন।
এ হেন বীর যোদ্ধা মহামতি কর্ণ
সারা জীবন ধরে বারংবার চাতুরী ও ছলনার
স্বীকার হয়েছেন। দেবাদিদেব ইন্দ্র
ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে তাঁর সহজাত
সুরক্ষা কবচকুণ্ডল হরণ করেছেন নিজপুত্র
অর্জুনের সুরক্ষা ও জয় নিশিত করার জন্য।
আপন জননীও তাঁকে অন্যায় প্রতিজ্ঞায়
আবদ্ধ করেছেন।
দ্রোণাচার্য তাঁকে ছলনা করেছেন তাঁর
কাছে শিষ্যত্ব কালে। স্বয়ং কৃষ্ণ
তাঁকে ইন্দ্রপ্রস্থ ও দ্রৌপদীর প্রলোভন
দেখিয়েছেন। দ্রৌপদী তাঁকে অপমান করেছেন
আপন স্বয়ম্বর সভায়। শ্রীকৃষ্ণ কর্ণের
রথে শল্যকে নিযুক্ত করেছেন গুপ্তচর হিসাবে,
তাঁর মনোবল ও মনঃসংযোগ বিনষ্ট করার
জন্য। কৃষ্ণ জানতেন কর্ণ অর্জুনের
চেয়ে অনেক বড় ধনুর্ধর; তাই যুদ্ধের সপ্তদশ
দিবসে যখন অন্তিমকাল আগত, কর্ণের রথের
বাম চক্র যখন মাতা মেদিনী গ্রাস করেছেন,
পার্থসারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণই তখন আর এক
মুহূর্তও কালক্ষেপ করতে দেননি ধনঞ্জয়কে।
তিনি অর্জুনকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই
কর্ণই জতুগৃহ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন,
তিনিই ভরা রাজ সভায় দ্রৌপদীকে অসম্মান
করেছিলেন, সর্বোপরি, অন্যায়
সমরে অর্জুনপুত্র কিশোর বীর
অভিমন্যুকেও তিনিই নিধন করেছেন। অর্জুনও
এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ
করেননি আর। অনৈতিক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন
মহাকাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর.........
কর্ণ ছিলেন সেই একমাত্র বীর, স্বয়ং ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ নিজহস্তে যাঁর পারলৌকিক
ক্রিয়াকর্ম করেছেন। সারা জীবনে কর্ণ কিছুই
পাননি, যা তাঁর একান্তই প্রাপ্য ছিল। প্রথম
কৌন্তেয় হিসাবে তিনিই রাজপরিবার,
ইন্দ্রপ্রস্থ, দ্রৌপদী, সব কিছুরই
অধিকারী ছিলেন। অসম্ভব সাহসী, বীর
যোদ্ধা এবং নীতিপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও
বারবার অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত
হয়ে পড়েছেন ভাগ্যের অমোঘ পরিহাসে। এ যেন সমস্ত পৃথিবীর
প্রতি এক প্রগাঢ় অভিমানে জীবন-বিমুখ
হয়ে মরণের পানে ছুটে চলা!!!
মহাবীর কর্ণ। হতভাগ্য কর্ণ। নিজের
ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য নিজের জন্মপরিচয়
জানার পর থেকে মাতা কুন্তীকে কোনোদিন
ক্ষমা করতে পারেননি।
জ্ঞানে, গুনে, দানে, ধ্যানে শ্রেষ্ঠতর
হওয়া সত্ত্বেও কেবলমাত্র জন্ম ও
সংস্কারের বিরুদ্ধতার কারণেই তাঁর
চরিত্রে বিপরীতমুখী বিশিষ্ট উন্মেষিত
হয়েছে। মহত্ত্বের সঙ্গে হীনতা, বীরত্বের
সঙ্গে ভীরুতা, উদারতার সঙ্গে ক্রুরতা -
কর্ণ-চরিত্রকে এক অপূর্ব বৈচিত্র দান
করেছে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত,
লোকসমাজে অশেষ লাঞ্ছিত, দৈবাভিশপ্ত
মহাবীরের এই অসহায় বিনষ্ট পরাক্রম
পাঠকের হৃদয় আর্দ্র করে তোলে।
পুত্রকে জন্মদানকালে যে পাপ আদিত্যদেব
করেছিলেন, তার ফলস্বরূপ
অন্তিমকালে সমস্ত
দৈবসহায়তা একে একে প্রত্যাহিত হয়েছে। দৈব
কবচকুণ্ডল, অমোঘ দৈবশক্তি, দৈবসম্পদ
সর্পবাণ, সমস্ত কিছু একে একে বিনষ্ট
হয়েছে। আর অভিশপ্ত বীরের এই চরম
অসহায়তাই জ্যেষ্ঠ কৌন্তেয়
কর্ণকে সর্বকালীন বিশ্ব সাহিত্যের
ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্রাজেডির নায়ক
করে তুলেছে।।
©somewhere in net ltd.