নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।
১.
নাহিদ আজ একটা কবিতা লিখে ফেলেছে। তার আনন্দ ধরে না। সে অনেক বড়ো কিছু একটা করে ফেলেছে। সৃষ্টির আনন্দের কোনো তুলনা হয় না।
নাহিদ এবার জয়পাড়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে। যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে তাদের জীবনের লক্ষ্য থাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবার। নাহিদের জীবনের লক্ষ্য সে কবি হবে। পরীক্ষার খাতায়ও সে তাই লিখে থাকে। এ নিয়ে শিক্ষকগণ ঠাট্টা করে বলেন, দেশে কবির সংখ্যা কাকের সংখ্যার সমান। দয়া করে বাপু তাঁদের সংখ্যাটি পিঁপড়ার সংখ্যার সমান করো না। ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও খোটা দিয়ে ওকে কবি ডাকে। এসব শুনে নাহিদের জেদ আরো বহুগুণ বেড়ে যায়, কবি সে হবেই।
কিন্তু শত চেষ্টায়ও সে কখনো দু-লাইনের বেশি অগ্রসর হতে পারে নি। তবু লেগে থাকতো। অধ্যবসায়ে সবকিছুই হয়, সবুরে মেওয়া ফলে। একদিন না একদিন সে কবি হতে পারবেই।
আজ কবিতা লিখেই সে লাফিয়ে উঠলো। ওর ইমেডিয়েট ছোটো ভাই, একাদশ শ্রেণির ছাত্র তুহিন একমনে প্র্যাকটিক্যাল খাতায় ব্যাঙের পাকস্থলি আঁকছিল। নাহিদ সেখানে উপস্থিত হলো।
তুহিন শোন তো কবিতাটা কেমন হয়েছে। বলেই নাহিদ আরম্ভ করে দিল- তুমি যদি পাখি হয়ে উড়ে যাও বনে ...
তুহিন মাঝপথে নাহিদকে থামিয়ে দিয়ে বললো, প্লি-জ ভাইয়া ... একটু পরে শুনবো। প্র্যাকটিক্যাল খাতাটা তৈরি করছি তো ...
ও ... তুই তো আবার কবিতা বুঝিস না, স্যরি টু ডিসটার্ব ইউ, বলেই নাহিদ ক্ষিপ্রবেগে বেরিয়ে গেল।
রুবিনা। নাহিদের ক্লাসমেট, চাচাত বোন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কী একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। হন্তদন্ত হয়ে নাহিদ ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।
জানিস রুবি, সেই কবিতাটা আজ শেষ করেছি।
তাই? দেখি তো। বলেই নাহিদের হাত থেকে ছোঁ মেরে কবিতাটা কেড়ে নিয়ে রুবিনা পড়তে শুরু করলো। পড়া শেষ করে হতাশভাবে বললো, এটা তো দেখি তুই একটা গবিতা লিখেছিস।
মানে? নাহিদ ভীষণ অবাক হয়।
মানে এটা কোনো কবিতা হয় নাই, হয়েছে একটা গদ্য রচনা। গরু রচনার মতো গদ্য রচনা আর কী। এমন গরু রচনা সবাই লিখতে পারে।
সবাই লিখতে পারে? কথাটা শুনে নাহিদের গায়ে যেন আগুন ধরে গেল। সে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো, খু-উ-ব তো শোনালি গরু রচনার কথা, তা লিখেছিস কখনো দু-চার লাইন? বাংলায় কখনো পাশ করেছিস বলে তো দেখি নাই। নিজের নামঠিকানাটা ঠিকমতো লিখতে পারলি না বলে পাত্রপক্ষ কত হাসিঠাট্টা করে পিছ-পা নিল।
কথাটা কাঁটার মতো রুবিনার বুকে বিঁধলো। কারণ, নাহিদের কথাটার কোনো অর্থই নেই রুবিনার কাছে। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের কোনো মেয়েকে বরপক্ষ দেখতে এসে তাকে দিয়ে নামঠিকানা লেখানোর কোনো মানে হয়? অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়ে রুবিনা চেঁচিয়ে উঠলো, খোটাতো ঐ একটাই পেয়েছিস। আজ নিয়ে কম করে হলেও পঞ্চাশবার হলো। আর কোনো কিছু কি পাস না তুই? রাগে গজগজ করতে থাকলো রুবিনা।
নাহিদেরও শরীর কামড়াতে লাগলো। বহুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাধনায় আজ সে কবিতাটা শেষ করতে পেরেছে। অথচ রুবিটা বলে কিনা এটা নাকি কবিতাই হয় নি! হয়েছে গবিতা। কেন যে এরা আধুনিক কবিতা পড়ে না, কেন যে এরা আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা বোঝে না, এসব ভাবতে ভাবতে এদের বিরুদ্ধে নাহিদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো।
নাহিদ পুনরায় কবিতার পৃষ্ঠাটা খুলে পড়তে লাগলো। পড়তে তার ভীষণ ভালো লাগছে। অপূর্ব শব্দগাঁথা। একটা উৎকৃষ্ট আধুনিক কবিতা। সবাই কি এমন সরস কবিতা লিখতে পারে? সবাই কি সমান প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে? সবাই তো আর কবিও হতে পারে না। নাহিদ বার বার – বার বার তার স্বরচিত বিখ্যাত আধুনিক কবিতাটি পড়তে লাগলো। যতই সে পড়ে ততই তার ভালো লাগে, ততই সে নিজের কবিপ্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়।
কার চিঠি পড়ছিস, দোস? চুপিচুপি পেছনে এসে খপ করে নাহিদের কাঁধে হাত রাখে একজন, তাকে চমকে দেয়। সে সহপাঠী আব্দুল করিম। উঁকি দিয়ে সে নাহিদের হাতের কাগজটার দিকে তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করে ... তুমি যদি পাখি হয়ে উড়ে যাও বনে ... তারপর মুগ্ধ হয়ে বলে, বাহ্, চমৎকার ... চমৎকার ... দোস …।
সত্যিই বলছিস? আব্দুল করিমের কথা যেন নাহিদের বিশ্বাসই হয় না, যদিও সে মনে মনে ততোধিক নিশ্চিত যে একটি চমৎকার কবিতা লিখে ফেলেছে সে।
খোদার কসম, আব্দুল করিম জোর দিয়ে বলে। সে আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তা মেয়েটা কে রে দোস ... এত সুন্দর চিঠি ...
ধ্যা-ত ... নাহিদ যারপরনাই বিরক্ত এবং হতাশ হয়ে বলে, চিঠি হবে কেন? এটা কোনো মেয়েটেয়ের প্রেমপত্র না। আমার হাতের লেখাও চিনতে পারছিস না? এটা একটা কবিতা, আমার লেখা জীবনের প্রথম কবিতা।
সত্যিই? আব্দুল করিম বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়। বলে, খুব সুন্দর লিখেছিস তো দোস্ত। দে, তোকে আবৃত্তি করে শোনাই।
আব্দুল করিম খুব ভালো আবৃত্তি করে, যদিও এটা তার নিজের ধারণা। আবৃত্তি প্রতিযোগিতার সকল অনুষ্ঠানেই সে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু স্থানলাভ হয় না। এতে তার কোনো আফসোসও নেই। সে বলে, বিচারকগণ যাকে বেশি পছন্দ করেন তাকে বেশি নম্বর দিয়ে থাকেন। আমি ভালো আবৃত্তি করলেই যে আমি ভালো নম্বর পাব তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই, শিক্ষকগণ আমাকে সবার মতো অত বেশি ভালোবাসেন না। ঈর্ষা ... ঈর্ষা।
অনেকে হাঁটতে বসতে চলতে গুনগুন করে গান গায়, আব্দুল করিমের অভ্যাস হলো গুনগুন করে আবৃত্তি করে বেড়ানো।
আব্দুল করিম খুব দরদ দিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করলো। নাহিদ তন্ময় হয়ে তা শুনলো। নিজের লেখা কবিতা অন্যের মুখে আবৃত্তি হতে শুনলে নিজেকে প্রকৃত কবি মনে হয়, গর্বে বুক ভরে যায়। অনির্বচনীয় আনন্দে মন নেচে ওঠে।
আবৃত্তি কেমন হলো রে দোস? আব্দুল করিম জানতে চায়।
অপূর্ব। নাহিদ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
আত্মপ্রসাদে দু-জনেরই বুক ভরে গেল।
নাহিদের ছোটোবোন কোহিনূর টেপরেকর্ডারে যুগল কণ্ঠে অলকা ইয়াগনিক আর অভিজিতের হিন্দি গান শুনছিল। হঠাৎ নাহিদ আবির্ভূত হয়ে টেপরেকর্ডার অফ করে দিল। তার হাতে একটা ক্যাসেট। সে কোহিনূরকে বললো, তোকে আজ একটা দারুণ জিনিস শোনাবো। বলেই সে ভেতরের ক্যাসেটটা বের করে হাতের ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে দিল। এরপর প্লেয়ার অন করে দিয়ে বললো, এটা তুই সম্পূর্ণ শুনে আমাকে বলবি কেমন হয়েছে।
টেপরেকর্ডার বেজে উঠলো ... তুমি যদি পাখি হয়ে উড়ে যাও বনে ...
কোহিনূর চেয়ারে দু-পা গুটিয়ে বসে অতিশয় মনোযোগ দিয়ে শোনার প্রস্তুতি নিল। ওর এতখানি মনোযোগের ভাব লক্ষ করে নাহিদ ওর প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে মনে মনে বললো, আমার অতি আদরের ছোটোবোনটি কবিতার দারুণ ভক্ত তো! সে নীচু হয়ে চু শব্দ করে কোহিনূরের তুলতুলে নরম গালে একটি চুমু খায়। আর তখনি কোহিনূরের উস্খুস্ ভাব লক্ষ করা গেল। এবং অল্পপক্ষণেই কোহিনূর বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, এটা কি যাত্রার ডায়লগ? যাত্রার ডায়লগ আমার ভালো লাগে না ভাইয়া। দাও না ঐ হিন্দিটাই একটু শুনি।
সে কী রে, নাহিদ বলে, এটা তো কোনো যাত্রার ডায়লগ না।
নাটক শুনতেও আমার ভালো লাগে না। কোহিনূরের গলায় স্পষ্ট বিরক্তির স্বর ফুটে ওঠে।
তুই একটা আস্ত গোবরে পোকা, নাহিদ চটে যায়, এস.এস.সি.র ক্যান্ডিডেট হয়েও কবিতা আবৃত্তি বুঝিস না? জানিস, এটা একটা উৎকৃষ্ট আধুনিক কবিতা? আর এই উৎকৃষ্ট আধুনিক কবিতাটা যে আবৃত্তি করেছে সে একজন মহান আবৃত্তিকার যার নাম আব্দুল করিম। তুই আরো যে জিনিসটা জানিস না তা হলো এই যে, এই উৎকৃষ্ট কবিতাটা লিখেছি স্বয়ং আমি, বুঝেছিস?
খুট করে ক্যাসেটটা বের করে নিয়ে নাহিদ প্রস্থান করলো। কিন্তু কোহিনূরের কোনো দুঃখবোধ জন্মালো না এবং তার কোনো ভাবান্তরও হলো না। সে বরং আরো খুশি হয়ে আগের ক্যাসেটটা চড়িয়ে আগের চাইতে জোর ভলিয়্যুমে গান শুনতে লাগলো।
লতা নাহিদের পিঠাপিঠি বড়োবোন। গতবার এইচ.এস.সি ফেল করেছে। এবার নাহিদের সাথে সে-ও পরীক্ষার্থী। এবারের ফেলটা এড়ানোর জন্য লতা কখনো সময়ের অপচয় করে না। সে মনোযোগ দিয়ে ‘হৈমন্তী’ চরিত্র মুখস্থ করছিল।
নাহিদ ঘরে ঢুকেই লতার পড়ার টেবিলে ধপ করে বসে পড়ে বললো, শোন, একটা কবিতা আবৃত্তি করি।
একনিষ্ঠ ভক্তের মতো মনোযোগ দিয়ে কবিতা আবৃত্তি শুনলো লতা।
ভালোই আবৃত্তি করিস তো। আবৃত্তি শেষে লতা মন্তব্য করলো।
নাহিদ বললো, কবিতা ভালো হলে আবৃত্তি তো ভালো হবেই। জানিস কবিতাটা কার?
কবিদের সংখ্যা সম্বন্ধে লতার মোটেও কোনো ধারণা নেই। তা সত্ত্বেও পাঠ্যবইয়ের বদৌলতে গোটা কয়েক কবির নাম তার জানা আছে। অবশ্য ভালো কবি ও ভালো কবিতা বলতে সে কেবল রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলকেই বুঝে থাকে। কাজেই লতা উত্তর দিল, কবিতাটা হয় রবীন্দ্রনাথের, নতুবা নজরুলেরই হবে।
ধূর বোকা, নাহিদ বলে, কবি আর কবিতা সম্বন্ধে তোর দেখি সত্যি কোনো আইডিয়া নাই। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল কি কখনো এরকম আধুনিক কবিতা লিখেছেন?
তাহলে আর কার হবে, লতা বলে, নিশ্চয়ই শামসুর রাহমানের?
জি না। নাহিদ বলে, এটা আমার নিজের লেখা কবিতা।
ও, হতে পারে। লতা টেনে টেনে বলে।
হতে পারে আবার কী? নাহিদ ঈষৎ ভর্ৎসনার স্বরে বলে, তুইও একটা আস্ত গাধা। কিচ্ছুটুকুন তোর মনে থাকে না। তোর সামনেই তো কতদিন এই প্রথম দু-লাইন লিখে কলম ধরে বসে থেকেছি, শেষ করতে পারি নাই। আজ কিছুক্ষণ আগে এটা শেষ করলাম।
লতা আগের মতোই বলে, হতে পারে, আমার মনে নাই।
তোর তো মনে থাকবেই না, নাহিদ বলতে থাকে, মনে থাকলে তো আর বছর বছর পরীক্ষায় ফেল মারতি না।
লতাও রেগে গিয়ে বললো, বেশি বকবি না এখন। ফাঁকে যা, পড়তে দে। যেই না কবি ...
নাহিদের মনটা বিষাদে ভরে গেল। পৃথিবীতে কেউ কবিতা বোঝে না। কেউ কবিতার দাম দিতে চায় না। কবির মূল্য কোথায়? কিন্তু নাহিদ দমবার পাত্র নয়। দমবে কেন? মহৎ কাজের জন্য নিরুদ্যম হতে নেই। নিজের পড়ার ঘরে চলে এলো সে। চেয়ারে বসলো। কাগজ কলম টেনে নিল। সে নতুন কবিতা লিখবে। কিন্তু মনটা এখন ভালো নেই। মনে কোনো ভাব নেই এখন। ঐ কোহিনূর, লতা আর রুবিনা - ওরা এমন কেন? মনটাই বিগড়ে দিয়েছে। নাহিদ মনে মনে ভাবে, নিজেরই ভুল, সমঝদার না বুঝে সে কবিতা শুনিয়েছে।
আগের কবিতাটা আরেকবার পড়ে নিলে কেমন হয়? নাহিদ তাই করলো। গম্ভীর স্বরে আবৃত্তি করলো, তুমি যদি পাখি হয়ে উড়ে যাও বনে ...। একবার। দুইবার। বেশ কয়েকবার সে পড়লো। পড়ে পড়ে যেন তৃপ্তি আর মেটে না।
পড়দিন কলেজে যাওয়ার পথে। নাহিদ এবং আব্দুল করিম।
নাহিদ বললো, দোস, আরো একটা লিখেছি।
আব্দুল করিম উৎসাহের সাথে বলে, কই, দেখি?
নাহিদ প্যান্টের পকেট থেকে কবিতার খসড়াটি বের করে এগিয়ে দিয়ে বলে, নে পড়।
নোট বইটা বগলে চেপে আব্দুল করিম দু-হাতে কাগজটা মেলে পড়তে শুরু করলো। প্রথমে মনে মনে। এরপর মৃদু স্বরে। তারপর স্ফুট স্বরে আবৃত্তি করতে লাগলো। একসময় একটা হোঁচট খেলো এবং পরক্ষণেই জনৈক পথচারীর সাথে ধাক্কা খাওয়া থেকে কোনোমতে বেঁচে গেল। পথচারী লোকটা নিজেকে সামলে নিয়ে রুক্ষ স্বরে বললো, চোখে দেখেন না? কিন্তু এরা তা শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না। অবশ্য শুনতে পেলেও পথচারীদের এমন দু-চারটে কথায় এদের কোনো প্রতিক্রিয়া হতো না। এরা কাব্যজগতের বাসিন্দা। একজন নব্য কবি, অন্যজন নব্য আবৃত্তিকার। তা না হলে কোনো কলেজ-ছাত্রকে কেউ ‘চোখে দেখেন না’ বললে কি তার রক্ষা হতো?
আবৃত্তি শেষ হওয়া মাত্র আব্দুল করিম উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, অ্যাকসিলেন্ট! দোস, এটা তোর একটা অপূর্ব সৃষ্টি, একটা কালোত্তীর্ণ কবিতা হয়েছে।
আব্দুল করিমের প্রশংসায় ডগমগ হয়ে নাহিদ বলে, আরো একটায় হাত দিয়েছি দোস্ত। ক্লাসে বসেই ওটা শেষ করবো আশা রাখি। এ কথা বলে নাহিদ অসম্পূর্ণ কবিতাটির প্রথম কয়েকটা পঙ্ক্তি পড়ে শোনালো। ভাবে গদগদ হয়ে আব্দুল করিম বললো, চালিয়ে যা দোস্ত, একদিন তুইও অনেক বড়ো কবি হবি। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান - এঁদের সাথে তোর নামও উচ্চারিত হবে।
নাহিদ ততোধিক গদগদভাবে বললো, ইন্শাল্লাহ্ ...।
২.
টেস্ট পরীক্ষা শেষ।
নাহিদ এখন ক্লাসের পড়া পড়ে না। সে আজকাল কেবল কবিতা লেখে। ছোটো একটুকরো সাদা কাগজ পেলেও সে লেখে। হাতের সামনে যে কারো খাতা পেলেই সে তাতে কবিতা লিখে থাকে। তুহিন, লতা, কোহিনূর, রুবিনা - এদের একদম নতুন খাতাগুলোতে, এমনকি ওদেরও কিছু লেখার আগেই, মাঝেমধ্যে নাহিদ তার কাব্যচর্চার উজ্জ্বল স্বাক্ষর দিয়ে দেয়। তার হয় কাব্যচর্চা, আর বাকিরা হয় অতিষ্ঠ।
নাহিদ কবিতা লেখে। আব্দুল করিম আবৃত্তিচর্চা করে। আব্দুল করিমের উদ্যোগে এবং আব্দুল করিমের ক্যাসেটেই, তা আবার রেকর্ডবন্দি হয়। ভালো ভালো গানের ক্যাসেটগুলো কেটে তারা এই মহৎ কাজটি করে থাকে। আব্দুল করিমের ইংরেজি গান-শোনা মেঝ চাচাটি অবশ্য এজন্য কম অতিষ্ঠ হয় না।
দেখতে দেখতে কবিতার খাতা ভরে গেল। প্রতিদিন নতুন নতুন আর চমৎকার সব ডিজাইনের নোট বই কিনে আনে নাহিদ। রং-বেরংয়ের কালিতে পাণ্ডুলিপি সাজায়। মাঝে মাঝে কবিতার পাশে খালি জায়গায় আল্পনাও আঁকে। এতে পুরো পাণ্ডুলিপিটা অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। নাহিদ ভাবে, কবে সে বইটি ছাপবে, ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে তার কবিতা আর নাম উদ্ভাসিত হবে, চারদিকে হৈচৈ পড়ে যাবে, ভীষণ প্রতিভাবান এক নব্য কবির কাব্যচ্ছন্দে আকাশ-বাতাস-তরুলতা আর রসিক-হৃদয় আন্দোলিত হতে থাকবে। বইটা কার নামে উৎসর্গ করবো? নাহিদ ভেবে পায় না।
কলেজ-বার্ষিকী ছাপা হবে। লেখা আহ্বান করা হয়েছে। লেখা আহ্বান বাক্সে নাহিদ তার উৎকৃষ্ট কবিতাটিই জমা দিল। অবশ্য আব্দুল করিমের বিচারেই এটা তার লেখা উৎকৃষ্ট কবিতা।
এর আগে কলেজের দেয়ালিকাতেও লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। নাহিদ তার প্রথম লেখা কবিতাটি জমা দিয়েছিল। দেয়ালিকাতে সেই লেখাটি স্থান পেয়েছিল। এ নিয়ে বাড়িতে সে প্রচুর গর্ব করেছিল এবং রুবিনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, আমি যে ভালো কবিতা লিখি তার প্রমাণ পেলে এবার? কত ছাত্রছাত্রীই তো লেখা জমা দিয়েছিল। কিন্তু সম্পাদক সাহেব কি সবার লেখাই সিলেক্ট করেছেন? সবাই গরু রচনা লিখতে পারলেও কবিতা লেখা সবার দ্বারা হয় না। রুবিনাকে জব্দ করতে পেরে সে দারুণ সুখ পেয়েছিল।
নাহিদের খাওয়া দাওয়াও আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। রাত জেগে সে কবিতা লেখে। রাত যত গভীর হয় তার মনে তত ভাব জাগে।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা ও বড়ো পত্রিকায়ও নাহিদ কবিতা পাঠানো শুরু করেছে। কবিতা পাঠানোর সময় সে সারা বাড়ি তোলপাড় করে তোলে। সে সগর্বে বলে বেড়ায়, আজ অমুক পত্রিকায় আমার অমুক কবিতাটা পাঠালাম। তো, অমুক পত্রিকাটি বের হবার পর জনৈক তমুক যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে বসে, কী ব্যাপার, তোমার সমুক কবিতাটা কি ছাপা হলো? তখন তার সোজাসাপটা জবাব, কবিতা কি আর এত তাড়াতাড়ি ছাপা হয়? পত্রিকা-অফিসে প্রতিদিন হাজার হাজার কবিতা এসে জড়ো হয়। পত্রিকায় তো আর হাজার হাজার পৃষ্ঠা থাকে না, তাই সবগুলো কবিতাও একসংগে ছাপা হয় না। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে, সম্পাদকরা আবার সবগুলো ভালো কবিতা একসংগে ছাপতে চান না। সবগুলো সংখ্যার স্ট্যান্ডার্ড সমান রাখতে হয় কিনা। নাহিদের এ কথার অর্থ একটাই যে তার কবিতাগুলো ও-রকম উঁচু মান সম্পন্ন কবিতাগুলোরই অন্তর্গত।
এভাবে একদিন ফাইনাল পরীক্ষা এসে দরজায় কড়া নাড়লো। নাহিদ বই খুলে পড়তে বসে দেখলো সে সব পড়া ভুলে গেছে। কিন্তু সে ঘাবড়ালো না। মনে মনে বললো, পাশের দরকার কী? পাশের কোনো দরকার নেই। কজনই বা আর পাশ করা কবি আছেন? নজরুল তো টেনেটুনে মাত্র দশম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন, আমি তাঁর চেয়ে বরং কয়েক ধাপ ওপরেই উঠতে পেরেছি।
এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষায় রুবিনা আর লতা উৎরে গেল, তবে নাহিদ এবং আব্দুল করিমের কোনো হিল্যা হলো না।
আব্দুল করিম অজুহাত দেখালো, পরীক্ষার সময় তার দাঁতে ব্যথা ছিল বলে সে পড়তে পারে নি। না পড়ে কেউ কখনো পাশ করতে পারে নাকি?
নাহিদ বললো, খাতায় নম্বর যোগ করতে নিশ্চয়ই গণ্ডগোল হয়েছে। এত ভালো লিখেও কি কেউ ফেল করে?
মার্কশীট দেখে নাহিদের মা বললেন, কেবল তোর একার চারটে খাতায়ই কি নম্বর যোগ করতে ভুল হলো?
তুহিন আর নাহিদ দু-ভাই এবার একই ক্লাসে পড়বে, অর্থাৎ দু-ভাই একসঙ্গে এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেবে। এ জন্য তুহিন অবশ্য সুযোগ পেলেই নাহিদকে মৃদু খোঁচা দিয়ে থাকে। রুবিনাও ফেল-মাস্টার বলে টিটকিরি দিয়ে ওকে ফুঁসলে দেয়। নাহিদের গায়ে আগুন জ্বলে ওঠে। মাঝে মাঝে কষে চড় দিতে ইচ্ছে করে। কেবল সোমত্ত মেয়ে বলেই গায়ে হাত তুলতে বিবেকে বাঁধে, শত হলেও অবলা নারী তো!
কোহিনূরও বেশ ভালো নম্বর পেয়ে এস.এস.সি পাশ করেছে। নাহিদ কখনো সখনো ছোটো বোনটির সাথে কবিতা সংক্রান্ত আলোচনার সূত্রপাত করে। কিন্তু আদরের বোনটি শুরুতেই বাঁধা দিয়ে বলে, ভাইয়া প্লিজ, এসব বাদ দিয়ে একটু কাজের কাজ করো। কবিতা লিখে কি ভাত পাবে?
একদিন রাত জেগে নাহিদ তার নিজস্ব কাব্যভুবনে কর্মমগ্ন ছিল। ওর বাবা আব্দুস ছামাদ মিয়া ঘরে ঢুকে বিরক্ত মুখে বললেন, কীসব ছাইভস্ম লিখে মাথা খোয়াচ্ছো? পরীক্ষার পড়া পড়তে পারো না? এসব কবিগিরি রাখো, বুঝলে? নাহিদ নির্বিবাদে লেখা বন্ধ করলো, খাতা গোছালো, অতঃপর বাতি নিভিয়ে একান্ত সুবোধ বালকের মতো ঘুমোতে গেল। বাবা কিন্তু একরত্তি জানতে পারলেন না যে নাহিদের কাব্যভুবনে বাবার অনভিপ্রেত অনুপ্রবেশের জন্য তূষের আগুনে তার অন্তর জ্বলে যাচ্ছিল।
৩.
নাহিদের মন আজ ভীষণ খারাপ। কলেজ-বার্ষিকীতে তার কবিতা ছাপা হয় নি। ম্যাগাজিনটির প্রত্যেকটি কবিতাই সে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। ছাপানো লেখাগুলোর সাথে সে তার নিজের সবগুলো লেখার তুলনা করে দেখেছে। নাহিদের বিবেচনায় ম্যাগাজিনে ছাপানো কবিতাগুলো কোনো কবিতাই হয় নি। ডাহা স্বজনপ্রীতি। সম্পাদকের স্বজনপ্রীতির জন্য কবিতা নয়, বরং কবিদের নামগুলো প্রচারের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে মাত্র। এটা কোনো ম্যাগাজিনই হয় নি, নাহিদ মনে মনে বলে, ম্যাগাজিনের মান উন্নত করতে হলে ভালো লেখা ছাপতে হয়, এসব বস্তাপঁচা লেখা দিয়ে কোনোদিন উন্নত মানের ম্যাগাজিন বের করা যায় না।
রাগে ক্ষোভে আর দুঃখে নাহিদের চোখে পানি আসার উপক্রম হলো। বাড়িতে যদি কোনোমতে জানাজানি হয়ে যায় যে কলেজ ম্যাগাজিনে তার কবিতা ছাপা হয় নি, কেউ কি খোটার একশেষ রাখবে? তার কবিত্বই তখন হুমকির মুখে পড়বে।
নাহিদের পড়ার টেবিলে কত্তসব ম্যাগাজিন থরে থরে সাজানো। অধিকাংশই সাহিত্যপত্রিকা। প্রবীণদের সাহিত্যসংকলন। নতুন লিখিয়েদের লেখার সম্ভার। নাহিদ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবই পড়ে। তার মনে হয় কাগজে যেসব কবিতা ছাপা হচ্ছে তা আহামরি গোছের কিছু নয়। সে তো এদের চেয়ে খারাপ লেখে না। বরং কারো কারো চেয়ে বেশ ভালো লিখেছে। তবু কেন সম্পাদকেরা তার কবিতা ছাপছেন না? নাহিদ কিছু ভেবে পায় না।
নাহিদ আবার ভাবে, যাঁদের লেখা ছাপা হয় তাঁরা নিশ্চয়ই সম্পাদকের আত্মীয়স্বজন হবেন। এখানেও শালার স্বজনপ্রীতি।
কখনো ভাবে নাহিদ নিজে গিয়ে একদিন পত্রিকা অফিসে হাজির হবে। সম্পাদকের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। লজ্জায় পড়ে হলেও সম্পাদক সাহেব তার কবিতাটি কাগজে ছেপে দেবেন।
কিন্তু পত্রিকার পাদটীকায় যে লেখা থাকে লেখা পাঠিয়ে ব্যক্তিগত যোগাযোগ নিষেধ। এর অর্থ কী? নিশ্চয়ই কেউ কেউ লেখা পাঠিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে থাকেন এবং তাতে হয়ত লাভই হয়।
পরক্ষণেই তার মনে হয়, এতে লেখকের লেখার প্রকৃত মান নির্ণিত হয় না। সম্পাদকের নিজের বিচারে বাছাইকৃত লেখাই প্রকৃত লেখা।
একদিন রুবিনা একটা পোস্টকার্ড নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে বললো, নাহিদ এই দেখ, তোর কবিতা ছাপা হবে।
নাহিদ উত্তেজনায় বসা থেকে লাফিয়ে উঠলো। পোস্টকার্ডটা হাতে নিয়ে একনিশ্বাসে পড়ে ফেললো। সম্পাদকের লেখা। ‘সমাহার’ - একটি নতুন সাহিত্যপত্রিকা। এর প্রথম সংখ্যা বের হবে আগামী মাসে। পত্রিকায় ‘লেখা আহ্বান’ বিজ্ঞাপন দেখে সে লেখা পাঠিয়েছিল। তার কবিতাটি নির্বাচিত হয়েছে। প্রথম সংখ্যায়ই ছাপা হবে। ঝলমলে ছাপার অক্ষরে তার নাম ফুটে উঠবে - নাহিদ কামাল।
এটি একটি দারুণ খবর। নাহিদের দেহমনে যেন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো। এ উপলক্ষে পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের বেশ করে খাওয়ালো। তার কবিতা ছাপা হচ্ছে। সে একজন কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে। এর চেয়ে বিরাট ঘটনা আর কী হতে পারে? নাহিদের খু-উ-ব গর্ববোধ হচ্ছিল।
নাহিদের লেখার গতি ও তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে গেল। এখন আর সে আগ বাড়িয়ে কাউকে কবিতা শোনায় না। লতাকেও না। কোহিনূরকেও না। রুবিনাকেও না। আর তুহিন? প্রশ্নই ওঠে না - ও কবিতার কী বোঝে?
একমাত্র আব্দুল করিমই হলো নাহিদের কবিতার একনিষ্ঠ সমঝদার। উৎসাহ দেয়, প্রেরণা দেয়। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করে। আগের মতোই নাহিদ কবিতা লেখে আর আব্দুল করিম আবৃত্তি করে, তা টেপরেকর্ডারে রেকর্ড করে, সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এবং নতুন-পুরাতন গানের ক্যাসেটগুলোর বারোটা বাজিয়ে।
এই তো মোক্ষম সময় একখানি কবিতার বই প্রকাশ করার। বই বের না হলে এই প্রতিভা সম্পর্কে কেউ জানবে না। নিজের মগজে যা আছে, তা মানুষের মনে ছড়িয়ে দিতে হবে। কবিতা। কবিতা। কবতার বই।
প্রিয় বন্ধু ও আবৃত্তিকার আব্দুল করিমকে নিয়ে একদিন তারা ঢাকার বাংলা বাজার গেল। কবিতার পাণ্ডুলিপিটা বেশ বড়োসড়োই। কবি নাহিদের কবিতাগুলো প্রকাশকরা লুফে নেবেন বলেই তারা মনে করতে থাকলো।
কিন্তু বাংলা বাজার গিয়ে তারা প্রচণ্ড রকমভাবে নিরুৎসাহিত হলো। ঢাউস সাইজের বই ছাপাতে বিরাট অঙ্কের টাকা লাগবে। ঐ টাকা স্বয়ং কবি মহোদয়কেই দিতে হবে যে! তারা সবে ছাত্র মানুষ। বই ছাপাবার টাকা কোথায় পাবে? মনমরা হয়ে দুজনে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।
কিন্তু কবি দমে গেল না। দ্বিগুণ উৎসাহে সে কবিতা লিখতে শুরু করলো। তার কলম তিরবেগে ছুটতে থাকলো। একদিন না একদিন তার কবিতার বই আলোর মুখ দেখবেই। নিজের টাকায়ই হোক, বা বাবাজানের টাকায়ই হোক।
কলেজে বিজয় দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিজয়ের গৌরবকে নিয়ে এক বিশালকায় কবিতা লিখে ফেললো কবি নাহিদ কামাল। আব্দুল করিম আবৃত্তিকারের তালিকায় নাম লেখালো। এবং যথাসময়ে মঞ্চে উঠে শুরু করলো- আমি এখন যার কবিতাটি আবৃত্তি করবো আপনারা সবাই তাঁকে চেনেন, কিন্তু তাঁর কবিপ্রতিভা সম্পর্কে আপনাদের কারো কোনো সম্যক ধারণা নাই। উনি একজন প্রতিভাবান তরুণ কবি, আমাদেরই সহপাঠী বন্ধু নাহিদ কামাল। বলেই আব্দুল করিম নিজে থেকে করতালির সূত্রপাত করলো, কিন্তু উপবিষ্ট দর্শকবৃন্দ সেই করতালিতে যোগ না দেয়ায় সে আশাহত হয়ে থেমে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে আব্দুল করিম পুনরায় বলতে শুরু করলো, এ পর্যন্ত আমাদের কবিভাই অজস্র কবিতা লিখেছেন এবং দেশের জাতীয় পত্রিকায় সেগুলো নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। এ সময় সমাগত দর্শকবৃন্দের মধ্য থেকে মৃদু প্রশংসা-ধ্বনি উত্থিত হলো বলে মনে হওয়ায় আব্দুল করিম বুক ফুলিয়ে স্মিত হাসলো এবং কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে ঘোষণা করলো, এখন আমি যে কবিতাটি আবৃত্তি করবো এটি হলো তাঁর অনেকগুলো ‘উৎকৃষ্ট’ কবিতার একটি ... ।
দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জরণ স্পষ্ট হলো এবং কে একটা দুষ্টু ছেলে চাপা স্বরে বলে উঠলো, আবে ঐ ... লেকচার বন্ধ করবি, নাকি পুলিশ ডাকবো?
আব্দুল করিম তার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরাও আপন খেয়ালে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। আবৃত্তি শেষ হতেই মাঝের সারি থেকে একজন আবৃত্তি-মুগ্ধ দর্শক খুব জোরে হাততালি দিয়ে উঠলো, কেবল একজনই। সবাই একযোগে সেদিকে তাকালো, দেখলো, যে মুগ্ধ দর্শকটি সজোরে হাতের তালু ফাটিয়ে যাচ্ছে সে আর কেউ নয়, স্বয়ং কবি নাহিদ কামাল।
মঞ্চ থেকে নেমেই আব্দুল করিম সোজা চলে এলো নাহিদের পাশে।
আবৃত্তি কেমন হলো রে দোস্ত? জায়গায় বসতে বসতে আব্দুল করিম জানতে চায়।
চমৎকার! চমৎকার! নাহিদ তার সপ্রশংস ও সকৃতজ্ঞ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
ওদের পাশে বসা একটি ছেলে আব্দুল করিমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, তুমি কি দোস্ত কবিতা গাইলা, নাকি ভাষণ দেয়ার প্র্যাক্টিস করলা? কোনটা করলা? বুঝতে পারলাম না যে?
আব্দুল করিম উত্তর দেয়ার জন্য মুখ হাঁ করতেই নাহিদ উত্তর কেড়ে নিয়ে বললো, ভাষণ আর আবৃত্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। দুটোর জন্যই সুন্দর বাঁচনভঙ্গির প্রয়োজন। দুটোই মানুষের মনে আবেগের সৃষ্টি করে। যে যত বেশি আবেগ সৃষ্টি করতে পারে সে তত সার্থক। ভালো ভাষণ দেয়া যেমন সহজ না, তদ্রূপ ভালো আবৃত্তি করাও সহজ না। সব জিনিস সবার দ্বারা হয় না। আমাদের এখানে আর কয়টা ছেলে আছে বলো তো, যে-ছেলে করিমের মতো এত চমৎকার আবৃত্তি করতে পারে?
ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বললো, স্যরি, আই হ্যাভ হার্ট ইউ।
‘সমাহার’ পত্রিকাটি বেরুবার সময় কি অত্যাসন্ন নয়? নাহিদ আজকাল সকল বুকস্টলে ‘সমাহার’ খুঁজে বেড়ায়। কেউ ‘সমাহার’-এর খবর জানে না। এ নামে কোনো পত্রিকার নাম কেউ কখনো শুনেছে বলেও জানা গেল না। নাহিদ বলে, এ-মাসেই এটার প্রথম সংখ্যা বেরুবে। হকারগণ বলে, পরে খোঁজ নিয়েন।
সেদিন কী একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে আব্দুল করিম দৌড়ে এসে হাজির। তার চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল। ম্যাগাজিনটা খুলে কবিতার পাতাটা নাহিদের সামনে টেবিলের ওপরে মেলে ধরলো আব্দুল করিম। ‘তারুণ্য’ পত্রিকাটির নাম। ম্যাগাজিনের প্রথম কবিতা ‘মরীচিকা’, ‘মরীচিকা’র নীচে জ্বলজ্বল করছে কবির নাম - নাহিদ।
আব্দুল করিম সেটি সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে লাগলো, উচ্চস্বরে আবৃত্তি করে সবাইকে শোনাতে থাকলো। সহপাঠীদের কাছে নাহিদের ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
লতা অভিনন্দন জানালো। তুহিন, ডিটেক্টিভ ছাড়া যে অন্য কিছু বোঝে না, সেও বললো, তোর কবিতাটা বেশ ভালো হয়েছে রে ভাইয়া, আমি দু-বার পড়েছি। কোহিনূর আর রুবিনাও ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে অন্তত একবার করে পড়ে ফেললো। ওরা প্রত্যেকেই স্বীকার করলো, হ্যাঁ, কবিতাটা চমৎকার।
সকলের এতসব উল্লাস-অভিনন্দনে নাহিদকে কিন্তু উচ্ছ্বসিত মনে হলো না। কেউ কেউ ভাবলো, ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হবে, কবির জন্য এটা কীইবা এমন বড়ো ঘটনা? কবিতা তো ছাপা হবেই। ম্যাগাজিনওয়ালারা কবিতার জন্য কবি নাহিদ কামালের কাছে ধরনা দিতে দিতে পায়ের চামড়া ছুলে ফেলছে না? পত্রিকায় এত অধিক কবিতা ছাপা হয়েছে যে আজকাল কবিতা ছাপা হওয়াটাকে কবির কাছে কোনো উত্তেজনাকর ঘটনা মনে হয় না।
আব্দুল করিম নাহিদের প্রতি অভিমানের স্বরে বললো, দোস, এমন একটা ‘উৎকৃষ্ট’ কবিতা লিখে ফেললি, তা ম্যাগাজিনেও ছাপা হলো, অথচ কবিতাটা আমাকে কোনোদিন দেখালি না? এমন একটা কবিতা তুই আমার কাছেও গোপন রাখতে পারলি?
কবি নাহিদ কামাল অত্যন্ত বিমর্ষ বদনে করুণ চোখে আব্দুল করিমের মুখের দিকে তাকালো। তারপর বললো, তোকে তো কখনো মিথ্যা বলি না, আজ একটা সত্যি কথা বলবো, দোস্ত?
বল।
ওটা আমার কবিতা না।
মানে? আব্দুল করিম তাজ্জব বনে যায়।
নাহিদ নামের অন্য কোনো কবি - নাহিদ কথা শেষ করতে পারলো না। ওর কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল।
আব্দুল করিমও এতে কম কষ্ট পেল না। কিন্তু ওদের দু-জনের কেউই এ গোপন সত্যটি কারো কাছে প্রকাশ করলো না।
রাত্রে খেতে বসে নাহিদ আরেকবার তিরবিদ্ধ হলো। ওর বাবা বললেন, ছাপা হলেই ভালো কবিতা হয় না। এবং কেবল ভালো কবিতাই ছাপা হয় না। ঐ এতটুকু ছড়ায় এত বানান ভুল, এত সাধু-চলিত রীতির মিশ্রণ হয়েছে যে ছয় লাইন পড়েই আমার বিরক্তি ধরে গেছে। বিষয়বস্তুরও তো আগামাথা নাই।
ওর মা অবশ্য সাহায্যের হাত বাড়ালেন। পুত্র-কবির পক্ষাবলম্বন করে বললেন, একটু সংশোধন করে দেবে কী, তার বদলে ক্রিটিসাইজ করা শুরু করে দিলে। এটাই কি ওর প্রথম ছাপা হওয়া কবিতা না? ভুলচুক তো হবেই। রবীন্দ্রনাথও কি তাঁর প্রথম লেখাটা নির্ভুল লিখতে পেরেছিলেন?
নাহিদ মায়ের কথায় প্রচুর উৎসাহ পেল। কাজেই রাত্রে সে আরো একটা কবিতা লিখতে পারলো। পরদিন সকালে বারান্দায় চেয়ারে বসে মা চা পান করছিলেন। নাহিদ এসে বললো, এই কবিতাটা কারেকশান করে দাও। মা সাধারণ বিষয়ে আর্ট্স থেকে বিএ পাশ করেছিলেন। তিনি কবিতা তেমন বোঝেন না। তবু কবিতাটা পড়ে নিয়ে বললেন, ‘শাদা’ বানানটার শুদ্ধ বানান হবে সাদা, আর ‘নরোম’ বানানটা হবে নরম।
নাহিদ বললো, মা, আধুনিক কবিতার বানানরীতি এ-রকমই। আধুনিক কবিতায় কবি ইচ্ছেমতো নিত্য নতুন শব্দ সৃষ্টি করতে পারেন এবং নিজস্ব স্টাইলের বানানরীতি অনুসরণ করতে পারেন।
সাহিত্যে ছেলের জ্ঞানের গভীরতা দেখে মা অতিশয় মুগ্ধ হলেন। কিন্তু তাঁর মনে হলো কবিতাটাতে যেন কেমন একটু প্রেমের ছোঁয়া আছে। আমার পুত্রধনটি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে না তো? আশংকাগ্রস্ত জননী চিন্তিত মুখে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিস?
… দেশকে। এটা একটা দেশপ্রেমমূলক কবিতা। … তুমি আছো আমার প্রাণের গভীরে প্রিয় …। কবির উত্তর।
কবি-মাতা আশ্বস্ত হলেন বটে, তবে তাঁর কাছে এটাকে দেশপ্রেমমূলক না হয়ে বরং নারীপ্রেমমূলক কবিতাই মনে হতে লাগলো। ছেলের ধৃষ্টতায় তিনি মনে মনে একটু ক্ষুব্ধও হলেন, মায়ের মুখের সামনে যেভাবে অবলীলায় ‘প্রেমমূলক’ শব্দটা উচ্চারণ করলো, তিনি ভাবলেন, আমাদের মা-বাবার সামনে আমরা কি কখনো তা পারতাম? কবিতা লিখতে লিখতে ছেলেটা মনে হচ্ছে বেশ নির্লজ্জ হয়ে উঠেছে।
৪.
‘সমাহার’ পত্রিকাটির আর কোনো হদিস মিললো না। কত আশায় বুক বেঁধেছিল নাহিদ, সমাহারে তার কবিতা ছাপা হবে, সে দেখবে, বাড়ির সবাইকে দেখাবে, বন্ধুবান্ধবদের দেখাবে। সমাহারই হলো একমাত্র পত্রিকা যার সম্পাদকের দপ্তর থেকে কবিতা ছাপা হওয়ার ব্যাপারে সে চিঠি পেয়েছিল। এমন নিশ্চিত অবস্থায়ও কবিতাটি ছাপা না হওয়ায় নাহিদ বাস্তবিকই খুব মুষড়ে পড়েছিল।
এভাবে আশানিরাশার কাব্যসমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে একসময় দেখলো পরীক্ষা দোরগোড়ায়। অতঃপর যা হবার তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। নাহিদ এবং আব্দুল করিম এবারও যথারীতি ফেল করলো। তুহিনকে অবশ্য পাশ করতে বেগ পেতে হয় নি। তবে এটাও ঠিক যে বড়ো ভাইকে ডিঙ্গিয়ে পাশ করার ফলে গর্বে এখন তার মাটিতে পা পড়ে না।
নাহিদের বাবা অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলেন। কবিতার খাতাগুলো দলে-মুচড়ে জড়ো করে আগুনে পুড়তে গেলেন। ওর মা থামালেন। নিজের প্রতি নাহিদের খুব রাগ হলো, অভিমানও হলো। সবাই কটু কথা বলে, ধিক্কার দেয়। বড়োবোন পাত্তা দেয় না। ছোটোরাও সম্মান করে কথা বলে না।
আব্দুল করিম এসে অস্থিরভাবে পাশে বসে বললো, দোস রে দোস, খবর ভালো না রে প্রিয় দোস।
কী হয়েছে, বন্ধু? নাহিদ করুণভাবে আব্দুল করিমের দিকে মুখ তুলে তাকায়।
লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বলে অসহায়ের মতো নাহিদের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আব্দুল করিম। অন্তরের গভীর দুঃখগুলো যেন আরো স্পষ্ট হয়ে তাদের মুখাবয়বে ফুটে উঠতে থাকলো। কারো কোনো কথা নেই, শুধু চেয়ে থাকা। নীরবতা ঘনীভূত হতে থাকে।
এখন তাহলে কী করবি দোস? নাহিদ জিজ্ঞাসা করে।
কী আর করার আছে? আব্দুল করিম বলে, আমাকে আর দেশে রাখবে না। মিডল ইস্টে পাঠিয়ে দিচ্ছে চাকরির জন্য।
কীসের চাকরি?
চাকরি না রে দোস, বল চাকরামি। আব্দুল করিম জানায়।
অর্থাৎ? নাহিদ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
অর্থাৎ চাকর + আমি = চাকরামি। কোনো কাজ শিখেছি আমি? চাকরামি ছাড়া তো আমি আর কিচ্ছু করতে পারবো না।
তাহলে মিডল ইস্টে কেন, দেশেই তো কত চাকরামির কাজ আছে?
শত ‘চাকরামি’ থাকলেও বেতন তো নাই। বিদেশে মেথরের কাজ করলেও কেউ জানবে না। জানবে আমি একজন বিদেশের চাকুরে, মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসবে। আর দেশে কাজ করলে যেমন ভালো বেতন পাব না, অন্যদিকে দামও নাই।
ডানবাম সব ভেবে আমিও স্থির করে ফেলেছি, দোস, নাহিদ বলে।
কী করবি তুই? আব্দুল করিম ব্যাকুলভাবে জানতে চায়।
কবিতা লেখা বন্ধ করে দেব …
ষাট ষাট … আব্দুল করিম ডানহাত বাড়িয়ে নাহিদের মুখ বন্ধ করে ধরে। বলে, দোহাই তোর, ও-কথা মুখে আনিস না দোস। কবিতা লেখা তুই বন্ধ করবি না, খবরদার।
কী হবে কবিতা লিখে? ভালো কবিতা কেউ ছাপে না। দু-বছর লিখে লিখে পণ্ডশ্রমই হলো। আর নয়। নাহিদের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ অভিমানের স্বর।
আব্দুল করিম বলতে থাকে, কে বলে ভালো লেখা কেউ ছাপে না? আমি ছাপবো তোর লেখা।
নাহিদ বুঝতে পারে না আব্দুল করিমের কথা। তার কপাল কুঞ্চিত হয়, সে অবাক হয়।
আব্দুল করিম বলে, তোর লেখা আর কেউ না ছাপুক, আমি ছাপবো। আমি চাকরি করবো, টাকা রুজি করবো। আমার টাকায়ই তোর প্রথম কবিতার বই ছাপা হবে, ঝকঝকে অফসেট পেপারে। আমি তো আর লিখতে পারি না। তাই বিনিময়ে তোর কাছ থেকে একটা মাত্র প্রতিদানই চেয়ে নিচ্ছি, কবিতার বইটিতে অন্তত এক জায়গায় আমার নামটা ছাপবি। ওহ্, ছাপার অক্ষরে কতই না সুন্দর দেখাবে আমার প্রিয় নামটি - আব্দুল করিম। বলতে বলতে তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
৫.
আব্দুল করিম মিডল ইস্টে চলে গেছে, রেখে গেছে প্রতিশ্রুতি। পুরো উদ্যমে নাহিদ লেখনি চালিয়ে যাচ্ছে। আব্দুল করিম টাকা পাঠাবে। নাহিদের কবিতার বই ছাপা হবে - ‘ফুটন্ত কলি’। নাহিদকে বেশি ভাবতে হয় না কাকে সে এ বইটি উৎসর্গ করবে।
একদিন ডাকযোগে নাহিদের নামে একটা ম্যাগাজিন এলো। হাতে নিয়ে দেখে ‘সমাহার’। সবেগে পাতা উলটোতে থাকে সে। কবিতার পাতা বের হতেই তার কবিতাটা চোখে পড়ে - ‘জীবন প্রবাহ’। সুস্পষ্ট অক্ষরে কবির নাম লেখা - নাহিদ কামাল। আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে সে। লতাকে দেখায়। রুবিনাকে দেখায়। কোহিনূর, তুহিন, সবাইকে দেখায়। ওর মা বললেন, তোর এবারের কবিতাটা ভালো হয়েছে। আব্বু বললেন, আগেরটার চেয়ে সামান্য ইম্প্রুভ করেছ।
আব্দুল করিম আজ কাছে নেই, নাহিদ ভাবে, থাকলে সে-ই সবচেয়ে বেশি খুশি হতো।
একদিন একটা বুকস্টলে আনমনে একটা ম্যাগাজিন নাড়াচাড়া করছিল নাহিদ। হঠাৎ তার চোখে পড়লো প্রায় মাস ছয়েক আগে পাঠানো একটি কবিতা ছাপা হয়েছে। সে ম্যাগাজিনটার দুই কপি কিনে আনে। একটা কপি বাসায় সংগ্রহে রাখে, অন্যটি থেকে কবিতার পাতাটা কেটে আব্দুল করিমের কাছে পাঠিয়ে দেয়। জবাবে মিডল ইস্ট থেকে আব্দুল করিমের উষ্ণ অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা আসে, আসে প্রেরণাদীপ্ত চিঠি।
নাহিদ এখন দেশের প্রায় প্রতিটি ম্যাগাজিনেই লেখা পাঠায়। প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসেই পাঠায়। প্রতিটি সংখ্যা বের হবার প্রতীক্ষায় সে সর্বদা ব্যাকুল থাকে।
মাস ছয়েক তো হলোই আব্দুল করিম মিডল ইস্টে গেছে। সে চাকরিও পেয়েছে ইতোমধ্যে। শীপইয়ার্ডে চাকরি। ওয়েল্ডারের হেল্পার সে, লোহা টানে, হ্যামার পেটায়, যখন যা আদেশ হয় মুখ বুঝে সে সবই করে। তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তবে একটাই সান্ত্বনা, তাকে মেথরের কাজ ধরতে হয় নি। বেতন মন্দ নয়। প্রথম মাসের বেতনের পুরোটাই সে বাড়িতে পাঠিয়েছে। দ্বিতীয় মাস থেকে পুরো বেতন বাড়িতে না পাঠিয়ে তা থেকে কিছু অংশ কেটে রেখে জমানো শুরু করেছে। আগামী মাস ছয়েকের মধ্যেই একটি কবিতার বই ছাপানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থ দেশে পাঠাতে পারবে বলে সে সুনিশ্চিত। কতই বা আর খরচ পড়বে একটা কবিতার বই ছাপতে? পনর হাজার? বড়োজোর বিশ হাজার? এটা জোগাড় হয়ে যাবেই।
আরো একটা ম্যাগাজিনে নাহিদের একটা কবিতা ছাপা হলো। এবারো কবিতার একটা কাটিং সে আব্দুল করিমের কাছে পাঠিয়ে দিল।
একদিন সত্যিই নাহিদের নামে টাকা এলো। হাতে টাকা পেয়ে তার চোখে পানি আসার উপক্রম হলো - এতদিনে তার বইটি তাহলে সত্যি সত্যিই আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। বাংলা বাজারে প্রকাশকদের কাছে সে অনেক ধরনা দিয়েছে। বই ছাপানোর সমস্ত টাকাই লেখককে দিতে হবে, কোনো প্রকাশক বিনা খরচে বই বের করবেন না। আব্দুল করিমের এই টাকা হলো বই ছাপানোর সেই টাকা। আব্দুল করিমের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার অন্তর ছেয়ে গেল। এখন তাকে কোনো প্রকাশকের কাছে ধরনা দিতে হবে না। ছাপাখরচ দিলে যে-কোনো প্রকাশকই বই প্রকাশ করতে আগ্রহী হবেন।
নাহিদ প্রেসে গেল। সে অবশ্য নিজেকে একজন কবি বলে পরিচয় দিতে সংকোচবোধ করছিল। নিজের টাকায় নিজের বই ছাপানো হচ্ছে শুনতে পেয়ে কেউ ঠাট্টা-মশকরা করে বসতে পারে। তাই সে আসল নাম-পরিচয় গোপন রেখে নিজের নামটি আব্দুল করিম বলেই সবাইকে জানালো।
বই যথাসময়ে ছাপা হলো। নাহিদের বয়োজ্যেষ্ঠ ফ্রেন্ড জহিরুল ইসলাম ঢাকা আর্ট্স কলেজের ছাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে সে এখন তার গ্রামের বাড়ি গাজীরটেক এসেছে। নাহিদ তাকে দিয়ে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকালো। প্রস্ফুটনোন্মুখ একটি গোলাপের ছবি। গোলাপটি ফুটছে - ফুটন্ত কলি। কবি নাহিদ কামালও যেন আজ একটি কলিমাত্র, যে কুঁড়ি থেকে সদ্য ফুটে বেরিয়েছে। তার কবিপ্রতিভা আজ জনসমক্ষে প্রস্ফুটনের পথে।
চমৎকার বাঁধাই হয়েছে বইটির। ঝকঝকে অফসেট পেপারে অক্ষরগুলো যেন ঝলমল করছে। বইটি নাড়ে, পৃষ্ঠা উলটোয়। ‘উৎসর্গ’ পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রয়েছে- ‘আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু, তরুণ আবৃত্তিকার আব্দুল করিম। লেখাটি বার বার দেখে আর কেবল আব্দুল করিমের কথা ভাবতে থাকে নাহিদ - প্রাণপ্রিয় বন্ধুটি আজ দেশে নেই, থাকলে তার কত আনন্দ হতো। অত্যধিক আনন্দে জহিরুল ইসলামও খুব এক্সাইটেড হয়ে পড়লো, এটি তারও জীবনে সৃজনশীলতার প্রথম আত্মপ্রকাশ। সৃষ্টির আনন্দের সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।
নাহিদের বাবা বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বললেন, কে ছাপলো?
আব্দুল করিম। নাহিদ জবাব দেয়।
এত ভালো লিখেছিস, তো আমাকে কখনো বই ছাপানোর কথা বলিস নাই কেন? আমার কি টাকার কমতি ছিল?
তোমাকে আর কী বলবে, নাহিদের মা রাগত স্বরে বলে ওঠেন, মাস্টার হয়েছ বলে সবকিছুতেই মাস্টারি ফলাতে চাও। কেবল তো সমালোচনাই করলে এতদিন, কখনো দু-কলম লিখতে পেরেছ? যা-ও ছেলেটা লিখেছে, বানান ভুল, দাড়ি নেই, কমা নেই করে করে ওর উৎসাহটাই দিয়েছ শেষ করে।
ছামাদ সাহেব অপরাধ স্বীকার করলেন। অবশ্য এ অবস্থায় অপরাধ স্বীকার করে নেয়া ছাড়া তার কোনো উপায়ও নেই। ডাইয়ারকুম প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার তিনি। তাঁর যে প্রজ্ঞা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা তা দিয়ে তিনি অনায়াসে যে-কোনো উচ্চ সরকারি পদ লাভ করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে পাড়াগাঁয়ের এই প্রাইমারি স্কুলটাকেই চাকুরিস্থল হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন। দোহার উপজেলার এই যে অখ্যাত একটি ছোট্ট গ্রাম, অন্ধকারে ঢাকা, হতদরিদ্র, জ্বরাক্লিষ্ট, অনাহারী মানুষেরা, যেখানে কেউ বিদ্যার মাহাত্ম্য বোঝে না বলে কেউ বিদ্যার অন্বেষণও করে নি কোনোদিন, অথচ কী সুন্দর শ্যামল বৃক্ষ আর লতাপাতায় ঘেরা গ্রামটি - তিনি চেয়েছিলেন, সেই ডাইয়ারকুম গ্রামে আলো জ্বলুক, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখুক, আর দশটি গ্রামের মানুষের মতো ওরাও বিদ্যাশিক্ষায় প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুক। অসীম উৎসাহে তিনি নিজ জন্মস্থানের জন্য আত্মোৎসর্গ করলেন। পঞ্চাশোর্ধ ছামাদ সাহেব আজ এ গ্রামের পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। শুধু এ গ্রামেই নয়, আশেপাশের গ্রাম সুতারপাড়া, ঝনকী, দোহার, বানাঘাটা, ঘাড়মোড়া - সব গ্রামেই রয়েছে তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী, যে সকল ছাত্রছাত্রীর ছেলেমেয়েরাও বহু আগেই তাঁর কাছে স্কুলের পাঠ শেষ করে ফেলেছে। এই কীর্তিমান পুরুষটির সামনে যে কেউ এসে দাঁড়ালেই তিনি তার মুখ না দেখেও বুঝতে পারেন যে সম্মুখে দণ্ডায়মান মানুষটা কোনো এককালে তাঁর ছাত্র ছিল। কালের প্রবাহে ঘরে কী বাইরে তাই প্রত্যেকটা মানুষকেই আজ তাঁর ছাত্র মনে হয়, এবং তাদের সাথে তাঁর কথাবার্তা এবং ব্যবহারও নিছক ছাত্রশিক্ষকের মতোই। তাঁর অমায়িক আর ভদ্র আচরণের কাছেও তেমনি সবাইকে মস্তকাবনত হতে হয়।
এমন গুরু গম্ভীর হেডমাস্টার মহোদয় বাস্তবিকই ছেলের নাবালকসুলভ সাহিত্যচর্চার উৎকর্ষসাধন বিষয়ে কোনোরূপ মাথা ঘামান নি। বার বার পরীক্ষায় ফেল করায় তিনি বরং বিরক্তই হয়েছিলেন। যখন দেখলেন তাঁর পাগল ছেলেটি ইতোমধ্যে একটি বই বের করে ফেলেছে, তাকে উৎসাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে বললেন, ঠিক আছে, লিখে যাও। পরের বই আমিই ছেপে দেব।
বাবার কথায় নাহিদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল প্রচুর, সে সত্যিকারেই ভালো লেখে। সে বার বার বইটি খুলে পড়ে, পৃষ্ঠা নাড়ে। তার খুব ভালো লাগে।
পঞ্চাশ কপির মতো সৌজন্য কপি বিতরণ করলো নাহিদ। তুহিন, রুবিনা, কোহিনূর, ওরা সবাই এক কপি করে পেয়েছে। কেবল আব্দুল করিমই এখনো পায় নি।
একদিন প্রচুর টাকা খরচ করে আব্দুল করিমের নামে তিনটি কপি বুকপোস্ট করে পাঠানো হলো মিডল ইস্টের দেশ সউদী আরবে। একটি কপি আব্দুল করিম সেখানে তার কোনো এক কাছের বন্ধুকে উপহার দিতে পারবে। নিশ্চয়ই আমার মতোই এতদিনে তার কেউ একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু তৈরি হয়েছে সউদী আরবে, নাহিদ ভাবে, সেখানে কি কবি থাকতে পারে না? দ্বিতীয় কপিটি আব্দুল করিম সর্বদা হাতের কাছে রাখবে পড়ার জন্য। আর তৃতীয় ও শেষ কপিটি সে খুব যত্ন করে সংগ্রহে রেখে দেবে, কেননা, হাতের কাছের কপিটা হারিয়ে যেতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে, বা পোকায়ও তো কাটতে পারে। তখন ভেতর থেকে তৃতীয় কপিটি বের করে আব্দুল করিম আবৃত্তিচর্চা অব্যাহত রাখতে পারবে।
৬.
আরো কিছুদিন পরের কথা।
নাহিদ জয়পাড়া বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিল। আব্দুল করিমদের বাড়ির কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ালো। বাড়িময় কান্নার রোল উঠেছে। বাইরের বাড়িতে প্রচুর মানুষের সমাগম। কী এক অজানা আশংকায় তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। নাহিদ দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কী হয়েছে?
টেলিগ্রাম …
কীসের টেলিগ্রাম?
কেউ ঠিকমতো জবাব দিচ্ছে না। অথচ নাহিদ অন্তরে অন্তরে ঠিকই জেনে গেছে এ কীসের ডামাডোল। তবু সে মনকে প্রবোধ দিতে চাইছে, না, আমি যা ভাবছি তা নয়, তা নয়। নিশ্চয়ই অন্যকিছু। সে চাইছে তার জিজ্ঞাসার জবাবে কেউ একজন বলুক, এ টেলিগ্রাম সউদী আরব থেকে আসে নি, এ টেলিগ্রামে আব্দুল করিমের, তোমার প্রাণাধিক প্রিয় দোস্তের মৃত্যুর ঘটনা লেখা হয় নি।
আব্দুল করিম অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
আকাশ ফালি ফালি হলো, প্রচণ্ড ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হলো সারি সারি বৃক্ষলতা, বিকট শব্দে পৃথিবীর বুক ফেটে চৌচির হলো, কিন্তু নাহিদের বিশ্বাস হলো না যে এ ঘটনা সত্য। কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। সে আবার জিজ্ঞাসা করে, বার বার জিজ্ঞাসা করে, ঘটনা কীভাবে ঘটলো? কবে ঘটলো? কেউ উত্তর দেয় না। কেউ তার কথা কানেও তুলছে না। কেউ প্রশ্ন শুনতেও পায় না, শুনতে পেলেও কারো উত্তর দেয়ার কোনো ফুরসতই যেন নেই। আব্দুল করিমের মা-বাবা-ভাইবোন সবাই কাঁদছে। কাঁদছে প্রতিবেশিরা। আহূত মানুষেরা আফসোসে ফেটে পড়ছে, দরদর বেগে অশ্রু ঝরছে।
নাহিদের বুক ফেটে যাচ্ছিল কান্নায়। কিন্তু কাঁদতে পারছিল না। ওর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কাঁদতে পারছিল না।
কীভাবে সে বাড়ি চলে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর টেবিলে হাত পা মুখ আছড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো … ক..রি..ম রে... ও বন্ধু ... বন্ধু রে …
আব্দুল করিমের মৃতদেহ বাড়ি আসতে দশ দিনের মতো লেগে গেল। মাথাটা একদম থ্যাবড়া খেয়ে গেছে। সমতল থেকে প্রায় পঁচিশ ফুট ওপরে সে কাজ করছিল। হঠাৎ পা ফসকে যায়, এবং কোনো অবলম্বন ধরে ফেলার আগেই নীচে এবড়োথেবড়ো ভাবে ছড়ানোছিটানো অসংখ্য লোহার পাত আর রডের মাঝখানে ধ-পা-স করে মাথা-নীচে অবস্থায় পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বেল ফাটার মতো শব্দে মাথার খোলটি ফেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে চারদিকে মগজ, মাংস আর রক্ত ছড়িয়ে পড়ে।
শেষ বারের মতো কাফনে মুখ ঢাকবার আগে যখন সবাইকে একনজর করে দেখানো হলো, আব্দুল করিমকে কেউ চিনতে পারলো না।
পাদটীকাঃ
আব্দুল করিমকে ওদের বার বাড়ির কাছে পথের ধার ঘেঁষে বাতাবি নেবুর ছায়ার নীচে কবর দেয়া হয়েছে। এ-পথে ওরা কলেজে যেত।
নাহিদ তৃতীয়বারের মতো পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজও সে এ-পথে কলেজে যাতায়াত করে। আব্দুল করিম যায় না, সে বাতাবি লেবুর শীতল ছায়ার নীচে শুয়ে আছে। কারো পদধ্বনি কি সে শুনতে পায়? কবরের পাশটাতে এলেই কষ্টে নাহিদের বুক ফেটে যায়।
নাহিদ এখন পুরোদমে কবিতা লেখে। কত কত ম্যাগাজিনে তার কবিতা ছাপা হয়। একেবারে পরিচিতদের নিয়ে নাহিদের একটা নিজস্ব ভক্তকুলও তৈরি হয়ে গেছে, যারা ওর প্রতিটি কবিতার জন্য অধীর প্রতীক্ষায় থাকে। তারা সবাই ওর কবিতা পড়ে। আব্দুল করিম পড়ে না।
রচনাকালঃ মার্চ ১৯৯৪
* এ গল্পের আগে ক্লাস নাইন বা টেনে থাকা কালে আরো দু-একটা গল্প লিখেছিলাম; কিন্তু সেগুলোর বিষয়বস্তু কী ছিল তা মনে নেই; ওগুলো যে-খাতায় লেখা ছিল তা কয়েক যুগ ধরে নিখোঁজ বা নিহত
**
ছোটোগল্প সংকলন 'সুগন্ধি রুমাল'-এর অন্তর্ভুক্ত। (২০০৪ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত)
**
সুগন্ধি রুমাল কেউ ডাউনলোড করতে চাইলে প্লিজ এই লিংকে ক্লিক করুন
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:০৩
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জি, গল্পটা বড়োই। তবে, আমি সচরাচর এর চেয়েও বড়ো গল্প লিখি রে ভাই
২| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:০৬
সম্রাট ইজ বেস্ট বলেছেন: আমিও একটা ছোটখাট গল্প লিখছি। সময় হলে পড়ে আসবেন। আমন্ত্রণ রইল।
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:১০
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জি, যাব। ধন্যবাদ নিমন্ত্রণের জন্য।
৩| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:০৮
নূর আলম হিরণ বলেছেন: রুবিনারে খোঁচা মারা পর্যন্ত আসতে পেরেছি। ব্লগে কবিদের নিয়ে এলার্জি দেখা যাচ্ছে ইদানীং তবে শেষমেশ কি নাহিদ কবি হতে পেরেছিলো?
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:১১
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: নাহিদ সা'ব যে একজন কবি, তা তো প্রথম লাইনেই বোঝা গেলো
৪| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:২৫
কালীদাস বলেছেন: সময়ের সাথে আপনার লেখার স্কিলের পার্থক্য বোঝা যায়, তখন সম্ভবত মাত্র লেখালেখি শুরু করেছিলেন। গল্পটা শুরুর দিকে খুব ফ্লুয়েন্ট না লাগলেও পরে একটানে পুরোটা পড়ে শেষ করেছি। ইভেন রুবিনার সাথে ইটিস পিটিশ শুরু হয়ে যায় কিনা সেটা নিয়েও খানিকটা কনফিউজড ছিলাম শুরুতে প্লটটা হৃদয়গ্রাহী মেইনলি ফিনিশিংএর জন্য।
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৯
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ চমৎকার বিশ্লেষণের জন্য। এটা আমার প্রথম গল্প। এর আগে একটা কী দুটো গল্প লিখেছিলাম, ক্লাস নাইন বা টেনে থাকা কালে। সেগুলোর থিম কী ছিল তাও ভুলে গেছি। ওগুলো যে-খাতায় লেখা ছিল তা অনেক কাল আগেই হারিয়ে গেছে। কাজেই স্বীকৃতভাবে এটাই আমার প্রথম গল্প।
স্কিলের পার্থক্য??? আর হাসাইয়েন না। এখনই যে-স্কিল, তার আবার পার্থক্য
আবারও ধন্যবাদ জানবেন।
৫| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:২৬
কালীদাস বলেছেন: বাইদ্যাওয়ে, প্রচলিত ছোট গল্প বলতে যা বোঝানো হয়, এটা মনে হয়না ঠিক সেই ফরম্যাটে পড়ে। আমার ভুলও হতে পারে
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: কোনো এক সময়ে তো ছোটোগল্পের ফরম্যাট বলতে রবীন্দ্রনাথের ফরম্যাটকেই বুঝতাম। কালের বিবর্তনে এখন দেখতে পাচ্ছি গল্পের আদতে কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাটই হয় না। একেকজন একেকটা স্টাইল বা ফরম্যাটে লিখতে চেষ্টা করেন এবং তার মধ্য দিয়েই স্বকীয়তার দিকে এগোতে থাকেন। এ হলো আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে মতামত।
অসংখ্য ধন্যবাদ।
৬| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:৩১
চাঁদগাজী বলেছেন:
আপনার শুরুর দিকের গল্পটা পড়লাম।
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ প্রিয় চাঁদগাজী ভাই।
৭| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৭
সকাল রয় বলেছেন: বেশ ভালোই। মনযোগ দিয়ে পড়লে লেখার স্বকীয়তাটা বুঝা যায়
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৪
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ধন্যবাদ সকাল রয়। অনেক দিন পর দেখলাম আপনাকে। আশা করি ভালো আছেন/ছিলেন।
৮| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৩
মো: নিজাম উদ্দিন মন্ডল বলেছেন: ধূর, ভাই! এত বড় লেখা? পরে পড়বো।
দেশে কবির সংখ্যা কাকের সংখ্যার সমান--- এই জন্য আমি কবিতা লিখি না
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৫
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: হা হা হা। কবির সংখ্যা যাদের সমানই হোক না কেন, আমি কবিতা লিখবোই কবিতা না লিখলে ভালো লাগে নাহ
৯| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৪
বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: প্রথম লেখা। সমালোচনার কিছু নেই। মন্দ হয়নি।
তবে ছোটোগল্প বড় হয়ে গেছে।
আশা করি এখন ছোটো হয়ে গেছে।
শুভেচ্ছা।
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৬
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: বড়ো হয়ে যাওয়া ছোটোগল্পটি পড়ে ফেলার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। আমার একটা টেন্ডেন্সি আছে না-উপন্যাস না-ছোটোগল্প ধরনের গল্প লেখার, যাকে উপন্যাসিকা বা নভেলা বলা যেতে পারে। এরকম কিছু গল্প নিয়ে ২০০৬ সালের দিকে কয়েকজন লেখকের একটা যৌথ সংকলনও বের করেছিলাম। অন্যদিকে, খুবই ছোটো সাইজেরও গল্প লেখার একটা বাতিক আছে, যেটাকে আমি 'গল্প-কণিকা' নাম দিয়েছি, যেগুলো ৪-৫ লাইন থেকে এক পৃষ্ঠা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আবারও ধন্যবাদ জানবেন।
১০| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৮:৪৩
ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: প্রথম টুক পড়লাম, শেষ টুক পড়লাম।
এখন বলেন, আব্দুল করিম কে?
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৯:০৬
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: প্রথমটুকু আর শেষটুকু পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আব্দুল করিম আর কেউ নন, প্রসিদ্ধ গল্পকার জনাব খলিল মাহ্মুদ সাহেব বিরচিত বিখ্যাত ছোটোগল্প 'কবিতার জন্য'-এর একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র। তথ্যটি জেনে আশা করি প্রভূত উপকৃত হইলেন (এটা বিসিএস-এর ভাইবাতে আসবে)।
১১| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৯:১৩
ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন:
৩১ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৯:৫৭
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন:
১২| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:১৬
ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: আমি এইবার কলেজে উঠবো, বিসিএস দেরি আছে -_-
০১ লা এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪২
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: ওয়াও। এসএসসির রেজাল্টের জন্য শুভ কামনা থাকলো। ক্রিটিকাল টাইম। আগামী দুই বছর ব্লগ ও ফেইসবুক যাতে নেশা না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আমার পরামর্শ- এগুলো থেকে দূরে থাকুন।
১৩| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৫:২৫
এম এ কাশেম বলেছেন: কবির অনাদর অবহেলা বারে বারে ব্যা্র্থতা থেকে সফলতায় উত্তরনের কাহিনী - নিজের আত্মকথা নয় তো?
গল্প - স্বাভাবিক সহজ আঁকা বাঁকা বন্ধুর পথ বেয়ে চলে গেছে উত্থান পতনের করুণ পরিনতির পথে ।
শুভ কামনা কবি ও গল্পকার।
০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ৯:২৮
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। শুভ কামনা আপনার জন্য।
১৪| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:৫৮
জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: পড়লাম। ভালো লেগেছে। আব্দুল করিমের এক্সিডেন্ট এবং মৃত্যু'টা বুকের ভেতর'টা নাড়িয়ে দিলো। (গতমাসে আমার এক বাল্যবন্ধু সৌদিআররে এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। তাকে খুব মনে পড়ছে।)
০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৪৫
সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: আপনার বাল্যবন্ধুর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
গল্প পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:০০
সম্রাট ইজ বেস্ট বলেছেন: এতবড় গল্প পড়তে গিয়ে হাঁপ ধরে গেল। শেষমেষ রণেভঙ্গ দিলাম। পরে সময় নিয়ে পড়ব।