নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শব্দকবিতা : শব্দেই দৃশ্য, শব্দেই অনুভূতি [email protected]

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই

দুঃখের কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা। ভালোবাসা হলো দুঃখ, এক ঘরে কবিতা ও নারী।

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই › বিস্তারিত পোস্টঃ

তুই ফেলে এসেছিস কারে : শাহনাজের ফোন এবং ওর মন

২৮ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:২৭

শাহনাজ যখন আমাকে ফোন করলো, তখন ওর ওখানে দুপুর একটা, আর আমি সবে রাত ১১টা পার করলাম।

- ‘হ্যালো, তুই কে?’ আমি আমার গতানুগতিক প্রশ্ন করতেই শাহনাজ হেসে দিয়ে ওর গতানুগতিক জবাব দেয়- আমারে চিনবি না রে :)

‘হ্যালো, তুই কে?’ - এটা আমার খুবই প্রিয় একটা প্রশ্ন। আমার অন্তরঙ্গ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, এমনকি শ্যালক-শ্যালিকারাও যখন আমাকে ফোন করে, কল রিসিভ করেই প্রশ্নটা করি - ‘হ্যালো, তুই কে?’ এটা ওদের সদাশয় বদান্যতা যে, দিনের পর দিন আমার এই প্রশ্নটা শুনেও ওদের কাছে কখনো একঘেঁয়ে মনে হয় নি, ওরা কোনোদিন বিরক্তও হয় নি – বরঞ্চ ফিক করে হেসে দিয়ে একেকজন একেক রকমের একেকটা উত্তর দিয়ে থাকে, যেমন শাহনাজের উত্তর ঐ একটাই – ‘আমারে চিনবি না রে’! আর, এই যে ওরা একগাল ফিক-করা হাসি দিয়ে আমাকে রিপ্লাই দেয়, এটাই আমাকে আনন্দ দেয়; সত্যি কথা, ওদের এরকম একটা রেসপন্স শোনার জন্যই আমি এ প্রশ্নটা করে থাকি।

‘আমারে চিনবি না রে’ – শাহনাজের এ উত্তর শোনার পর আমি অবাক হবার ভান করে বলি- ‘ওওও, তুই!’ তারপর ক্ষুদ্র একটু দম নিয়ে, ওর উত্তর দেয়ার আগেই বলে ফেলি, ‘আচ্ছা বল তো, তোর ঐখানে এখন কয় তারিখ?’ শাহনাজ গত নভেম্বরে নিউ ইয়র্কে যাবার পর আরও ২/৩ বার কল করেছিল। প্রতিবারই আমার কমন প্রশ্ন ছিল- ‘বল তো, তোর ঐখানে এখন কয় তারিখ?’ ও একটু সময় নিয়ে হিসাব করে যে তারিখ বলতো, তাতে দেখা যেতো আমেরিকা বাংলাদেশের চেয়ে দুই দিন এগিয়ে আছে। ওর হিসাব মতে আমেরিকার তারিখ এভাবে দুই দিন এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো, ওর হিসাবটা ছিল খুব অদ্ভুত। ওর অদ্ভুত হিসাবের রহস্যটা সহজ করে বুঝিয়ে বলি- বাংলাদেশে ২২ এপ্রিল সকাল ৮টায় নিউ ইয়র্কে ২১ এপ্রিল রাত ১০টা হয়; শাহনাজ শুধু বাংলাদেশের তারিখটা মনে রাখে, আর তা থেকে ১দিন বিয়োগ না করে ১দিন যোগ করে ফেলে। ফলে বাংলাদেশের সময় থেকে আমেরিকা ১দিন পিছিয়ে থাকার বদলে ২দিন এগিয়ে যায় :)

ওর দিনতারিখে এরূপ ভুল হয় বলে একদিন সাধারণ একটা সূত্র বলে দিলাম : ‘তর ঐখানে দিন শুরু হইবার পর দুপুর ১টা পর্যন্ত বাংলাদেশ আর আমেরিকার দিনতারিখ একই থাকবে; দুপুর ১টার পর আমেরিকা ১দিন পিছাইয়া পড়বে, আবার রাত ১টায় বাংলাদেশ আর আমেরিকা দিনের হিসাবে একই লেভেলে চইলা আসবে।’ শাহনাজকে যখন এই ফর্মুলা বলছিলাম তখন আমেরিকা-বাংলাদেশ টাইম গ্যাপ ১১ ঘণ্টা ছিল, যা এখন ১০ ঘণ্টা। সুতরাং এ পোস্ট পড়ে যারা অংক কষতে বসবেন, তারা উপরে দুপুর ১টার জায়গায় দুপুর ২টা ধরে নিবেন, দয়া করে ;)

শাহনাজকে এবার দিনতারিখ বলতে বললে ও হেসে দিয়ে বললো, ‘আজ ২২ এপ্রিল। আর ভুল হবে না রে!’ বলে কিটকিট করে হাসতে থাকে। ‘যাক, তর বুদ্ধি আগের চাইতে বাড়ছে তাইলে। আমার ভালো লাগতেছে।’
- ‘কী করতেছিস?’
- ‘ফেইসবুকে গান লিখতেছি।’
- ‘বাহ! চমৎকার তো! কিন্তু তুই যে গান লেখস তা তো জানতাম না। ভালোই, তর প্রতিভা চাইরদিকে ছড়াইয়া পড়তেছে।’ শাহনাজ এসব বলে আর হাসতে থাকে। তারপর বলে, ‘গানে সুর করস নাই?’
- ‘হ, সুর দিসি তো। শুনবি?’ বলেই আমি গেয়ে উঠি, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন মন রে আমার।’ অমনি শাহনাজ গলা ফাটিয়ে হেসে উঠে বলে, ‘এই তর গান লেখা?’
- ‘হ। আমিই তো লিখতেছি। পুরাডা শুনবি না?’
- ‘শোনা। এত কইরা যেহেতু শুনাইতে চাইতেছস, না শুইন্যা কি উপায় আছে?’

তুই ফেলে এসেছিস কারে মন
মন রে আমার
তাই জনম গেলো শান্তি পেলি নারে মন
মন রে আমার

যে পথ দিয়ে চলে গেলি
সে পথ এখন ভুলে গেলি রে
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন
মন রে আমার

নদীর জলে থাকি রে কান পেতে
কাঁপে রে প্রাণ পাতার মর্মরেতে

মনে হয় যে পাবো খুঁজি
ফুলের ভাষা যদি বুঝি রে
যে পথ গেছে সন্ধ্যাতারার পাড়ে মন
মন রে আমার
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন
মন রে আমার

আমি পুরা গানটা গেয়ে ফেলি। গাওয়া শেষে শাহনাজের প্রান্ত নীরব। আমি বলি, ‘গানটার ১ম লাইন শুইন্যা তর যেমন হাসি পাইতেছিল, এখন ঠিক ততখানিই খারাপ লাগতেছে, তাই না?’
শাহনাজ খুব ধরা গলায় বলে, ‘হ। ঠিক বলছস। খুব ভালো গাইছস তুই। অনেক ভালো গাইছস।’

আমার ধেড়ে গলায় গাওয়া গানটা শুনে শাহনাজের মন খারাপ হয়ে যেতে পারে এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আন্দাজ করেছি। অনেক আগে, যখন আমি ঢাকায় ছিলাম, আমার টিএন্ডটি ফোনে আমাদের আরেক ক্লাসমেট ইমরানের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হতো। হাস্যচ্ছলে ইমরানকেও অনেক গান শুনিয়েছি। দেখতাম, ইমরানও নীরব হয়ে যায়। মন ভারী হয়ে ওঠে।

টাকার প্রয়োজনে রাজ্জাক ভাই (শাহনাজের জামাই) সুদীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকায় প্রবাস জীবন পার করছেন। শাহনাজেরর এক ছেলে বুয়েট, এক ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিল; ছোটো ছেলে ঢাকা কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ছিল। ওর সন্তানদের ভবিষ্যত শাহনাজ নিজহাতে গড়ে তুলছিল। কিন্তু সবকিছুর মায়া কাটিয়ে, নিজদেশে সন্তানদের শক্ত ভিত্তি গড়ে ওঠা সত্ত্বেও ওদেরকে চলে যেতে হলো সুদূর আমেরিকায়। সবকিছুর মূলে কাজ করেছে ছেলেদের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করা, সংসারকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা; বাংলাদেশে বসবাস করে সেই অর্থের সংকুলান করা রাজ্জাক ভাইয়ের জন্য সম্ভব ছিল না।

আমি বেশ ক’বার বিদেশে থেকেছি- কখনো এক বছর, কখনো এক মাস, কখনো বা দুই-তিন মাস দীর্ঘ ছিল সেই প্রবাসকাল। দেশে স্ত্রীছেলেমেয়ের সংসার, বন্ধুবান্ধব, চেনা পথঘাট ফেলে বিদেশের মাটিতে অল্প দিনেই আমি ‘নদীর মাছ ডাঙ্গায় তোলার মতো’ অবস্থায় পড়ে যেতাম। আমার মনপ্রাণ সবসময়ই ছটফট করতো। যেদিন ফিরতি বিমানে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম, উত্তেজনায় আমার সময় কাটতো না – কতক্ষণে আমি বাংলার মাটিতে নামবো! আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছতে! তারপর যখন ঢাকার বিমান বন্দরে নামতাম, মনে হতো আমি স্বর্গের দরজায় পা রাখছি। সুদীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বলতাম – এ আমার দেশের বাতাস! এ আমার দেশের আলো! কী মিষ্টি, কী গন্ধ, আহ, আমার বুক ভরে গেল, প্রাণ জুড়িয়ে গেল!

সোনার স্বদেশকে ছেড়ে গিয়ে স্বপ্নের আমেরিকায় মনে হয় শাহনাজের মন টিকছে না। কেবলই ঢাকা শহরে ফেলে যাওয়া দিনগুলোর কথা ওর মনে পড়ছে। ওর ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ঢাকায় বাস করে; ওর নাড়ি পড়ে রয়েছে ঢাকার দোহারে। চড়ুই পাখির মত শাহনাজ ঢাকা শহরের একগলি থেকে আরেক গলি, ভাইয়ের বাসা থেকে বোনের বাসা, দোহারে বাপ-দাদা-শ্বশুরের ভিটায় উড়ে বেড়াতো। মাঝে মাঝেই আমাদের ক্লাসমেটদের দাওয়াত দিত, জম্পেশ আড্ডা হতো! অন্য ক্লাসমেটদের বাসায় (এবং আমার বাসায়ও) ক্লাসমেটরা আসতো। জেনে রাখুন, সকল আড্ডায় শাহনাজই থাকতো মধ্যমণি। এসব ছেড়েছুঁড়ে, আমেরিকার বরফঢাকা ছাদের নীচে শাহনাজের মন কি টেকে? ওর মন কেবলই কাঁদে। ওর ক্রন্দসী মন যখন আমার কণ্ঠে শুনতে পেলো ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’, তখন ওর ভিতরে তূষের আগুন জ্বলে উঠছিল – ‘তাই শান্তি পেলি নারে মন মন রে আমার।’

দেশের মায়া এমনই। তুমি যেখানেই যাও, তোমার বুকে দেশ জ্বলতে থাকবে। স্বপ্নের দেশে তুমি যত সুখেই থাকো না কেন, তোমার মন সঙ্গোপনে কেঁদে কেঁদে খুন হতে থাকবে। তুমি দেশ ছেড়ে যেখানেই যাও, তোমার নাড়ির মূল রয়ে যায় বাংলাদেশের গভীরে। সেই নাড়ি কাটা যায় না, ছেঁড়া যায় না। যেদিন ছিঁড়ে যাবে, সেদিন তোমার মৃত্যু হবে।

শাহনাজ আর ওর সংসারের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা থাকলো; শুভ কামনা থাকলো নাড়ি ছিঁড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পড়ে থাকা প্রবাসী সকল ভাইবোনের জন্য।


২৪ এপ্রিল ২০১৪


-----

এটা পুরোনো লেখা। মাঝে মাঝেই রিপোস্ট করি। শাহনাজকে শোনানো গানটা আমার অনেক প্রিয় একটা গান। এ পোস্টটি যেদিন লেখা হয় (২৪ এপ্রিল ২০১৪), তার আগেও এটা গেয়ে একটা ক্যাজুয়াল রেকর্ডিং করেছিলাম। এরপর ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে আবার গেয়ে মিউজিক অ্যাড করে ইউটিউবে আপলোড করি। তার লিংক নীচে দেয়া হলো।

প্লিজ এখানে ক্লিক করুন - তুই ফেলে এসেছিস কারে

অথবা নীচের লিংকে ক্লিক করুন।


মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১২:৫২

রাজীব নুর বলেছেন: পুরোনো লেখা মাঝে মাঝে রিপোষ্ট করা মন্দ না। আমিও করি।

২| ২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:০৯

সৈয়দ মশিউর রহমান বলেছেন: পুরোনো গানগুলে এখনো মনকে দোলা দেয় কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো আমার ছেলে মেয়ে পুরোনো গান শুনলে রাগ করে বলে এগুলো কোন গান হলো?

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৪২

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: গানের পছন্দের ব্যাপারে জেনারেশন গ্যাপ একটা বড়ো ফ্যাক্টর। যে-কোনো যুগের যে-কোনো ক্যাটাগরির বাংলা গানই আমি শুনি ও পছন্দ করি। কিন্তু আমার ছেলেদের দেখি, ওরা প্রথমত বাংলা গান তেমন শুনতে বা গাইতেই চায় না। আর যেগুলো শোনে, সেগুলো শুধু এ যুগের গান, পুরোনো দিনের গানগুলো ওদের কাছে 'এন্টারটেইনিং' মনে হয় না।

বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নাই :(

৩| ২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:১৪

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: বেশ ছিল স্মৃতিচারণ মূলক লিখাটি!

তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার.....
কোন কারন ছাড়াই গানটি আমারও খুব প্রিয়।

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৪৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: লেখাটা পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ মল্লিক ভাই। শুভেচ্ছা নেবেন।

৪| ৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৪৮

খায়রুল আহসান বলেছেন: শাহনাজের মন কি সেখানে থীতু হতে পেরেছে? নাকেি সে ইতোমধ্যে পরিযায়ী সাইবেরিয়ান পাখির মত উড়াল দিয়ে স্বদেশে ফিরে এসে আবার চড়ুই পাখির মত ছোটাছুটি করছে?
গানটা চমৎকার গেয়েছেন, তবে মাঝের pause গুলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দীর্ঘতর হয়েছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সকাল ১০:৪৭

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: স্যার, ওর মন ওখানে থিতু হয়েছে বলে মনে হয় না; তবে, সে তল্পিতল্পা গুটিয়ে স্বদেশে ফিরেও আসে নি। জীবিকার প্রয়োজনে, ছেলেদের ভবিষ্যতের জন্য তাকে ওখানেই থাকতে হচ্ছে।

গানের pause-এর ব্যাপারে আপনারে অবজারভেশন শতভাগ ঠিক। গানটা আগে খালি গলায় গাওয়া ছিল। মিউজিক যোগ করা হয়েছে পরে। বিট বা তালের সাথে মেলানোর pause-গুলো ওরকম হয়েছে। তবে, গ্যাপ কমিয়ে নরমাল করা যাবে। এসব কাজের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। ভবিষ্যতে সেটা করার প্ল্যান আছে।

লেখাটা পড়ার জন্য এবং গানটা শোনার জন্য অনেক ধন্যবাদ স্যার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.