![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আলোর সন্ধানে
বিলাদত শরীফ
ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত ফতেহ্গড় তহসীলে অবস্থিত “সিরহিন্দ” নামক স্থানে হিজরী ৯৭১ সনে (১৫৬৩ ঈসায়ী) ১৪ই শাওয়াল বিলাদত শরীফ লাভ করেন । উনার পিতার নাম ছিল হযরত মখদুম আবদুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি।
একদিন হযরত বড় পীর গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি কোন জঙ্গলে মোরাকাবায় মশগুল ছিলেন । হঠাৎ আসমান থেকে একটি নূরের প্রকাশ ঘটল এবং তার জ্যোতিতে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠল । অত:পর হযরত গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে অবহিত করা হলো যে, এখন থেকে পাঁচ শত বৎসর পর পৃথিবীতে যখন শেরেক ও বিদয়াত ছড়িয়ে পড়বে একজন হক্কানী ওলী উ¤মতে হাবীবীর মধ্যে বিলাদত শরীফ লাভ করে শেরেক ও বিদয়াতকে নিশ্চিহ্ন করবেন এবং দ্বীনে হাবীবীকে সঞ্জীবিত করে তুলবেন । অত:পর হযরত গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজের খাছ খেরকা মোবারক কামালাতে ভরপুর করে উনার ছাহেবযাদা সাইয়্যিদ তাজউদ্দীন আবদুর রাজ্জাক রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে ওসীয়ত করেন : যখন ঐ বযুর্গ প্রকাশ হবেন, তখন আমার খেরকা উনাকে সোপর্দ করবে । সেই সময় থেকে খেরকা মোবারক হস্তান্তরিত হয়ে হযরত গাওসুল আজম-উনার বংশধর হযরত সাইয়্যিদ শাহ সিকান্দর রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট আমানত ছিল । তিনি হযরত ইমামে রব্বানী মোজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট এই বরকতময় খেরকা সোপর্দ করেন ।
তা’লীম ও তরবীয়াত
হযরত ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু, সেই সময় তিনি একবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন । উনার বাঁচার আশা ছিল না । ঠিক সেই সময় হযরত শাহ কামাল কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সিরহিন্দ শরীফে উপস্থিত হলেন । হযরতের পিতা উনাকে নিয়ে হযরত কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাযির হলেন । তিনি উনার পবিত্র জিহ¦া মুবারক শিশু হযরত ইমামে রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মুখে প্রবেশ করিয়ে দিলে তিন অনেকক্ষণ ধরে হযরত কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার জিহ¦া মুবারক চূষতে লাগলেন । হযরত শাহ কামাল কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি শিশুর বুযুর্গ পিতা হযরত মখদুম আবদুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন : আপনি শান্ত থাকুন, আপনার সন্তান দীর্ঘায়ূ এবং জবরদস্ত আ’লিম ও আ’রিফ হবেন । যদিও ইহা শিশুকালের ঘটনা, তথাপি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলতেন : আমার এখনও ঐ ঘটনা স্মরণ আছে ।
শিক্ষালাভ করার বয়সে উপনীত হলে হযরত ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মক্তবে ভর্তি করে দেয়া হল । অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কুরআন শরীফ হেফজ করে ফেললেন । অত:পর নিজের বুযুর্গ পিতার নিকট বিভিন্ন ইলেম শিক্ষা করতে লাগলেন । অন্যান্য আলেমের নিকটও তিনি শিক্ষা লাভ করেন । শিয়ালকোটের তৎকালীন খ্যাতনামা আলেম মাওলানা কামালউদ্দীন কাশ্মিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট তিনি “আজুদী” ও অন্যান্য কঠিন কিতাব অধ্যয়ন করেন । ইহা ছাড়াও সেকালের বড় আলেম শায়খুল মুহাদ্দিছীন শায়খ আবদুর রহমান ইবনে ফাহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার ছাত্র মাওলানা কাজী বাহলুল বদখশানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট তিনি মিশকাত শরীফ, ছহীহ বুখারী, শামায়েলে তিরমিজী, জামে ছগীর, তফসীরে ওয়াহেদী, বায়জাবী শরীফ, কাসিদায়ে বোরদা প্রভৃতি অধ্যয়ন করেন এবং ইজাজত হাসিল করেন ।
তিনি কাশ্মীরের শায়েখ ইয়াকুব মোহাদ্দিছ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে হাদীছ শরীফের কিতাব শুনিয়ে হাদীছ-শরীফের সনদ এবং কোব্রাবীয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া তরীকার ইজাজত হাসিল করেন ।
মাত্র সতের বৎসর বয়স মুবারকে নিজের শিক্ষা সমাপন করে তিনি শিক্ষকতার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং খুবই পরিশ্রমের সাথে ছাত্রদেরকে শিক্ষা দান করতে থাকেন । ইতিমধ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে একবার তৎকালীন রাজধানী আকবরাবাদ যাওয়ার সুযোগ হয় । সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থানকালে শাহী দরবারের বিশিষ্ট সদস্য আবুল ফজলের সাথে উনার সাক্ষাত ঘটেছিল । কিন্তু পরিশেষে তার খারাপ আকীদার জন্য আবুল ফজলের উপর নারাজ হয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার সাহচর্য পরিত্যাগ করেন ।
আকবরাবাদ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইলেম ও কামালাত হাছিলের জন্য পূণরায় উনার বুযুর্গ পিতার খিদমতে অবস্থান করে চিশ্তিয়া তরীকার খিলাফত ও ইজাজত লাভ করেন ।
বায়তুল্লাহ শরীফের তওয়াফ এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার রওযা শরীফের যিয়ারতের আগ্রহে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সদা সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন । কিন্তু উনার বুযুর্গ পিতার বৃদ্ধাবস্থার জন্য উনার খিদমত থেকে পৃথক হওয়া পছন্দ করতেন না ।
অত:পর উনার বুযুর্গ পিতার বিছাল শরীফের পর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ১০০৮ হিজরীতে হজ্বের উদ্দেশ্যে সিরহিন্দ শরীফ থেকে রওয়ানা হন । দিল্লী পৌঁছবার পর হযরতের সঙ্গে উনার বন্ধু মাওলানা হাসান কাশ্মিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাক্ষাত হলে তিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে উনার সাথে সাক্ষাতের জন্য উনাকে উৎসাহিত করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অন্তরে নকশবন্দীয় তরীকার উচ্চতম নিসবত হাসিলের প্রবল আগ্রহ ছিল । সেজন্য তিনি হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাযির হলেন। হযরত খাজা সাহেব উনার শুভাগমনে খুবই খুশী হয়ে উনার আগমনের কারণ ও ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উনার হজ্ব সফরের সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করলেন ।
হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি কাউকে বয়েত করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করতেন । কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি উনার অভ্যাসের খেলাফ করে বললেন : যদিও আপনার সফরের ইচ্ছা খুবই মুবারক, তথাপি যদি আপনি কমপক্ষে এক সপ্তাহ কিংবা এক মাস ফকীরদের ছোহবতে অবস্থান করেন, তাতে কি কোন দোষ আছে ? অগত্যা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এক সপ্তাহ উনার ছোহবতে অবস্থানের ইচ্ছা করলেন ।
মাত্র দু’ দিন উনার ছোহবতে থাকার পরই হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মনে নকশবন্দীয়া তরীকায় দাখেল হওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল । তিনি হযরত খাজা সাহেব-উনার খিদমতে উনার ইচ্ছার কথা পেশ করলেন। হযরত খাজা সাহেব কাউকে বয়েত করার পূর্বে ইস্তেখারা করার নির্দেশ দিতেন । কিন্তু এ ক্ষেত্রে হযরত খাজা সাহেব বিনা ইস্তেখারায় হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে উনার তরীকায় দাখেল করে নির্জনে তাওয়াজ্জুহ দিতে লাগলেন । প্রথম ছোহবতের তাওয়াজ্জোহতেই হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানি রহমতুল্লাহি আলাইহি-উন্রা ক্বলবে যিকির জারী হয়ে, ইহার মিষ্টতা ও স্বাদ সৃষ্টি হয়ে গেল । এর পর হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তরীকতের তা’লীম ও তরবীয়ত স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাথে এমন বে-নজীর ব্যবহার প্রদর্শন করতে লাগলেন, যা কেউ কখনও দেখে নি বা শুনে নি । মাত্র দু’ মাস কয়েকদিনের মধ্যে হযরত মজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নকশবন্দীয়া তরীকার সমস্থ নিছবত হাছিল করে ফেললেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
একদিন হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে বললেন : হযরত খাজা মুহ¤মদ আমকাঙ্গী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন আমাকে হুকুম দিলেন : আপনি হিন্দুস্থান চলে যান, সেখানে আপনার দ্বারা এই তরীক্বা জারী হবে । আমি নিজের মধ্যে এই যোগ্যতার কোন লক্ষণ না দেখে ওজর আপত্তি পেশ করলাম । তখন তিনি আমাকে ইস্তেখারা করার হুকুম দিলেন । ইস্তেখারা কালে আমি দেখতে পেলাম একটি তোতা পাখী গাছের ডালে বসে আছে । আমি মনে মনে বললাম, যদি এই তোতা পাখী উড়ে এসে আমার হাতে বসে, তা হলে আমার হিন্দুস্থান সফর সাফল্যমন্ডিত হবে । আমার মনে এই ধারণা জাগার সঙ্গে সঙ্গেই তোতা পাখিটি আমার হাতে এসে বসল । আমি তার ঠোঁটে নিজের মুখের লালা দিয়ে দিলাম । আর তার পরিবর্তে তোতা পাখী আমার মুখে চিনির লালা প্রদান করল । আমি সকালে উঠে হযরত খাজা মুহ¤মদ আমকাঙ্গী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে ইস্তেখারা কালে আমার রাত্রের স্বপ্নের বিবরণ পেশ করলাম । ইহা শুনে তিনি বললেন : হিন্দুস্থানের পাখীর মধ্যে তোতাই সমধিক প্রসিদ্ধ । হিন্দুস্থানে আপনার মাধ্যমে এমন এক বুযুর্গ প্রকাশ হবে, যার দ্বারা সারা দুনিয়া আলোকিত হবে এবং আপনিও উপকৃত হবেন ।
যখন আমি সিরহিন্দ শরীফে পৌঁছলাম, তখন কেউ আমাকে স্বপ্নে বললেন : আপনি একজন কুতুবের আশে পাশে অবস্থান করছেন । তিনি আমাকে কুতুবের চেহারাও দেখিয়ে দিলেন । সকালে উঠে আমি সিরহিন্দ শরীফের বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাত করলাম । যারা গোশনশিনী (একাকী নির্জনবাস) অবলম্বন করে আছেন, উনাদের খেদমতেও হাজির হলাম, কিন্তু স্বপ্নে দেখা চেহারা পেলাম না । আমি মনে করলাম এই স্থানের বাসিন্দাদের মধ্যেই কোন ব্যক্তি সেই যোগ্যতার অধিকারী হবেন এবং সম্ভবত: পরে উনার প্রকাশ হবে । তারপর যখন আপনি এখানে আসলেন, তখন স্বপ্নে দেখা চেহারা হুবহু মিলে গেল এবং আপনার মধ্যে সেই যোগ্যতার চিহ্নও বিদ্যমান দেখতে পেলাম । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : একদিন হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যিকির করছিলেন । সেই সময় আমি উনার খিদমতে হাযির হলাম । উনার ছোহবতের ওছীলায় প্রায়ই আমি বে-খুদী হালতে (আত্ম-ভোলা অবস্থায়) থাকতাম । উহা ‘ফানা’র আলামত। হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার পীর ভাই জনাব তাজ সম্বলী রহমতুল্লাহি আলাাইহি-উনাকে হুকুম দিয়েছিলেন যেন তিনি প্রত্যেক মুরীদকে তার রুহানী অবস্থা স¤পর্কে জিজ্ঞাসা করে হযরতের নিকট পেশ করেন । কিন্তু আমার উপর খাছভাবে হুকুম ছিল আমি যেন নিজে উনার খেদমতে হাজির হয়ে নিজের অবস্থা পেশ করি । আমার জন্য কোন ওছীলার প্রয়োজন নেই । এমন কি কোন কোন সময় হযরত নিজেই আমাকে স্মরণ করিয়ে আমার অবস্থা জানতে চাইতেন। কিন্তু আমি আদবের খাতিরে প্রায়ই নীরব থাকতাম এবং কিছুই বলতাম না ।
একদিন তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন : আপনি কেন নিজের হালাত (অবস্থা) বলতে ইতস্তত: করেন এবং নীরব থাকেন ? আমি মনে মনে বললাম : আমার হালই বা কি, আর কাইফিয়াতই বা কি, যে আমি তা হযরতের খেদমতে পেশ করব ? তিনি পূণরায় আমাকে একদিন বললেন : যা কিছু কাইফিয়াত (অবস্থা) হয়, তা আমাকে ঠিক ঠিক ভাবে বর্ণনা করবেন । ইতিমধ্যে একটি ঘটনা সংঘটিত হলো। আমি পীরভাই জনাব শায়েখ তাজ সম্বলী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি তাওয়াজ্জুহ দিলে, তিনি বেহুঁশ হয়ে যমিনে পড়ে গেলেন । হযরত বার বার জিজ্ঞাসা করলে আমি এই ঘটনা উনার খিদমতে আরজ করলাম । ইহা শ্রবণমাত্র হযরতের চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল । মজলিসে উপস্থিত সালেকগণ হযরতের চেহারা মুবারক দেখে দীর্ঘ সময় যাবত নীরবে অবনত মস্তকে বসে থাকলেন । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মত এইরূপ একজন সুযোগ্য মুরীদের তরবীয়ত করার এবং উনাকে কামালাতের দরজায় পৌঁছাবার জন্য আল্লাহ পাক-উনার দরবারে শোকর আদায় করলেন । অত:পর এক মুবারক সময়ে উনাকে খিলাফত দানে বিভূষিত করে সিরহিন্দ শরীফ থেকে বিদায় নিলেন।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি মাত্র চল্লিশ বছর বয়স মুবারকে বিছাল শরীফ লাভ করেন এবং চার বৎসর ইশায়াতে দ্বীন ও তরীক্বার খিদমত করেন। এই স্বল্প কালের মধ্যে উনার ফয়েজের বরকতে লক্ষ লক্ষ লোক আল্লাহ পাক-উনার মহব্বত ও মা’রিফাত হাছিল করেছেন ।
হিদায়েতের কাজে আত্মনিয়োগ
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সিরহিন্দ শরীফ প্রত্যাবর্তনের পর নিজ বুযুর্গ পীরের নির্দেশ অনুযায়ী ঈশায়াতে দ্বীন ও মানুষের তরবীয়তের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার তালেবে-মাওলা (আল্লাহ পাক-উনার অন্বেষণকারী) উনাদেরকে মা’রিফাতের উচ্চ মকামে পৌঁছাতে সক্ষম হন । পঙ্গপালের ঝাঁকের মত লোক উনার খিদমতে হাজির হতে থাকেন ।
ইত্যবসরে হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার একখানি পত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার হস্তগত হয় । তিনি উক্ত পত্রে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন । পত্র পেয়ে তিনি পূণরায় দিল্লী রওয়ানা হলেন । উনার আগমনবার্তা পেয়ে সমস্ত খাদিম এবং সঙ্গীগণ সহ হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীর কাবুলী দরজায় হাজির হলেন এবং অত্যন্ত ইজ্জতের সাথে উনাকে অভ্যর্থনা করলেন ।
দ্বিতীয়বার পীর সাহেব ক্বিবলার ছোহবতে দিল্লী তশরীফ আনার পর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিশেষ কামালাত ও উরুজ (উর্দ্ধারোহণ) হয় । এই সময় হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি পীর হয়েও মুরীদের প্রতি এত ইজ্জত প্রদর্শন করতেন যে, তিনি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মাহফিলের প্রধান বানিয়ে নিজে সমস্ত মুরীদসহ ফয়েজের জন্য মাহফিলে শরীক হতেন এবং মুরাকাবা হতে অবসর হয়ে এমনভাবে মাহফিলের বাইরে যেতেন, যেন হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দিকে পিঠ দেয়া না হয় ।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এইরূপ ব্যবহারে উনার কোন কোন খলীফা ও মুরীদের অন্ত:করণে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয় । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বাতেনী শক্তি দ্বারা ইহা জানতে পেরে খুবই দু:খিত হয়ে বললেন : যদি আপনারা নিজের ঈমান বাঁচাতে চান, তা হলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি আদব ও আক্বীদা ঠিক রাখুন । কারণ তিনি রূহানী সূর্য-সদৃশ এবং উনার নূরের জ্যোতির মুকাবেলায় আমাদের মত হাজার হাজার তারকার কোন অস্তিত্ব নেই । মনে রাখবেন, উ¤মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের মধ্যে যে চারজন শ্রেষ্ঠ আউলিয়া আছেন, তিনি উনাদের অন্যতম ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি এত উচ্চ মকাম লাভ করা সত্তে¦ও নিজের পীরের প্রতি এত তাজীম ও আদব প্রদর্শন করতেন যে, তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলািিহ-উনার একজন খলীফা হযরত হুসামুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এত উচ্চ মকামের অধিকারী হয়েও নিজের পীর ও মুর্শীদের আদবের প্রতি এমন খেয়াল রাখতেন যে, কোন মুরীদ কিংবা কোন খলীফা এত বা-আদব (শিষ্টাচারী) ছিলেন না । সেজন্যই তিনি হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট থেকে সবচেয়ে বেশী ফয়েজ হাসিল করেছিলেন । হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে একবার স্মরণ করেন । আমি গিয়ে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে সংবাদ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনার চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে যায় এবং ভয়ে উনার শরীর কাঁপতে থাকে ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মাবদা ও মায়াদ” কিতাবে লিখেন : হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাথে প্রত্যেক মুরীদ নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী পৃথক পৃথক আক্বীদা রাখতেন এবং প্রত্যেক মুরীদ নিজ নিজ আক্বীদা অনুযায়ী ফয়েজ প্রাপ্ত হতেন । আমার আক্বীদা ছিল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পর এইরূপ ছোহবত, তরবীয়ত ও ইরশাদ হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি ব্যতিরেকে আর কারো নসীব হয় নি । আল্লাহ পাক-উনার দরবারে হাজার শোকর, আমি আমার আক্বীদা অনুযায়ী ফয়েজ প্রাপ্ত হয়েছি ।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তৃতীয়বার দিল্লী আগমনের পর হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন : আমার আর বেশী দিন বাঁচার আশা নেই । অত:পর তিনি উনার দু’ ছাহেবযাদা হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ রহমতুল্লাহি আল্ইাহি এবং হযরত খাজা আবদুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাদেরকে তাওয়াজ্জুহ দানের জন্য হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার স¤মুখে পেশ করলেন । তখন ইনারা দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই তাওয়াজ্জুহ-এর প্রভাব হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপরও প্রতিফলিত হয় ।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ঈশায়াতে দ্বীন, ইরশাদ ও তালক্বীন-এর গুরুদায়িত্ব হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আল্ইাহি-উনার উপর সোপর্দ করার সময় বলেছিলেন : বর্তমানে আসমানের নীচে এই সিলসিলায় উনার মত এত উচ্চ মকামের অধিকারী আর কেউ নেই । তিনি মুকা¤িমল মুরাদ, মাহবুব ও কুতুব । ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবেঈন ও ইমাম মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের পরে উনার মত ব্যক্তিত্ব খুব অল্পই নজরে আসে । এই তিন চার বৎসর আমি মুর্শিদী করি নি, কয়েকদিন আমি খেল্ তামাসা করেছি । কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ! আমার সামান্য প্রচেষ্টা বিফল যায় নি বরং উনার (হযরত মুজাদ্দেদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার) মত এক বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হয়েছে ।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজের পীর ও মুর্শীদের নিকট থেকে ইজাজত (অনুমতি) ও খিলাফত লাভের পর উনার নির্দেশ অনুযায়ী কিছুদিন সিরহিন্দ শরীফে অবস্থানের পর লাহোরে রওয়ানা হন । উনার পরিপূর্ণ কামালাতের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । বড় বড় আলেম ও মাশায়েখগণ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার হাতে বয়েত হাসিল করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি লাহোরে অবস্থানকালে হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ১০১২ হিজরী সনে দিল্লীতে বিছাল শরীফ লাভ করেন । এই সংবাদ শুনে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লী রওয়ানা হন । পথিমধ্যে সিরহিন্দ শরীফ আতিক্রম কালে সিরহিন্দ শরীফে এক মূহূর্তের জন্যও না থেমে দিল্লী পৌঁছে নিজের পীর ও মুর্শীদের মাযার শরীফে হাজির হন ।
ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় মুরশিদ হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহ-উনার নিকট থেকে নকশবন্দীয়া তরীক্বার খাছ নিসবত লাভ করার পর উনার নির্দেশে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন । ইতপূর্বেই উনার সুখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে । উনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে চারদিক থেকে দলে দলে লোক উনার খিদমতে হাজির হয়ে বাইয়াত হতে থাকে।
এই সময় একদিন তিনি স্বীয় হুজরার মধ্যে ফজরের নামাযের পর মুরাকাবায় মশগুল আছেন । এমন সময় নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রূহানী ভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশ্তা এবং আওলিয়া ও গাউস-কুতুবদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে তশরীফ আনেন এবং নিজ হাতে উনাকে একটি অমূল্য ‘খিল্আত’ অর্থাৎ স্বীয় প্রতিনিধিত্বের প্রতীক স্বরূপ এক বিশেষ পোষাক পরিয়ে দেন এবং বলেন : শায়েখ আহমদ ! মুজাদ্দিদের প্রতীক স্বরূপ আমি আপনাকে এই ‘খিলআত’ পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য আপনাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম । আমার উ¤মতের দ্বীন-দুনিয়া তথা ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্ব আজ থেকে আপনার উপর ন্যস্ত করা হলো । এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল শরীফ শুক্রবার ফজরের নামাযের সময় সংঘটিত হয় । আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণ সাধারণত: যে বয়সে পয়গম্বরী লাভ করতেন, সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়স মুবারকের সময় তিনি ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভূষিত হন । (বিপ্লবী মুজাদ্দিদ রহ
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স¤পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । হাদীছ শরীফে তিনি ইরশাদ করেন : একাদশ শতকের প্রারম্ভে আল্লাহ পাক দুনিয়ার বুকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি অত্যুজ্জল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন । উনার নামকরণ হবে আমারই নামানুসারে । দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশাহের যুগে উনার আবির্ভাব হবে । উনার তালীম-তরবীয়তে অসংখ্য লোক জান্নাতের অধিকারী হবে (রওজাতুল কাইয়ূমিয়া) । উপরোক্ত হাদীছ শরীফে যে দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশাহের কথা উল্লেখ রয়েছে, তারা ছিলেন সম্রাট আকবর ও তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর । আকবরের শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সংস্কারমূলক কাজ আরম্ভ হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে সেই কর্মসূচী পূর্ণতা লাভ করে ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মাবদা ও মা’আদ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন : আমি একদিন আমার সঙ্গী সাথীগণের সহিত বসা ছিলাম, তখন আমার দৃষ্টি স্বীয় খারাবীর দিকে পতিত হলো । কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকার পর আমার মনে হলো, ফকিরী দরবেশীর সহিত আমি পূর্ণভাবে স¤পর্কহীন । আল্লাহ পাক-উনার জন্য যে অবনত হয়, আল্লাহ পাক তাকে উচ্চ করেন। এই হাদীছ অনুযায়ী আল্লাহ পাক যেন আমাকে মাটি হতে উত্তোলন করলেন এবং আমি আমার অন্ত:করনে শব্দ শুনতে পেলাম --
غَفَرْتُ لَكَ وَ مَنْ تَوَسَّلَ بِكَ بِوَاسِطَةٍ اَوْ بِغَيْرِ وَاسِطَةٍ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ -
(অর্থ: আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা আপনাকে মধ্যস্থতায় অথবা বিনা মধ্যস্থতায় ওছিলা করবে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম ।) এই কথা আমার অন্তরে পুন: পুন: নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল । যখন আমি সন্দেহহীন হলাম, তখন ইহা প্রকাশ করার জন্য আদেশ প্রাপ্ত হলাম । হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই ইলহাম দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ তরিকায় দাখিল হবে এবং মউতের পূর্ব পর্যন্ত কায়েম থাকবে তাদের পরলোকে নাজাত নিশ্চিত । (মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ৪/৪২)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আকবরী ফিত্না
হিজরী ৯৬৩ সাল (১৫৫৩ ঈসায়ী) থেকে হিজরী ১০১৪ সাল (১৬০৪ ঈসায়ী) পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছরের অধিককাল সম্রাট আকবর দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন । অত:পর ১০১৪ হিজরী সাল থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল শুরু হয় এবং তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে রাজত্ব করেন । অত:পর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিছাল শরীফের সাথে সাথে তার রাজত্বের অবসান ঘটে ।
আকবরের সময় রাষ্ট্র ছিল তিনটি শক্তির দ্বার বেষ্টিত । প্রথমত: আফগান সম্রাট: আকবরের পিতা হুমায়ূন যাদের হাতে পরাজিত হয়ে হিন্দুস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, অত:পর আকবরও তাদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত: শিয়া স¤প্রদায়: এদের কেন্দ্র ছিল ইরাণ এবং এদের বদৌলতেই আকবরের পিতা হুমায়ূন দ্বিতীয়বার সিংহাসনে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তৃতীয়ত: হিন্দু : হিন্দুস্তানে যদিও হিন্দু অধিবাসীদের সংখ্যা শতকরা ৯৫ জন ছিল, কিন্তু তবুও অতীত মুসলিম সম্রাটের ভয়ে তারা এত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে মোকাবিলা করার কোন শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না ।
এই তিনটি প্রতিকূল শক্তির মাঝখানে নিশ্চিন্ত মনে রাজত্ব পরিচালনা করা সম্ভব নয় চিন্তা করে সম্রাট আকবর নিজের গদি সংরক্ষণের জন্য হিন্দুদের মন রক্ষা করে চলাকেই সঙ্গত ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করে । সাথে সাথে সে সুন্নী মুসলিম স¤প্রদায়কে বাদ দিয়ে তথাকথিত মুসলিম নামধারী অন্যান্য স¤প্রদায়ের সাথে হাত মিলায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সকল ধর্ম ও মতবাদের দু’-চার জন পন্ডিত নিয়ে সভানুষ্ঠান ও তাদের সাথে ধর্মালোচনা করাও তার রাজনীতির অন্যতম বিশেষ নীতি হিসাবে পরিগণিত হয় । সে মনে করেছিল যে, তার এই কর্মকান্ডের ফলে সকল ধর্ম ও সকল স¤প্রদায়ের লোকই তাকে আপন জন বলে মনে করবে এবং সে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘেœ তার রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে। এই মন মানসিকতার বশবর্তী হয়েই সে সকল ধর্মের সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় ব্রতী হয় । কিন্তু যেহেতু সে নিরক্ষর ছিল, সেহেতু বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারী পন্ডিতবর্গের কারসাজীর ফলে সে “দীনে ইলাহী” নামে এক অদ্ভূত ‘খিচূড়ী ধর্ম’ আবি®কার করে বসে, যা প্রকৃত ধর্মকে বিকৃত করার সাথে সাথে উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের ইতিহাসকেও কলঙ্কিত করে তোলে।
উলামায়ে “ছূ” (অসৎ আলেমগণ)-এর ফিত্না
যদিও ব্যক্তিগতভাবে বাদশাহ আকবর এই ফেত্নার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, সে এ ব্যাপারে দুনিয়াদার আলেমদের দ্বারাই বিভ্রান্ত ও প্রভাবান্বিত হয়েছিল । ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে দেখা যায় যে, বাদশাহ আকবর প্রথম জীবনে একজন খাঁটি ধর্মভীরু সুন্নী মুসলমান ছিল । সে আলেমদের ছোহবত পছন্দ করত। জুমার দিবস ওলামাদের মজলিস বসত এবং দ্বীনী বিষয়ে আলোচনা হতো । জীবিকা অর্জনের খাহেসে শতাধিক ওলামা এই মজলিসে একত্রিত হতো । ক্রমে টাকা পয়সা ও লোভের বশবর্তী হয়ে ওলামাদের মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্য শুরু হয় । প্রত্যেকেই শাহী দরবারে প্রিয়পাত্র হওয়ার মানসে নানারূপ অশোভন ও অযোক্তিক কার্যাবলী প্রদর্শন করতে প্রয়াস পায় । প্রথমত: বাদশাহ তাদের ব্যাপারে দেখেও না দেখার ভান করত । কিন্তু তাদের পরস্পর মতানৈক্য ও বিবাদ বিসম্বাদ শেষ পর্যন্ত চরমে পৌঁছে । এতে বাদশাহ খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে ।
আকবরের দরবারে আবুল ফজল, ফৈজী ও মোল্লা মোবারকের ফেত্না ছিল ওলামায়ে ছু-এর ফেত্নার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক । আবুল ফজল ও ফৈজী ছিল মোল্লা মোবারকের দুই পুত্র । মোল্লা মোবারক একজন বিখ্যাত আলেম ছিল । সে চার মজহাবের সব রীতি নীতি স¤পর্কে ওয়াকেবহাল ছিল । সেজন্য সে নিজকে ইজতিহাদের দরজা প্রাপ্ত ব্যক্তি মনে করত । ইলেমের গৌরবে সে এক বিপদসঙ্কূল রাস্তায় পদক্ষেপ করে । তার অভ্যাসগত শিক্ষাদান ও তালীম-তালকীন-এর কাজ পরিত্যাগ করে । ইতিপূর্বে এই মোল্লা সাহেব শেরশাহ ও তার পুত্রের অনেক পীড়াপীড়ি সত্বেও সামান্য হাদিয়াও কবুল করে নি । কিন্তু বাদশাহ আকবরের যামানায় সে তার দুই পুত্রের সহায়তায় রাজনীতিতে যোগদান করে হিন্দুস্তানের সুন্নী ওলামাদেরকে তথা দ্বীন ইসলামকে আঘাত করে । ফলকথা শাহী দরবারে আবুল ফজল ও ফৈজীর ফিত্না ও ওলামায়ে ছু-এর ফেত্না এবং সঙ্গে সঙ্গে মোল্লা মোবারক নাগোরীর সমর্থনে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার দ্বার খুলে যায় এবং সুযুগমত বাদশাহ আকবরও নির্বিঘেœ তার মসনদ রক্ষার্থে সাহস ও সুযোগ পায় ।
বাদশাহ আকবর তার প্রচারিত দ্বীনে ইলাহীর আশান্বিত প্রচার ও প্রসার না হওয়াতে সে ক্ষুব্ধ হয়ে তার সভাসদগণকে তার ব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞাসা করলো । তখন তার অনুরক্তরা জবাবে বলে : মযহাবের ইমামগণ নিজেদের গবেষণা দ্বারা বিভিন্ন মযহাব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং উনাদের মযহাবের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান কায়েম করেছেন, যা সমস্ত দুনিয়ার মুসলমানগণ বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন । আপনি যদি ইজতিহাদ বা গবেষণা দ্বারা তেমন কিছু বিধি বিধান প্রবর্তন করেন, তবে সবাই তা মেনে নিবে । আর আপনি যে ইজতিহাদের যোগ্য ব্যক্তি সে বিষয়ে আমরা আলেমদের নিকট থেকে ফতোয়া যোগাড় করে দিব।
অত:পর মোল্লা মোবারাক নাগোরী, আবুল ফজল ও ফৈজী প্রমূখগণ বাদশাহের মুজতাহিদ হওয়ার জন্য একখানি সনদ রচণা করে, যা ইতিহাসে “মাহযার নামা” রূপে বিখ্যাত । এতে বাদশাহের ইনামভোগী আলেমরা দস্তখত করল । এতে মূল বিষয় ছিল বাদশাহ আকবরের মর্যাদা একজন মুজতাহিদের মর্যাদা অপেক্ষাও উচ্চে । আকবর এই ইজতিহাদি সনদের বলে ইসলামী আকায়েদ সমূহের উপর আঘাত হানতে শুরু করল । ঐতিহাসিক বাদায়ূনী আক্ষেপ করে বলেন : পাঁচ ছয় বছর পর ইসলামের নাম নিশানও বাকী রইল না । বাদশাহ তার খুশীমত নতুন ধর্ম গঠন করতে লাগল (বাদায়ূনী) । আকবরের মত একজন নিরক্ষর স্বার্থপর ব্যক্তি শরীয়তবেত্তা মুজতাহিদ হওয়ায় তার পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছিল এবং অল্পদিনের মধ্যে তার বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া সমাজে প্রকাশিত হয় । দ্বীন ইসলাম স¤পর্কে আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে সর্বজনমান্য চারি মযহাবের ইমামদের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে আকবরের প্রধান সহচর ও সমস্ত অপকর্মের বড় সহায়ক আবুল ফজল বলত : তোমরা কি মহানুভব বাদশাহ ও যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমামের সাথে অমুক রুটিওয়ালা, কষাই চামারের পুত্রদের তুলনা করতে চাও ? (আইনে আকবরী)
বাদশাহ আকবর হিজরী ১০১৪ সনে (১৬০৫ ঈসায়ী) মৃত্যুমুখে পতিত হয় । আবুল ফজল হিজরী ১০১১ সনে (১৬০২ ঈসায়ী) মৃত্যুবরণ করে । বাদশাহ আকবরের মৃত্যু ইসলামের উপর অথবা তার প্রবর্তিত দ্বীনে ইলাহীর উপর হয়েছিল কিনা তা বলা কঠিন । কেননা এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরোধী মত ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিলক্ষিত হয় । বাদশাহ জাহাঙ্গীরের বর্ণনা অনুসারে তার পিতা আকবর মৃত্যুর সময় কলেমায় শাহাদত পাঠ করেছিল এবং মৃত্যুর সময় তার চোখ বেয়ে অশ্র“ ঝরেছিল । মৃত্যুর পূর্বক্ষণে একজন আলেমকে সুরা ইয়াসিন পড়ার জন্য নাকি সম্রাট নির্দেশ দিয়েছিল ।
আকবরী ফিত্নার অন্যতম সহায়ক উলামায়ে “ছু” বা দুনিয়াদার অসৎ আলেমদের স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মকতুবাত শরীফে বলেন : “আলেমগণ পার্থিব মুহব্বত ও আসক্তিতে গ্রেপ্তার হলে তাদের সৌন্দর্য বিকৃত হয়ে যায় । অবশ্য এই অবস্থায়ও লোক তাদের নিকট থেকে বহু উপকার প্রাপ্ত হয় । কিন্তু তাদের ইলেম তাদের কোন উপকারে আসে না। শরীয়ত এদের ইলেম দ্বারা সময় সময় সাহায্যপ্রাপ্ত ও শক্তিশালী হয়ে থাকে। কোন কোন সময় বদকার ফাসেক লোকদের দ্বারাও এই প্রকার সাহায্য হয়ে থাকে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শ্রেণীর লোকদের খবর দিয়েছেন ।
প্রকৃতপক্ষে দুনিয়াদার নিকৃষ্ট আলেমদের কম্বখ্তি ও বদ্ নিয়ত এই যামানায় শরীয়তের ব্যাপারে গাফলতী ও উদাসিনতা সহ মযহাব প্রচলনে ও ত্র“টি বিচ্যূতি এনে দিয়েছে । অবশ্য যে সমস্ত আলেম দুনিয়াদারী থেকে উদাসীন এবং যশ:লিপ্সা, রাজনৈতিক সুবিধা, ধন স¤পদ ও উচ্চ আসন লাভের মুহব্বত থেকে নিজকে মুক্ত রেখেছেন, উনারাই প্রকৃত আলেম ও নবী আলাইহিমুস সালামগণের ওয়ারীশ বা উত্তরাধিকারী ” (মকতুব নং ৩৩) ।
আকবরী ফিত্না স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন: বিগত বাদশাহের (বাদশাহ আকবর) সময় বাদশাহী প্রাধান্যে কাফিরগণ প্রকাশ্যভাবে দারুল ইসলামে (হিন্দুস্তানে) কুফরী হুকুম-আহকাম জারী করত এবং মুসলমানরা ইসলামী হুকুম আহকাম জারী করতে অক্ষম ছিল । মুসলমানরা এইরূপ করলে তাদেরকে হত্যা করা হতো । বড়ই আফসোসের বিষয় এই যে, হক্বতায়ালা-উনার দোস্ত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উপর ঈমান আনয়নকারীগণ বেইজ্জত ও অপদস্ত হতো এবং উনার প্রতি অবিশ্বাসীরা স¤মানী ও আস্তাভাজন ছিল । মুসলমানরা আহত হƒদয়ে ইসলামের জন্য মাতম জারী করত এবং শত্র“গণ হাসি তামাসা করে তাদের যখমের উপর লবণ ছিটিয়ে দিত । (মকতুব নং ৪৭)
বাদশাহ আকবরের পরে বাদশাহ জাহাঙ্গীরও মযহাবী দৃষ্টিকোন থেকে পিতার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি উনার পিতার অনুসারী ও দ্বীনে ইলাহীর একজন পরমভক্ত মুরীদ ছিলেন । উপরন্তু উনার আমলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার অনুসারীদের জন্য এক নুতন ফিত্না দেখা দিয়েছিল । এই ফিত্নার উৎসমূলে ছিল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তার দক্ষতার বলে সমস্ত রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন । স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীর বলেন: আমার রাজত্ব এখন নূরজাহান ও তার গোষ্ঠির হাতে । আমি রাজত্ব তাদেরকে দিয়ে দিয়েছি । প্রত্যহ আধা সের গোস্ত ও একসের শরাব ব্যতীত আর কিছুই আমি চাই না। (তুয্কে জাহাঙ্গীর)
নূরজাহান নিজে শিয়া ছিলেন । তার মাধ্যমে শিয়া মতবাদ প্রচার ও সুন্নীদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন চলতে থাকে এবং নানাপ্রকার ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ সমাজে বিস্তার লাভ করতে থাকে । এই সমস্ত অপকর্মের প্রতিরোধ করার দাবীতে বিভিন্ন মহল থেকে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খেদমতে আবেদন আসতে থাকে । এমতাবস্থায় তিনি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস ও মঙ্গলময় ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিয়ে সকলকে আশ্বস্ত করেন।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সময় বহু মাশায়েখ ও ওলামায়ে কিরাম বিদ্যমান ছিলেন, যেমন শাহ সিকান্দার রহমতুল্লাহি আলাইহি, শাহ ফজলুর রহমান বোরহানপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা জামাল উদ্দীন লাহোরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমূখ । এতদসত্বেও মহান আল্লাহ পাক-উনার নির্দ্দেশিত মুজাদ্দেদিয়াত ও কাইউমিয়াতের লক্বব (উপাধী) একমাত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর ন্যস্ত হয় এবং তিনি এই দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠ ও সূচারুরূপে স¤পন্ন করেন । উনার ব্যক্তিত্ব ও কামিয়াবী সর্বজন স্বীকৃতিলাভ করতে সক্ষম হয় ।
হিন্দুস্তানের তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম ও মুহাদ্দিস, হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি প্রায় ১০০ খানা কিতাব রচণা করেন, প্রথমত: হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর আপত্তিকর প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু যখন বিষয়টির আসল স্বরূপ প্রকাশ পায় তিনি উনার পূর্ব অভিমত থেকে ফিরে যান । তিনি স্বপ্নে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার যিয়ারত হাসিল করে প্রত্যক্ষ করেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দিকে ঈশারা করে বলছেন : যে আমাকে ভালবাসে, ইনার সাথেও তার ভালবাসা হওয়া উচিত । এই ঘটনার পর হযরত শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পূর্ব ধারণা থেকে তওবা করেন এবং উনার মুরীদ হয়ে যান ।
হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শরহে রিসালায় লিখেছেন: আল্লাহ পাক-উনার বড় আশ্চর্য কারিগরী যে, বাদশাহ আকবর ও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে যেরূপভাবে সর্বগ্রাসী ফিত্না ও ফাসাদের সমাবেশ ঘটেছিল, বিগত যুগে তার এক দশমাংশও দৃষ্টিগোচন হয় নি । অনুরূপভাবে এই দু’টি যুগে কারামত স¤পন্ন বহু আওলিয়ায়ে কিরাম ও বহু মূল্যবান গ্রন্থ লেখক ওলামাদেরও সমাবেশ ঘটেছিল । এসব ব্যক্তিরা এতদূর বুযুর্গ ছিলেন যে, উনাদের নামের ওছীলায় বরকত হাসিল করা যেত এবং উনাদের নাম স্মরণ করলে আল্লাহ পাক-উনার রহমত নাযিল হওয়ার আশা করা যেত। ইনারা সবাই বিশেষভাবে দিল্লী ও তার চার পাশের অধিবাসী ছিলেন । তাছাড়া গুজরাট ও দাক্ষিনাত্যেও এরূপ বহু মনীষী ও ওলামায়ে কিরামের সমাবেশ ঘটে । বাদশাহ আকবর ও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় এইসব ব্যক্তিত্বস¤পন্ন মনীষী থাকা সত্বেও কেউই এই উভয় রাজত্বকালে দ্বীন ইসলাম বিরোধী শাহী ফেত্না ও বেদ্বীনী কার্যকলাপ এবং দুনিয়াদার আলেম, সুফী, রাফেজী ও মুশরেকদের ফেত্না ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় আধিপত্য, বিভিন্ন প্রকারের বিদয়াতের প্রচলন, দ্বীনে ইলাহী নামক এক অভিনব ধর্মের প্রবর্তন, দ্বীন ইসলাম বিরোধী রুসুমাত, আকীদা ও আল্লাহ পাক-উনাকে অস্বীকার করা, দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জষন্য অপপ্রয়াস ও অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আল্লাহ পাক-উনার কিতাবের ও সুন্নতের শিক্ষা ও আদর্শে দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে সাহসী হন নি । পক্ষান্তরে একমাত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই সমস্ত দ্বীন ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরূদ্ধে একাকী রুখে দাঁড়ান । আল্লাহ পাক-উনার তরফ থেকে উনাকে এই মহা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি দ্বিতীয় সহস্র বছরের মুজাদ্দিদ রূপে গায়েবী মদদে এই সমস্ত বে-দ্বীনী কার্যকলাপের আমূল সংস্কার পূর্বক একদিকে দ্বীন ইসলামকে কলুষমুক্ত ও অন্য দিকে সতেজ করে স্বীয় দায়িত্ব পালনে কামিয়াব হন । (বিপ্লবী মুজাদ্দেদ রহ)
শাহ ছাহেব শরহে রেছালায় বলেন : বুযুর্গী ও বিচক্ষণতায় ইলমের আধিক্য, তীক্ষœধী-শক্তিস¤পন্ন, আমলের ইস্তেকামাত, আল্লাহ পাক ও রসুল স¤পর্কে দ্বীনী গায়রত, বড় বড় কারামত, বহু উঁচূ মকাম -- এই প্রশংসনীয় গুণাবলী এই বুযুর্গের পবিত্র আত্মার মধ্যে আল্লাহ পাক নিহিত রেখেছিলেন । হিন্দুস্তানের লোকের উপর উনার বহু ইহসান রয়েছে, যার শুকরিয়া আদায় করা তাদের পক্ষে জরুরী । কেননা যারা মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা আল্লাহ পাক-উনারও শুকুরগুজার হয় না ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মর্যাদা
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সুসংবাদ দান করেছেন: কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশের দ্বারা হাজার হাজার লোকের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে ।
হযরত ইমামে রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার যিয়ারতের জন্য কাবা শরীফ সিরহিন্দ শরীফে তশরীফ নিয়ে এসেছিলেন । এখনও সেই স্থান চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে । তিনি হজ্বে যেতে না পারায় আফসোস করেছিলেন । সেই জন্য স্বয়ং কাবা শরীফ উনার যিয়ারতের জন্য সিরহিন্দ শরীফ হাজির হয়েছিলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
আল্লাহ পাক উনাকে বিশিষ্ট বুযুর্গগণের মধ্য থেকে বিশিষ্ট করেছেন । তিনি ঐসব বুজুর্গগণের মধ্যে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এভাবে যে, তিনি কোরআন পাকের “মুতাশাবেহাত” এবং “হরুফে মুকাত্তায়াত”-এর গোপন ভেদ জানতেন, যা তিনি নিজেই বলেছেন । (মকতুবাত শরীফ ১ম খন্ড, মকতুব ৩১১) একদিন উনার ছাহেবযাদা হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রহমতুল্লাহি আলাইহি নির্জনে হযরত শায়েখ বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বললেন: হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর “মুতাশাবেহাত” ও “হরূফে মুকাত্তায়াত”-এর রহস্যাবলী ও গোপন-ভেদ প্রকাশিত হয়েছে । কিন্তু তিনি নিজে তা প্রকাশ করেন না । যদি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তিনি প্রকাশ করে থাকেন । তিনি বলে থাকেন : শয়তান বড় শত্র“ । সে চায় যেন গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশ করে দেওয়া হয় যেন সে চূরী করে শ্রবণ করে তৎক্ষণাৎ তা প্রচার করে দিবে । আল্লাহ পাক এই আলেমদেরকে, যাঁরা এই মকামে পৌঁছেছেন, “রাসেখীন” (সুদৃঢ় ইলেমধারী) বলে আখ্যা দিয়েছেন । তা সেই দৃঢ়তার কারণে যদ্বারা উনারা এই মকামকে গোপন রাখেন । আর যাকেই ইহা অবহিত করেন, তিনিও ইহাকে গোপন রাখেন । আমি আরজ করলাম : আপনি অবশ্যই এই ক্ষমতা রাখেন যেন এই স্থান ও অবস্থান থেকে শয়তানকে দূর হয়ে যায়, যেন চূরী করে সে শুনতে না পারে । আমি যখন খুব বেশী জেদ ও কাকুতি মিনতি করতে লাগলাম, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন “কাফ” অক্ষরের গোপন রহস্য এরূপভাবে প্রকাশ করলেন যে, আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। (হাযারাতুল কুদ্স)
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন : ইহা সকলেই অবগত আছেন যে, প্রত্যেক শতকে একজন করে মুজাদ্দিদ বিলাদত শরীফ লাভ করেন । প্রত্যেক শতকের মুজাদ্দিদের সাথে হাজার বছরের মুজাদ্দিদের কোন স¤পর্ক নেই । শতাব্দির মুজাদ্দেদের সাথে হাজার বছরের মুজাদ্দেদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান । বরং হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শতাব্দির মুজাদ্দিদ অপেক্ষা অনেক বড় । কারণ উক্ত মুজাদ্দিদের ওসীলায় উক্ত যামানার সমস্ত উ¤মতকে ফয়েজ পৌঁছে থাকে । এমনকি সেই যামানার কুতুব এবং আবদালগণও উনারই ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়ে থাকেন ।
তিনি অন্য এক স্থানে লিখেছেন : পূর্ববর্তী যামানায় জুলমতের অন্ধকারে ধরণী আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে দুনিয়ায় নূতনভাবে শরীয়ত কায়েমের জন্য উলুল আযম পয়গম্বরের আবির্ভাব হতো । যেহেতু এই উ¤মত সর্বশ্রেষ্ঠ উ¤মত এবং এই উ¤মতের পয়গম্বর আলাইহিছ ছালাত ওয়াস সালাম সর্বশেষ পয়গম্বর । তিনি উনার উ¤মতের আলেম স¤প্রদায়কে বণি ইসরাইলের আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম-উনাদের সম-মর্যাদা দান করেছেন এবং আলিম স¤প্রদায়ের অস্তিত্বকে আম্বিয়া কিরামের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে যথেষ্ট মনে করেছেন । এই জন্যই প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে শরীয়ত পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে এই উ¤মতের আলিম স¤প্রদায় হতে একজন মুজাদ্দিদ মনোনীত করা হয় । বিশেষভাবে পূর্ববর্তী যামানার উ¤মতদের সময়ে হাজার বৎসর পরে যেমন একজন উলুল আযম পয়গম্বর দুনিয়ায় আবির্ভূত হতেন, তেমনি এই যামানায় এই উ¤মতের মধ্যে মা’রিফাতে পরিপূর্ণ একজন হাজার বছরের মুজাদ্দিদ প্রয়োজন, যিনি আম্বিয়াদের স্থলাভিষিক্ত হবেন । অপর এক মকতুবে হযরত লিখেছেন : এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ পাক-উনার নিয়ামতের শোকর করে এই তরীক্বার তালেব ও মুরীদগণকে উৎসাহিত করা, অন্য লোকের নিকট নিজের মর্যাদার বিষদ ব্যাখ্য করা নহে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত শাহ ওযালিউল্লাহ মোহাদ্দেছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত শাহ আবদুল আযিয মোহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের নিজ কিতাব সমূহে হযরত ইমামে রব্বানী শায়েখ আহমদ সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মুজাদ্দিদে আলফেছানী অর্থাৎ দ্বিতীয় এক হাজার হিজরী সনের মুজাদ্দেদ লক্ববে ভূষিত করেছেন । তিন শতাধিক বৎসর অতিবাহিত হতে চলল, আজও বিনা দলীলে বিনা বাক্যব্যয়ে উনার মুজাদ্দেদীয়াত স¤পর্কে যামানার উলামায়ে কিরাম উনাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য কিংবা মত-বিরোধ দেখা দেয় নি ।
হযরত কাজী সানউল্লাহ পানিপথী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “ইরশাদুত তালেবীন” কিতাবে লিখেছেন : হযরত আদম আলাইহিস সালাম-উনার হাজার বছর পর হযরত নূহ্ আলাইহিস সালাম এবং এইভাবে উনার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত মুছা আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দুনিয়ায় তশরীফ এনেছেন । হাদীছ শরীফের রেওয়ায়েত অনুযায়ী নবীগণের সংখ্যা এক লক্ষ ২৪ হাজার ও রাসুলের সংখ্যা তিনশত তের । হাজার বছর পরে বা এর নিকটবর্তী সময়ে একজন উ’লুল আযম পয়গম্বর বিলাদত শরীফ লাভ করেন এবং তিনি তাজদীদ করে থাকেন । সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পরে উনার উ¤মতের ওলীগণ হচ্ছেন মানুষের হেদায়েতের জন্য হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নায়েব বা প্রতিনিধি । আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত একটি হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন :-
إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهذِهِ الْأُمَّةِ عَلَى رَأسِ كُلِّ مِأَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِيْنَهَا -
(অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি এই উম্মতের (ইছলাহের জন্য) প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে একজন ব্যক্তিকে (মুজাদ্দিদ) পাঠাবেন যিনি দ্বীনের তাজদীদ (সংষ্কার) করবেন) ।
হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন উলুল আযম পয়গম্বরের আগমনের সময় হয়, তখন আল্লাহ পাক উনার কাদীম অভ্যাস মোতাবেক দ্বিতীয় হাজারের জন্য একজন মুজাদ্দিদ সৃষ্টি করেন । তিনি সমস্ত ওলীর মধ্যে এমন মর্যাদা রাখেন যেমন নবীগণের মধ্যে রসুলের মর্যাদা । এই অনন্য মর্যাদায় ভূষিত হয়ে হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি দুনিয়ায় তশরীফ আনেন ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সংস্কারের দিকগুলোর মধ্যে বিশেষ দিক হচ্ছে বাদশাহ আকবর প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীকে রদ করে বা মিটিয়ে দিয়ে তৎস্থলে ইসলামী আইন-কানুন প্রবর্তন বা জারী করা । অত:পর তিনি ইলমে তাছাউফ স¤পর্কে ভূল ধারণা দূর করে দিয়ে সঠিক ধারণা তুলে ধরেন এবং তাছাউফের মকামাত স¤পর্কে নতুন নতুন তথ্য দান করেন, যাহা পূর্বে কেউই উল্লেখ করেন নি । তিনি সমস্ত তরীকাগুলিকে সংস্কার করেন । বিশেষ করে নকশবন্দীয়া তরীক্বাকে সংস্কার করে তার নাম দেন নকশবন্দীয়-মুজাদ্দেদীয়া তরীকা ।
কাইয়ূমিয়াতের মর্যাদা : হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : একদিন যোহরের নামাযের পর আমি মোরাকাবায় বসেছিলাম এবং হাফেজ সাহেব কোরআন পাক তেলাওয়াত করছিলেন । হঠাৎ আমি আমার উপরে একটি বিরাট নূরানী খেলয়াত (রাজকীয় পোষাক) দেখতে পেলাম । আমার মনে হলো, কাইয়ূমিয়াতের এই খেলয়াতই হলো সমগ্র সৃষ্টি, যা আখেরী নবী নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়ারিশ সূত্রে এবং উনার তাবেদারী ও আনুগত্যের কারণে আমাকে দান করা হয়েছে । ইত্যবসরে হযরত নবীয়ে করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তশরীফ এনে উনার মোবারক হাত দ্বারা আমর মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দিলেন এবং কাইয়ূমিয়াত উনার পদ-মর্যাদার মোবারকবাদ জানালেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি কাইয়ূমিয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : “কাইয়ূম” এই জগতে আল্লাহ পাক-উনার খলীফা । সমস্ত কুতুব আবদাল উনার দায়রায়ে জেলালে (প্রতিবিম্বের পরিধির মধ্যে) উনারই প্রতিনিধির অন্তর্ভূক্ত । আওতাদগণও কাইয়ূমের কামালতের বেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আওতাদ হচ্ছে আওলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের এক প্রকার পদ-মর্যাদা। সারা পৃথিবীতে মাত্র চার জন আওতাদ থাকেন। সমগ্র জগতের মানব মন্ডলী তাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য কাইয়ূমের প্রতি চেয়ে থাকেন । তিনিই সমস্ত জাহানের তাওয়াজ্জুহের একমাত্র লক্ষ্যস্থল । আল্লাহ পাক যাঁকে কাইয়ূমিয়াত দান করেন, তিনি এই বিষয়ে অবগত থাকুন বা নাই থাকুন, সমগ্র সৃষ্ট জগত উনার পবিত্র সত্ত¦ার ওছীলাতেই কায়েম থাকে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া) আমাদের মামদুহ মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার একটি লক্বব মুবারক ক্বাইয়ূমুয যামান ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে আল্লাহ পাক “মুকাল্লাম” এবং “মুহাদ্দাছ” বানিয়েছিলেন, যেমন তিনি মকতুবাত শরীফে উল্লেখ করেছেন । বান্দার সঙ্গে আল্লাহ পাক কোন কোন সময় বিনা মাধ্যমে কথা বলে থাকেন, যেমন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-উনাদের কারো কারো সাথে হয়েছিল । আবার কখন কখন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-উনাদের পূর্ণ অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ উত্তরাধীকারী সূত্রে এই মকাম হাসিল করে থাকেন । যদি এই তরীক্বায় কথা বলা উ¤মতের মধ্যে কোন ব্যক্তির অনেক বার হাসিল হয়ে যায়, তবে সেই ব্যক্তিকে “মুহাদ্দাছ” বলা হয়, যেমন হযরত ওমর ফারুক আলাইহিস সালাম । এই কথা বলা ক্বলবী ইলহাম ও ইলকা থেকে ভিন্ন ধরণের । ফেরেশ্তার সঙ্গে যে কথা হয়ে থাকে ইহা সেই প্রকারের কথাও নয় । (মকতুবাত শরীফ দ্বিতীয় খন্ড, মকতুব নং ৫১) (হাযারাতুল কুদস)
দুনিয়াতেই আখিরাত : আল্লাহ পাক তিনি উনার অশেষ রহমতে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দুনিয়াকে আখিরাতে পরিণত করেছিলেন । হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ১৯১ নং মকতুবে লিখেছেন : আল্লাহ পাক তিনি হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে এই সুসংবাদ দান করেছিলেন যে, “আপনার জন্য দুনিয়াকে আখিরাতে পরিণত করে দিলাম” । এর ব্যাখ্যা এইরূপ হতে পারে যে, আল্লাহ পাক তিনি উনার পেয়ারা বান্দাদের জন্য মর্যাদা স¤পন্ন যে আখিরাতের ওয়াদা করেছেন, তা কেবল শান্তিই শান্তি । সেখানে কোন চিন্তা, কোন পেরেশানী কিংবা ভয় ভীতির লেশমাত্র নেই । আছে কেবল আল্লাহ পাক-উনার রহমত ও দীদার । আল্লাহ পাক তিনি নিজের রহমতে যে সমস্ত সুউচ্চ মকামের আওলিয়া কিরামের দুনিয়াকে আখিরাত বানিয়ে দেন, উনারা সাধারণ মানুষের মত দুনিয়ায় বাস করলেও, কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা উনাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না । এমনকি জ্বরা-ব্যাধি ও মৃত্যুর প্রতিক্রিয়াও উনাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না । উনারা সব সময় দুনিয়াতেই আখিরাতের অনন্ত জীবনের মত আল্লাহ পাক-উনার দীদার এবং রহমতের সীমাহীন মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত থাকেন । ইহাকেই বলা হয় দুনিয়াতে আখিরাত । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
একদিন হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি মোরাকাবা হালতে নিজের দোষ-ত্র“টি অবলোকন করলেন । ইত্যবসরে উনার উপর ইলহাম হলো :-
غَفَرْتُ لَكَ وَ لِمَنْ تَوَسَّلَ بِكَ بِوَاسِطَةٍ اَوْ بِغَيْرِ وَاسِطَةٍ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ -
(আমি কিয়ামত পর্যন্ত আপনাকে এবং আপনার ওছীলা অবলম্বনকারীগণ সকলকে মাফ করে দিলাম । তা আপনার সিলসিলার মাধ্যমে হউক আর নাই হউক ।) (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : কিয়ামত পর্যন্ত যত পুরুষ ও নারী আমার সিলসিলা কিংবা অন্য কোন সিলসিলার মাধ্যমে আমার তরীক্বার মধ্যে দাখেল হবে, তাদের সকলকেই আমার স¤মুখে পেশ করে তাদের নাম, নসব, বংশ পরিচয়, জš§ভূমি এবং বাসস্থান সমস্ত কিছুই বলে দেয়া হয়েছে । আমি ইচ্ছা করলে সকলেরই পূর্ণ ঠিকানা বলে দিতে পারি । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
উনাকে এই সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল যে, তিনি যার জানাযার নামাজ পড়াবেন, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আল্লাহ পাক নিজের মেহেরবানীতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমার সমস্ত লিখিত বস্থু ও মকতুবাত শরীফ আখেরী যামানায় হযরত ইমাম মেহদী আলাইহিস সালাম-উনার স¤মুখে পেশ করা হবে এবং ইহা উনার নিকট মকবুল এবং গ্রহণযোগ্য হবে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
তিনি আরো বলেছেন : নবুয়ত ব্যতীত মানুষের পক্ষে যত কামালাত সম্ভব, আল্লাহ পাক আমাকে তা দান করেছেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খলীফা মাওলানা বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “হাজারাতুল কুদস” কিতাবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই ক্বওল শরীফ লিখেছেন : ঐ সময় আওলিয়া কিরামের এত অধিক পরিমাণ রূহ মোবারক সিরহিন্দে তশরীফ এনেছিলেন যে, সিরহিন্দের সমস্ত ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট বন-জঙ্গল ভরে গিয়েছিল । বুজযর্গানে দ্বীনের বিতর্ক এত চরমে উঠেছিল যে, সকাল থেকে যোহরের ওয়াক্ত হয়ে গেল । এমন সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজলিসে তশরীফ এনে সকলের প্রতি মহব্বত ও মেহেরবানী প্রদর্শন করে ইরশাদ করলেন, “যেহেতু শায়েখ আহমদের তকমীল (পরিপূর্ণতা) নকশবন্দীয়া তরীক্বার মাধ্যমে হয়েছে, সেইজন্য তিনি এই তরীক্বারই সংস্কার ও প্রচার করবেন । অন্যান্য বাকী তরীক্বার নিসবতও ইল্কা (শিক্ষাদান) করবেন । কারণ উনাদের হক্বও সাবিত (প্রমাণিত) আছে । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার এই সুন্দর মীমাংসায় সকলেই ফাতেহা খায়ের পড়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় গ্রহণ করলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : আমি কাশফের মারফত জানতে পেরেছি যে, হিন্দুস্থানে বহু আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম বিলাদত শরীফ লাভ করেছিলেন । ইনাদের মধ্যে কারো একজন উ¤মত, কারো দু’ জন উ¤মত এবং কারো তিনজন মাত্র উ¤মত ছিল । তিনজনের অধিক কারো উ¤মত ছিল না । আমি ইচ্ছা করলে উনাদের বিলাদত শরীফের স্থান, বাড়ী এবং নবুয়তের স্থান বলে দিতে পারি । এমনকি উনাদের মাযারও দেখিয়ে দিতে পারি । কারণ উনাদের কবর শরীফ হতে নূর প্রকাশ হচ্ছে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার তাছাররুফাত ও কারামাত
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনেক তাছাররুফাত ও কারামতের কথা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে । হযরত শায়েখ বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন) কর্তৃক লিখিত “হাযারাতুল কুদস” নামক কিতাবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রায় এক শত কারামত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।
গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বেলায়েতের প্রভাবে আমীর ওমরাহ হতে শুরু করে ছোট বড় সকলেই দলে দলে উনার নিকট বয়েত হতে লাগল । রাফেজী স¤প্রদায় বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে বুঝাতে লাগল : ফকীরির আবরণে শায়েখ আহমদ আপনার রাজ্যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় । তারা ইহাও বলতে লাগল যে, শাহী দরবারে তাকে তলব করলেই ইহা প্রমাণিত হবে । কারণ বাদশাহের বশ্যতা স্বীকারের প্রমাণ স্বরূপ প্রত্যেককেই শাহী দরবারে হাযির হয়ে বাদশাহকে সিজদা করতে হয় । কিন্তু যেহেতু তিনি নিজকে বাদশাহের বরাবর মনে করেন, সেজন্য সিজদা করবেন না।
বাদশাহ তাদের কথা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে দরবারে দাওয়াত দিলেন । হযরত দাওয়াত গ্রহণ করে দিল্লীর শাহী দরবারে হাজির হলেন, কিন্তু বাদশাহকে সিজদা করলেন না । অনেক চেষ্টা ও ফন্দী করা হলো, তথাপি হযরত সিজদা তো দূরের কথা বাদশাহের স¤মানের জন্য মস্তক সামান্য অবনতও করলেন না । অত:পর বাদশাহ চক্রান্তকারীদের কথায় বিশ্বাস করে হযরতকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করলেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার জীবনের একটি নির্দিষ্টকাল জেলখানায় অতিবাহিত হয়ে গেল । আল্লাহ পাক এ সময়ের মধ্যে জেলখানায় যাদেরকে বাতেনী ফায়দা পৌঁছাবার ছিল, হযরতের ওসীলায় তাদেরকে বাতেনী ফায়দা পৌঁছালেন । বন্দীদশায় মুছিবতের মধ্যে হযরতকে যে যে মকামে উন্নতি দানের ইচ্ছা ছিল, তা পূর্ণ হলো ।
হযরত গোয়ালিয়র দুর্গে থাকা অবস্থায় এক সময় দেখা গেল দুর্গের বাইরে অবস্থা ভিন্নরূপ ধারণ করেছে । আবদুর রহীম খান খানান, খানে-আজম মীর্জা আযিয, হায়দর জাহান, ইসলাম খান, হায়াত খান, কাসেম খান প্রমুখ আমীর ওমরাহ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি সম্রাট জাহঙ্গীরের এই দুর্ব্যবহারে মর্মাহত হলেন । শাহজাদা খুররম (পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান) স্বয়ং এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করে ব্যর্থ হন । ওদিকে কাবুলের শাসনকর্তা মহব্বত খান সম্রাটের এই বে-আদবীতে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন । কাবুল ও পেশোয়ারের বীর পাঠানরা মহব্বত খানের সাথে যোগ দিলেন । সম্রাট জাহাঙ্গীর এই বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কাবুলের দিকে রওয়ানা হলেন । পথিমধ্যে ঝিলাম নদীর তীরে উভয় বাহিনীর মোকাবেলা হলো । সম্রাটের বাহিনী পর্যুদস্থ হলো, আর বাদশাহ স্বয়ং বন্দী হলেন মুহব্বত খানের হাতে ।
গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন । মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তপাত উনার জীবনের কাম্য নয় । তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের পুত্র, মুহব্বত খান ও আমীর ওমরাহদের নিকট পত্র প্রেরণ করলেন যেন সম্রাটকে মুক্তি দেয়া হয় ।
পক্ষান্তরে মুহব্বত খানেরও অকৃত্রিম ভক্তি যে কোন মানুষের অদর্শ স্থল । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার পত্র প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরসহ সকলকেই মুক্তি দিলেন এবং আগের মত সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন । অথচ মুহব্বত খান ইচ্ছা করলে এই সময় দিল্লীর সিংহাসন দখল করতে পারতেন । কিন্তু দিল্লীর মসনদের চেয়ে নিজের মুর্শীদের নির্দেশ ছিল উনার নিকট বেশী মূল্যবান ।
এই ঘটনার পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনের মোড় ঘুরে গেল । তিনি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মুক্তির আদেশ দিলেন, ক্ষমা চেয়ে উনার কাছে পত্র লিখলেন । এই পত্রের জাওয়াবে তিনি সম্রাটকে জানালেন : আপনি যদি আমার কয়েকটি শর্ত মেনে নেন, তবেই আমি মুক্তি লাভ করতে রাযী আছি । হযরত উনার পত্রে সাতটি শর্ত আরোপ করেন । তার মধ্যে বাদশাহকে সিজদা করার প্রথা বাতিল, রাজ দরবারে প্রচলিত শরীয়ত বিরোধী রীতিনীতি বর্জন, দেশ থেকে কুসংস্কার ও বিদয়াতের মুলোচ্ছেদ এবং বিশেষ করে রাজবন্দীদের মুক্তিদানের শর্ত সমূহ ছিল অন্যতম ।
সম্রাট জাহাঙ্গীর দ্বিধাহীন চিত্তে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সমস্ত শর্ত মেনে নিলেন এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উনার মুক্তির ব্যবস্থা করলেন । হযরতকে মুক্তি দিয়েই সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষান্ত হলেন না । বরং উনার মহানুভবতা ও মুজাদ্দেদী আখলাকের মাহাত্ম্যে নিজ প্রাণ ও সিংহাসন ফিরে পেয়ে উনার কাছে বয়েতও গ্রহণ করলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
বিছাল শরীফ
হিজরী ১০৩২ সনে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন আজমীর শরীফে ছিলেন বললেন : আমার বিছাল শরীফের সময় নিকটবর্তী । আর এ সময় তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে সুসংবাদ ও কারামত সমূহ হাসিল করতে লাগলেন ।
উনার বিছাল শরীফের পূর্বরাত্রে খাদেমদেরকে ডেকে বললেন : আপনারা খুবই কষ্ট করেছেন । আর কেবল আজকের রাত্রি । রাত্রির শেষভাগে তাহাজ্জুদ পড়ে বললেন : ইহাই শেষ তাহাজ্জুদ । পরদিন ভোরে ইশরাকের নামাযের পরে ইস্তেঞ্জার জন্য পাত্র চাইলেন, কিন্তু তাতে বালি ছিল না । হযরত এতে বালি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন : বালি ছাড়া ইস্তেঞ্জা করলে ছিটা পড়ার সন্দেহ থাকে। এ নির্দেশ দানের সঙ্গে সঙ্গেই বললেন : আমাকে শোয়ায়ে দাও । হয়ত হযরতের ধারণা হয়েছিল ইস্তিঞ্জা করার পর ওযু করার অবসর হবে না । অত:পর তিনি ডান হাত গন্ডদেশে রেখে ডান কাতে শুয়ে যিকিরে মশগুল হলেন । ছাহেবযাদাগণ জিজ্ঞাসা করলেন : হযরত ! এখন কেমন মনে হচ্ছে ? তিনি জাওয়াব দিলেন : যে দু’ রাকাত নামায পড়েছি, তাই যথেষ্ট । এরপর আর কোন কথা বলেন নি । পর মূহূর্তেই যিকিরের অবস্থায় ১০৩৪ হিজরীর (১৬২৪ ঈসায়ী) ২৮শে ছফর আল্লাহ পাক-উনার দীদারের জন্য দুনিয়া হতে বিদায় নিলেন । বিছাল শরীফের সময উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৬৩ বছর । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সন্তান-সন্ততি
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাত পুত্র ও তিন কন্যা ছিলেন । কন্যা সন্তানগণ সকলেই শিশু অবস্থায় বিছাল শরীফ লাভ করেন ।
ত¤মধ্যে সর্বপ্রথম সন্তান ছিলেন হযরত খাজা মুহ¤মদ ছাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি । আট বছর বয়সেই উনার উপর আশ্চর্যজনক যজ্বা, হাল, কাশফ ও ইসতিগরাকের অবস্থা প্রকাশিত হয়েছিল । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার যজ্বার প্রাবল্য দেখে বলতেন : এই ছেলেকে কিছু বাজারী খানা খাওয়াও যাতে সে স্বাভাবিক থাকে । উনার বহু কারামত, বুজুর্গী ও কামালাত-এর উল্লেখ আছে । তিনি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে হিজরী ১০২৫ সনে বিছাল শরীফ লাভ করেন । (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাজা মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বাল্যকাল থেকেই উনার ওলীত্বের বহু নিদর্শন প্রকাশিত হয় । তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন । উনার অনেক কাশফ ও কারামতের উল্লেখ আছে । তিনি বর্ণনা করেন : যে সময় সিরহিন্দ শরীফে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন আমার কয়েকজন ভাই বোন একসঙ্গে বিছাল শরীফ লাভ করলে একদিন আমার বুযুর্গ পিতা আমাকে এবং আমার ভাই মুহ¤মদ মাসুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে লক্ষ্য করে বললেন : আজ সাহরীর সময় মহান আল্লাহ পাক তিনি মিছালী ছুরতে তোমাদের দু’ জনকে আমার কোলে অর্থাৎ হযরত মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে ডান জানুতে এবং হযরত মুহ¤মদ মা’সুম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বাম জানুতে বসালেন এবং এইরূপ ইলহাম করলেন, এই দু’জনকে আপনাকে দান করলাম, উনারা দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন এবং বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হবেন। (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার তৃতীয় সন্তান হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হিজরী ১০০৭ সনে বিলাদত শরীফ লাভ করেন (তারীখে দাওয়াত ও আযীমত, ৪র্থ খন্ড পৃ: ৩৭৩) )। শৈশবকাল থেকেই উনার মধ্যে কতগুলো আশ্চর্যজনক লক্ষণ প্রকাশ পায় । তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেন । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন উ¤মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রথম কাইয়ূম এবং উনার পুত্র হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকেও আল্লাহ পাক “কাইয়ূমিয়াত” দান করেন, যে জন্য তিনি দ্বিতীয় কাইয়ূম উপাধীতে ভূষিত হন । তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যেদিন ‘গদীনশীন’ হন, সেদিনই পঞ্চাশ হাজার লোক উনার হাত মুবারকে বাইয়াত হন । উনার অসংখ্য কাশফ ও কারামত রয়েছে । তিনি হেদায়েতের কাজে এতই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন যে, উনার প্রায় নয় লক্ষ মুরীদ এবং সাত হাজার খলীফা ছিলেন । কথিত আছে যে, হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি এতই প্রভাবমন্ডিত ও তেজস্বী ছিলেন যে, আওরঙ্গজেব বাদশাহ হয়েও উনার সাথে সরাসরি আলাপ করতে সাহস পেতেন না । উনার যা কিছু বক্তব্য থাকত, নিতান্ত আদবের সাথে তিনি তা লিখিতভাবে পেশ করতেন । (বিপ্লবী মুজাদ্দেদ রহ
হযরত খাজা মুহ¤মদ ইয়াহইয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র । তিনি উনার বড় ভাইগণ হযরত খাজা মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাদের নিকট জাহেরী ও বাতেনী ইলমে পরিপূর্ণতা লাভ করেন । (হাযারাতুল কুদস)। হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বাকী সন্তানগন শৈশবাস্থায়ই বিছাল শরীফ লাভ করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দু’টি বড় কারামত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরকাল লিখিত থাকবে । প্রথম হচ্ছে উনার পবিত্র ক্বওল শরীফ অর্থাৎ মকতুবাত শরীফ উনার মত অন্য কোন মাশায়েখ লিখতে অপারগ । আর দ্বিতীয় হচ্ছে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সন্তানগণকে নিজের তাছাররুফ দ্বারা নিজের মত ইলেম, আমল ও বাতেনী কামালাতে এতই পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ পাক-উনার যমিনে অন্য কোন মাশায়েখ এরূপ করতে সক্ষম হন নি । আর এ দু’টি কারামত দুনিয়াতে সূর্যের চেয়েও বেশী আলোকময় এবং সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে এক আশ্চর্যজনক বিষয় হিসাবে পরিগণিত। (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খলীফা
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার কয়েক হাজার খলীফা ছিলেন, যাঁরা কেবল হিন্দুস্তানেই নয়, বরং ইরাণ, তুরান, আফগানিস্তান, ইরাক প্রভৃতি দেশে দীন ইসলামের প্রচার, তথা মুজাদ্দেদীয়া তরীকার ব্যাপক প্রসার ও প্রচারের জন্য আত্মনিয়োগ করেন । ত¤মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন হযরত খাজা মুহম্মদ মা’ছুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত শায়খ আদম বিন্নুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি । তারীখে দাওয়াত ও আযীমত কিতাবে অন্যান্য আরো ত্রিশ জন প্রসিদ্ধ খলীফার নাম উল্লেখ করা হয়েছ।
(সূত্র: হালতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, রওযাতুল কাইয়ূমিয়া, হাযারতুল কুদ্স,
মকতুবাত শরীফ, বিপ্লবী মুজাদ্দিদ রহ:, তারীখে দাওয়াত ও আযীমত )
িলাদত শরীফ
ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের অন্তর্গত ফতেহ্গড় তহসীলে অবস্থিত “সিরহিন্দ” নামক স্থানে হিজরী ৯৭১ সনে (১৫৬৩ ঈসায়ী) ১৪ই শাওয়াল বিলাদত শরীফ লাভ করেন । উনার পিতার নাম ছিল হযরত মখদুম আবদুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি।
একদিন হযরত বড় পীর গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি কোন জঙ্গলে মোরাকাবায় মশগুল ছিলেন । হঠাৎ আসমান থেকে একটি নূরের প্রকাশ ঘটল এবং তার জ্যোতিতে সমগ্র বিশ্ব আলোকিত হয়ে উঠল । অত:পর হযরত গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে অবহিত করা হলো যে, এখন থেকে পাঁচ শত বৎসর পর পৃথিবীতে যখন শেরেক ও বিদয়াত ছড়িয়ে পড়বে একজন হক্কানী ওলী উ¤মতে হাবীবীর মধ্যে বিলাদত শরীফ লাভ করে শেরেক ও বিদয়াতকে নিশ্চিহ্ন করবেন এবং দ্বীনে হাবীবীকে সঞ্জীবিত করে তুলবেন । অত:পর হযরত গাওসুল আজম রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজের খাছ খেরকা মোবারক কামালাতে ভরপুর করে উনার ছাহেবযাদা সাইয়্যিদ তাজউদ্দীন আবদুর রাজ্জাক রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে ওসীয়ত করেন : যখন ঐ বযুর্গ প্রকাশ হবেন, তখন আমার খেরকা উনাকে সোপর্দ করবে । সেই সময় থেকে খেরকা মোবারক হস্তান্তরিত হয়ে হযরত গাওসুল আজম-উনার বংশধর হযরত সাইয়্যিদ শাহ সিকান্দর রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট আমানত ছিল । তিনি হযরত ইমামে রব্বানী মোজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট এই বরকতময় খেরকা সোপর্দ করেন ।
তা’লীম ও তরবীয়াত
হযরত ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু, সেই সময় তিনি একবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন । উনার বাঁচার আশা ছিল না । ঠিক সেই সময় হযরত শাহ কামাল কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি সিরহিন্দ শরীফে উপস্থিত হলেন । হযরতের পিতা উনাকে নিয়ে হযরত কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাযির হলেন । তিনি উনার পবিত্র জিহ¦া মুবারক শিশু হযরত ইমামে রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মুখে প্রবেশ করিয়ে দিলে তিন অনেকক্ষণ ধরে হযরত কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার জিহ¦া মুবারক চূষতে লাগলেন । হযরত শাহ কামাল কায়থালী রহমতুল্লাহি আলাইহি শিশুর বুযুর্গ পিতা হযরত মখদুম আবদুল আহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন : আপনি শান্ত থাকুন, আপনার সন্তান দীর্ঘায়ূ এবং জবরদস্ত আ’লিম ও আ’রিফ হবেন । যদিও ইহা শিশুকালের ঘটনা, তথাপি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলতেন : আমার এখনও ঐ ঘটনা স্মরণ আছে ।
শিক্ষালাভ করার বয়সে উপনীত হলে হযরত ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মক্তবে ভর্তি করে দেয়া হল । অল্প দিনের মধ্যেই তিনি কুরআন শরীফ হেফজ করে ফেললেন । অত:পর নিজের বুযুর্গ পিতার নিকট বিভিন্ন ইলেম শিক্ষা করতে লাগলেন । অন্যান্য আলেমের নিকটও তিনি শিক্ষা লাভ করেন । শিয়ালকোটের তৎকালীন খ্যাতনামা আলেম মাওলানা কামালউদ্দীন কাশ্মিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট তিনি “আজুদী” ও অন্যান্য কঠিন কিতাব অধ্যয়ন করেন । ইহা ছাড়াও সেকালের বড় আলেম শায়খুল মুহাদ্দিছীন শায়খ আবদুর রহমান ইবনে ফাহাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার ছাত্র মাওলানা কাজী বাহলুল বদখশানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট তিনি মিশকাত শরীফ, ছহীহ বুখারী, শামায়েলে তিরমিজী, জামে ছগীর, তফসীরে ওয়াহেদী, বায়জাবী শরীফ, কাসিদায়ে বোরদা প্রভৃতি অধ্যয়ন করেন এবং ইজাজত হাসিল করেন ।
তিনি কাশ্মীরের শায়েখ ইয়াকুব মোহাদ্দিছ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে হাদীছ শরীফের কিতাব শুনিয়ে হাদীছ-শরীফের সনদ এবং কোব্রাবীয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া তরীকার ইজাজত হাসিল করেন ।
মাত্র সতের বৎসর বয়স মুবারকে নিজের শিক্ষা সমাপন করে তিনি শিক্ষকতার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং খুবই পরিশ্রমের সাথে ছাত্রদেরকে শিক্ষা দান করতে থাকেন । ইতিমধ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে একবার তৎকালীন রাজধানী আকবরাবাদ যাওয়ার সুযোগ হয় । সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থানকালে শাহী দরবারের বিশিষ্ট সদস্য আবুল ফজলের সাথে উনার সাক্ষাত ঘটেছিল । কিন্তু পরিশেষে তার খারাপ আকীদার জন্য আবুল ফজলের উপর নারাজ হয়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তার সাহচর্য পরিত্যাগ করেন ।
আকবরাবাদ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইলেম ও কামালাত হাছিলের জন্য পূণরায় উনার বুযুর্গ পিতার খিদমতে অবস্থান করে চিশ্তিয়া তরীকার খিলাফত ও ইজাজত লাভ করেন ।
বায়তুল্লাহ শরীফের তওয়াফ এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার রওযা শরীফের যিয়ারতের আগ্রহে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সদা সর্বদা উদগ্রীব থাকতেন । কিন্তু উনার বুযুর্গ পিতার বৃদ্ধাবস্থার জন্য উনার খিদমত থেকে পৃথক হওয়া পছন্দ করতেন না ।
অত:পর উনার বুযুর্গ পিতার বিছাল শরীফের পর হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ১০০৮ হিজরীতে হজ্বের উদ্দেশ্যে সিরহিন্দ শরীফ থেকে রওয়ানা হন । দিল্লী পৌঁছবার পর হযরতের সঙ্গে উনার বন্ধু মাওলানা হাসান কাশ্মিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাক্ষাত হলে তিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে উনার সাথে সাক্ষাতের জন্য উনাকে উৎসাহিত করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অন্তরে নকশবন্দীয় তরীকার উচ্চতম নিসবত হাসিলের প্রবল আগ্রহ ছিল । সেজন্য তিনি হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে হাযির হলেন। হযরত খাজা সাহেব উনার শুভাগমনে খুবই খুশী হয়ে উনার আগমনের কারণ ও ইচ্ছা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উনার হজ্ব সফরের সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত করলেন ।
হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি কাউকে বয়েত করার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা অবলম্বন করতেন । কিন্তু হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি উনার অভ্যাসের খেলাফ করে বললেন : যদিও আপনার সফরের ইচ্ছা খুবই মুবারক, তথাপি যদি আপনি কমপক্ষে এক সপ্তাহ কিংবা এক মাস ফকীরদের ছোহবতে অবস্থান করেন, তাতে কি কোন দোষ আছে ? অগত্যা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এক সপ্তাহ উনার ছোহবতে অবস্থানের ইচ্ছা করলেন ।
মাত্র দু’ দিন উনার ছোহবতে থাকার পরই হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মনে নকশবন্দীয়া তরীকায় দাখেল হওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল । তিনি হযরত খাজা সাহেব-উনার খিদমতে উনার ইচ্ছার কথা পেশ করলেন। হযরত খাজা সাহেব কাউকে বয়েত করার পূর্বে ইস্তেখারা করার নির্দেশ দিতেন । কিন্তু এ ক্ষেত্রে হযরত খাজা সাহেব বিনা ইস্তেখারায় হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে উনার তরীকায় দাখেল করে নির্জনে তাওয়াজ্জুহ দিতে লাগলেন । প্রথম ছোহবতের তাওয়াজ্জোহতেই হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানি রহমতুল্লাহি আলাইহি-উন্রা ক্বলবে যিকির জারী হয়ে, ইহার মিষ্টতা ও স্বাদ সৃষ্টি হয়ে গেল । এর পর হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তরীকতের তা’লীম ও তরবীয়ত স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাথে এমন বে-নজীর ব্যবহার প্রদর্শন করতে লাগলেন, যা কেউ কখনও দেখে নি বা শুনে নি । মাত্র দু’ মাস কয়েকদিনের মধ্যে হযরত মজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নকশবন্দীয়া তরীকার সমস্থ নিছবত হাছিল করে ফেললেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
একদিন হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে বললেন : হযরত খাজা মুহ¤মদ আমকাঙ্গী রহমতুল্লাহি আলাইহি একদিন আমাকে হুকুম দিলেন : আপনি হিন্দুস্থান চলে যান, সেখানে আপনার দ্বারা এই তরীক্বা জারী হবে । আমি নিজের মধ্যে এই যোগ্যতার কোন লক্ষণ না দেখে ওজর আপত্তি পেশ করলাম । তখন তিনি আমাকে ইস্তেখারা করার হুকুম দিলেন । ইস্তেখারা কালে আমি দেখতে পেলাম একটি তোতা পাখী গাছের ডালে বসে আছে । আমি মনে মনে বললাম, যদি এই তোতা পাখী উড়ে এসে আমার হাতে বসে, তা হলে আমার হিন্দুস্থান সফর সাফল্যমন্ডিত হবে । আমার মনে এই ধারণা জাগার সঙ্গে সঙ্গেই তোতা পাখিটি আমার হাতে এসে বসল । আমি তার ঠোঁটে নিজের মুখের লালা দিয়ে দিলাম । আর তার পরিবর্তে তোতা পাখী আমার মুখে চিনির লালা প্রদান করল । আমি সকালে উঠে হযরত খাজা মুহ¤মদ আমকাঙ্গী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খিদমতে ইস্তেখারা কালে আমার রাত্রের স্বপ্নের বিবরণ পেশ করলাম । ইহা শুনে তিনি বললেন : হিন্দুস্থানের পাখীর মধ্যে তোতাই সমধিক প্রসিদ্ধ । হিন্দুস্থানে আপনার মাধ্যমে এমন এক বুযুর্গ প্রকাশ হবে, যার দ্বারা সারা দুনিয়া আলোকিত হবে এবং আপনিও উপকৃত হবেন ।
যখন আমি সিরহিন্দ শরীফে পৌঁছলাম, তখন কেউ আমাকে স্বপ্নে বললেন : আপনি একজন কুতুবের আশে পাশে অবস্থান করছেন । তিনি আমাকে কুতুবের চেহারাও দেখিয়ে দিলেন । সকালে উঠে আমি সিরহিন্দ শরীফের বুযুর্গদের সাথে সাক্ষাত করলাম । যারা গোশনশিনী (একাকী নির্জনবাস) অবলম্বন করে আছেন, উনাদের খেদমতেও হাজির হলাম, কিন্তু স্বপ্নে দেখা চেহারা পেলাম না । আমি মনে করলাম এই স্থানের বাসিন্দাদের মধ্যেই কোন ব্যক্তি সেই যোগ্যতার অধিকারী হবেন এবং সম্ভবত: পরে উনার প্রকাশ হবে । তারপর যখন আপনি এখানে আসলেন, তখন স্বপ্নে দেখা চেহারা হুবহু মিলে গেল এবং আপনার মধ্যে সেই যোগ্যতার চিহ্নও বিদ্যমান দেখতে পেলাম । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : একদিন হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যিকির করছিলেন । সেই সময় আমি উনার খিদমতে হাযির হলাম । উনার ছোহবতের ওছীলায় প্রায়ই আমি বে-খুদী হালতে (আত্ম-ভোলা অবস্থায়) থাকতাম । উহা ‘ফানা’র আলামত। হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার পীর ভাই জনাব তাজ সম্বলী রহমতুল্লাহি আলাাইহি-উনাকে হুকুম দিয়েছিলেন যেন তিনি প্রত্যেক মুরীদকে তার রুহানী অবস্থা স¤পর্কে জিজ্ঞাসা করে হযরতের নিকট পেশ করেন । কিন্তু আমার উপর খাছভাবে হুকুম ছিল আমি যেন নিজে উনার খেদমতে হাজির হয়ে নিজের অবস্থা পেশ করি । আমার জন্য কোন ওছীলার প্রয়োজন নেই । এমন কি কোন কোন সময় হযরত নিজেই আমাকে স্মরণ করিয়ে আমার অবস্থা জানতে চাইতেন। কিন্তু আমি আদবের খাতিরে প্রায়ই নীরব থাকতাম এবং কিছুই বলতাম না ।
একদিন তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন : আপনি কেন নিজের হালাত (অবস্থা) বলতে ইতস্তত: করেন এবং নীরব থাকেন ? আমি মনে মনে বললাম : আমার হালই বা কি, আর কাইফিয়াতই বা কি, যে আমি তা হযরতের খেদমতে পেশ করব ? তিনি পূণরায় আমাকে একদিন বললেন : যা কিছু কাইফিয়াত (অবস্থা) হয়, তা আমাকে ঠিক ঠিক ভাবে বর্ণনা করবেন । ইতিমধ্যে একটি ঘটনা সংঘটিত হলো। আমি পীরভাই জনাব শায়েখ তাজ সম্বলী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি তাওয়াজ্জুহ দিলে, তিনি বেহুঁশ হয়ে যমিনে পড়ে গেলেন । হযরত বার বার জিজ্ঞাসা করলে আমি এই ঘটনা উনার খিদমতে আরজ করলাম । ইহা শ্রবণমাত্র হযরতের চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে গেল । মজলিসে উপস্থিত সালেকগণ হযরতের চেহারা মুবারক দেখে দীর্ঘ সময় যাবত নীরবে অবনত মস্তকে বসে থাকলেন । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মত এইরূপ একজন সুযোগ্য মুরীদের তরবীয়ত করার এবং উনাকে কামালাতের দরজায় পৌঁছাবার জন্য আল্লাহ পাক-উনার দরবারে শোকর আদায় করলেন । অত:পর এক মুবারক সময়ে উনাকে খিলাফত দানে বিভূষিত করে সিরহিন্দ শরীফ থেকে বিদায় নিলেন।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি মাত্র চল্লিশ বছর বয়স মুবারকে বিছাল শরীফ লাভ করেন এবং চার বৎসর ইশায়াতে দ্বীন ও তরীক্বার খিদমত করেন। এই স্বল্প কালের মধ্যে উনার ফয়েজের বরকতে লক্ষ লক্ষ লোক আল্লাহ পাক-উনার মহব্বত ও মা’রিফাত হাছিল করেছেন ।
হিদায়েতের কাজে আত্মনিয়োগ
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সিরহিন্দ শরীফ প্রত্যাবর্তনের পর নিজ বুযুর্গ পীরের নির্দেশ অনুযায়ী ঈশায়াতে দ্বীন ও মানুষের তরবীয়তের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার তালেবে-মাওলা (আল্লাহ পাক-উনার অন্বেষণকারী) উনাদেরকে মা’রিফাতের উচ্চ মকামে পৌঁছাতে সক্ষম হন । পঙ্গপালের ঝাঁকের মত লোক উনার খিদমতে হাজির হতে থাকেন ।
ইত্যবসরে হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার একখানি পত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার হস্তগত হয় । তিনি উক্ত পত্রে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন । পত্র পেয়ে তিনি পূণরায় দিল্লী রওয়ানা হলেন । উনার আগমনবার্তা পেয়ে সমস্ত খাদিম এবং সঙ্গীগণ সহ হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লীর কাবুলী দরজায় হাজির হলেন এবং অত্যন্ত ইজ্জতের সাথে উনাকে অভ্যর্থনা করলেন ।
দ্বিতীয়বার পীর সাহেব ক্বিবলার ছোহবতে দিল্লী তশরীফ আনার পর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিশেষ কামালাত ও উরুজ (উর্দ্ধারোহণ) হয় । এই সময় হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি পীর হয়েও মুরীদের প্রতি এত ইজ্জত প্রদর্শন করতেন যে, তিনি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মাহফিলের প্রধান বানিয়ে নিজে সমস্ত মুরীদসহ ফয়েজের জন্য মাহফিলে শরীক হতেন এবং মুরাকাবা হতে অবসর হয়ে এমনভাবে মাহফিলের বাইরে যেতেন, যেন হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দিকে পিঠ দেয়া না হয় ।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এইরূপ ব্যবহারে উনার কোন কোন খলীফা ও মুরীদের অন্ত:করণে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয় । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বাতেনী শক্তি দ্বারা ইহা জানতে পেরে খুবই দু:খিত হয়ে বললেন : যদি আপনারা নিজের ঈমান বাঁচাতে চান, তা হলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি আদব ও আক্বীদা ঠিক রাখুন । কারণ তিনি রূহানী সূর্য-সদৃশ এবং উনার নূরের জ্যোতির মুকাবেলায় আমাদের মত হাজার হাজার তারকার কোন অস্তিত্ব নেই । মনে রাখবেন, উ¤মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনাদের মধ্যে যে চারজন শ্রেষ্ঠ আউলিয়া আছেন, তিনি উনাদের অন্যতম ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি এত উচ্চ মকাম লাভ করা সত্তে¦ও নিজের পীরের প্রতি এত তাজীম ও আদব প্রদর্শন করতেন যে, তার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলািিহ-উনার একজন খলীফা হযরত হুসামুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এত উচ্চ মকামের অধিকারী হয়েও নিজের পীর ও মুর্শীদের আদবের প্রতি এমন খেয়াল রাখতেন যে, কোন মুরীদ কিংবা কোন খলীফা এত বা-আদব (শিষ্টাচারী) ছিলেন না । সেজন্যই তিনি হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট থেকে সবচেয়ে বেশী ফয়েজ হাসিল করেছিলেন । হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে একবার স্মরণ করেন । আমি গিয়ে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে সংবাদ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনার চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে যায় এবং ভয়ে উনার শরীর কাঁপতে থাকে ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মাবদা ও মায়াদ” কিতাবে লিখেন : হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাথে প্রত্যেক মুরীদ নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী পৃথক পৃথক আক্বীদা রাখতেন এবং প্রত্যেক মুরীদ নিজ নিজ আক্বীদা অনুযায়ী ফয়েজ প্রাপ্ত হতেন । আমার আক্বীদা ছিল, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পর এইরূপ ছোহবত, তরবীয়ত ও ইরশাদ হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি ব্যতিরেকে আর কারো নসীব হয় নি । আল্লাহ পাক-উনার দরবারে হাজার শোকর, আমি আমার আক্বীদা অনুযায়ী ফয়েজ প্রাপ্ত হয়েছি ।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তৃতীয়বার দিল্লী আগমনের পর হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন : আমার আর বেশী দিন বাঁচার আশা নেই । অত:পর তিনি উনার দু’ ছাহেবযাদা হযরত খাজা ওবায়দুল্লাহ রহমতুল্লাহি আল্ইাহি এবং হযরত খাজা আবদুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাদেরকে তাওয়াজ্জুহ দানের জন্য হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার স¤মুখে পেশ করলেন । তখন ইনারা দুগ্ধপোষ্য শিশুমাত্র । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই তাওয়াজ্জুহ-এর প্রভাব হযরত খাজা সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপরও প্রতিফলিত হয় ।
হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ঈশায়াতে দ্বীন, ইরশাদ ও তালক্বীন-এর গুরুদায়িত্ব হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আল্ইাহি-উনার উপর সোপর্দ করার সময় বলেছিলেন : বর্তমানে আসমানের নীচে এই সিলসিলায় উনার মত এত উচ্চ মকামের অধিকারী আর কেউ নেই । তিনি মুকা¤িমল মুরাদ, মাহবুব ও কুতুব । ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবেঈন ও ইমাম মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের পরে উনার মত ব্যক্তিত্ব খুব অল্পই নজরে আসে । এই তিন চার বৎসর আমি মুর্শিদী করি নি, কয়েকদিন আমি খেল্ তামাসা করেছি । কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ! আমার সামান্য প্রচেষ্টা বিফল যায় নি বরং উনার (হযরত মুজাদ্দেদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার) মত এক বিরাট ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হয়েছে ।
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজের পীর ও মুর্শীদের নিকট থেকে ইজাজত (অনুমতি) ও খিলাফত লাভের পর উনার নির্দেশ অনুযায়ী কিছুদিন সিরহিন্দ শরীফে অবস্থানের পর লাহোরে রওয়ানা হন । উনার পরিপূর্ণ কামালাতের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে । বড় বড় আলেম ও মাশায়েখগণ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার হাতে বয়েত হাসিল করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি লাহোরে অবস্থানকালে হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ১০১২ হিজরী সনে দিল্লীতে বিছাল শরীফ লাভ করেন । এই সংবাদ শুনে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি দিল্লী রওয়ানা হন । পথিমধ্যে সিরহিন্দ শরীফ আতিক্রম কালে সিরহিন্দ শরীফে এক মূহূর্তের জন্যও না থেমে দিল্লী পৌঁছে নিজের পীর ও মুর্শীদের মাযার শরীফে হাজির হন ।
ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় মুরশিদ হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহ-উনার নিকট থেকে নকশবন্দীয়া তরীক্বার খাছ নিসবত লাভ করার পর উনার নির্দেশে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন । ইতপূর্বেই উনার সুখ্যাতি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে । উনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পেয়ে চারদিক থেকে দলে দলে লোক উনার খিদমতে হাজির হয়ে বাইয়াত হতে থাকে।
এই সময় একদিন তিনি স্বীয় হুজরার মধ্যে ফজরের নামাযের পর মুরাকাবায় মশগুল আছেন । এমন সময় নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রূহানী ভাবে সমস্ত আম্বিয়া, অসংখ্য ফেরেশ্তা এবং আওলিয়া ও গাউস-কুতুবদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে তশরীফ আনেন এবং নিজ হাতে উনাকে একটি অমূল্য ‘খিল্আত’ অর্থাৎ স্বীয় প্রতিনিধিত্বের প্রতীক স্বরূপ এক বিশেষ পোষাক পরিয়ে দেন এবং বলেন : শায়েখ আহমদ ! মুজাদ্দিদের প্রতীক স্বরূপ আমি আপনাকে এই ‘খিলআত’ পরিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য আপনাকে আমার বিশেষ প্রতিনিধি মনোনীত করলাম । আমার উ¤মতের দ্বীন-দুনিয়া তথা ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় বিষয়ের দায়িত্ব আজ থেকে আপনার উপর ন্যস্ত করা হলো । এই ঘটনাটি ১০১০ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল শরীফ শুক্রবার ফজরের নামাযের সময় সংঘটিত হয় । আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণ সাধারণত: যে বয়সে পয়গম্বরী লাভ করতেন, সেই বয়সে অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়স মুবারকের সময় তিনি ‘মুজাদ্দিদ’ উপাধিতে ভূষিত হন । (বিপ্লবী মুজাদ্দিদ রহ
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি স¤পর্কে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন । হাদীছ শরীফে তিনি ইরশাদ করেন : একাদশ শতকের প্রারম্ভে আল্লাহ পাক দুনিয়ার বুকে এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি অত্যুজ্জল ‘নূর’ স্বরূপ হবেন । উনার নামকরণ হবে আমারই নামানুসারে । দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশাহের যুগে উনার আবির্ভাব হবে । উনার তালীম-তরবীয়তে অসংখ্য লোক জান্নাতের অধিকারী হবে (রওজাতুল কাইয়ূমিয়া) । উপরোক্ত হাদীছ শরীফে যে দু’জন স্বেচ্ছাচারী বাদশাহের কথা উল্লেখ রয়েছে, তারা ছিলেন সম্রাট আকবর ও তার পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর । আকবরের শাসনামলে প্রকৃতপক্ষে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সংস্কারমূলক কাজ আরম্ভ হয় এবং জাহাঙ্গীরের আমলে সেই কর্মসূচী পূর্ণতা লাভ করে ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “মাবদা ও মা’আদ” কিতাবে উল্লেখ করেছেন : আমি একদিন আমার সঙ্গী সাথীগণের সহিত বসা ছিলাম, তখন আমার দৃষ্টি স্বীয় খারাবীর দিকে পতিত হলো । কিছুক্ষণ এই অবস্থায় থাকার পর আমার মনে হলো, ফকিরী দরবেশীর সহিত আমি পূর্ণভাবে স¤পর্কহীন । আল্লাহ পাক-উনার জন্য যে অবনত হয়, আল্লাহ পাক তাকে উচ্চ করেন। এই হাদীছ অনুযায়ী আল্লাহ পাক যেন আমাকে মাটি হতে উত্তোলন করলেন এবং আমি আমার অন্ত:করনে শব্দ শুনতে পেলাম --
غَفَرْتُ لَكَ وَ مَنْ تَوَسَّلَ بِكَ بِوَاسِطَةٍ اَوْ بِغَيْرِ وَاسِطَةٍ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ -
(অর্থ: আমি আপনাকে ক্ষমা করলাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত যারা আপনাকে মধ্যস্থতায় অথবা বিনা মধ্যস্থতায় ওছিলা করবে তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম ।) এই কথা আমার অন্তরে পুন: পুন: নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল । যখন আমি সন্দেহহীন হলাম, তখন ইহা প্রকাশ করার জন্য আদেশ প্রাপ্ত হলাম । হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই ইলহাম দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যারা কিয়ামত পর্যন্ত এ তরিকায় দাখিল হবে এবং মউতের পূর্ব পর্যন্ত কায়েম থাকবে তাদের পরলোকে নাজাত নিশ্চিত । (মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ ৪/৪২)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আকবরী ফিত্না
হিজরী ৯৬৩ সাল (১৫৫৩ ঈসায়ী) থেকে হিজরী ১০১৪ সাল (১৬০৪ ঈসায়ী) পর্যন্ত দীর্ঘ ৫০ বছরের অধিককাল সম্রাট আকবর দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন । অত:পর ১০১৪ হিজরী সাল থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমল শুরু হয় এবং তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে রাজত্ব করেন । অত:পর হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিছাল শরীফের সাথে সাথে তার রাজত্বের অবসান ঘটে ।
আকবরের সময় রাষ্ট্র ছিল তিনটি শক্তির দ্বার বেষ্টিত । প্রথমত: আফগান সম্রাট: আকবরের পিতা হুমায়ূন যাদের হাতে পরাজিত হয়ে হিন্দুস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, অত:পর আকবরও তাদের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন । দ্বিতীয়ত: শিয়া স¤প্রদায়: এদের কেন্দ্র ছিল ইরাণ এবং এদের বদৌলতেই আকবরের পিতা হুমায়ূন দ্বিতীয়বার সিংহাসনে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তৃতীয়ত: হিন্দু : হিন্দুস্তানে যদিও হিন্দু অধিবাসীদের সংখ্যা শতকরা ৯৫ জন ছিল, কিন্তু তবুও অতীত মুসলিম সম্রাটের ভয়ে তারা এত ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে মোকাবিলা করার কোন শক্তিই অবশিষ্ট ছিল না ।
এই তিনটি প্রতিকূল শক্তির মাঝখানে নিশ্চিন্ত মনে রাজত্ব পরিচালনা করা সম্ভব নয় চিন্তা করে সম্রাট আকবর নিজের গদি সংরক্ষণের জন্য হিন্দুদের মন রক্ষা করে চলাকেই সঙ্গত ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করে । সাথে সাথে সে সুন্নী মুসলিম স¤প্রদায়কে বাদ দিয়ে তথাকথিত মুসলিম নামধারী অন্যান্য স¤প্রদায়ের সাথে হাত মিলায়, যার পরিপ্রেক্ষিতে সকল ধর্ম ও মতবাদের দু’-চার জন পন্ডিত নিয়ে সভানুষ্ঠান ও তাদের সাথে ধর্মালোচনা করাও তার রাজনীতির অন্যতম বিশেষ নীতি হিসাবে পরিগণিত হয় । সে মনে করেছিল যে, তার এই কর্মকান্ডের ফলে সকল ধর্ম ও সকল স¤প্রদায়ের লোকই তাকে আপন জন বলে মনে করবে এবং সে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘেœ তার রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে। এই মন মানসিকতার বশবর্তী হয়েই সে সকল ধর্মের সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় ব্রতী হয় । কিন্তু যেহেতু সে নিরক্ষর ছিল, সেহেতু বিভিন্ন মতাদর্শের অনুসারী পন্ডিতবর্গের কারসাজীর ফলে সে “দীনে ইলাহী” নামে এক অদ্ভূত ‘খিচূড়ী ধর্ম’ আবি®কার করে বসে, যা প্রকৃত ধর্মকে বিকৃত করার সাথে সাথে উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের ইতিহাসকেও কলঙ্কিত করে তোলে।
উলামায়ে “ছূ” (অসৎ আলেমগণ)-এর ফিত্না
যদিও ব্যক্তিগতভাবে বাদশাহ আকবর এই ফেত্নার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল, তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, সে এ ব্যাপারে দুনিয়াদার আলেমদের দ্বারাই বিভ্রান্ত ও প্রভাবান্বিত হয়েছিল । ইতিহাসের কষ্টিপাথরে বিচার করলে দেখা যায় যে, বাদশাহ আকবর প্রথম জীবনে একজন খাঁটি ধর্মভীরু সুন্নী মুসলমান ছিল । সে আলেমদের ছোহবত পছন্দ করত। জুমার দিবস ওলামাদের মজলিস বসত এবং দ্বীনী বিষয়ে আলোচনা হতো । জীবিকা অর্জনের খাহেসে শতাধিক ওলামা এই মজলিসে একত্রিত হতো । ক্রমে টাকা পয়সা ও লোভের বশবর্তী হয়ে ওলামাদের মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্য শুরু হয় । প্রত্যেকেই শাহী দরবারে প্রিয়পাত্র হওয়ার মানসে নানারূপ অশোভন ও অযোক্তিক কার্যাবলী প্রদর্শন করতে প্রয়াস পায় । প্রথমত: বাদশাহ তাদের ব্যাপারে দেখেও না দেখার ভান করত । কিন্তু তাদের পরস্পর মতানৈক্য ও বিবাদ বিসম্বাদ শেষ পর্যন্ত চরমে পৌঁছে । এতে বাদশাহ খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে ।
আকবরের দরবারে আবুল ফজল, ফৈজী ও মোল্লা মোবারকের ফেত্না ছিল ওলামায়ে ছু-এর ফেত্নার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক । আবুল ফজল ও ফৈজী ছিল মোল্লা মোবারকের দুই পুত্র । মোল্লা মোবারক একজন বিখ্যাত আলেম ছিল । সে চার মজহাবের সব রীতি নীতি স¤পর্কে ওয়াকেবহাল ছিল । সেজন্য সে নিজকে ইজতিহাদের দরজা প্রাপ্ত ব্যক্তি মনে করত । ইলেমের গৌরবে সে এক বিপদসঙ্কূল রাস্তায় পদক্ষেপ করে । তার অভ্যাসগত শিক্ষাদান ও তালীম-তালকীন-এর কাজ পরিত্যাগ করে । ইতিপূর্বে এই মোল্লা সাহেব শেরশাহ ও তার পুত্রের অনেক পীড়াপীড়ি সত্বেও সামান্য হাদিয়াও কবুল করে নি । কিন্তু বাদশাহ আকবরের যামানায় সে তার দুই পুত্রের সহায়তায় রাজনীতিতে যোগদান করে হিন্দুস্তানের সুন্নী ওলামাদেরকে তথা দ্বীন ইসলামকে আঘাত করে । ফলকথা শাহী দরবারে আবুল ফজল ও ফৈজীর ফিত্না ও ওলামায়ে ছু-এর ফেত্না এবং সঙ্গে সঙ্গে মোল্লা মোবারক নাগোরীর সমর্থনে গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতার দ্বার খুলে যায় এবং সুযুগমত বাদশাহ আকবরও নির্বিঘেœ তার মসনদ রক্ষার্থে সাহস ও সুযোগ পায় ।
বাদশাহ আকবর তার প্রচারিত দ্বীনে ইলাহীর আশান্বিত প্রচার ও প্রসার না হওয়াতে সে ক্ষুব্ধ হয়ে তার সভাসদগণকে তার ব্যর্থতার কারণ জিজ্ঞাসা করলো । তখন তার অনুরক্তরা জবাবে বলে : মযহাবের ইমামগণ নিজেদের গবেষণা দ্বারা বিভিন্ন মযহাব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং উনাদের মযহাবের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান কায়েম করেছেন, যা সমস্ত দুনিয়ার মুসলমানগণ বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছেন । আপনি যদি ইজতিহাদ বা গবেষণা দ্বারা তেমন কিছু বিধি বিধান প্রবর্তন করেন, তবে সবাই তা মেনে নিবে । আর আপনি যে ইজতিহাদের যোগ্য ব্যক্তি সে বিষয়ে আমরা আলেমদের নিকট থেকে ফতোয়া যোগাড় করে দিব।
অত:পর মোল্লা মোবারাক নাগোরী, আবুল ফজল ও ফৈজী প্রমূখগণ বাদশাহের মুজতাহিদ হওয়ার জন্য একখানি সনদ রচণা করে, যা ইতিহাসে “মাহযার নামা” রূপে বিখ্যাত । এতে বাদশাহের ইনামভোগী আলেমরা দস্তখত করল । এতে মূল বিষয় ছিল বাদশাহ আকবরের মর্যাদা একজন মুজতাহিদের মর্যাদা অপেক্ষাও উচ্চে । আকবর এই ইজতিহাদি সনদের বলে ইসলামী আকায়েদ সমূহের উপর আঘাত হানতে শুরু করল । ঐতিহাসিক বাদায়ূনী আক্ষেপ করে বলেন : পাঁচ ছয় বছর পর ইসলামের নাম নিশানও বাকী রইল না । বাদশাহ তার খুশীমত নতুন ধর্ম গঠন করতে লাগল (বাদায়ূনী) । আকবরের মত একজন নিরক্ষর স্বার্থপর ব্যক্তি শরীয়তবেত্তা মুজতাহিদ হওয়ায় তার পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়েছিল এবং অল্পদিনের মধ্যে তার বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া সমাজে প্রকাশিত হয় । দ্বীন ইসলাম স¤পর্কে আলাপ আলোচনা প্রসঙ্গে সর্বজনমান্য চারি মযহাবের ইমামদের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে আকবরের প্রধান সহচর ও সমস্ত অপকর্মের বড় সহায়ক আবুল ফজল বলত : তোমরা কি মহানুভব বাদশাহ ও যুগের শ্রেষ্ঠ মুজতাহিদ ও ইমামের সাথে অমুক রুটিওয়ালা, কষাই চামারের পুত্রদের তুলনা করতে চাও ? (আইনে আকবরী)
বাদশাহ আকবর হিজরী ১০১৪ সনে (১৬০৫ ঈসায়ী) মৃত্যুমুখে পতিত হয় । আবুল ফজল হিজরী ১০১১ সনে (১৬০২ ঈসায়ী) মৃত্যুবরণ করে । বাদশাহ আকবরের মৃত্যু ইসলামের উপর অথবা তার প্রবর্তিত দ্বীনে ইলাহীর উপর হয়েছিল কিনা তা বলা কঠিন । কেননা এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের পরস্পর বিরোধী মত ও দৃষ্টিভঙ্গী পরিলক্ষিত হয় । বাদশাহ জাহাঙ্গীরের বর্ণনা অনুসারে তার পিতা আকবর মৃত্যুর সময় কলেমায় শাহাদত পাঠ করেছিল এবং মৃত্যুর সময় তার চোখ বেয়ে অশ্র“ ঝরেছিল । মৃত্যুর পূর্বক্ষণে একজন আলেমকে সুরা ইয়াসিন পড়ার জন্য নাকি সম্রাট নির্দেশ দিয়েছিল ।
আকবরী ফিত্নার অন্যতম সহায়ক উলামায়ে “ছু” বা দুনিয়াদার অসৎ আলেমদের স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মকতুবাত শরীফে বলেন : “আলেমগণ পার্থিব মুহব্বত ও আসক্তিতে গ্রেপ্তার হলে তাদের সৌন্দর্য বিকৃত হয়ে যায় । অবশ্য এই অবস্থায়ও লোক তাদের নিকট থেকে বহু উপকার প্রাপ্ত হয় । কিন্তু তাদের ইলেম তাদের কোন উপকারে আসে না। শরীয়ত এদের ইলেম দ্বারা সময় সময় সাহায্যপ্রাপ্ত ও শক্তিশালী হয়ে থাকে। কোন কোন সময় বদকার ফাসেক লোকদের দ্বারাও এই প্রকার সাহায্য হয়ে থাকে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শ্রেণীর লোকদের খবর দিয়েছেন ।
প্রকৃতপক্ষে দুনিয়াদার নিকৃষ্ট আলেমদের কম্বখ্তি ও বদ্ নিয়ত এই যামানায় শরীয়তের ব্যাপারে গাফলতী ও উদাসিনতা সহ মযহাব প্রচলনে ও ত্র“টি বিচ্যূতি এনে দিয়েছে । অবশ্য যে সমস্ত আলেম দুনিয়াদারী থেকে উদাসীন এবং যশ:লিপ্সা, রাজনৈতিক সুবিধা, ধন স¤পদ ও উচ্চ আসন লাভের মুহব্বত থেকে নিজকে মুক্ত রেখেছেন, উনারাই প্রকৃত আলেম ও নবী আলাইহিমুস সালামগণের ওয়ারীশ বা উত্তরাধিকারী ” (মকতুব নং ৩৩) ।
আকবরী ফিত্না স¤পর্কে হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন: বিগত বাদশাহের (বাদশাহ আকবর) সময় বাদশাহী প্রাধান্যে কাফিরগণ প্রকাশ্যভাবে দারুল ইসলামে (হিন্দুস্তানে) কুফরী হুকুম-আহকাম জারী করত এবং মুসলমানরা ইসলামী হুকুম আহকাম জারী করতে অক্ষম ছিল । মুসলমানরা এইরূপ করলে তাদেরকে হত্যা করা হতো । বড়ই আফসোসের বিষয় এই যে, হক্বতায়ালা-উনার দোস্ত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার উপর ঈমান আনয়নকারীগণ বেইজ্জত ও অপদস্ত হতো এবং উনার প্রতি অবিশ্বাসীরা স¤মানী ও আস্তাভাজন ছিল । মুসলমানরা আহত হƒদয়ে ইসলামের জন্য মাতম জারী করত এবং শত্র“গণ হাসি তামাসা করে তাদের যখমের উপর লবণ ছিটিয়ে দিত । (মকতুব নং ৪৭)
বাদশাহ আকবরের পরে বাদশাহ জাহাঙ্গীরও মযহাবী দৃষ্টিকোন থেকে পিতার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি উনার পিতার অনুসারী ও দ্বীনে ইলাহীর একজন পরমভক্ত মুরীদ ছিলেন । উপরন্তু উনার আমলে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার অনুসারীদের জন্য এক নুতন ফিত্না দেখা দিয়েছিল । এই ফিত্নার উৎসমূলে ছিল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান তার দক্ষতার বলে সমস্ত রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন । স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীর বলেন: আমার রাজত্ব এখন নূরজাহান ও তার গোষ্ঠির হাতে । আমি রাজত্ব তাদেরকে দিয়ে দিয়েছি । প্রত্যহ আধা সের গোস্ত ও একসের শরাব ব্যতীত আর কিছুই আমি চাই না। (তুয্কে জাহাঙ্গীর)
নূরজাহান নিজে শিয়া ছিলেন । তার মাধ্যমে শিয়া মতবাদ প্রচার ও সুন্নীদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন চলতে থাকে এবং নানাপ্রকার ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ সমাজে বিস্তার লাভ করতে থাকে । এই সমস্ত অপকর্মের প্রতিরোধ করার দাবীতে বিভিন্ন মহল থেকে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খেদমতে আবেদন আসতে থাকে । এমতাবস্থায় তিনি কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস ও মঙ্গলময় ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিয়ে সকলকে আশ্বস্ত করেন।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সময় বহু মাশায়েখ ও ওলামায়ে কিরাম বিদ্যমান ছিলেন, যেমন শাহ সিকান্দার রহমতুল্লাহি আলাইহি, শাহ ফজলুর রহমান বোরহানপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা জামাল উদ্দীন লাহোরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মাওলানা আবদুল হাকিম শিয়ালকোটি রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রমূখ । এতদসত্বেও মহান আল্লাহ পাক-উনার নির্দ্দেশিত মুজাদ্দেদিয়াত ও কাইউমিয়াতের লক্বব (উপাধী) একমাত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর ন্যস্ত হয় এবং তিনি এই দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠ ও সূচারুরূপে স¤পন্ন করেন । উনার ব্যক্তিত্ব ও কামিয়াবী সর্বজন স্বীকৃতিলাভ করতে সক্ষম হয় ।
হিন্দুস্তানের তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম ও মুহাদ্দিস, হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি প্রায় ১০০ খানা কিতাব রচণা করেন, প্রথমত: হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর আপত্তিকর প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু যখন বিষয়টির আসল স্বরূপ প্রকাশ পায় তিনি উনার পূর্ব অভিমত থেকে ফিরে যান । তিনি স্বপ্নে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার যিয়ারত হাসিল করে প্রত্যক্ষ করেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দিকে ঈশারা করে বলছেন : যে আমাকে ভালবাসে, ইনার সাথেও তার ভালবাসা হওয়া উচিত । এই ঘটনার পর হযরত শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় পূর্ব ধারণা থেকে তওবা করেন এবং উনার মুরীদ হয়ে যান ।
হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার শরহে রিসালায় লিখেছেন: আল্লাহ পাক-উনার বড় আশ্চর্য কারিগরী যে, বাদশাহ আকবর ও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে যেরূপভাবে সর্বগ্রাসী ফিত্না ও ফাসাদের সমাবেশ ঘটেছিল, বিগত যুগে তার এক দশমাংশও দৃষ্টিগোচন হয় নি । অনুরূপভাবে এই দু’টি যুগে কারামত স¤পন্ন বহু আওলিয়ায়ে কিরাম ও বহু মূল্যবান গ্রন্থ লেখক ওলামাদেরও সমাবেশ ঘটেছিল । এসব ব্যক্তিরা এতদূর বুযুর্গ ছিলেন যে, উনাদের নামের ওছীলায় বরকত হাসিল করা যেত এবং উনাদের নাম স্মরণ করলে আল্লাহ পাক-উনার রহমত নাযিল হওয়ার আশা করা যেত। ইনারা সবাই বিশেষভাবে দিল্লী ও তার চার পাশের অধিবাসী ছিলেন । তাছাড়া গুজরাট ও দাক্ষিনাত্যেও এরূপ বহু মনীষী ও ওলামায়ে কিরামের সমাবেশ ঘটে । বাদশাহ আকবর ও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় এইসব ব্যক্তিত্বস¤পন্ন মনীষী থাকা সত্বেও কেউই এই উভয় রাজত্বকালে দ্বীন ইসলাম বিরোধী শাহী ফেত্না ও বেদ্বীনী কার্যকলাপ এবং দুনিয়াদার আলেম, সুফী, রাফেজী ও মুশরেকদের ফেত্না ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় আধিপত্য, বিভিন্ন প্রকারের বিদয়াতের প্রচলন, দ্বীনে ইলাহী নামক এক অভিনব ধর্মের প্রবর্তন, দ্বীন ইসলাম বিরোধী রুসুমাত, আকীদা ও আল্লাহ পাক-উনাকে অস্বীকার করা, দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জষন্য অপপ্রয়াস ও অন্যান্য অনৈসলামিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আল্লাহ পাক-উনার কিতাবের ও সুন্নতের শিক্ষা ও আদর্শে দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে সাহসী হন নি । পক্ষান্তরে একমাত্র হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই সমস্ত দ্বীন ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরূদ্ধে একাকী রুখে দাঁড়ান । আল্লাহ পাক-উনার তরফ থেকে উনাকে এই মহা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি দ্বিতীয় সহস্র বছরের মুজাদ্দিদ রূপে গায়েবী মদদে এই সমস্ত বে-দ্বীনী কার্যকলাপের আমূল সংস্কার পূর্বক একদিকে দ্বীন ইসলামকে কলুষমুক্ত ও অন্য দিকে সতেজ করে স্বীয় দায়িত্ব পালনে কামিয়াব হন । (বিপ্লবী মুজাদ্দেদ রহ)
শাহ ছাহেব শরহে রেছালায় বলেন : বুযুর্গী ও বিচক্ষণতায় ইলমের আধিক্য, তীক্ষœধী-শক্তিস¤পন্ন, আমলের ইস্তেকামাত, আল্লাহ পাক ও রসুল স¤পর্কে দ্বীনী গায়রত, বড় বড় কারামত, বহু উঁচূ মকাম -- এই প্রশংসনীয় গুণাবলী এই বুযুর্গের পবিত্র আত্মার মধ্যে আল্লাহ পাক নিহিত রেখেছিলেন । হিন্দুস্তানের লোকের উপর উনার বহু ইহসান রয়েছে, যার শুকরিয়া আদায় করা তাদের পক্ষে জরুরী । কেননা যারা মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, তারা আল্লাহ পাক-উনারও শুকুরগুজার হয় না ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মর্যাদা
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সুসংবাদ দান করেছেন: কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশের দ্বারা হাজার হাজার লোকের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে ।
হযরত ইমামে রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার যিয়ারতের জন্য কাবা শরীফ সিরহিন্দ শরীফে তশরীফ নিয়ে এসেছিলেন । এখনও সেই স্থান চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে । তিনি হজ্বে যেতে না পারায় আফসোস করেছিলেন । সেই জন্য স্বয়ং কাবা শরীফ উনার যিয়ারতের জন্য সিরহিন্দ শরীফ হাজির হয়েছিলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
আল্লাহ পাক উনাকে বিশিষ্ট বুযুর্গগণের মধ্য থেকে বিশিষ্ট করেছেন । তিনি ঐসব বুজুর্গগণের মধ্যে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এভাবে যে, তিনি কোরআন পাকের “মুতাশাবেহাত” এবং “হরুফে মুকাত্তায়াত”-এর গোপন ভেদ জানতেন, যা তিনি নিজেই বলেছেন । (মকতুবাত শরীফ ১ম খন্ড, মকতুব ৩১১) একদিন উনার ছাহেবযাদা হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রহমতুল্লাহি আলাইহি নির্জনে হযরত শায়েখ বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বললেন: হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার উপর “মুতাশাবেহাত” ও “হরূফে মুকাত্তায়াত”-এর রহস্যাবলী ও গোপন-ভেদ প্রকাশিত হয়েছে । কিন্তু তিনি নিজে তা প্রকাশ করেন না । যদি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তিনি প্রকাশ করে থাকেন । তিনি বলে থাকেন : শয়তান বড় শত্র“ । সে চায় যেন গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশ করে দেওয়া হয় যেন সে চূরী করে শ্রবণ করে তৎক্ষণাৎ তা প্রচার করে দিবে । আল্লাহ পাক এই আলেমদেরকে, যাঁরা এই মকামে পৌঁছেছেন, “রাসেখীন” (সুদৃঢ় ইলেমধারী) বলে আখ্যা দিয়েছেন । তা সেই দৃঢ়তার কারণে যদ্বারা উনারা এই মকামকে গোপন রাখেন । আর যাকেই ইহা অবহিত করেন, তিনিও ইহাকে গোপন রাখেন । আমি আরজ করলাম : আপনি অবশ্যই এই ক্ষমতা রাখেন যেন এই স্থান ও অবস্থান থেকে শয়তানকে দূর হয়ে যায়, যেন চূরী করে সে শুনতে না পারে । আমি যখন খুব বেশী জেদ ও কাকুতি মিনতি করতে লাগলাম, হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তখন “কাফ” অক্ষরের গোপন রহস্য এরূপভাবে প্রকাশ করলেন যে, আমি বেহুঁশ হয়ে গেলাম। (হাযারাতুল কুদ্স)
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন : ইহা সকলেই অবগত আছেন যে, প্রত্যেক শতকে একজন করে মুজাদ্দিদ বিলাদত শরীফ লাভ করেন । প্রত্যেক শতকের মুজাদ্দিদের সাথে হাজার বছরের মুজাদ্দিদের কোন স¤পর্ক নেই । শতাব্দির মুজাদ্দেদের সাথে হাজার বছরের মুজাদ্দেদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান । বরং হাজার বছরের মুজাদ্দেদ শতাব্দির মুজাদ্দিদ অপেক্ষা অনেক বড় । কারণ উক্ত মুজাদ্দিদের ওসীলায় উক্ত যামানার সমস্ত উ¤মতকে ফয়েজ পৌঁছে থাকে । এমনকি সেই যামানার কুতুব এবং আবদালগণও উনারই ইঙ্গিতে পরিচালিত হয়ে থাকেন ।
তিনি অন্য এক স্থানে লিখেছেন : পূর্ববর্তী যামানায় জুলমতের অন্ধকারে ধরণী আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে দুনিয়ায় নূতনভাবে শরীয়ত কায়েমের জন্য উলুল আযম পয়গম্বরের আবির্ভাব হতো । যেহেতু এই উ¤মত সর্বশ্রেষ্ঠ উ¤মত এবং এই উ¤মতের পয়গম্বর আলাইহিছ ছালাত ওয়াস সালাম সর্বশেষ পয়গম্বর । তিনি উনার উ¤মতের আলেম স¤প্রদায়কে বণি ইসরাইলের আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম-উনাদের সম-মর্যাদা দান করেছেন এবং আলিম স¤প্রদায়ের অস্তিত্বকে আম্বিয়া কিরামের স্থলাভিষিক্ত হিসাবে যথেষ্ট মনে করেছেন । এই জন্যই প্রত্যেক শতাব্দীর শেষে শরীয়ত পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে এই উ¤মতের আলিম স¤প্রদায় হতে একজন মুজাদ্দিদ মনোনীত করা হয় । বিশেষভাবে পূর্ববর্তী যামানার উ¤মতদের সময়ে হাজার বৎসর পরে যেমন একজন উলুল আযম পয়গম্বর দুনিয়ায় আবির্ভূত হতেন, তেমনি এই যামানায় এই উ¤মতের মধ্যে মা’রিফাতে পরিপূর্ণ একজন হাজার বছরের মুজাদ্দিদ প্রয়োজন, যিনি আম্বিয়াদের স্থলাভিষিক্ত হবেন । অপর এক মকতুবে হযরত লিখেছেন : এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ পাক-উনার নিয়ামতের শোকর করে এই তরীক্বার তালেব ও মুরীদগণকে উৎসাহিত করা, অন্য লোকের নিকট নিজের মর্যাদার বিষদ ব্যাখ্য করা নহে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত শাহ ওযালিউল্লাহ মোহাদ্দেছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত শাহ আবদুল আযিয মোহাদ্দিছে দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের নিজ কিতাব সমূহে হযরত ইমামে রব্বানী শায়েখ আহমদ সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে মুজাদ্দিদে আলফেছানী অর্থাৎ দ্বিতীয় এক হাজার হিজরী সনের মুজাদ্দেদ লক্ববে ভূষিত করেছেন । তিন শতাধিক বৎসর অতিবাহিত হতে চলল, আজও বিনা দলীলে বিনা বাক্যব্যয়ে উনার মুজাদ্দেদীয়াত স¤পর্কে যামানার উলামায়ে কিরাম উনাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য কিংবা মত-বিরোধ দেখা দেয় নি ।
হযরত কাজী সানউল্লাহ পানিপথী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “ইরশাদুত তালেবীন” কিতাবে লিখেছেন : হযরত আদম আলাইহিস সালাম-উনার হাজার বছর পর হযরত নূহ্ আলাইহিস সালাম এবং এইভাবে উনার পর হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, হযরত মুছা আলাইহিস সালাম, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম দুনিয়ায় তশরীফ এনেছেন । হাদীছ শরীফের রেওয়ায়েত অনুযায়ী নবীগণের সংখ্যা এক লক্ষ ২৪ হাজার ও রাসুলের সংখ্যা তিনশত তের । হাজার বছর পরে বা এর নিকটবর্তী সময়ে একজন উ’লুল আযম পয়গম্বর বিলাদত শরীফ লাভ করেন এবং তিনি তাজদীদ করে থাকেন । সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী । হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার পরে উনার উ¤মতের ওলীগণ হচ্ছেন মানুষের হেদায়েতের জন্য হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার নায়েব বা প্রতিনিধি । আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত একটি হাদীছ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন :-
إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهذِهِ الْأُمَّةِ عَلَى رَأسِ كُلِّ مِأَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِيْنَهَا -
(অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক তিনি এই উম্মতের (ইছলাহের জন্য) প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে একজন ব্যক্তিকে (মুজাদ্দিদ) পাঠাবেন যিনি দ্বীনের তাজদীদ (সংষ্কার) করবেন) ।
হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন উলুল আযম পয়গম্বরের আগমনের সময় হয়, তখন আল্লাহ পাক উনার কাদীম অভ্যাস মোতাবেক দ্বিতীয় হাজারের জন্য একজন মুজাদ্দিদ সৃষ্টি করেন । তিনি সমস্ত ওলীর মধ্যে এমন মর্যাদা রাখেন যেমন নবীগণের মধ্যে রসুলের মর্যাদা । এই অনন্য মর্যাদায় ভূষিত হয়ে হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি দুনিয়ায় তশরীফ আনেন ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সংস্কারের দিকগুলোর মধ্যে বিশেষ দিক হচ্ছে বাদশাহ আকবর প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীকে রদ করে বা মিটিয়ে দিয়ে তৎস্থলে ইসলামী আইন-কানুন প্রবর্তন বা জারী করা । অত:পর তিনি ইলমে তাছাউফ স¤পর্কে ভূল ধারণা দূর করে দিয়ে সঠিক ধারণা তুলে ধরেন এবং তাছাউফের মকামাত স¤পর্কে নতুন নতুন তথ্য দান করেন, যাহা পূর্বে কেউই উল্লেখ করেন নি । তিনি সমস্ত তরীকাগুলিকে সংস্কার করেন । বিশেষ করে নকশবন্দীয়া তরীক্বাকে সংস্কার করে তার নাম দেন নকশবন্দীয়-মুজাদ্দেদীয়া তরীকা ।
কাইয়ূমিয়াতের মর্যাদা : হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : একদিন যোহরের নামাযের পর আমি মোরাকাবায় বসেছিলাম এবং হাফেজ সাহেব কোরআন পাক তেলাওয়াত করছিলেন । হঠাৎ আমি আমার উপরে একটি বিরাট নূরানী খেলয়াত (রাজকীয় পোষাক) দেখতে পেলাম । আমার মনে হলো, কাইয়ূমিয়াতের এই খেলয়াতই হলো সমগ্র সৃষ্টি, যা আখেরী নবী নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়ারিশ সূত্রে এবং উনার তাবেদারী ও আনুগত্যের কারণে আমাকে দান করা হয়েছে । ইত্যবসরে হযরত নবীয়ে করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তশরীফ এনে উনার মোবারক হাত দ্বারা আমর মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দিলেন এবং কাইয়ূমিয়াত উনার পদ-মর্যাদার মোবারকবাদ জানালেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি কাইয়ূমিয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : “কাইয়ূম” এই জগতে আল্লাহ পাক-উনার খলীফা । সমস্ত কুতুব আবদাল উনার দায়রায়ে জেলালে (প্রতিবিম্বের পরিধির মধ্যে) উনারই প্রতিনিধির অন্তর্ভূক্ত । আওতাদগণও কাইয়ূমের কামালতের বেষ্টনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আওতাদ হচ্ছে আওলিয়া কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের এক প্রকার পদ-মর্যাদা। সারা পৃথিবীতে মাত্র চার জন আওতাদ থাকেন। সমগ্র জগতের মানব মন্ডলী তাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণের জন্য কাইয়ূমের প্রতি চেয়ে থাকেন । তিনিই সমস্ত জাহানের তাওয়াজ্জুহের একমাত্র লক্ষ্যস্থল । আল্লাহ পাক যাঁকে কাইয়ূমিয়াত দান করেন, তিনি এই বিষয়ে অবগত থাকুন বা নাই থাকুন, সমগ্র সৃষ্ট জগত উনার পবিত্র সত্ত¦ার ওছীলাতেই কায়েম থাকে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া) আমাদের মামদুহ মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার একটি লক্বব মুবারক ক্বাইয়ূমুয যামান ।
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে আল্লাহ পাক “মুকাল্লাম” এবং “মুহাদ্দাছ” বানিয়েছিলেন, যেমন তিনি মকতুবাত শরীফে উল্লেখ করেছেন । বান্দার সঙ্গে আল্লাহ পাক কোন কোন সময় বিনা মাধ্যমে কথা বলে থাকেন, যেমন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-উনাদের কারো কারো সাথে হয়েছিল । আবার কখন কখন আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম-উনাদের পূর্ণ অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ উত্তরাধীকারী সূত্রে এই মকাম হাসিল করে থাকেন । যদি এই তরীক্বায় কথা বলা উ¤মতের মধ্যে কোন ব্যক্তির অনেক বার হাসিল হয়ে যায়, তবে সেই ব্যক্তিকে “মুহাদ্দাছ” বলা হয়, যেমন হযরত ওমর ফারুক আলাইহিস সালাম । এই কথা বলা ক্বলবী ইলহাম ও ইলকা থেকে ভিন্ন ধরণের । ফেরেশ্তার সঙ্গে যে কথা হয়ে থাকে ইহা সেই প্রকারের কথাও নয় । (মকতুবাত শরীফ দ্বিতীয় খন্ড, মকতুব নং ৫১) (হাযারাতুল কুদস)
দুনিয়াতেই আখিরাত : আল্লাহ পাক তিনি উনার অশেষ রহমতে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দুনিয়াকে আখিরাতে পরিণত করেছিলেন । হযরত খাজা মুহ¤মদ মাসুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ১৯১ নং মকতুবে লিখেছেন : আল্লাহ পাক তিনি হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে এই সুসংবাদ দান করেছিলেন যে, “আপনার জন্য দুনিয়াকে আখিরাতে পরিণত করে দিলাম” । এর ব্যাখ্যা এইরূপ হতে পারে যে, আল্লাহ পাক তিনি উনার পেয়ারা বান্দাদের জন্য মর্যাদা স¤পন্ন যে আখিরাতের ওয়াদা করেছেন, তা কেবল শান্তিই শান্তি । সেখানে কোন চিন্তা, কোন পেরেশানী কিংবা ভয় ভীতির লেশমাত্র নেই । আছে কেবল আল্লাহ পাক-উনার রহমত ও দীদার । আল্লাহ পাক তিনি নিজের রহমতে যে সমস্ত সুউচ্চ মকামের আওলিয়া কিরামের দুনিয়াকে আখিরাত বানিয়ে দেন, উনারা সাধারণ মানুষের মত দুনিয়ায় বাস করলেও, কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা উনাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না । এমনকি জ্বরা-ব্যাধি ও মৃত্যুর প্রতিক্রিয়াও উনাদের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না । উনারা সব সময় দুনিয়াতেই আখিরাতের অনন্ত জীবনের মত আল্লাহ পাক-উনার দীদার এবং রহমতের সীমাহীন মহাসমুদ্রে নিমজ্জিত থাকেন । ইহাকেই বলা হয় দুনিয়াতে আখিরাত । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
একদিন হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি মোরাকাবা হালতে নিজের দোষ-ত্র“টি অবলোকন করলেন । ইত্যবসরে উনার উপর ইলহাম হলো :-
غَفَرْتُ لَكَ وَ لِمَنْ تَوَسَّلَ بِكَ بِوَاسِطَةٍ اَوْ بِغَيْرِ وَاسِطَةٍ اِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ -
(আমি কিয়ামত পর্যন্ত আপনাকে এবং আপনার ওছীলা অবলম্বনকারীগণ সকলকে মাফ করে দিলাম । তা আপনার সিলসিলার মাধ্যমে হউক আর নাই হউক ।) (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : কিয়ামত পর্যন্ত যত পুরুষ ও নারী আমার সিলসিলা কিংবা অন্য কোন সিলসিলার মাধ্যমে আমার তরীক্বার মধ্যে দাখেল হবে, তাদের সকলকেই আমার স¤মুখে পেশ করে তাদের নাম, নসব, বংশ পরিচয়, জš§ভূমি এবং বাসস্থান সমস্ত কিছুই বলে দেয়া হয়েছে । আমি ইচ্ছা করলে সকলেরই পূর্ণ ঠিকানা বলে দিতে পারি । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
উনাকে এই সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল যে, তিনি যার জানাযার নামাজ পড়াবেন, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আল্লাহ পাক নিজের মেহেরবানীতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমার সমস্ত লিখিত বস্থু ও মকতুবাত শরীফ আখেরী যামানায় হযরত ইমাম মেহদী আলাইহিস সালাম-উনার স¤মুখে পেশ করা হবে এবং ইহা উনার নিকট মকবুল এবং গ্রহণযোগ্য হবে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
তিনি আরো বলেছেন : নবুয়ত ব্যতীত মানুষের পক্ষে যত কামালাত সম্ভব, আল্লাহ পাক আমাকে তা দান করেছেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খলীফা মাওলানা বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার “হাজারাতুল কুদস” কিতাবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এই ক্বওল শরীফ লিখেছেন : ঐ সময় আওলিয়া কিরামের এত অধিক পরিমাণ রূহ মোবারক সিরহিন্দে তশরীফ এনেছিলেন যে, সিরহিন্দের সমস্ত ঘর-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট বন-জঙ্গল ভরে গিয়েছিল । বুজযর্গানে দ্বীনের বিতর্ক এত চরমে উঠেছিল যে, সকাল থেকে যোহরের ওয়াক্ত হয়ে গেল । এমন সময় হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মজলিসে তশরীফ এনে সকলের প্রতি মহব্বত ও মেহেরবানী প্রদর্শন করে ইরশাদ করলেন, “যেহেতু শায়েখ আহমদের তকমীল (পরিপূর্ণতা) নকশবন্দীয়া তরীক্বার মাধ্যমে হয়েছে, সেইজন্য তিনি এই তরীক্বারই সংস্কার ও প্রচার করবেন । অন্যান্য বাকী তরীক্বার নিসবতও ইল্কা (শিক্ষাদান) করবেন । কারণ উনাদের হক্বও সাবিত (প্রমাণিত) আছে । নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার এই সুন্দর মীমাংসায় সকলেই ফাতেহা খায়ের পড়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বিদায় গ্রহণ করলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : আমি কাশফের মারফত জানতে পেরেছি যে, হিন্দুস্থানে বহু আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম বিলাদত শরীফ লাভ করেছিলেন । ইনাদের মধ্যে কারো একজন উ¤মত, কারো দু’ জন উ¤মত এবং কারো তিনজন মাত্র উ¤মত ছিল । তিনজনের অধিক কারো উ¤মত ছিল না । আমি ইচ্ছা করলে উনাদের বিলাদত শরীফের স্থান, বাড়ী এবং নবুয়তের স্থান বলে দিতে পারি । এমনকি উনাদের মাযারও দেখিয়ে দিতে পারি । কারণ উনাদের কবর শরীফ হতে নূর প্রকাশ হচ্ছে । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার তাছাররুফাত ও কারামাত
হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনেক তাছাররুফাত ও কারামতের কথা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে । হযরত শায়েখ বদরুদ্দীন সিরহিন্দী রহমতুল্লাহি আলাইহি (যিনি হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার একজন বিশিষ্ট খলীফা ছিলেন) কর্তৃক লিখিত “হাযারাতুল কুদস” নামক কিতাবে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রায় এক শত কারামত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ।
গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বেলায়েতের প্রভাবে আমীর ওমরাহ হতে শুরু করে ছোট বড় সকলেই দলে দলে উনার নিকট বয়েত হতে লাগল । রাফেজী স¤প্রদায় বাদশাহ জাহাঙ্গীরকে বুঝাতে লাগল : ফকীরির আবরণে শায়েখ আহমদ আপনার রাজ্যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় । তারা ইহাও বলতে লাগল যে, শাহী দরবারে তাকে তলব করলেই ইহা প্রমাণিত হবে । কারণ বাদশাহের বশ্যতা স্বীকারের প্রমাণ স্বরূপ প্রত্যেককেই শাহী দরবারে হাযির হয়ে বাদশাহকে সিজদা করতে হয় । কিন্তু যেহেতু তিনি নিজকে বাদশাহের বরাবর মনে করেন, সেজন্য সিজদা করবেন না।
বাদশাহ তাদের কথা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে দরবারে দাওয়াত দিলেন । হযরত দাওয়াত গ্রহণ করে দিল্লীর শাহী দরবারে হাজির হলেন, কিন্তু বাদশাহকে সিজদা করলেন না । অনেক চেষ্টা ও ফন্দী করা হলো, তথাপি হযরত সিজদা তো দূরের কথা বাদশাহের স¤মানের জন্য মস্তক সামান্য অবনতও করলেন না । অত:পর বাদশাহ চক্রান্তকারীদের কথায় বিশ্বাস করে হযরতকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করলেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার জীবনের একটি নির্দিষ্টকাল জেলখানায় অতিবাহিত হয়ে গেল । আল্লাহ পাক এ সময়ের মধ্যে জেলখানায় যাদেরকে বাতেনী ফায়দা পৌঁছাবার ছিল, হযরতের ওসীলায় তাদেরকে বাতেনী ফায়দা পৌঁছালেন । বন্দীদশায় মুছিবতের মধ্যে হযরতকে যে যে মকামে উন্নতি দানের ইচ্ছা ছিল, তা পূর্ণ হলো ।
হযরত গোয়ালিয়র দুর্গে থাকা অবস্থায় এক সময় দেখা গেল দুর্গের বাইরে অবস্থা ভিন্নরূপ ধারণ করেছে । আবদুর রহীম খান খানান, খানে-আজম মীর্জা আযিয, হায়দর জাহান, ইসলাম খান, হায়াত খান, কাসেম খান প্রমুখ আমীর ওমরাহ হযরত মুজাদ্দিদ আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার প্রতি সম্রাট জাহঙ্গীরের এই দুর্ব্যবহারে মর্মাহত হলেন । শাহজাদা খুররম (পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান) স্বয়ং এ ব্যাপারে মধ্যস্থতা করে ব্যর্থ হন । ওদিকে কাবুলের শাসনকর্তা মহব্বত খান সম্রাটের এই বে-আদবীতে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন । কাবুল ও পেশোয়ারের বীর পাঠানরা মহব্বত খানের সাথে যোগ দিলেন । সম্রাট জাহাঙ্গীর এই বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে কাবুলের দিকে রওয়ানা হলেন । পথিমধ্যে ঝিলাম নদীর তীরে উভয় বাহিনীর মোকাবেলা হলো । সম্রাটের বাহিনী পর্যুদস্থ হলো, আর বাদশাহ স্বয়ং বন্দী হলেন মুহব্বত খানের হাতে ।
গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার কাছে এই সংবাদ পৌঁছলে তিনি বিচলিত হয়ে উঠলেন । মানুষে মানুষে হানাহানি, রক্তপাত উনার জীবনের কাম্য নয় । তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের পুত্র, মুহব্বত খান ও আমীর ওমরাহদের নিকট পত্র প্রেরণ করলেন যেন সম্রাটকে মুক্তি দেয়া হয় ।
পক্ষান্তরে মুহব্বত খানেরও অকৃত্রিম ভক্তি যে কোন মানুষের অদর্শ স্থল । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার পত্র প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরসহ সকলকেই মুক্তি দিলেন এবং আগের মত সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন । অথচ মুহব্বত খান ইচ্ছা করলে এই সময় দিল্লীর সিংহাসন দখল করতে পারতেন । কিন্তু দিল্লীর মসনদের চেয়ে নিজের মুর্শীদের নির্দেশ ছিল উনার নিকট বেশী মূল্যবান ।
এই ঘটনার পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের জীবনের মোড় ঘুরে গেল । তিনি হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার মুক্তির আদেশ দিলেন, ক্ষমা চেয়ে উনার কাছে পত্র লিখলেন । এই পত্রের জাওয়াবে তিনি সম্রাটকে জানালেন : আপনি যদি আমার কয়েকটি শর্ত মেনে নেন, তবেই আমি মুক্তি লাভ করতে রাযী আছি । হযরত উনার পত্রে সাতটি শর্ত আরোপ করেন । তার মধ্যে বাদশাহকে সিজদা করার প্রথা বাতিল, রাজ দরবারে প্রচলিত শরীয়ত বিরোধী রীতিনীতি বর্জন, দেশ থেকে কুসংস্কার ও বিদয়াতের মুলোচ্ছেদ এবং বিশেষ করে রাজবন্দীদের মুক্তিদানের শর্ত সমূহ ছিল অন্যতম ।
সম্রাট জাহাঙ্গীর দ্বিধাহীন চিত্তে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সমস্ত শর্ত মেনে নিলেন এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উনার মুক্তির ব্যবস্থা করলেন । হযরতকে মুক্তি দিয়েই সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষান্ত হলেন না । বরং উনার মহানুভবতা ও মুজাদ্দেদী আখলাকের মাহাত্ম্যে নিজ প্রাণ ও সিংহাসন ফিরে পেয়ে উনার কাছে বয়েতও গ্রহণ করলেন । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
বিছাল শরীফ
হিজরী ১০৩২ সনে হযরত মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন আজমীর শরীফে ছিলেন বললেন : আমার বিছাল শরীফের সময় নিকটবর্তী । আর এ সময় তিনি নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে সুসংবাদ ও কারামত সমূহ হাসিল করতে লাগলেন ।
উনার বিছাল শরীফের পূর্বরাত্রে খাদেমদেরকে ডেকে বললেন : আপনারা খুবই কষ্ট করেছেন । আর কেবল আজকের রাত্রি । রাত্রির শেষভাগে তাহাজ্জুদ পড়ে বললেন : ইহাই শেষ তাহাজ্জুদ । পরদিন ভোরে ইশরাকের নামাযের পরে ইস্তেঞ্জার জন্য পাত্র চাইলেন, কিন্তু তাতে বালি ছিল না । হযরত এতে বালি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন : বালি ছাড়া ইস্তেঞ্জা করলে ছিটা পড়ার সন্দেহ থাকে। এ নির্দেশ দানের সঙ্গে সঙ্গেই বললেন : আমাকে শোয়ায়ে দাও । হয়ত হযরতের ধারণা হয়েছিল ইস্তিঞ্জা করার পর ওযু করার অবসর হবে না । অত:পর তিনি ডান হাত গন্ডদেশে রেখে ডান কাতে শুয়ে যিকিরে মশগুল হলেন । ছাহেবযাদাগণ জিজ্ঞাসা করলেন : হযরত ! এখন কেমন মনে হচ্ছে ? তিনি জাওয়াব দিলেন : যে দু’ রাকাত নামায পড়েছি, তাই যথেষ্ট । এরপর আর কোন কথা বলেন নি । পর মূহূর্তেই যিকিরের অবস্থায় ১০৩৪ হিজরীর (১৬২৪ ঈসায়ী) ২৮শে ছফর আল্লাহ পাক-উনার দীদারের জন্য দুনিয়া হতে বিদায় নিলেন । বিছাল শরীফের সময উনার বয়স মুবারক হয়েছিল ৬৩ বছর । (হালাতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া)
হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সন্তান-সন্ততি
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সাত পুত্র ও তিন কন্যা ছিলেন । কন্যা সন্তানগণ সকলেই শিশু অবস্থায় বিছাল শরীফ লাভ করেন ।
ত¤মধ্যে সর্বপ্রথম সন্তান ছিলেন হযরত খাজা মুহ¤মদ ছাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি । আট বছর বয়সেই উনার উপর আশ্চর্যজনক যজ্বা, হাল, কাশফ ও ইসতিগরাকের অবস্থা প্রকাশিত হয়েছিল । হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার যজ্বার প্রাবল্য দেখে বলতেন : এই ছেলেকে কিছু বাজারী খানা খাওয়াও যাতে সে স্বাভাবিক থাকে । উনার বহু কারামত, বুজুর্গী ও কামালাত-এর উল্লেখ আছে । তিনি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে হিজরী ১০২৫ সনে বিছাল শরীফ লাভ করেন । (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দ্বিতীয় সন্তান হযরত খাজা মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বাল্যকাল থেকেই উনার ওলীত্বের বহু নিদর্শন প্রকাশিত হয় । তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন । উনার অনেক কাশফ ও কারামতের উল্লেখ আছে । তিনি বর্ণনা করেন : যে সময় সিরহিন্দ শরীফে কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তখন আমার কয়েকজন ভাই বোন একসঙ্গে বিছাল শরীফ লাভ করলে একদিন আমার বুযুর্গ পিতা আমাকে এবং আমার ভাই মুহ¤মদ মাসুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে লক্ষ্য করে বললেন : আজ সাহরীর সময় মহান আল্লাহ পাক তিনি মিছালী ছুরতে তোমাদের দু’ জনকে আমার কোলে অর্থাৎ হযরত মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকে ডান জানুতে এবং হযরত মুহ¤মদ মা’সুম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বাম জানুতে বসালেন এবং এইরূপ ইলহাম করলেন, এই দু’জনকে আপনাকে দান করলাম, উনারা দীর্ঘ জীবন লাভ করবেন এবং বৃদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হবেন। (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দেদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার তৃতীয় সন্তান হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি হিজরী ১০০৭ সনে বিলাদত শরীফ লাভ করেন (তারীখে দাওয়াত ও আযীমত, ৪র্থ খন্ড পৃ: ৩৭৩) )। শৈশবকাল থেকেই উনার মধ্যে কতগুলো আশ্চর্যজনক লক্ষণ প্রকাশ পায় । তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেন । হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন উ¤মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রথম কাইয়ূম এবং উনার পুত্র হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাকেও আল্লাহ পাক “কাইয়ূমিয়াত” দান করেন, যে জন্য তিনি দ্বিতীয় কাইয়ূম উপাধীতে ভূষিত হন । তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যেদিন ‘গদীনশীন’ হন, সেদিনই পঞ্চাশ হাজার লোক উনার হাত মুবারকে বাইয়াত হন । উনার অসংখ্য কাশফ ও কারামত রয়েছে । তিনি হেদায়েতের কাজে এতই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন যে, উনার প্রায় নয় লক্ষ মুরীদ এবং সাত হাজার খলীফা ছিলেন । কথিত আছে যে, হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি এতই প্রভাবমন্ডিত ও তেজস্বী ছিলেন যে, আওরঙ্গজেব বাদশাহ হয়েও উনার সাথে সরাসরি আলাপ করতে সাহস পেতেন না । উনার যা কিছু বক্তব্য থাকত, নিতান্ত আদবের সাথে তিনি তা লিখিতভাবে পেশ করতেন । (বিপ্লবী মুজাদ্দেদ রহ
হযরত খাজা মুহ¤মদ ইয়াহইয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র । তিনি উনার বড় ভাইগণ হযরত খাজা মুহ¤মদ ছা’ঈদ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত খাজা মুহ¤মদ মা’ছুম রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনাদের নিকট জাহেরী ও বাতেনী ইলমে পরিপূর্ণতা লাভ করেন । (হাযারাতুল কুদস)। হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বাকী সন্তানগন শৈশবাস্থায়ই বিছাল শরীফ লাভ করেন ।
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার দু’টি বড় কারামত ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরকাল লিখিত থাকবে । প্রথম হচ্ছে উনার পবিত্র ক্বওল শরীফ অর্থাৎ মকতুবাত শরীফ উনার মত অন্য কোন মাশায়েখ লিখতে অপারগ । আর দ্বিতীয় হচ্ছে হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সন্তানগণকে নিজের তাছাররুফ দ্বারা নিজের মত ইলেম, আমল ও বাতেনী কামালাতে এতই পরিপূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আল্লাহ পাক-উনার যমিনে অন্য কোন মাশায়েখ এরূপ করতে সক্ষম হন নি । আর এ দু’টি কারামত দুনিয়াতে সূর্যের চেয়েও বেশী আলোকময় এবং সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে এক আশ্চর্যজনক বিষয় হিসাবে পরিগণিত। (হাযারাতুল কুদস)
হযরত মুজাদ্দিদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার খলীফা
হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার কয়েক হাজার খলীফা ছিলেন, যাঁরা কেবল হিন্দুস্তানেই নয়, বরং ইরাণ, তুরান, আফগানিস্তান, ইরাক প্রভৃতি দেশে দীন ইসলামের প্রচার, তথা মুজাদ্দেদীয়া তরীকার ব্যাপক প্রসার ও প্রচারের জন্য আত্মনিয়োগ করেন । ত¤মধ্যে বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন হযরত খাজা মুহম্মদ মা’ছুম রব্বানী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত শায়খ আদম বিন্নুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি । তারীখে দাওয়াত ও আযীমত কিতাবে অন্যান্য আরো ত্রিশ জন প্রসিদ্ধ খলীফার নাম উল্লেখ করা হয়েছ।
(সূত্র: হালতে মাশায়েখে নকশবন্দীয়া মোজাদ্দেদীয়া, রওযাতুল কাইয়ূমিয়া, হাযারতুল কুদ্স,
মকতুবাত শরীফ, বিপ্লবী মুজাদ্দিদ রহ:, তারীখে দাওয়াত ও আযীমত )
লেখক: সাঈদ আহমদ গজনবী
©somewhere in net ltd.