নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যুক্তির মাঝেই সমাধান খুঁজি।

উড়ন্ত বাসনা

জীবন কে ভালবাসি।

উড়ন্ত বাসনা › বিস্তারিত পোস্টঃ

সভ্যতার ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ সা.

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৭:১৯

মুহাম্মদ সা. কে যে মক্কাবাসীরা প্রথমে নবী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, মোহাম্মদ সা:-এর মানুষি-অবয়ব ও নবুয়াত, একাধারে এ দু’টি বিষয় তাদের কাছে মনে হয়েছিল পরস্পরবিরোধী। তারা ধারণা করত, আল্লাহ যদি সর্বমানবের কল্যাণার্থে সত্যের বার্তাবহ কোনো নবীই পাঠাবেন, সেই নবী হবেন কোনো ফেরেশতা। আর যদি আল্লাহ কোনো মানুষকেই নবী হিসেবে মনোনীত করেন, তাহলে সেই মানুষটির হওয়া উচিত এমন, যিনি ধনাঢ্যতা, রাজক্ষমতা কিংবা অন্য কোনো অভিনবত্বের গুণে সর্বসাধারণের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সম্ভ্রম দাবি করতে পারেন। কিন্তু জীবনের শুরু থেকেই যিনি পিতৃমাতৃহীন এতিম ও অসহায়, দারিদ্র্য যাঁর নিত্যসঙ্গী, মোহাম্মদ সা. এর মতো অতি সাধারণ এমন একটি মানুষ কী করে নবী হবেন! এটা যুগপৎ অসংগত ও অসম্ভব। সত্য যে, বহু সদগুণের আধার এই মানুষটি, কিন্তু তাই বলে নবুয়াতের মতো অসাধারণ মুকুট কী তাঁর শিরে শোভা পায়! অতএব অধিকাংশ মক্কাবাসী এই হেতুও মোহাম্মদ সা. কে মেনে নিতে পারেনি যে, তিনি ছিলেন সাধারণ, অতিসাধারণ এমন এক মানবসন্তান যাঁর জাগতিক অবস্থান নবুওয়াতের মতো অতি বিশিষ্ট উচ্চাসনের পক্ষে একেবারেই ‘বেমানান’ ও ‘সংগতিহীন’।
‘যে সমস্ত মহাপুরুষের আবির্ভাবে এই পাপ-পঙ্কিল পৃথিবী ধন্য হইয়াছে, যাঁহাদিগের প্রেমের অমৃত সেচনে দুঃখ তপ্ত মানবচিত্ত স্নিগ্ধ হইয়াছে, যাঁহারা মানব সমাজের যুগ-যুগান্তরের কুক্ষিগত কালিমা রশ্মির মধ্য হইতে সূর্যের ন্যায় উত্থিত হইয়া পাপের কুহক ভাঙ্গিয়াছেন, ধর্মের নবীন কিরণ জ্বালাইয়াছেন ও পতিত মানবকে সত্য ও প্রেমে সঞ্জীবিত করিয়া নবীন জীবন পথে টানিয়া লইয়া গিয়াছেন, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হজরত মুহাম্মদ সা. তাঁহাদের অন্যতম। ‘হজরত মুহাম্মদ সা. তাছাড়াও ছিলেন বিশ্বমানবের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক। তিনি ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কও। সাধের জন্মভূমি পরিত্যাগ করে মক্কা থেকে যখন হজরত মুহাম্মদ সা. ইয়াসরিবে পা রাখলেন, ইয়াসরিবের জনসমষ্টি তাঁকে অভূতপূর্ব পরিবেশে অত্যন্ত আবেগঘন আবহে স্বাগত জানালেন। ইয়াসরিব নগরীর চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁকে শুধু প্রিয়তম ব্যক্তিত্বরূপে আপন করে নিলেন তাই নয়, এই নগরীর পরিচালনার সব দায়িত্ব তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাঁর নেতৃত্ব অবনত মস্তকে স্বীকার করে নিলেন। এই স্বীকৃতির প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ইয়াসরিবের জনগণ তাদের প্রিয় নগরীর নামকরণ করলেন ‘মদিনাতুন্নবী’ অথবা ‘মদিনাতুর রাসূল’। দিনটি ১২ রবিউল আউয়াল। খ্রিষ্টীয় ৬২২ অব্দের ২২ অথবা ২৪ সেপ্টেম্বর।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের খ্যাতনামা দার্শনিক জন লক (John Lock) যে তত্ত্বের ভিত্তিতে বলেছিলেন- ‘সেই রাষ্ট্রই সর্বশ্রেষ্ঠ যা শাসিতদের সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ [That government is the best one which is based on the consent of the government] সেই তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটে মদিনায় ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং এই অনবদ্য সৃষ্টির মূলে ছিলেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মনীষী হজরত মুহাম্মদ সা.। এই নগরীতে প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবীর নেতৃত্বে মসজিদে নববী। এই মসজিদই ছিল গণতান্ত্রিক মদিনা রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্বের প্রাণকেন্দ্র। আইন প্রণয়নের কেন্দ্রবিন্দু এবং ন্যায়নীতির শীর্ষস্থান, বিচার বিভাগের শীর্ষস্থান।
মদিনা রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল মদিনা সনদ-৫৩ অনুচ্ছেদ সম্মিলিত লিখিত সংবিধান। এর ভূমিকায় সনদকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘কিতাব’ রূপে এবং আধুনিক অর্থে সংবিধান। সনদের ২৩, ৪০, ৪৬ ও ৫১ অনুচ্ছেদে সনদকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সহিফা’ হিসেবে এবং আধুনিক অর্থে তাও হলো সংবিধান। প্রকৃত প্রস্তাবে মদিনা সনদ ছিল একটি সংবিধান এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটাই হলো সর্বপ্রথম লিখিত পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। পাশ্চাত্যের প্রচারণায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতায় এবং মুসলিম পণ্ডিতদের ঔদাসীন্যের ফলে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের ছাত্রছাত্রীরা জানে, আমেরিকার সংবিধানই সমগ্র বিশ্বে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ১৭৮৯ সালে, কিন' এর প্রায় সাড়ে এগারো শ’ বছর আগেই রচিত হয়েছে মদিনা সনদ। রাসূলুল্লাহ সা: রাজনীতিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক রাষ্ট্রনায়ক, শ্রেষ্ঠতম প্রজ্ঞায় বিভূষিত একজন জননেতা। যদি তিনি চাইতেন তিনি হতে পারতেন পরম পরাক্রমশালী সম্রাট। হতে পারতেন প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহ। মহামহিম সুলতান। আর তখনকার এটিই ছিল নিয়ম। সূচনা করতে পারতেন রোমান সম্রাটদের অথবা পারস্য সম্রাটের মতো অথবা চীনের রাজাধিরাজের মতো, মিসরের ফেরাউনদের মতো এক পারিবারিক ধারা (dynastic line)। রাজনীতিক হলে তিনি হয়তো তাই করতেন, কেননা তখনকার বিশ্বে অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্রের চিহ্নিমাত্র ছিল না। রাজনীতিকরা সবসময় বর্তমান কালেই বসবাস করেন। তাদের দৃষ্টি থাকে ক্ষমতার দিকে এবং ক্ষমতাপ্রসূত সুযোগ-সুবিধা অথবা বৈভব-প্রভাবের দিকে। দৃষ্টি থাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অথবা পারিবারিক পর্যায়ে বিলাসিতার দিকে। আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ সা. ছিলেন একজন রাষ্ট্রনায়ক (Statesman), বর্তমানে বসবাস করেও তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। মানবজাতির ঐক্য-সংহতির দিকেই তিনি দৃষ্টি রেখেছিলেন।
জনসম্মতির ওপর ভিত্তি করে যেসব রাষ্ট্র পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে, যেমন ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পরে ইংল্যান্ডের অবস্থা অথবা ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তেরোটি উপনিবেশের অবস্থা অথবা ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্সের অবস্থা ছিল অত্যন্ত সঙ্কটজনক। গৃহযুদ্ধের আগুনে ঝলসে গেছে সমাজজীবন। অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে গেছে চারদিক। কিন্তু মদিনা রাষ্ট্র বিশ্বময় মাথা তুলে স্থিতিশীলতার আশীর্বাদ নিয়ে সমৃদ্ধি ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার সম্পদকে মূলধন করে বিশ্বজয়ী হয়ে ওঠে সেই মদিনা রাষ্ট্র। অথচ সপ্তম শতাব্দীতে রাষ্ট্র গঠনের আগে মদিনার অবস্থা ছিল অনেকটা নৈরাজ্যপূর্ণ। ওই সময় মদিনায় ছিল সুসংগঠিত আদি পৌত্তলিক সমপ্রদায়। ছিল দেশী ও বিদেশী ইহুদি জনগোষ্ঠী। তার পরে আসেন মক্কা থেকে হিজরত করে নব্য মুসলিমরা। প্রত্যেক ইতিহাসবিদ একথা অত্যন্ত জোরে প্রচার করেছেন যে, তখনকার আবর সমাজ ছিল গোত্র-গোষ্ঠীতে খণ্ডছিন্ন, শতধাবিভক্ত এবং ওই সব গোত্র-গোষ্ঠী-উপজাতি সব সময় লিপ্ত ছিল পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, অসূয়াতাড়িত প্রতিহিংসার জিঘাংসায়। সমাজে ছিল না কোনো ঐক্যবোধ, ছিল না সহানুভূতি অথবা সহযোগিতার কোনো সূত্র। সংক্ষেপে প্রাক-ইসলাম আরবে সমাজজীবনে ‘নিঃসঙ্গ, দীন, কদর্য, পশুতুল্য এবং স্বল্পায়ু’ (Solitary, Poor, nasty, brutis and short) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হজরত মুহাম্মদ সা: সৃজনশীল নেতৃত্বে এবং সীমাহীন আন্তরিকতার সেই খণ্ডছিন্ন শতধাবিভক্ত সমাজ জীবনের অফুরন্ত কল্যাণকামী প্রবাহের সৃষ্টি হয়ে তা পরবর্তী সাত শ’ বছর ধরে স্থায়ী হয়ে সমগ্র বিশ্বের চিন্তা-ভাবনাকে আলোকিত করে রাখে। সৃষ্টি করে নতুন নতুন সৃষ্টির প্রাণ, যা অতীতে আর কখনো দেখা যায়নি।
মদিনা রাষ্ট্র শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র নয়, নয় কুরাইশদের অথবা মুহাজির বা আনসারদের। এই রাষ্ট্র সব ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার। মুসলমান ও ইহুদির। আদি পৌত্তলিক ও অমুসলিমদের। যে যার ধর্ম অনুসরণ করবে, কিন' জাতি হিসেবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; এর প্রতিরক্ষায় সবাই কৃতসঙ্কল্প। জাতীয়তার প্রকৃতি বিশ্লেষণকারী হাজারো তাত্ত্বিক আজ পর্যন্ত যেসব জটিল ক্ষেত্রে কোনো সুষ্ঠু সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হননি, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পথ হারিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে মদিনা সনদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কের নেতৃত্বে কিভাবে সহজ ও সরল পথে পথপরিক্রমা শুরু করেছিল তা আজো সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে পর্যালোচনা করে থাকেন। আধুনিক জাতীয়তার যেমন রয়েছে আকর্ষণীয় এক সম্মিলনের স্বর্ণসূত্র, অন্য দিকে তেমনি রয়েছে বিভাজনের এক প্রবণতা। কিছুসংখ্যক জনসমষ্টি একত্র হয়ে যেমন জাতি গঠন করে, তেমনি জাতি হিসেবে তারা বিশ্ব মানব সমপ্রদায় থেকে স্বাতন্ত্র্য অনুভব করে বিচ্ছিন্ন হয়েও পড়ে। মদিনা রাষ্ট্রটি কিন' একক উম্মাহ্র দেয়াল ডিঙিয়ে ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে রীতিনীতি এবং সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সব বাধাবন্ধনকে জয় করে, বিশ্বময় উম্মাহর পথ প্রশস্ত করেছে। যে চুক্তির ভিত্তিতে মদিনা রাষ্ট্রের জন্ম হয়, সেই চুক্তিতে নবী করিম সা. স্বাক্ষর করেন একজন জননেতারূপে সততার মূর্ত রূপ জনকল্যাণকামী এক পরিপূর্ণ মানুষ রূপে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকত, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে যেত সপ্তম এবং অষ্টম শতকেই। পাশ্চাত্যে আজ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণইচ্ছা, গণ-অধিকার, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে গর্ব করে এবং গর্বভরে বলে থাকে, একই ভিত্তিতে উন্নত এক সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে রাসূলে করিম সা. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণসম্মতিভিত্তিক মদিনা রাষ্ট্রের আদর্শ সার্বিকভাবে বাস্তবায়ন হলে মানব জাতি উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারত। আমরা তাই নিজেদের সোনার খনিকে উপেক্ষা করে অন্যদের কয়লা খনির মূল্য নির্ধারণেই অধিক ব্যস্ত রয়েছি এবং হীনমন্যতার শিকার হয়েছি। এই হীনমন্যতা জয় করতেই হবে।

মানব জাতির শিক্ষক এই মহামানবের রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকা পর্যালোচনার আগে তার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ও অত্যন্ত সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। হেরা গুহায় তাঁর ধ্যানমগ্নতা, তারপর বাস্তবতার জগতে তাঁর প্রত্যাবর্তন, এক কথায়, পারমার্থিকতা এবং যুক্তির তথা আধ্যাত্মিকতা এবং কর্মনিষ্ঠার সুষ্ঠু সমন্বয়- এই হলো এক দিকে যেমন তার জীবনের সৌন্দর্য, তেমনি ইসলামের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবদান। মরমিবাদ দিয়ে যার শুরু, রাষ্ট্রের মধ্যে তার পরিপূর্ণতা। এই তো মানব জীবনের সারবত্তা। এই সারবত্তার মূর্ত রূপ হলেন আদর্শ মানব হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন। এক অর্থে, এ তো এক পরশমণি। এর স্পর্শে সব কিছুই সোনা হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব যে অসাধারণ তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।
ইসলাম ধর্মে মূর্খতা ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এবং জ্ঞান ও জ্ঞানীদের যথাযোগ্য মর্যাদার বিধান করা হয়েছে। জ্ঞানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে অবগত হতে চাইলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ঘোষণাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি বলেন, 'প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ।' (ইবনে মাজাহ)
এতটুকু জেনে রাখাই যথেষ্ট যে প্রিয়নবী মুস্তফা সা. -এর ওপর অবতীর্ণ প্রথম আসমানি বাণীতে আবৃত্তি ও কলম এবং কলমের সাহায্যে জ্ঞানচর্চার সুমহান মর্যাদার কথা উচ্চকণ্ঠে ব্যক্ত করা হয়েছে। মানবতার উদ্দেশে উচ্চারিত এ ধর্মের প্রথম আহ্বান ছিল নিম্নরূপ :
'পড়ুন (হে মুহাম্মদ!), আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে; পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহা মহিমান্বিত, যিনি কলম দ্বারা জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ যা জানত না তা তিনি তাকে শিখিয়েছেন।' (সুরা আল-আলাক : ১-৫)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর অনুসৃত রীতি অনুযায়ী কোনো কোনো বিষয়ে শপথ করেছেন। এর উদ্দেশ্য দ্বিবিধ। ক. শপথকৃত বিষয়টির মাহাত্ম্য ও বিপুল উপকারের ব্যাপারে সচেতন করা। খ. তাঁর প্রতি সৃষ্টিকুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
আমাকে বলুন, কলমের চেয়ে অধিক উপকারী বস্তু আরেকটি আছে কি? জ্ঞানের সম্প্রচার, স্থিতি প্রদান এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ সম্পদ হস্তান্তরের জন্য কলমের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আধুনিককালের ছাপাখানাগুলোও তো কলমের পরিবর্তিত রূপ মাত্র। অতএব দুনিয়াজুড়ে জ্ঞান-গবেষণা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে কলম। আল কোরআনে কলমের মহিমাকীর্তন এবং আল্লাহ কর্তৃক কলমের শপথ দ্বারা মুসলমানদের লেখালেখির ব্যবস্থাপনার জন্য ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে; এর মধ্যে ধারকর্জ অন্যতম। ঋণ আদায়-প্রদান, দলিল-দস্তাবেজ লিপিবদ্ধ করা ইসলামের একটি আবশ্যিক বিধান। মহান আল্লাহ নির্দেশের সুরে বলেছেন : 'হে ইমানদারগণ! তোমরা যখন পরস্পর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন তা লিখে নাও।' (সুরা আল-বাকারাহ : ২৮২)
এমনিভাবে ওসিয়ত লিখে রাখার নির্দেশও এসেছে। রাসুল (সা.)-এর বাণী : 'প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো, লিখিত ওসিয়তনামা নিজের কাছে সংরক্ষণ ব্যতীত রাত্রিযাপন না করা।' বুখারি ও অন্যান্য গ্রন্থে হাদিসটির অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে।
অন্য হাদিসের বর্ণনা মতে, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : 'সন্তানের ব্যাপারে পিতার করণীয় হচ্ছে তাকে লেখা, সাঁতার ও তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ দেওয়া।'
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অক্ষরজ্ঞান ছিল না। তিনি লিখিত কোনো কিছু পড়তে পারতেন না এবং কিছু লিখতেও সক্ষম ছিলেন না। কারণ যদি তিনি লেখাপড়া জানতেন, তবে মিথ্যাবাদীদের জন্য কোরআন ঐশীগ্রন্থ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকত। তারা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিত, কোরআন কোনো আসমানি কিতাব নয়। বরং তা মুহাম্মদ (সা.)-এর অধ্যয়ন-গবেষণার ফসল কিংবা পূর্ববর্তী ইঞ্জিল ও তাওরাত অবলম্বনে রচিত। কিন্তু একজন নিরক্ষর ও লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপরিচিত উম্মী নবী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা কার্যক্রম আপনাকে কেবল বিস্ময়ের জগতেই নিয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) জাতিকে লেখাপড়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করার নিমিত্তে কেবল শিক্ষা দর্শন প্রচারেই ব্যাপৃত ছিলেন তা নয়, বরং নিরক্ষরতা প্রতিরোধ ও শিক্ষা সম্প্রসারণের যাবতীয় কার্যকর উপায় উদ্ভাবনের জন্যও নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
শিক্ষা বিস্তারে প্রিয় রাসুল সা. -এর একটি মনোরম প্রয়াস লক্ষণীয়। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিপুলসংখ্যক কুরাইশ মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়। এদের মধ্যে অনেকের লেখনীশক্তি ছিল প্রখর। তাদের আবার মুক্তিপণ আদায় করার ক্ষমতা ছিল না। রাসুল সা. এই অপূর্ব সুযোগ লুফে নিলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, যেকোনো বন্দি ১০ জন মুসলিম সন্তানকে লেখা শিক্ষা দেওয়ার শর্তে মুক্তি পেতে পারে। এ ঘোষণার মাধ্যমে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নিরক্ষরতাবিরোধী অভিযান প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন ঘটল। বলাবাহুল্য, এ-জাতীয় শিক্ষা প্রকল্প মুসলিম উম্মাহই নয়, সমগ্র মানব ইতিহাসেও এই প্রথম। এই শিক্ষা প্রকল্পের প্রত্যক্ষ সুফল লাভকারী আনসার-তনয়দের মধ্যে প্রথিতযশা তরুণ যায়েদ ইবনে সাবিতের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন অন্যতম ওহি লেখক, অতঃপর কোরআন সংকলকের দুরূহ দায়িত্বও পালন করেন। আবার তিনিই রাসুলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশে ইহুদি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে যখন উল্লেখযোগ্য হারে জ্ঞানচর্চা আরম্ভ হয়ে গেল তখন রাসুলুল্লাহ সা. এ মর্মে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, শিক্ষার ব্যাপারে পরস্পর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা মুসলমানদের সামাজিক দায়িত্ব, যেমনিভাবে জীবিকা নির্বাহের বেলায় একে অন্যের সহায়তা করা সামাজিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতএব জ্ঞানীদের দায়িত্ব হলো অজ্ঞদের জ্ঞান বিতরণ করা এবং নিরক্ষরদের হাতে ধরে বিদ্যার আরেক প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা।
হেগেলের ইতিহাস দর্শন, কিংবা মার্কসের ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদী ব্যাখ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে আমর বড়জোর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, আরবের তদানীন্তন পরিবেশে একটি জাতি গঠন এবং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার যোগ্যতাসম্পন্ন নেতার আবির্ভাবের প্রয়োজন ছিল কিংবা আবির্ভাব হতে পারতো। কিন্তু হেগেল কিংবা মার্কসীয় দর্শন যা ঘটে গেল তার কি ব্যাখ্যা দিবে? সে সময় সে পরিবেশে এমন এক ব্যক্তি জন্ম নিলেন যিনি সর্বোত্তম নৈতিক চরিত্র শিক্ষা দিলেন। মানবতাকে সুসজ্জিত পরিশীলিত ও সুসংগঠিত করলেন। মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করলেন। জাহেলী ধ্যান ধারণা এবং হিংসা বিদ্বেষ নির্মূল করলেন। যার দৃষ্টি জাতি গোষ্ঠী এবং দেশের সীমা সরহদ ডিঙ্গিয়ে সমগ্র মানবতার ওপর পরিব্যাপ্ত হয়েছে। যিনি নিজের জাতির জন্যই নয় বরং গোটা বিশ্ব মানবতার একটা নৈতিক, আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেছেন। যা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে কল্পনার জগতে নয় বরং বাস্তবতার জগতে নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দেখিয়েছেন। আধ্যাত্মিকতা এবং বস্ত্তবাদের এমন সুসম ভারসাম্যপূর্ণ মিশ্রণ তৈরি করেছেন যা সে কালের ন্যায় আজো জ্ঞান ও বিচক্ষণতার শ্রেষ্ঠতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এমন এক ব্যক্তিত্বকে আপনি কি করে তৎকালীন আরবের জাহেলী পরিবেশের সৃষ্ট বলতে পারেন? শুধু এতটুকুই নয় যে, সে ব্যক্তি তার পরিবেশের ফসল হিসেবে পরিদৃষ্ট হয় না বরং যখনই আমরা তার কৃতিত্বের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তখন মনে হয় তিনি স্থান-কাল-পাত্র থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তার দৃষ্টি পরিবেশ পরিস্থিতির বন্ধন ছিন্ন করে শতাব্দী ও সহস্রাব্দের (Millenium) সীমানা সম্মুখে এগিয়ে গেছে।
তিনি মানুষকে দেখেছেন সকল যুগ ও পরিবেশের আলোকে। একই সাথে তার জীবন যাপনের জন্য এমন সব নৈতিক এবং ধর্মগত পথ নির্দেশনা দান করেছেন যা সর্বকালে সর্বাবস্থায় একইভাবে খাপ খেয়ে যায়। তিনি সে সব লোকের অন্তর্ভুক্ত নন ইতিহাস যাদেরকে সেকেলে লোকদের তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের পরিচয় আমরা এভাবে দিতে পারি যে, তারা সে যুগের শ্রেষ্ঠ পথ প্রদর্শক ছিলেন। মানবতার জন্য সবচেয়ে ব্যতিক্রম এবং বিশিষ্ট নেতা হলেন ঐ ব্যক্তি যিনি ইতিহাসের চলমান ধারার সাথে (March) এগিয়ে যেতে পারেন। যিনি তার যুগের যেমন আদর্শ ও উত্তম নেতা তেমনি প্রত্যেক যুগেই তিনি আধুনিক (Modern) নেতা প্রমাণিত হন যেমন তার পূর্বের যুগে ছিলেন। আপনি যাদেরকে উদারতার সাথে ইতিহাস সৃষ্টিকারী বলে আখ্যায়িত করেন প্রকৃতপক্ষে তারা ইতিহাসের সৃষ্টি সমগ্র মানবেতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব একজনই। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নেতাই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তার অবস্থার ওপর পর্যালোচনার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে লক্ষ্য করবেন যে, কার্যকারণ বা উপাদানগুলো স্বয়ং বিপ্লবের লক্ষ্য এবং পন্থা -নির্ধারণ করে দিচ্ছিল। বিপ্লবের নায়ক শুধু এতটুকু ভূমিকা পালন করেছে যে, সময়ের চাহিদানুযায়ী বিপ্লবের দিক ও পথ নির্দেশ করেছিল। বিপ্লবের নেতা অবস্থা ও পরিবেশের চাহিদাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য এমন একজন অভিনেতার ভূমিকা পালন করেছেন যার জন্য মঞ্চ পূর্ব থেকে প্রস্ত্তত ছিল। কিন্তু ইতিহাস এবং বিপ্লব সৃষ্টিকারী উভয় শ্রেণীর মধ্যে মহানবী সা. এমন ব্যক্তি যেখানে বিপ্লবের উপাদান বিদ্যমান ছিল না সে ক্ষেত্রে তিনি নিজেই বিপ্লবের উপাদান কার্যকারণগুলো উদ্ভাবন করেন যেখানে লোকদের মধ্যে বিপ্লবের সৃষ্টি এবং কর্মক্ষমতার মধ্যে বর্তমান ছিল না সেখানে তার নিজস্ব চেষ্টায় বিপ্লবের উপযোগী লোক তৈরি করেন, নিজের প্রচন্ড ব্যক্তিত্বকে দ্রবীভূত করে সহস্র মানুষের দেহে প্রবিষ্ট করিয়ে তাদের এবং তাদেরকে নিজের মনের মত করে তৈরি করে নিয়েছেন। এমনি একজন ইতিহাস স্রষ্টা এবং এ ধরনের বিপ্লবী মানুষ মানবেতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে কি?
























মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.