![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শ্রদ্ধেয় সচ্চবাদী, একজন বর্মী ভিক্ষুণী যিনি শ্রীলঙ্কাতে পড়ালেখা করা অবস্থায় ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে শ্রদ্ধেয় ধম্মানন্দা ভিক্ষুণীর সাথে এক সময়ে উপসম্পদাপ্রাপ্ত হন। ২০০৫ সালে পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি মায়ানমারে ফিরে আসেন।
প্রথমদিকে তিনি তাঁর শিক্ষকের সাথে অবস্থান করেছিলেন এবং ভালো যত্ন-আত্তির মধ্যে ছিলেন। বিপত্তি বাধলো তখন, যখন তিনি সঙ্ঘের নিকট গিয়ে ভিক্ষুণী-মর্যাদা লাভের প্রস্তাব দেন। সঙ্ঘ উল্টো একটি কাগজ তাঁকে ধরিয়ে দিল দস্তখত করার জন্য যেখানে লেখা ছিল তিনি ভিক্ষুণী নন। কিন্তু তিনি ঐ কাগজে সাক্ষর করতে আপত্তি করলে তাঁকে ৭৬ দিন কারাবন্দী করে রাখা হয়। এখন তিনি শ্রীলঙ্কায় ফিরে গিয়ে তাঁর অসম্পূর্ণ পড়ালেখা পুণরায় শুরু করেছেন। তিনি কোন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন এবং তা হতে কীভাবে বেরিয়ে এসেছেন তা জানিয়ে আমাদের কাছে একটি চিঠি লিখেন। আমি এখনে তা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করছি।
তিনি লেখাটি এভাবে শুরু করেন ,
আমার ধম্মবন্ধুগণ,
আপনারা হয়তো জানেন না মায়ানমারে থাকাকালীন সময়ে আমার সাথে কী ঘটেছিল।
উত্তম বিপাক-কম্ম সম্পাদন না-করে বুদ্ধমতাবলম্বীরা নিজের টিকিয়ে রাখতে গিয়ে কলুষিত হয়ে গিয়েছিল। ভিক্ষুণীদের অবস্থার উন্নতিসাধনে আমার ব্যাপারটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হতে পারত।
সাধারণ বৌদ্ধ আদালতে জিজ্ঞাসাবাদ প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সঙ্ঘ দুই পর্যায়ের প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে যাচাই বা অনুসন্ধান করে থাকেন। প্রথম পর্যায়ের প্রশ্নগুলো লিখিত-আকারে থাকে। দুই সপ্তাহ বাদে ঐ ব্যক্তিটিকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ৪০টি প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে হয়। এরপরে, মহানায়ক আদালতের জ্যেষ্ঠ ভিক্ষুরা বিবেচনা করেন কোনটি বৌদ্ধধর্মের জন্য যথাযথ।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে, তাদের আমাকে কোনোরূপ প্রশ্ন করতে হয় নি, তাদের জন্য কেবল এটা জরুরী ছিলো অন্যান্য বৌদ্ধ রাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করা এবং সেই দিকটির উন্নয়ন করা যা বিশেষত ভিক্ষুণীর অনুকূলে কাজ করে। (এটা ভালো যে, মায়ানমারে অনেক প্রস্থ ত্রিপিটক, পালিভাষা-বিশারদ, বহু ধ্যানশিক্ষক রয়েছেন, এমনকি আমার মামলা নিয়ে যারা করছিলেন সেই কমিটিতে দুইজন ত্রিপিটক-বিশারদও ছিলেন। )
আমি বহুবার ভিক্ষুদের নিকট আমার উপসম্পদা-গ্রহণের উদ্দেশ্য বোঝাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার অনুরোধ প্রত্যাখান করা হয়। তারা ক্রুদ্ধ ও ভ্রান্ত ছিলেন। স্বভাবতই তারা আমার পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক ছিলেন না। আমার বর্মী শিক্ষক-ভিক্ষুরা আমাকে সবসময় স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। মায়ানমার ফেরার আগে উপসম্পদা গ্রহণ করে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ভিক্ষুণীচীবর পরিধান করে আমি আমার শিক্ষকের (ভিক্ষু) সাথে পাঁচ মাস অতিবাহিত করেছিলাম। সে সময় বিহারটিতে আরো একশ বিশ জনের মতো ভিক্ষু সেখানে অবস্থান করছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তারা আমায় কেবল প্রথম প্রস্থের দশটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, উত্তর প্রদানের জন্য আমি পালিভাষার পরিবর্তে বর্মী ভাষা বেছে নিয়েছিলাম, যাতে গৃহীরা বুঝতে পারেন। (ভিক্ষুরা পালিভাষা করায় গৃহীরা না-পারতেন বুঝতে, না-পারতেন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। ) উত্তর প্রদানের জন্য আমি দ্বিতীয় প্রস্থের প্রশ্নমালা পাই নি। আমার মামলাটি অতি দ্রুত মহানায়ক কোর্টে স্থানান্তর করা হয়।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে বেলা ১টার সময়, কমিটিতে নিযুক্ত ভিক্ষুরা আমার সমালোচনা ও নিন্দা করেন, ‘কেননা মন্দকম্মের ফলে আমি নারী হয়ে জন্মেছি’ এবং তারা আরো বলেন মহাযানী ভিক্ষুণীদের তুলনায় বর্মী শীলমাতারা শীল ভালো করে প্রতিপালন করতে পারেন। থেরবাদে ভিক্ষুণীসঙ্ঘ পুনরুত্থানের উদ্যোগ বিবেচিত হয় সঙ্ঘে শত্রু নিয়ে আসার মতো যা ভেদ তৈরি যেটি খুবই গুরুতর। ‘ভিক্ষুরা দাবী করেন আমার উদ্দেশ্য ছিল সঙ্ঘে বিভেদ তৈরী করা, ইত্যাদি’।
দুপুর আড়াইটার দিকে কমিটি আমাকে পোশাক পরিবর্তন করে শীলমাতার পোশাক পরিধানের জন্য জোর প্রয়োগ করেন। (গোলাপী ব্লাউজ এবং কমলা লং স্কার্ট।) কাপর পরিবর্তনের পরেও আমি এটা ভেবে স্থির ছিলাম যে এমনকি আমাকে নগ্ন করে ফেলা হলেও তারা আমার উপসম্পদা-মর্যাদা কেড়ে নিতে পারেন না, চীবর হচ্ছে কেবল বাহ্যিক রূপ মাত্র। আমাকে ভিক্ষুদের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছিল। তাই আমাকে বলতে হয়েছিল, অজ্ঞানবশত লোভ-দ্বেষ-মোহে তাড়িত হয়ে অন্যায় কর্ম সাধনের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। প্রকৃতপক্ষে উপসম্পদা গ্রহণ করে আমি সমস্ত কলুষতা থেকে মুক্তিলাভ করতে চেয়েছিলাম। আমাকে এও বলতে হয়েছিল, গৃহীদের দানকৃত বস্তু ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন না করায় এবং ধম্ম অনুসারে যেটা সঠিক নয় তা করার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন। ভিক্ষুরা আমার কথা শুনে হাসছিলেন, কেননা আমি সে-সব বলতে চাই নি যা আমাকে দিয়ে জোর করে বলানো হয়েছিল। আমি না-পারছিলাম মৈত্রীভাব পোষণ করতে, না-পারছিলাম অনুকম্পা বোধ করতে এমনকি তাদের প্রতি ধৈর্যশীলও হতে পারছিলাম না। কিন্তু এইসব গুণাবলী বৌদ্ধদের ধারণ ও অনুশীলন করতে হয়, যা ভিক্ষুরা আমাদের শিক্ষা দিয়ে এসেছেন।
তারা আমাকে একগুচ্ছ কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে এটা বলতে বলল যে ভিক্ষুণী হয়ে আমি অন্যায় করেছি, যেটা ধম্ম-বিনয়ের বহির্ভূত, ইত্যাদি। তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমি খুবই ক্লান্ত ও বিচলিত ছিলাম। কাগজগুলো আমি ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমি গ্রেফতার হই এবং তার জন্য পুলিশ পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল।
শুরুতে তারা আমাকে স্থানীয় থানায় নিয়ে যায়। সেখানে নিযুক্ত পুলিশদের মধ্য থেকে একজন আমার ঊর্ধ্বদেশ ও নিম্নদেশ দেখে নিল। আমি ভয়ে কাঁপছিলাম। সেখানে বসে আমি কেবল ধ্যান করতে পারছিলাম। সাড়ে সাতটার সময় তারা আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করে। সেখানে আমাকে ইঁদুর, নোংরা শৌচাগার, জলহীনতা, ফাঁটা পাত্র (যেটাতে পানি বেশীক্ষণ টিকে না) সমেত ইঁদুরের গর্তের মতো পরিবেশে চারদিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল।
এ অবস্থায় আমি আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে-সিদ্ধান্ত বর্জন করি। আমি সুযোগ পেলেই সাধারণ মানুষকে ভিক্ষুণীদের সম্পর্কে যথার্থ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে আমাকে রেংগুন কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয় যেটা একটা নরক ছাড়া কিছুই ছিল না। সেখানে ছিল খুনি, এইচ আই ভি রোগী, কোনো রকম চিকিৎসাবিহীন সব সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের অবস্থান। সেখানে পায়ের চপ্পল ছিল না, বর্ষায় ছিল না ছাতা। আমাদের ভেজা কাপড় পরিধান করতে হতো, কারণ সেখানে কাপড় শুকানোর কোনো সুবিধা ছিল না। এটা যেন মশা-মাছি পোকা-মাকড়ের রাজত্ব। আমরা সবাই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম... যে কাজটা আমি শুধু করতাম সেটা হলো আমি যা সবচেয়ে বেশী ভালো পারতাম তা অনুশীলন করা। আমাকে বহু অর্থ খরচ করতে হয়েছিল উকিল ঠিক করতে। কারারক্ষীদের উৎকোচ দিতে হতো যাতে আমি একটু ভালো অবস্থায় থাকতে পারি... রাজনৈতিক বন্দীদের জীবনধারা অনুসরণ করতে হলে বহু অর্থ ব্যয় হতো।
অবশেষে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট সকাল আটটার সময় আমি বন্দীশালা থেকে মুক্তি লাভ করি। তারা আমাকে সরাসরি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যায় এবং শ্রীলঙ্কায় নির্বাসন দেয়। আমি ৭৬ দিনের কারাবাস সমাপ্ত করলাম।
আমার তিন নম্বর বোন যিনি ছিলেন একজন শীলমাতা, তিনি শান্তি ও উন্নয়ন বিভাগের সভাপতির নিকট গিয়ে অধিকন্তু বর্ণনা করলেন যে, আমরা একটি পরিবার থেকে এসেছি যেখানে আমাদের পিতা এবং ভাই দুজনেই সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। আগস্টের চার তারিখে আমাকে মহানায়ক কোর্টের কথা মতো সেখানে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। আমাকে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল যেখানে আমার মনে হয়েছিল কারাগারে আমাকে শেষ পর্যন্ত আটকে থাকতে হবে এবং বাইরের পৃথিবী আমাকে ভুলে যাবে। কারাবন্দী অবস্থায় বর্ষাকালে আমি দুইবার প্রায় মরতে বসেছিলাম।
এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেয়ে আমি এটা উপলব্ধি করেছি যে আমাদের জনসাধারণের জন্য গণতন্ত্র অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক। কিন্তু জনসাধারণকে সর্বপ্রথম পারমার্থিকভাবে উন্নত হতে হবে এবং মায়ানমারের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও শিক্ষাদীক্ষা পরিচালনার কৌশল অবশ্যই জানতে হবে তবেই তারা যথাযথভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রতিরক্ষা করতে পারবে।
মৈত্রীর সাথে
আশীন সচ্চবাদী
শ্রীলঙ্কা ছবি- ড. ধম্মানন্দা ভিক্ষুণীসহ ভিক্ষুণীসঙ্ঘ (থাইল্যান্ড)
আমি এটা জেনে খুশী হলাম যে পূজনীয় সচ্চবাদী দেয়ালে মাথা ঠুকছেন না। আমি তাঁকে একটা বার্তা পাঠিয়েছি যেন তিনি বেরিয়ে আসেন এবং জেলের বাইরে থেকে ইস্যুটির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। আমি আনন্দিত যে তিনি এখন শ্রীলঙ্কাতে তাঁর পি এই ডি কোর্স চালিয়ে যাচ্ছেন।
মহানায়ক কোর্টের আইনি প্রক্রিয়া বেশ উদ্ভট। আগেকার দিনগুলোতে আমরা মনে করতাম প্রধান তিনটি থেরবাদী রাষ্ট্র বিবিধ ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী। সূত্র-চর্চার জন্য শ্রীলঙ্কা ছিল সুপরিচিত, অভিধম্মের জন্য সুপরিচিত ছিল বার্মা, এবং বিনয়ের জন্য থাইল্যান্ডের সুপরিচিতি ছিল।
এমনটা বিশ্বাস ছিল যে থাইল্যান্ড বিনয় পালনের জন্য পরিচিত তার মানে থাই ভিক্ষুরা অন্যদের তুলনায় কঠোরভাবে বিনয় মানেন। আমি এখনো সঠিক জানি না এ-ব্যাপারে আমরা কতোটা সুনিশ্চিত।
ভিক্ষুণী-উপসম্পদার বিষয়ে বর্মী কমিই দাবী করেছিল ধম্ম-বিনয় অনুযায়ী এটা অন্যায়, এক্ষেত্রে আমরা খুব সহজেই প্রশ্ন রাখতে পারি, তিনি কে ছিলেন যিনি এটা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন? তিনি ছিলেন বুদ্ধ, আমরা যারা পরবর্তী প্রজন্ম আছি তাদের কর্তব্য_ তা নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা যা বুদ্ধ-কর্তৃক প্রবর্তিত। মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশে যেখানে কখনোই ভিক্ষুণী-উপসম্পদা পৌছে নি সেখানে কীভাবে এটাকে পুনরুজ্জীবিত ও পরিচিত করা যায় তা বিবেচনা করতে হবে।
বিদ্যমান প্রবৃত্তি ও মনোভাব হচ্ছে আমরা তা ছাড়া ভালোই জীবনযাপন করে আসছি , এটা অবহেলার মানসিকতা । উন্নয়নের উপর কোনো প্রস্তাব, কোনো পরিবর্তন করতে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে নিই নি । অধিকন্তু আমরা যদি আরো অধ্যয়ন করি তবে অনুধাবন করতে পারব যে বুদ্ধ চার বৌদ্ধিক পরিষদ, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী-উপাসক-উপাসিকা, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বুদ্ধমতবাদ রক্ষা ও প্রসারের জন্য তাদের উপর আস্থা রেখেছিলেন। তারপর আমাদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ভিক্ষুণী ইস্যুর প্রতি আমাদের মনোভাবের পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।
লেখাটি গৌতমী সাময়িকী 'সপ্তম সংখ্যা' থেকে নেয়া।
©somewhere in net ltd.