নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\'আপনারে দীপ করে জ্বালো\' (\'অত্তদীপ ভব\')

গৌতমী সাময়িকী

নীড় ছাড়ার গন্ধ শরীরে যার!

গৌতমী সাময়িকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাহায্য করো! কালাম-সুত্ত, সাহায্য করো! বুদ্ধদাস ভিক্ষু, ভাষান্তর:জয়দেব কর

০২ রা মে, ২০১৭ রাত ২:৪৯


থাই জনগণসহ পৃথিবীর সকল মানুষ এখন একই অবস্থায় আছেন যে-অবস্থায় ছিলেন বুদ্ধের সময়কার ভারতের কেসাপুত্তার অধিবাসী কালামগণ। তাদের গ্রাম এমন এক জায়গায় অবস্থিত ছিল যেখানে বিভিন্ন ধর্মগুরুরা প্রায়শই যেতেন। এই সকল গুরুদের প্রত্যেকেই প্রচার করতেন, তার নিজস্ব মতবাদই শুধু সত্য এবং তার পূর্বে ও পরে প্রচারিত সকল তত্ত্বই ভুল। তাই, কোন মতবাদটি তাদের গ্রহণ ও অনুসরণ করা উচিত তা কালামগণ স্থির করতে পারছিলেন না। যখন বুদ্ধ কোনো একসময় তাদের গ্রামে ভ্রমণ করতে গেলেন, কালামরা তাদের সমস্যা তাঁর কাছে উত্থাপন করলেন: কোন ধর্মগুরুকে বিশ্বাস করা যায় তারা জানেন না। এর ফলশ্রুতিতে বুদ্ধ তাদের যা শিক্ষা দেন তা এখন কালাম-সুত্ত হিশেবে পরিচিত, যা এখানে আমরা পরীক্ষা করব।

আজকালকার দিনে, বিশ্বজুড়ে মানুষ বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিয়ে অধ্যয়ন করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রায় প্রত্যেক বিষয়ে শিক্ষাদান করছে। তারপর, আধ্যাত্মিক ব্যপার নিয়ে , এখানে, থাইল্যান্ডে, অনেক শিক্ষক রয়েছেন, রয়েছে বুদ্ধশিক্ষার অনেক ভাষ্য, এবং এত বেশী ধ্যানকেন্দ্র আছে যে, কেউই জানেন না কোন শিক্ষাটি গ্রহণ করা যায় বা কোন চর্চাটি অনুসরণ করা যায়। এর ফলে এটি বলা যেতে পারে, আমরা আজ একই অবস্থায় পতিত হয়েছি যে-অবস্থায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে কালামগণ পড়েছিলেন।

শুধু যেকোনো একটা মানদণ্ডের সাথে মিলে গেলেই সাথসাথে কোনোকিছু গ্রহণ না-করার বা বিশ্বাস না-করার শিক্ষা বুদ্ধ তাদের, এবং আমাদের দিয়ে গেছেন। তিনি এরকম দশটি মানদণ্ডের প্রতি সচেতন থাকার তালিকা দিয়ে গেছেন, যাতে তারা কারো বুদ্ধিবৃত্তিক গোলাম হয়ে ওঠা পরিহার করতে পারেন, এমনকি বুদ্ধের নিজেরও। এই মূলনীতি আমাদের দুর্দশা উৎপাটনে যথাযথ ক্ষমতার অধিকারী শিক্ষাটি নির্বাচন করতে সক্ষম করে তোলে । কালাম-সুত্তে বুদ্ধের দেয়া দশটি উদাহরণ নিম্নে দেওয়া হলো।

১। মা অনুস্‌সবেন:
অনেক বছর ধরে চলে আসছে এবং বারবার বলা হয়েছে বলে কোন কিছুকে সত্য মনে করে বিশ্বাস ও গ্রহণ করবেন না। এই ধরণের অন্ধবিশ্বাস মস্তিষ্কহীন, ‘কাঠের গুঁড়ায় ঠাসা মস্তিষ্কের’, মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য। ঐ রকম ব্যংককে লোকজন একসময় বিশ্বাস করতো যে, ‘মা’ বর্ষে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিটি দূর্যোগ-দুর্ঘটনায় পতিত হন। (ছোট সর্পবর্ষ, বড় সর্পবর্ষ, অশ্ববর্ষ এবং মেষবর্ষ_ পাঁচ থেকে আট পর্যন্ত প্রাচীন থাই দ্বাদশ-বর্ষচক্রে_ সবকিছু মা দিয়ে শুরু হয়।)

২। মা পরম্পরায:
শুধুমাত্র প্রথাগত রীতি হয়ে গেছে বলে, কোন কিছুকে স্রেফ বিশ্বাস করবেন না। অন্যরা যা করে তা মানুষ অনুকরণ করতে চায় এবং তারপর অন্যের স্বভাব নিজের মধ্যে প্রয়োগ করে খরগোশের গল্পের ন্যায়, যেটি একটা পড়ন্ত আম দেখে ভয় পেয়ে (যেমন মুরগীছানারা আকাশ থেকে পড়ন্ত ছোট কিছু দেখলে হয়ে যায়) দৌড়ছিল এবং সেটির খুব দ্রুত দৌড় চোখে পড়ার সাথে সাথে অন্যান্য প্রাণীগুলোও তার পেছনে ভীত হয়ে দৌঁড়াতে শুরু করেছিল। পরিণামে, হোছট খেয়ে, গড়িয়ে পরে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়ে তাদের অধিকাংশই শেষ হয়ে গিয়ছিলো। যেকোনো বিপস্‌সনা-অনুশীলন (অন্তর্লোকে) যা স্রেফ অন্যদের অনুকরণ করে, যা শুধু প্রথাকে অনুসরণ করে এবং তা একই ফলাফল নিয়ে আসবে।


৩। মা ইতিকিরয়:
কোনো ঘটনা এবং এর খবর, গ্রাম হয়ে দূরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে বলেই, সহজে বিশ্বাস ও গ্রহণ করবেন না । একমাত্র বোকারাই এমন গুজবে সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাই তারা তাদের নিজের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাবোধের শক্তিগুলো চর্চা করতে আস্বীকৃতি জানায়।

৪। মা পিটকসম্পদনেন:
পিটকে (গ্রন্থ) লিখিত আছে বলেই গ্রহণ ও বিশ্বাস করবেন না। ‘পিটক’ শব্দটি যদিও সাধারণত বৌদ্ধশাস্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তা দিয়ে যেকোনো মানানসই লিখিত ও খোদিত লেখ্য উপকরণও বোঝানো যেতে পারে। মুখস্ত এবং মৌখিকভাবে চলে আসা শিক্ষার কারণে পিটকে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। পিটক হচ্ছে একধরণের সন্দেহাতীত আপেক্ষিক ব্যাপার যা মনুষ্যসৃষ্ট ও মনুষ্য-নিয়ন্ত্রিত, যা মনুষ্যহস্তেই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হতে পারে। ফলে আমরা এর প্রত্যেকটি শব্দ এবং তাতে যা পড়লাম তা বিশ্বাস করতে পারি না । আমাদের নিজস্ব বিবেচনাশক্তির ব্যবহার করে দেখা প্রয়োজন, কীভাবে এই কথাগুলো দুর্দশামুক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। বিভিন্ন বৌদ্ধ ধারার পিটকের মধ্যে অমিল রয়েছে, তাই সতর্কতার প্রয়োজন।

৫। মা তক্কহেতু:
কেবল যুক্তিসম্মত বিচারের (তক্ক) নিরীখে কোনো কিছু বিশ্বাস করবেন না। যুক্তি শ্রেফ জ্ঞানের একটি শাখা মাত্র যা সত্য হৃদয়ঙ্গম করতে চেষ্টা করে। তক্ক বা যুক্তি অব্যর্থ নয়। তথ্য ও অনুমিতি যদি সঠিক না হয়, তবে তা ভুলে পর্যবসিত হয়ে যেতে পারে।

৬। মা নযহেতু:
নয বা এখন যা ‘দর্শন’ বলে অভিহিত তার ভিত্তিতে কোনো কিছুকে সঠিক বলে মনে হলেই তা গ্রহণ করবেন না। থাইল্যান্ডে আমরা পাশ্চাত্য philosophy (বা দর্শন ) পরিভাষাটি প্রজ্ঞা হিসেবে ভাষান্তর করি। আমাদের ভারতীয় বন্ধুরা এটা গ্রহণ করতে পারবেন না, কারণ ‘নয’ একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা অনুকূল ধারণা মাত্র; এটা মহত্তম উপলব্ধি নয় যা যথাযথভাবে পঞ্‌ঞা বা প্রজ্ঞা নির্দেশ করে। নয বা নযয কেবল একটি অবরোহী বিচারপদ্ধতি অনুমিত সত্য বা পূর্ব ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই বিচার ভুল করতে পারে যখন পদ্ধতি বা অনুমিত সত্য অযথার্থ হয়।

৭। মা আকারপরিবিতক্কেন :
অগভীর চিন্তার ফলস্বরূপ, যেটাকে আমরা আজকালকার দিনে "common sense" বলে থাকি, যা শ্রেফ আকস্মিক বিচার যা একজনের চিন্তার ঝোঁকের উপর নির্ভরশীল, সেই "common sense" -এর মতো লাগছে বলেই কোনো কিছু সহজেই বিশ্বাস বা গ্রহণ করবেন না। আমরা এই অভিগমন এতোই প্রয়োগ করতে পছন্দ করি যে এটা স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিছু অসতর্ক ও অহঙ্কারী দার্শনিক এই ধরণের "common sense" এর উপর বিশাল ব্যাপারেও নির্ভর করেন এবং তারা নিজেদেরকে চালাক বিবেচনা করে থাকেন ।

৮। মা দিট্‌ঠিনিজ্ঝনক্‌খন্তিয়:
কারো বদ্ধমূল মতামত এবং তত্ত্বের সাথে একমত হলে বা মিলে গেলেই কোনোকিছু গ্রহণ ও বিশ্বাস কোরো না। ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ ভুল হতে পারে এবং আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি অপর্যাপ্ত হতে পারে, এর কোনোটাই আমাদের সত্যের দিকে পরিচালিত করে না। এই অভিগমণ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির সদৃশ মনে হতে পারে, কিন্তু কখনোই প্রকৃতভাবে বিজ্ঞানসম্মত হতে পারে না, কারণ, এর প্রমাণসমূহ ও নিরীক্ষাগুলো অপর্যাপ্ত।


৯। মা ভব্বরূপতয়:
শুধু সম্মান ও সুনাম থাকার জন্য বক্তাকে বিশ্বাসযোগ্য লাগছে বলে কোনো কিছু বিশ্বাস কোরো না । ব্যক্তির বাহ্যিক দৃষ্টিগোচরতা ও ভিতরের প্রকৃত জ্ঞান কখনোই অভিন্ন হতে পারে না। আমরা প্রায়শই দেখি যে যেসকল বক্তাকে বাহ্যত প্রশংসাযোগ্য মনে হয় তারা ভুল ও হাস্যকর কথা বলছেন। আজকালকার দিনে আমরা অবশ্যই কম্পিউটার সম্পর্কে সচেতন কারণ প্রোগ্রামার যিনি সেগুলোতে ডাটা প্রদান ও পরিচালনা করেন তিনি ভুল তথ্য দিতে পারেন তখন প্রোগ্রামিং ত্রুটি তৈরি হতে পারে, বা সেগুলোর ভুল ব্যবহার হতে পারে। কম্পিউটারকে এতো উপসনা করবেন না যাতে তা কালাম-সুত্তের নীতির বিপরীতে চলে যায়।

১০। মা সমন ন গরু তি:
সন্ন্যাসী (অধিক বিস্তৃতভাবে, যেকোনো বক্তাটি) ‘আমার শিক্ষক’ ভেবে কিছুই সহজে বিশ্বাস করবে না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে বুদ্ধ শিক্ষা দেন যে, কারোরই অন্যের বুদ্ধিবৃত্তিক দাস হওয়া উচিত নয়, এমনকি বুদ্ধের নিজেরও না। বুদ্ধ এই বিষয়বস্তুর উপর বহুবার জোর দিয়েছিলেন, শ্রদ্ধেয় সারিপুত্তের মতো শিষ্যগণ ছিলেন যাঁরা এটি অনুশীলনের মধ্য দিয়েই নিশ্চিত করেছিলেন। তাঁরা বুদ্ধের কথা শোনার সাথে সাথে বিশ্বাস করতেন না; কার্যকারণের প্রতিফলন এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পরীক্ষার পর তা করতেন । আপনারা নিজেরা দেখুন পৃথিবীতে আর কোনো ধর্মগুরু আছেন কিনা যিনি তার শিষ্য ও শ্রোতাদের এই সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছেন! পরীক্ষা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছাড়া বিশ্বাস করতে আমাদের চাপ প্রয়োগ করে এমন অন্ধবিশ্বাসের স্থান বুদ্ধমতবাদে নেই। এটা বুদ্ধমতবাদের মহত্ত্বর অনন্যসাধারণতা যা এর অনুশীলনকারীদের কারোর বুদ্ধিবৃত্তিক দাস হওয়া থেকে মুক্তি দেয়। আমরা, থাইরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পশ্চিমকে অনুসরণ করছি এখন যেভাবে করছি ঠিক দাসের মতো ।


বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা:

কালাম-সুত্তের দশটি উদাহরণ বুদ্ধিবৃত্তিক নির্ভরশীলতা ও কারো নিজস্ব গোলাম হওয়ার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা, তা হচ্ছে, কাউকে কোনোকিছু শোনার সাথে সাথে অন্য কারোর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখে (পরতোঘোস, ‘অন্যের শব্দ’ বৌদ্ধিক পরিভাষা)। একজন যাকিছুই শুনুক না কেন, তাতে সতর্কভাবে ও প্রণালীবদ্ধভাবে বিবেচনা করা উচিত। যখন ব্যাপারটির প্রত্যেকটি দিক সুস্পষ্টভাবে মঙ্গলজনক হয় এবং তা দুর্দশা-নির্মূলে সক্ষম হয়, তখনই কেউ চূড়ান্তভাবে তা শতভাগ বিশ্বাস করতে পারেন।

কালাম-সুত্তের মূলনীতি সকলের জন্য, সর্বত্র, সকল যুগে এবং সকল বিশ্বে, এমনকি স্বর্গতুল্য পৃথিবীতেও মানানসই ও যথোপযুক্ত। আজকের বিশ্ব অতিবিস্ময়কর যোগাযোগ এবং তথ্যের সহজ ও দ্রুত বিনময়ের বদৌলতে ছোট হয়ে এসেছে। মানুষ এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে নতুন জ্ঞান গ্রহণ করতে পারে। তা গ্রহণ করতে গিয়ে তারা জানে না কী বিশ্বাস করা যায়, এবং এই কারণে তাদের অবস্থা ঠিক বুদ্ধের সময়ের কালামদের মতো। বস্তুত কালাম-সুত্ত তাদের আশ্রয় হতে পারে। অনুগ্রহ করে এর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিন এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তা ধারণ করুন। এটা সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করুন যে, বুদ্ধ এই সুত্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন। এটা সমস্ত জগতের জন্য একটি উপহার। শুধু যারা অতি বোকা তারাই বুদ্ধের এই শিক্ষা থেকে সুফল গ্রহণ করতে অক্ষম।

সকল বয়সের মানুষের কালাম-সুত্তের অনুশীলন জরুরী। এমনকি বাচ্চারাও অজ্ঞানতার (অবিজ্জা) সন্তান না হয়ে জ্ঞানের (বোধি) সন্তান হওয়ার জন্য, এর মূলনীতি প্রয়োগ করতে পারে। পিতামাতার তাদের সন্তানদের এমনভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা উচিত যাতে তারা উপলব্ধি করতে পারে কীভাবে উপদেশ ও নির্দেশনা বুঝতে হয়, কীভাবে যুক্তিপাত করতে হয় ও সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ করতে হয় এবং সর্বোপরি যে ফলাফল দাবী করা হয়েছে তা সত্যিই সেরকম হবে কিনা তা দেখতে হয়। যখনই নিজেদের সন্তানদের কিছু শিক্ষা দেন বা কথা বলেন না কেন , পিতামাতার উচিত তাদেরকে সাহায্য করা, যাতে তাদেরকে যা করতে বলা হচ্ছে, তা প্রকৃতভাবে বুঝতে পারে এবং সেগুলোতে তাদের নিজেদের মঙ্গল দেখতে পায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন মাদক গ্রহণ না-করতে বলা হয়, সন্তানের তা শ্রেফ ভয় পেয়ে মেনে নেওয়া উচিত না, কিন্তু মাদক গ্রহণের প্রকৃত ফলাফল কী তা বুঝে মেনে নেওয়া উচিত, এবং এর ফলে নিজ থেকেই সকল নেশাদ্রব্য থেকে বিরত থাকার পথ খোলে যায় ।

কালাম-সুত্তের দশটি উদাহরণের কোনো একটিও বোঝায় না যে, বাচ্চাদের কখনোই কারোর কথা শোনা বা বিশ্বাস করা উচিত নয়। সেগুলো সহজেই বোঝায় যে, বাচ্চাসহ আমাদের বাকী সকলেরই সতর্কতার সাথে কোনোকিছু শোনা এবং নিজেদের জন্য এ-বিশ্বাসের যথার্থতা ও শুভ কার্যকারীতা উপলব্ধির পরই শুধু তা সত্য হিশেবে বিশ্বাস করা এবং তারপর তা সঠিকভাবে প্রতিপালন করা কর্তব্য। যখন একজন শিক্ষক কোনোকিছু শিক্ষা দেন, বাচ্চাদের বুঝতে সাহায্য করেন যে, তার শিক্ষাটির পেছনে যুক্তিপাত রয়েছে যা তাদের একগুয়ে বানাবে না। একজন একগুয়ের ক্ষেত্রে, একটা আলতু বেত্রাঘাত করে পুনরায় বিষয়টি ভাবতে বলেন। বাচ্চারা বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কালাম-সুত্ত বিস্তৃত পরিসরে বুঝবে ও মূল্যায়ন করবে। যদি আমরা বাচ্চাদের এই মানে প্রশিক্ষিত করে তুলি, তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে, দশ উদাহরণের সব কটি শিক্ষায় সুদক্ষ হয়ে উঠবে ।

আজকের বিজ্ঞান-জগত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে থেকে কালাম-সুত্তের দশটি শিক্ষা আনন্দের সাথে গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানের মূলনীতির সাথে কালাম-সুত্তের সামান্যতম সাংঘর্ষিকতা নেই। এমনকি, অষ্টম শিক্ষাটি, যেটির বক্তব্য হচ্ছে কারোর পূর্ব-অনুমিত তত্ত্বের সাথে কোনোকিছু সংগতিপূর্ণ মনে হলেই তা গ্রহণ অনুচিত, তা বিজ্ঞানের মূলনীতির সাথে কোনো সংঘর্ষ করে না। প্রকৃত বিজ্ঞানীরা কোনোকিছুকে সত্য বলে মেনে নিতে পরীক্ষামূলক প্রমাণকে তাদের বিচারের মূল মাপকাঠি হিশেবে জোর দেন_ ব্যক্তিগত মতামত, ধারণা, বিশ্বাস এবং তত্ত্বসমূহকে নয়। কালাম-সুত্তের এমন উচ্চতর মানের জন্য, বুদ্ধমতবাদ প্রকৃত বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের সন্তুষ্ঠি প্রদান করবে।

যদি কেউ কালাম-সুত্তের মূলনীতি অনুসরণ করেন, তবে তিনি স্বাধীন জ্ঞান ও যৌক্তিকতার সন্ধান পাবেন যা দিয়ে অর্থ অনুধাবন করা যায় এবং প্রথমবারের মতো শোনা বা পড়া ধারণা ও প্রতিজ্ঞাসমূহ বুঝতে পারা যায়। উদাহরণস্বরূপ, যখন কেউ শুনতে পান লোভ-দ্বেষ-মোহ বিপজ্জনক ও মন্দ , তিনি দ্রুত ও তৎক্ষণাৎ তা উপলব্ধি করতে পারেন, কারণ তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসব বিষয় কীরকম তা জানেন । তিনি বক্তাকে নয় বরং নিজেকে বিশ্বাস করেন। অনুশীলনের পথটি অন্য সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেও একই। বক্তব্য যদি পূর্বে কখনো না-দেখা, না-বোঝা কোনোকিছুর বিষয়ে হয়, প্রথমে তাকে তা বুঝতে পারার বা জানতে পারার চেষ্টা করতে হবে। তারপর তিনি বিবেচনা করতে পারবেন নতুন পাওয়া শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করা যায় কিনা। তার একবার সময় নেওয়া উচিত, এমনকি যদি এর মানে হয় খোঁজে বের করার পূর্বেই তিনি মারা যাচ্ছেন। এভাবেই কালাম-সুত্ত তাকে অন্য যেকোনোজনের বুদ্ধিবৃত্তিক দাস হওয়া থেকে রক্ষা করে, এমনকি অতিসুক্ষ্ণ ও তথাকথিত ‘অলৌকিকতা’র ক্ষেত্র থেকেও।

একটি নতুন ওষুধ বের হলে এবং সব জায়গায় বিজ্ঞাপিত হলে সব সময় সমস্যার উদয় হয়। বিজ্ঞাপনের উপর বিশ্বাস করে তা পরীক্ষা করতে আমাদের কি তাতে গিনিপিগ হিশেবে নিজেদের সমর্পণ করা উচিত ? বা, এতে পূর্ণরূপে নির্ভর করার আগে, প্রথমে, শুধু এর সামান্যটুকুও চেষ্টা করার পর্যাপ্ত কারণ জানা পর্যন্ত , তা বিজ্ঞাপন অনুযায়ী সত্যিই ভালো ফল দেয় কিনা তা দেখা পর্যন্ত, আমাদের অপেক্ষা করা কি উচিত নয়? যেভাবে আমরা ওষুধের ক্ষেত্রে সাড়া দেই, সেভাবে যথার্থ শরণ হিশেবে কালাম-সুত্তের মূলনীতি অনুসরণ করে আমাদের নতুন শিক্ষা ও বক্তব্যে সাড়া দেওয়া উচিত ।


কালাম-সুত্ত কোনোকিছু বিশ্বাসের পূর্বে আমাদের প্রজ্ঞার উন্নতিসাধন চায়। যদি কেউ প্রথমে বিশ্বাসকে নিয়ে আসতে চান, তাহলে তা সেই বিশ্বাসটি হোক যার শুরু প্রজ্ঞা দিয়ে, অজ্ঞানতা থেকে জন্ম নেওয়া অন্ধবিশ্বাস দিয়ে নয়। অষ্টাঙ্গিক মহাপথের (অরিয় অট্টাঙ্গিক মগ্‌গ) মূলনীতিতে একই সত্য বিদ্যমান: প্রজ্ঞা বা সঠিক উপলব্ধিকে (সম্মা দিট্‌ঠি) সূচনাবিন্দু হিশেবে নিন, তাহলে পরে সেই প্রজ্ঞা বা সঠিক উপলব্ধি থেকে বিশ্বাস জন্ম নেবে। এটাই একমাত্র সহজ আশ্রয়। কোনোকিছু শোনার সাথে সাথে অন্ধভাবে বিশ্বাস, অথবা ভয়, উৎকোচ, বা পছন্দ করার কারণে বিশ্বাস করতে বাধ্য হওয়া উচিত নয় । বিজ্ঞাপন আর রটনার শক্তিদ্বারা আজকের পৃথিবী এতই আচ্ছন্ন যে অধিকাংশ মানুষ এর দাস হয়ে উঠেছে। ওগুলো যা খাওয়ার দরকার নেই, যা রাখার দরকার নেই, এমনকি যা ব্যবহারেও লাগে না, সে সকল দ্রব্য মানুষকে দিয়ে বিনা ভাবনায় ক্রয় করাতে পারছে। এটা এতোই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, এর থেকে নিষ্কৃতিলাভের জন্য সম্পূর্ণরূপে কালাম-সুত্তের মূলনীতি অবশ্যই আমাদের এই সময়ের সকল মনুষ্য-বন্ধুদের নিকট নিবেদন করতে হবে। সাধারণ বিজ্ঞাপন, বা পালিতে যাকে ‘পরতঘোস’ বলা হয় তার চেয়ে রটনা অধিক বেশী ক্ষতিকর। এমনকি এই সাধারণ বিজ্ঞাপন বা ‘পরতঘোস’ এর ক্ষেত্রে, আমাদের অবশ্যই কালাম-সুত্তের মূলনীতিকে আশ্রয় করতে হবে, যাতে উদ্দেশ্যপূর্ণ ধারণা হতে উদ্ভুত রটনা অসাড় বলে প্রতীয়মান হয়। অতএব আমরা এও বলতে পারি যে অর্থনৈতিক সমস্যাবলী নিরসনে কালাম-সুত্তে ফলদায়ী।

আমি আপনাদের সকলকে কালাম-সুত্তে পাওয়া এমন মহা আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা অন্যখানে পাওয়া যায় কিনা তা বিবেচনা, অনুসন্ধান ও পরীক্ষা করতে বলি। যদি কেউ বলেন বুদ্ধমতবাদ হচ্ছে স্বাধীনতার ধর্ম, তবে এই বক্তব্যে বিরোধীতা বা আপত্তি করার কোনো কারণ আছে কি? স্বাধীনতার নেশায় মত্ত পৃথিবী সত্যিই কি কালাম-সুত্তের মূলনীতির সমরূপ স্বাধীনতা জানে বা পায়? কালাম-সুত্ত সম্পর্কে অন্ধ-অজ্ঞানতা ও উদাসীনতা কি এই ধরণের স্বাধীনতার অভাব সৃষ্টি করে না? এমনকি, এটা যে কোনো ব্যাপার বিশ্বাস না-করতে বা না-শুনতে শিক্ষা দেয়_ এই দাবী করে কেউ কেউ এই সুত্তকে অবজ্ঞা করেন। কেউ কেউ আরো দাবী করেন যে, বুদ্ধ শুধু সেই সময়ের কালামদের জন্য এই সুত্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন। আজকের দিনে মানুষ যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিকক্ষেত্রে দাস হয়ে উঠেছে, বুদ্ধের সময়কার কালামদের চেয়েও যে অনেক বেশী স্বাধীনতা হারিয়েছে, তা কেন আমরা আমাদের চোখ খোলে লক্ষ্য করি না ? প্রিয় বন্ধুগণ, স্বাধীনতার একনিষ্ট পূজারীবৃন্দ, আমি আপনাদের কালাম-সুত্তের সারবস্তু ও লক্ষ্য এবং এই শিক্ষা প্রদানে বুদ্ধের অভিপ্রায় সতর্কতার সাথে বিবেচনা করতে বলছি। তাহলে, আপনাদের জাগরণের বৌদ্ধিক গুণাবলীসমূহ সংকীর্ণ ও দুর্বলরূপে বিকশিত না হয়ে বরং বিস্তৃত ও প্রবলরূপে বিকশিত হবে। বোকার মতো কালাম-সুত্তকে ভয় ও বিরাগ পোষণ করবেন না। ‘থাই’ শব্দটি দিয়ে স্বাধীনতা বোঝায়। কী ধরণের স্বাধীনতা আপনারা আমাদের ‘থাই-গুণ’ –এ নিয়ে আসছেন? অথবা কোন ধরণের ‘থাই-গুণ’ বা বুদ্ধের শিষ্যদের বৌদ্ধিক ‘থাই-গুণ’ স্বাধীনতার জন্য নিখুঁত ও সঠিক?


মুক্ত মানসিকতার মধ্য দিয়ে সংঘর্ষ পরিহার

এখন চলুন আমরা কালাম-সুত্তে লুকিয়ে থাকা মঙ্গলসমূহ ও সুবিধাগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি। যে-সকল অকুশল ও সংকীর্ণমনা কথা আমাদের সহিংস সংঘর্ষ ও বিরোধের দিকে নিয়ে যায় তা পরিহার করতে সুত্তটি আমাদের সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সকল পরিবারের জন্য, স্বামী বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে, কে সেই হাতিটির (সংসারের) সামনের পা (নেতা), এবং কে পশ্চাতের পা, তা নির্ধারণ করে অপরিবর্তনীয় নীতি জারি করা বোকামী । এ বিষয়টি প্রত্যেক পরিবারের নির্দিষ্ট কিছু অবস্থার উপর নির্ভরশীল। কালাম-সুত্তের মূলনীতি ও নির্দিষ্ট আপেক্ষিকতার সূত্র (ইদপ্পচ্চয়ত) অনুসারে, আমরা শুধু প্রত্যেক পরিবারের পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে পরিবারের সদস্যদের যথাযথ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। দয়া করে একতরফা কথা বলবেন না এবং প্রাকৃতিক বিধান ভাঙবেন না।

গর্ভপাতের ক্ষেত্রে, তা সঠিক না ভুল, কোন ক্ষেত্রে তা উপযোগী বা উপযোগী নয়, তার অনুসন্ধানী আবিষ্কার না-করে, মানুষ তাদের মুখমণ্ডল লাল না-হওয়া পর্যন্ত তর্ক করে। যদি যুক্তিপাতের বৌদ্ধিক পথের প্রাকৃতিক মূলনীতি আমরা অনুসরণ করি, তবে প্রতিটি অবস্থাই দেখাবে কখন তা যথাযথ বা যথাযথ নয় । দয়া করে একপাক্ষিক অবস্থানগুলোতে গোঁ ধরা বন্ধ করুন।
মাংস খাওয়া বনাম নিরামিষ খাওয়ার ক্ষেত্রে ঘটনাটি একই। প্রত্যেক পক্ষই একগুঁয়ের মতো এর চূড়ান্ত অবস্থান ঠিক রেখে যুক্তি দেখায়। এই ধরণের লোকেরা খাদ্যের ক্ষেত্রে হয় মাংস না-হয় শাকশব্জির প্রতি আসক্ত। বুদ্ধমতাবলম্বীদের জন্য কোনো মাংস অথবা শাকশব্জি নেই; আছে শুধু প্রাকৃতিক উপাদান। খাদ্য-খাদক সকলেই প্রাকৃতিক উপাদান মাত্র। কোন অবস্থায় মাংস খাওয়া উচিত এবং কোন পারিপার্শ্বিকতায় উচিত নয় তা কালাম-সুত্তের মূলনীতি ব্যবহার করে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে। এই কারণে, বুদ্ধ কখনোই নির্দিষ্ট করে মাংস অথবা শাকশব্জির যেকোনো একটি খেতে, অথবা মাংস বা শকশব্জির যেকোনো একটি না-খেতে বলেন নি। দায়িত্বহীনভাবে কথা বলা বুদ্ধমতাবলম্বীদের পন্থা নয়।

গণতন্ত্র সর্বদাই উৎকৃষ্ট বলা কারোরই উচিত নয়। যারা এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর দেন, তারা বিবেচনা করেন না যে, স্বার্থপর মানুষের গণতন্ত্র, যিনি নিঃস্বার্থ, ধম্ম বা ন্যায়পরায়ণতা অনুযায়ী জীবনযাপন করেন, সেই মানুষের একনায়কতন্ত্রের চেয়ে খারাপ। স্বার্থপর মানুষের গণতন্ত্র মানে ভীতিকর ও আতংকপূর্ণ রীতিনীতিতে তাদের স্বার্থপরতা চরিতার্থ করতে পারার স্বাধীনতা। ফলশ্রুতিতে, যে-সমস্ত লোকের মধ্যে স্বার্থপরতার গণতন্ত্র আছে সে সমস্ত লোককে সীমাহীন সমস্যার ক্লান্তি বইতে হয়। গণতন্ত্রই সর্বোচ্চ বা একনায়কতন্ত্রই সর্বোচ্চ বলা থেকে বিরত থাকুন। তার পরিবর্তে, ধম্মের উপর ভিত্তি করা মূলনীতিটির উপর আস্থা রাখুন। সমাজ যে-সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা মোকাবেলা করছে, তা অনুযায়ী তাতে যেটি সবচেয়ে বেশী কার্যকরি, সেটিই প্রত্যেক সমাজের নির্বাচন করা উচিত।


প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এমন একজন হবেন যিনি হবেন নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং কখনোই সরাসরি জনতার দ্বারা নির্বাচিত নন এমন কেউ হবেন না _এটা বলা যেন মূক ও বধিরের সামনে তর্জন-গর্জন করা।১ সত্যিই, আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে পরিস্থিতি কী হতে পারে, সুস্পষ্ট পারিপার্শ্বিকতাগুলো ও কারণ কী, তারপর নির্দিষ্ট শর্তাবদ্ধতার নীতি অনুযায়ী সঠিকভাবে অনুশীলন করতে হবে। রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে একইভাবে প্রয়োগ করতে হয়। এটা প্রকৃত বৌদ্ধিক পন্থা, এ-নীতিটির যথোপযুক্ততার জন্য বুদ্ধমতবাদ গণতন্ত্র উন্মোচিত করে ধম্মীয় সমাজতন্ত্র (Dhammic socialism) রূপে। অতএব, সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন, সরকার-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক পদ্ধতির কাঠামো নির্মাণ, এবং এমনকি অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সবখানে কালাম-সুত্তের মূলনীতি দিয়ে পরিচালিত হওয়া উচিত। অনুগ্রহ করে, প্রত্যেকটি উদাহরণ বিবেচনা করুন এবং তাতে আপনি এই সুত্তের মূলনীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবেন।

যেকোনো সময়ের চেয়ে আধুনিক বিশ্বের পরিচালনায় মূলনীতি হিশেবে কালাম-সুত্তের বেশী প্রয়োজন রয়েছে। পৃথিবী মানবিক কলুষতা-দ্বারা ভাগ্যজাল খুব দ্রুত বয়ন করছে। উন্নত যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও যোগাযোগ-পদ্ধতির কারণে তা ছোট হয়ে আসছে। এবং যথাযথ সচেতনতা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার অভাবের কারণে তা প্রায় আত্মধ্বংসী হয়ে যাচ্ছে। কলুষতার শক্তির অধীন বিশ্ব জড়বাদ, যৌনতা, এবং ভোগবাদের পূজা করছে, কারণ এতে কালাম-সুত্তের মতো মানদণ্ডের অভাব রয়েছে। কেউই জানে না এর নীতিগুলো দিয়ে কীভাবে কোন জিনিস নির্বাচন করা যায়। ফলশ্রুতিতে, পৃথিবী শান্তির জন্য অনুপযুক্ত, প্রতিটি মুহূর্তে অপরাধ ও দুর্নীতিপরায়ণতা বাড়ছে। চলুন আমাদের মানদণ্ড হিশেবে কালাম-সুত্তের উপর নির্ভর করে এইসকল সমস্যাবলী ও সকল অমঙ্গল উপড়ে ফেলি।

সর্বশেষে, এই সুত্তের নামকরণের কথা বলতে হয়। প্রকৃতপক্ষে যারা এই শিক্ষা শুনেছিলেন, তাদের নাম যুক্ত করে একে ডাকা হয় কালাম-সুত্ত। যে-এলাকায় এ-শিক্ষাটি প্রদান করা হয়েছিল সে এলাকার নাম যুক্ত করে একে ডাকা হয় কেসপুত্ত-সুত্ত।২ নাম যাই হোক, সারমর্ম ও অর্থ একই থাকে। গত শতকের শুরুর দিকে ‘ধম্মসম্পত্তি’ নামক সিরিজের মধ্য দিয়ে ত্রিপিটক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।৩ তারপর এই সুত্ত কালাম-সুত্ত নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠে। অতএব, চলুন আমরা ফুসফুসের উপরিভাগে গর্জে উঠি, ‘সাহায্য করো! কালাম-সুত্ত, সাহায্য করো!’


উপসংহারে, কালাম-সুত্ত কখনোই আমাদেরকে কোনোকিছু বিশ্বাস করতে নিষেধ করে না; তা আমাদের শুধু মিনতি জানায় স্বাধীন বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে কোনোকিছু বিশ্বাস করার জন্য। তা কখনোই আমাদের কোনকিছু শুনতে নিষেধ করে না; তা আমাদের শ্রেফ বলে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা ছাড়া কোনোকিছু শুনলে দাসত্ব বরণ করতে হয়। অধিকন্তু, তা আমাদের খুব সুক্ষ্ম ও স্পষ্টভাবে চিন্তা, বিবেচনা, অনুসন্ধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেও সক্ষম করে, যাতে আমরা পাহাড়তুল্য আবর্জনার স্তূপ থেকে স্বর্ণদানা খোঁজে বের করতে পারি।

অনুগ্রহ করে আসো, কালাম-সুত্ত! আসো বর্তমান বিশ্বে, সকল বুদ্ধামতাবলম্বীর, সকল মানবসন্তানের হৃদয়-মনে, তোমাকে অধিষ্ঠিত করো।


মোক্ষবলরাম
এপ্রিল ৬, ১৯৮৮

পাদটিকা:
কালাম-১। ১৯৯০ এর মধ্য পর্যন্ত, এই ইস্যু ছিল একদিকে গণতন্ত্রকর্মী এবং অপরদিকে সেনাবাহিনী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে বিরোধের একটা বিপজ্জনক কেন্দ্রবিন্দু।
কালাম-২। ত্রিপিটকের বিভিন্ন সংস্করণে এই সুত্তের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে।
কালাম-৩। শ্রদ্ধেয় ফ্রা মহাসমনাচাও ক্রমফ্রায়া বচিরায়া ন্যানারোরোত ,সর্বোচ্চ ধর্মগুরু, যিনি থাইল্যান্ডে বুদ্ধমতবাদের মূলপাঠগুলো এবং শিক্ষা আধুনিকীকরণ করেন

[বুদ্ধমতবাদ ও থাই লোকবিশ্বাসের নবভাষ্যকার শ্রদ্ধেয় বুদ্ধদাস ভিক্ষু দক্ষিণ থাইল্যান্ডের চইয়া জেলার বান ফুম্রিয়াং-এ ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় গুয়াম ফনিচ। তাঁর পিতার নাম সিং ফনিচ ও মায়ের নাম ক্লুয়ান ফনিচ। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৃহ জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে তিনি সাঙ্ঘিক প্রশিক্ষণের জন্য রাজধানী ব্যংককে যান। কিন্তু সেখানের কোলাহল, নোংরা-ময়লা এবং বিশেষ করে কলুষিত সঙ্ঘের প্রতি বিরক্ত হয়ে নিজের জন্মস্থানে ফিরে এসে নিজ গ্রামের পাশে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সোয়ান মোক্ষ’ মানে ‘মুক্তির বাগান’। তিনি প্রথাগত আচার-পদ্ধতি ও যে আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যাজকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে তা এরিয়ে সহজভাবে বুদ্ধের শিক্ষা প্রচার করে গেছেন। ‘ভালো কাজ করো, মন্দ পরিহার করো, চিত্ত বিশুদ্ধ রাখো’, বুদ্ধের এই সহজ শিক্ষার নানামুখী ব্যখ্যা ও বিশ্লেষণ এবং ইহজীবনে নির্বাণলাভের শিক্ষা তাঁকে ধীরে ধীরে মানুষকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করছিল। বিশেষত শহুরে শিক্ষিত শ্রেণি, তরুণ-তরুণীদের নিকট তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। বিভিন্ন জটিল দর্শনশাস্ত্র ব্যখ্যায় তাঁর প্রজ্ঞা ছিল ব্যাপক। তাঁর অসাধারণ ভাবনাশক্তি শ্যমদেশীয় অভ্যুত্থানে-১৯৩২ এর নেতা প্রিদি বনোমিয়ং এবং ১৯৬০-৭০ সমাজকর্মী ও শিল্পীদের প্রভাবিত করেছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো : The A,B,Cs of Buddhism; Handbook for Mankind;Heart-wood from the Bo Tree;Keys to Natural Truth; Me and Mine: Selected Essays of Bhikkhu Buddhadasa; Mindfulness With Breathing; No Religion; Paticcasamuppada: Practical Dependent Origination;Teaching Dhamma with Pictures etc.১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে এই আলোকিত ভিক্ষুর মহাপ্রয়াণ ঘটে।]
লেখাটি গৌতমী সাময়িকী 'সপ্তম সংখ্যা' থেকে নেয়া।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.