![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সমালোচনামূলক চিন্তা, সংশয়বাদ, এবং গবেষণা শুধুমাত্র বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়,আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এটা বুদ্ধমতবাদের বেলাও সত্য, বিশেষ করে সেকুলার বুদ্ধমতবাদের ক্ষেত্রে। বস্তুত, বুদ্ধ যে কথাটি বলার জন্য সুপরিচিত ছিলেন ,আমি তা এখানে সহজভাবে উদ্ধৃত করছি: ‘আমি যা বলি তা-ই বিশ্বাস কোরো না, তা নিজেতে অনুসন্ধান করো।’
যখন আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যখন প্রথম ধ্যান এবং একাগ্রতার অনুশীলন শুরু করি ,শিক্ষাগুলোর অনেক কিছুই নিজেদের সত্যতা প্রমাণ করে। এটা সম্পূর্ণরূপে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতে শুরু হয়, উদাহরণস্বরূপ, আমরা আনন্দে আসক্ত থাকি এবং যন্ত্রণার প্রতি আমাদের বিরাগ রয়েছে। এমন আসক্তিতে আমাদের প্রতিক্রিয়াগুলো প্রায়শই অভ্যন্তরীণ দুর্ভোগ ঘটাতে বিশাল ভূমিকা পালন করে। পূর্ণ মনোসংযোগ আসক্তির চেয়ে বেশী কিছু উন্মোচিত করে , এমনকী আমরা কী করে আত্ম-এর অনুভূতি বারবার তৈরী করি তাও উন্মোচিত করে ।
অনাত্ম সম্পৃক্ত শিক্ষাগুলো আমাকে খুব সংশয়ী ও অবিশ্বাসী করে তুলেছিল। যদিও আমি দশ বছর বয়স থেকে একজন নাস্তিক এবং তখন থেকেই আত্মায় বিশ্বাসী না,একটি স্থির আত্ম-এর পরিচালনা না-থাকায় ব্যাপারটি উদ্ভট মনে হয়েছিল। আমি সহজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই শিক্ষার গভীরে প্রবেশ করতে ,যা আপনাদের সবার প্রয়োজন,এবং অনাত্ম সম্পর্কে বুদ্ধের শিক্ষা সঠিক নয় তা প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম।
সংযোজন হতে দুর্দশার উৎপত্তির আসক্তি সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি আমি স্থির কোনো সত্তা, কেন্দ্রীয় চালিকাশক্তি, আমার কোনো অংশের মধ্যে খুঁজে বের করতে পারি নি যা আমি অণ্বেষণ করেছি। তবে অন্য আকর্ষণীয় কিছু আমার কাছে স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছিল. . .
আমরা আমাদের দিনের মধ্য দিয়ে, আমরা আমাদের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ পরিবেশের প্রতি প্রতিক্রিয়া করি একটা আত্ম-অনুভূতি(‘আমি’, ‘আমাকে’ ‘আমার’-এর অনুভূতি) তৈরি করার মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ, প্রথমত পাকস্থলীতে ক্ষুধার অনুভূতি আছে। এটি কেবল একটি শারীরিক সংবেদন (sensation)। ঐ সংবেদন, খাবারের প্রয়োজন, ভাবনার উদয় ঘটায়,_ "আমি ক্ষুধার্ত"। ঐ ভাবনার মধ্য দিয়ে ‘আমি’ বোধটি আত্ম-বোধের জন্ম দেয়।
আমি পুরো সময় লক্ষ করলাম যে ‘আমি’-টিকে আমি স্থির সত্তা বলে গ্রহণ করে আসছিলাম তা মোটেই কেন্দ্রীয় চালক ছিলো না, কিন্তু তার পরিবর্তে জগতের প্রতি প্রতিক্রিয়ার ফলে তার দিনে হাজারবার উদয় এবং বিলয় হয়েছে। সত্তার এই খণ্ডিত অনুভূতি সেই কেন্দ্রীয় সত্তার ভ্রান্তি প্রদান করে যে ভোগ করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে নির্বাহী হয়ে। যতই আমি পর্যবেক্ষণ করলাম ততোই আমি বুঝতে পারলাম বুদ্ধ তাঁর অনাত্ম-শিক্ষায় সঠিক ছিলেন। খেয়াল করতে হবে, বুদ্ধ বলেন নি যে আত্ম নেই । তিনি যা বলেছিলেন তা হলো আপনি আপনার কোনো অংশেই আত্ম খুঁজে পাবেন না। যা কিছু আপনি প্রত্যক্ষ করেন তা আত্ম নয়। এখানে আত্ম-এর একটা অনুভূতি আছে, যার বারবার উদয়-বিলয় ঘটে।
কীভাবে চেতনা (consciousness) একটি ভ্রান্ত আত্ম তৈরী করে সে সম্পর্কে স্নায়ুতত্ত্ববিদরা বই প্রকাশ করেছেন। বাস্তবিকই, একটি বই পরামর্শ প্রদান করে মস্তিষ্ক মূলত দুইটি ভ্রান্ত আত্ম-এর জন্ম দেয়, একটা নির্বাহী দায়িত্ব অনুভব করে, আরেকটা অন্যকিছু পর্যবেক্ষণ করে। এটা ব্যাখ্যা করে আমরা যখন বসি এবং ধ্যান করি, তখন কেন অনুভব করি আমি হচ্ছি সে, যে বসে আছি, কিন্তু আমি আবার সে ব্যক্তিটিও যে পর্যবেক্ষণ করছি আমি বসে আছি।
আমি এই জায়গায় বুদ্ধের সাথে সম্পূর্ণ একমত নই যে, আমাদের খণ্ডিত আত্ম-এর উদয়ের কারণটি অবিশুদ্ধ মন থেকে আসে।১ স্নায়ুবিদ্যাবিদদের মতে অধিকাংশ আত্ম-এর উদয় আমাদের বেঁচে থাকার জন্য জরুরী, এবং তা ছাড়া আপনি আপনার খাদ্যগ্রহণ করার জন্য মাথা ঘামাতেন না। অধিকন্তু, আমি ভালো করেই বুঝেছি কীভাবে আমরা আত্ম-এর অনুভূতি তৈরির ক্ষেত্রে মিথ্যা প্রভাব তৈরি করি, কীভাবে তা অধিক আসক্তি সৃষ্টি করে, তারপর দুর্দশা সৃষ্টি করে । আত্ম-এর এই অনুভূতি অহমের অপরিহার্য উপাদান, একটি স্থূল ধারণা তাতে আছে। তাই আমি মনে করি বুদ্ধ প্রাগ্রসর ছিলেন।
কিন্তু সকল পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে যে অনাত্ম-তত্ত্বে বুদ্ধ সঠিক, এটা এও প্রমাণ করে যে মৃত্যুর পর পুণর্জন্ম জন্মান্তর গ্রহণের মতো কোনো জিনিসই এখানে বিদ্যমান নেই, তাই কাউকেই পুণরায় জন্ম নিতে হবে না। চেতনা (consciousness), মস্তিষ্কের একটি কার্যক্রম এবং আত্ম-অনুভূতির উৎপাদক, শরীরের মৃত্যুর সাথেসাথে মারা যায়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোনো কেন্দ্রীয় চালক নেই, বহমান হওয়ার মতো কোনো আত্ম নেই, কারণ এর কোনো অস্তিত্বই ছিলো না।
‘...যদি আপনি অনাত্ম নির্ভুল ও যথাযথভাবে বুঝতে পারেন, তাহলে আপনি আবিষ্কার করবেন যে আপনার জন্য কোনো পুনর্জন্ম ও দেহান্তর নেই। ’_ বুদ্ধদাস ভিক্ষু
সুত্তসমূহে, বুদ্ধ মৃত্যুর পর পুনর্জন্মের কথা বলেন, স্বর্গ-নরক ইত্যাদির কথা বলেন। এই সমস্ত শিক্ষা আমি আমার মধ্যে পর্যবেক্ষণ করেছি, আমাকে সেগুলোর আক্ষরিক অর্থ উপেক্ষা করতে হয়েছে। এর পরিবর্তে আমি তা দেখেছি রূপকভাবে, যে পথে আমরা অহমের জন্ম দেই। আমি কোনো কারণ দেখি নি মৃত্যুর পর কোনোকিছু বিবেচনা করার মতো যেহেতু আমি সে অবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি না। আমি যা জানি যা কিছু জন্ম নেয় তা মারা যায়। আমাদের সত্যিই মৃত্যুর ব্যাপারে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। আমাদের দিন আসবে। আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে মৃত্যুর পূর্বে এখানে জীবন আছে।
সেকুলার বুদ্ধমতবাদে, জোর দেওয়া হয় ইহজীবনের প্রতি, বর্তমান মুহূর্তের প্রতি এবং আমরা কীভাবে অন্তর্জগত ও বহির্জগতের উপর ক্রিয়া করি তার প্রতি। এটা দেখতে আকর্ষণীয় কীভাবে মন ভাবনা ও আবেগের মধ্য দিয়ে সাড়া দেয়, এবং গল্প তৈরি করে যা যত সম্ভব সীমা ছাড়িয়ে যায়। ধ্যান ও মনোযোগিতা আমাদের খুব নিজস্ব অন্তর্গত কর্মে যুক্তিবাদী করে গড়ে তোলতে সাহায্য করে, তাই আমরা অন্ধবিশ্বাসের আশ্রয় গ্রহণ করি না, কেউ কোনোকিছুকে সত্য বলেছে বলে বিশ্বাস করে তা আঁকড়ে ধরে থাকি না, এমনকি তা বুদ্ধ সুত্তগুলোতে বললেও।
যখন একটা সময় আমি অনাত্ম-তত্ত্ব পেয়েছিলাম তা ছিল আমার কাছে জঘন্য ও অপমানজনক, এখন আমি তা-দ্বারা মুগ্ধ। এবং স্নায়ুবিদ্যাবিদরা এই আলাপচারিতায় যা যুক্ত করলেন তা সত্যতা প্রমাণ করে যে আমরা আমাদের আত্মপর্যবেক্ষণে মধ্য দিয়ে কী আবিষ্কার করলাম। আমরা জটিল জনসাধারণ, কিন্তু অভ্যন্তরে কেউ নেই, কোনো অপরিবর্তনীয় সত্তা নেই পুণরায় জন্ম নেওয়ার মতো। তা বোঝার ফলে সব মিলিয়ে যে একটিই জীবন তার মর্ম উপলব্ধির, যা দুঃখ তা আমি নির্মূল করতে পারি তার এবং প্রত্যেক মুহূর্তে যেভাবে এর উদয় হয় তাতে থাকার সাহস পেলাম।
পাদটীকা :
১ এখানে লেখকের দ্বিমত পোষণের জায়গাটুকু আমার কাছে অস্পষ্ট। শারীরিকভাবে ক্ষুধার চেতনা যে ‘আমি’-টি জাগায় সে ‘আমি’-টির বিলোপ সাধন করতে হলে খাদ্য গ্রহণ না-করে চলতে হবে, তখন মৃত্যুই হবে একমাত্র মুক্তি। সুজাতার পায়েসান্ন গ্রহণের পূর্বে বুদ্ধ সম্ভবত সেই ধরণের সাধনাই করছিলেন। দেখা যায়, সুজাতার পায়েসান্ন গ্রহণের কারণে তার পঞ্চবর্গীয় শিষ্যগণ তাকে ছেড়ে যান। বুদ্ধ সকল সত্তার বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী বলে স্বীকার করেছেন। না-খেয়ে বাঁচা অসম্ভব। তার শিক্ষায় দেহকে প্রধান করেন নি তিনি, করেছেন মনকে। খাদ্য ও ক্ষুধা দিয়েই উদাহরণ যাক। ক্ষুধা প্রাকৃতিক, ক্ষুধা নিবারণের উপকরণ বা খাদ্য প্রাকৃতিক। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের উপায় মন ও চিন্তাকেন্দ্রিক। এখানেই মানুষের নিজের মতো কোনো কাজ করার সুযোগ আছে। ক্ষুধা-নিবারণের উপায় নিয়ে অবিশুদ্ধ মন ও চিন্তার কারণে যে খণ্ডিত ‘আমি’ জন্ম নেয় সে ‘আমি’-র বিলোপ করার শিক্ষা বুদ্ধ দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন মানুষের কর্মসম্পাদনের চেতনা যেন বিশুদ্ধ হয়। _অনুবাদক।
লেখাটি গৌতমী সাময়িকী 'সপ্তম সংখ্যা' থেকে নেয়া হয়েছে।
©somewhere in net ltd.