নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মোদি ভক্ত ! এটা জেনে আপনি দুঃখ পেলে আমি আনন্দিত হব।

গেছো দাদা

গেছো দাদা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : আমার বন্ধু জয়

১২ ই জুন, ২০২০ রাত ১:৩৬

জয়

লম্বা, রোগা সিড়িঙ্গে মত ছেলেটাকে প্রথম দেখি দেবাশিসদার বাড়িতে। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধেবেলায় দেবাশিসদার বাড়িতে যেতাম, অঙ্ক আর ভৌতবিজ্ঞানের প্রাইভেট টিউশনের জন্য। এক সন্ধ্যায়, সেখানেই জয়ের সঙ্গে আলাপ। বাবা পরিবহণ দপ্তরের নিচুতলার কর্মী; মা নিতান্তই গৃহবধূ। মাধ্যমিকে, অঙ্কে বার দুয়েক ব্যাক পেয়ে, জয় তখন দেবাশিসদার শরণাপন্ন। স্বাভাবিকভাবেই, জয় আমাদের থেকে কিছুটা বড়। তবে দোস্তি হতে এবং বাড়তে, বেশি সময় লাগল না। অদ্ভুত এক মিশুকে স্বভাবের জন্য, খুব অল্পদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব প্রবল হয়ে দাঁড়াল।

তবে পড়াশোনায় জয়ের মতিগতি খুব একটা ছিল না। একে বাড়ির আর্থিক অবস্থা খুব একটা স্বচ্ছল ছিল না তার; তায় মাধ্যমিকে বার দু’য়েক আটকে, তার তখন বদ্ধমূল ধারণা – লেখাপড়াটা তার জন্য নয়! যেহেতু ব্যাক পাওয়া ছেলে, স্কুলে যাওয়ার কোনও দায় ও তার ছিল না। ফলে, দিনের বেশিরভাগ সময়টাতেই সে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াত নানারকম উপার্জনের ফিকিরে। কখনও পোদ্দার কোর্টে ইলেক্ট্রিসিয়ানের হেল্পার হয়ে, কখনও অফিস পাড়ায় বাবুদের টিফিন সাপ্লায়ারের হেল্পার হয়ে, কখনও দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ‘ডালার’ দোকানে জুতোর পাহারাদার হয়ে – তার ঝুলিতে তখনই অজস্র অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার! এমনিতে সে বয়সে আড্ডা দেওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না; তবুও যখনই স্কোপ পেতাম, হাঁ করে শুনতাম, জয়ের অভিজ্ঞতার বিচিত্র বিচিত্র সব কাহিনী।

দিব্যি কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। এমনই ভাবে একদিন মাধ্যমিক পরীক্ষাও এসে গেল। যতদূর মনে পড়ে, পরীক্ষার রুটিনের একদম শেষদিনটায় ছিল অঙ্ক পরীক্ষা। সেদিনটা উতরে, বিকেলবেলায় গেলাম দেবাশিসদার সাথে দেখা করতে। দেবাশিসদার কড়া ইন্সট্রাকশন – মাধ্যমিকের পরে একদিনের জন্যও সময় নষ্ট করা যাবেনা, উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি শুরু করা চাইই চাই। যথা নিয়মে, জয়ও হাজির। দেবাশিসদা পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানতে চাওয়ায়, বিনম্র চিত্তে সে ঘোষণা করল, এবারেও তার অঙ্কে পাস করা হচ্ছে না। তবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে, মাধ্যমিক অভিযান, সে সেবারেই ইতি টানছে, বোর্ডকে আর সে বিব্রত করতে চায় না।

কদিন বাদে খবর পেলাম, চাঁদনী মার্কেটে, এক বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের দোকানে সে মোটামুটি ভালই একটা চাকরী জুটিয়ে নিয়েছে।

গড্ডালিকা প্রবাহে, আমাদের দিনও কাটতে শুরু করল। অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের কাছে শুনতে পেতাম, মাধ্যমিকের পরের তিনমাস নেহাতই স্বর্গীয় সময় বিশেষ। অথচ দেবাশিসদার খপ্পরে পড়ে আমাদের সেই একই থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়! ইতিমধ্যে, গ্রীষ্ম কেটে গিয়ে বর্ষাকাল এসেছে। আর বর্ষাকালের সাথে এসেছে রথের উৎসব। আমাদের পারিবারিক প্রথা ছিল, রথের উৎসব পুরীতে কাটানো। পুরো পরিবার, মায় পোষ্য কুকুরটিকে পর্যন্ত লটবহর সমেত ট্রেনে চাপিয়ে সোজা রথের দিন দুয়েক আগে পুরীতে পৌঁছনো হত এবং উল্টোরথের পরে আরও দিন তিনেক কাটিয়ে বাড়ি ফেরা হত। বড়রা যেমন সংসার গুছিয়ে নিয়ে যেতেন, ছোটরাও তেমন তাদের পড়াশোনার বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে যেত –সপরিবারে সে এক হৈ হৈ কাণ্ড! সে বছরও নিয়মের ব্যত্যয় হল না।

রথের দিন তিনেক আগে পৌঁছে গেলাম পুরীতে। আত্মীয়-পরিজন মিলিয়ে, প্রায় জনা বিশেকের গ্যাং! সমুদ্র সৈকতের ধারে অবিনাশ ধাম বাড়িটা যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রত্যেক বছর, একই বাড়িতে সপরিবারে ওঠা হত – খুব স্বাভাবিকভাবেই, আশেপাশের অধিকাংশ স্থায়ী বাসিন্দারাই অতি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।“ কেমন আছেন?” বা “এবারে আসতে দেরী হল কেন?” – এসব উত্তর দিতে দিতেই বেশ জেরবার হয়ে উঠতে হত প্রথম কটা দিন। এর সাথে পুরীর চিরন্তন আকর্ষণ – সামুদ্রিক মাছ, দ্বিধাহীন সমুদ্র এবং আদি অকৃত্রিম শ্রী মন্দির, এসব তো রইলই। ফলে কোথা দিয়ে যে দিনগুলি কেটে যেতে শুরু করল, তার ইয়ত্তা রইল না।

ইতিমধ্যে, এক সন্ধ্যার আনন্দবাজারে জানা গেল, ফল প্রকাশের দিন সমাসন্ন। যেদিন পুরী থেকে কলকাতায় ফেরা হবে, সেদিনই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ফল প্রকাশ করবেন বলে স্থির করেছেন। পাশ-ফেল নিয়ে চিন্তা ছিল না; কিন্তু তবুও ফল কেমন হবে, তা নিয়ে মনের মধ্যে এক চাপা উদ্বেগও শুরু হল। যাঁরা এই কাহিনী পড়ছেন, নির্ঘাৎ স্মরণ করতে পারছেন এই উদ্বেগের স্বাদ!

এরই মধ্যে, একদিন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। অবিনাশ ধাম বলে যে বাড়ীটায় থাকতাম, তার রাস্তার ধারের খোলা বারান্দাটা ছিল আমার খুব প্রিয়। খোলা বারান্দাটার ঠিক লাগোয়া চওড়া রাস্তা, আর তারপরেই পুরীর বিখ্যাত সোনালী তটভূমি। দুপুরবেলা, ভাত-টাত খেয়ে, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতাম সেই বারান্দায়। রাস্তা দিয়ে চলাচল করা অজস্র মানুষ, সামনে উদাত্ত সমুদ্র – দিব্যি একটা নেশা ধরিয়ে দিত। যেদিন আমাদের কলকাতায় ফেরার ট্রেন, ঠিক তার আগেরদিন দুপুরবেলায়, খাওয়াদাওয়া শেষে, অমন করেই সময় কাটাচ্ছিলাম, বারান্দাটায় বসে। হঠাৎ দেখি, রাস্তা দিয়ে জয় চলেছে, আমার দিকেই তাকাতে তাকাতে। দিব্যি অবাক হলাম। আনন্দও হল খুব। হাত নেড়ে, চেঁচিয়ে, ব্যাটাকে ডাকতে শুরু করলাম। সেও কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাসিমুখে হাত নাড়ল। তবে ইঙ্গিতে জানালো - পরে আসবে, এখন সে অন্য কোথাও যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে, আমার হাঁকাহাঁকি, মায়ের ভাতঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। মা বারান্দায় এসে দাঁড়াতে, মাকেও বললাম জয়ের কথা। মাও চিনত তাকে। তার মতো মিশুকে ছেলে, ডাকা সত্বেও বাড়ি এলো না – মাও কিছুটা অবাক হলোই বটে! তবে খুব বেশিক্ষণ জয়ের কথা মাথায় রইল না কারোরই। পরেরদিনই বাড়ি ফেরা, তার পরের দিন আবার রেজাল্ট – সবটা মিলিয়ে দুপুরের ঘটনাটা যেন কোথায় মিলিয়েই গেলো।

বাড়ি ফিরেই স্নানটান সেরে, স্কুলে দৌড়ালাম। স্কুলের সামনের প্রবল ভীড়ই বলে দিচ্ছিল, ফল প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। যাই হক – ফল কিন্তু আশানুরূপই হয়েছিল। অঙ্ক আর ভৌতবিজ্ঞানে তো আশাতিরিক্ত ফল! মনটা আনন্দ আর খুশিতে একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেলো। মার্কশীট সংগ্রহ করে, বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিদায় নিয়ে, সরাসরি হাজির হলাম দেবাশিসদার আস্তানায়। সেবারের মাধ্যমিকের ব্যাচের প্রায় সবাইই তখন সেখানে হাজির। ভালো ফল হওয়ার পরে দেবাশিসদার রিঅ্যাকশন কিরকম হবে, ব্যাচের বাকিরা কিরকম ফল করবে, নিজেদের মধ্যে সেলিব্রেশনই বা কিরকম হবে – মনে মনে এসব নিয়ে নানারকম চিন্তাভাবনা ছিলই। কিন্তু মার্কশীটটা স্যারের হাতে দিয়ে, ঢিপ করে একটা প্রণাম করে, মুখ তুলে চাইতেই অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য মাখা মুখটা দেখে, যাবতীয় উচ্ছ্বাস এক লহমায় যেন কোথায় হারিয়ে গেল। ব্যাচের আর সকলেও একইসাথে উপস্থিত – তাদের মধ্যেও যেন কেমন এক অত্যাশ্চর্য নীরবতা!

দেবাশিসদা ধীরে ধীরে মুখ খুললেন – “ জয় গতপরশু সকালবেলা গঙ্গার ঘাটে ডুবে মারা গিয়েছে!”

মাধ্যমিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে। সেদিনের পনেরো বছরের কিশোর ছেলেটার চুলে, আজ অজস্র রূপোলী আঁকিবুকি। তবু সমস্ত ঘটনা পরম্পরা যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। শুনতে পাই দেবাশিসদার গলাও। রেজাল্টের দু’দিন আগে, সকালবেলায় গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে, জয় যদি সত্যিই মারা গিয়েই থাকে; সেদিনই দুপুরে পুরীতে আমি কাকে দেখলাম? কেই বা আমাকে দেখে একগাল হেসে, হাত নাড়ল সেদিন?

আজও মেলাতে পারিনি সে হিসাব।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০২০ রাত ১:৪৮

মা.হাসান বলেছেন: মনটা একটু খারাপ করে দিলেন। জয়ের হয়তো আপনার (?) উপর বিশেষ টান ছিলো, এজন্য আপনাকে একটা দেখা দিয়ে গিয়েছিলো। যে জগতেই যাক , ঐ জগৎ তার জন্য জয়ফুল হয়ে উঠুক এটারই আশা থাকলো।

২| ১২ ই জুন, ২০২০ রাত ২:৫০

রাজীব নুর বলেছেন: জগত অনেক রহস্যময়।
আপনার বন্ধু আপনাকে দেখা দিয়ে গিয়েছে।

৩| ১২ ই জুন, ২০২০ রাত ৩:৩১

নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: ফল নিয়ে উদ্বেগ ছিল না।উদ্বেগ হলো ফল প্রকাশের পর।দেখি সেকেন্ড ডিভিশন ১৯৬৪সাল।গল্প আবার সত্যঘটনা।তাহলে হেলুসিনেশন

৪| ১২ ই জুন, ২০২০ ভোর ৫:১১

নেওয়াজ আলি বলেছেন: ভাইরে এই মরার দিনে কেন মারা যাওয়ার গল্প লেখেন

৫| ১২ ই জুন, ২০২০ সকাল ৯:৪৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


আপনি প্লট খুঁজে পচ্ছেন না?

৬| ১২ ই জুন, ২০২০ সকাল ১১:৩৩

মনিরা সুলতানা বলেছেন: কয়েকজনের গল্পে পড়েছি এমন শেষ দেখার কথা ;
যয় এর গল্প মন খারাপ করে দিলো।

৭| ১৩ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:৪৬

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: মন খারাপ করা গল্প।

৮| ১৩ ই জুন, ২০২০ রাত ৯:৫১

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
যগতে অনেক কিছুই ঘটে যায় যার কোন
কূল কিনারা করা যায়না। জয়ের ব্যাপারটা
মন খারাপ করে দিলো। যে হেতু সত্য ঘটনা
তাই জয়ের জন্য রইলো শুভকামনা যেখানেই
সে থাকুকনা কেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.