নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
:কলকাতা মেট্রোতে উঠেছি। রবীন্দ্র সরোবর থেকে শোভাবাজার সুতোনটি যাবো। ট্রেনে খুব ভীড়। একই হ্যান্ডেলে দুজনের হাত। আমার আর সত্যনারায়ণ সাহার। আমার একটি মাত্র কথা শুনে সত্যনারায়ণ কিভাবে যেন ধরে ফেলেছে আমি বাংলাদেশি। তাই মুখের কাছ মুখ এনে বললেন
- দাদা কি বাংলাদেশি?
- হ্যাঁ দাদা, আপনি?
- আমার পূর্বপুরুষরা বাংলাদেশে ছিলেন। কিন্তু আমার জন্ম এখানে!
- তা একবার আসুন বাংলাদেশে। আমি ঢাকাতে থাকি। গভ জব করি ওখানে!
- ঢাকার প্রতি তত মোহ নেই। তবে মা বার বার বলেন, বরিশাল পৈত্রিক ভিটে ছিল আমাদের।
- আরে বলেন কি দাদা! আমার বাড়ি বরিশাল, যদিও ঢাকা থাকি আমি!
- বাহ। তাই নাকি? মাধবপাশা গ্রামে বাড়ি ছিল আমাদের। ওখানে একটা বড় দিঘী ছিল। কি যেন নাম মা বলতেন!
- দুর্গা সাগর?
- হ্যাঁ হ্যাঁ! দেখেছেন ওটা কখনো? আমার বাবা কাকারা নাকি ঐ দিঘীতে স্নান করতেন!
- বরিশালের খুব কাছে ওটা। ৩০-মিনিট লাগে। শীতে খুব পাখি বসে ওখানে এখনো! সাইবেরিয়া থেকে নাকি আসে ওরা!
- দাদা, আমার মায়ের সাথে একটু ফোনে কথা বলবেন কি?
:
অচেনা সত্যনারায়ণ সাহার মায়ের সাথে কথা বলি আকস্মিক। সেই বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা। তিনি তার বাড়িতে যেতে বলেন আমাকে খুব করে। তার গাঁয়ের মানুষ! দেখতে চান তিনি খুব। শোভাবাজার নয়। সত্যনারায়ণের বিশেষ অনুরোধে বেলগাছিয়া নামতে হলো আমাকে। তাই টিকেটে জরিমানা দিতে হলো মেট্রোকে। তারপরো মাঝবয়সি এক লোকের বৃদ্ধা পঙ্গু মায়ের সাধ বলে কথা! ট্রেন থেকে নেমে অটো ধরতে হলো সত্যদার বাড়ি যেতে। তার ছিমছাম দোতলা বাড়ি। বার বার নিষেধের পরও মিষ্টির দোকান থেকে ছানার সন্দেশ আর রসগোল্লা কিনলাম ২-প্যাকেট। সত্যনারায়ণ বললো
- হ্যাঁ, মা বলেছে আপনারা নাকি দুচারকে মিষ্টি নেননা কোথাও, ন্যুনতম দুচার কেজি করে নেন!
- হ্যা! পূর্ব বঙ্গীয় লোকদের আচারটা এমনই দাদা! জানিনা এটা ভাল কি মন্দ!
বাড়িতে ঢুকে বসার আগেই ভেতর থেকে ডাক এলো সত্যনারায়ণের মার। অতিথিকে ভেতরে ডাকছেন তিনি! ভেতরের ঘরে ঢুকলাম গৃহকর্তার সাথে। হুইল চেয়ারে বসা সত্যনারায়ণের মা। বয়স অন্তত ৮০-৮৫ হবে। যেন দেবী! আর্য গড়ন! ফর্সা চকচকে মুখখানিতে এখনো আভিজাত্যের পূর্ণ ছাপ জ্বলজ্বল করছে!
:
দুহাত সালামের মত ওপরে তুলে বললাম
- কেমন আছেন মাসিমা! আপনি নাকি বরিশালের একজন মানুষ দেখতে চেয়েছেন?
- বাবা! তোমার বাড়ি কি মাধবপাশা! গুঠিয়া?
- না মাসিমা! বরিশাল শহরে বাড়ি আমাদের। তবে মাধবপাশা স্কুলে অনেকবার গিয়েছি আমি। গুঠিয়ার সন্দেশ খুব নামকরা! তাই তা কিনতে প্রায়ই গুঠিয়া যাই।
- আমার কি যে ভালা লাগতাছে। বাবা তুমি এই দ্যাশের ভাষাতে কথা কইওনা, আমার দ্যাশের ভাষাতে ইটটু কথা কও বাবা!
- হ মাসিমা, সরকারি চাকরির সূত্রে অনেকবার মাধবপাশা স্কুলে গেছি আমি!
- দুর্গাসাগরটা কি এহনো আছে ওমনই?
- আছে মাসিমা, হেইডা অহন পর্যটন কেন্দ্র করছে আমাগো সরকার!
- বাবা তুমি আরেটটু আমার কাছে আইয়া বও, আমার গ্রামের ঘ্রাণ লই এটটু তোমার থাইকা।
আমি আরো কাছে গিয়ে দাঁড়াই মাসিমার। একটা মানুষ তার মাতৃভূমি ছেড়ে গেলে তার যে কি আকুতি, কি কষ্ট তা অনুভব করতে পারি মাসিমার চোখে মুখে। সে আবার বলে চলে
- বাবা সন্ধ্যা নদীডা কি এহনো আছে!
- হ মাসিমা থাকপে না ক্যান? কি লাইগা!
- আমার বাবার বাড়ি আছিল বানারী পাড়া, সন্ধ্যা নদী দিয়া কোষা নৌকায় কইরা বউ আনছিল আমারে এই মাধবপাশায়!
- তা চইলা আইলেন ক্যা আপনেরা এহানে?
- একাত্তর সনের যুদ্ধের কালে জীবন বাঁচাইতে পলাইয়া আইছি ভারতে। কতবার কইলাম চল ফিরা যাই। কিন্তু তোমার মেসো মইরা গেল হঠাৎ। ছেলে মেয়েরা কেউ আর গেলনা! আমার কথা হুনলো না!
- আপনি তো বেড়াইতে যাইতে পারতেন?
- যামু যামু কইরা আর যাওয়া হইলনা রে বাবা! কে শোনে বিধবার কথা! তা ছাড়া এখন হাঁটতে পারিনা, পঙ্গু আমি!
:
কথা বলতে বলতে অনেক রাত হলো। রাতে মাসিমা ও তার পরিবারের সাথে খেতে হলো আমাকে। খেতে বসে বললেন
- তোমারে দেইখা অনেক দিনের আমার মনের সাধ পুরা অইল বাবা!
দেখলাম সেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা শুনে আনন্দে চিকচিক করছে তার মুখখানি। যেন একটা জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে। খাওয়া-দাওয়া গল্প করতে করতে কখন যে রাত এগারোটা হলো বুঝতেই পারিনি। বললাম
- মাসিমা একবার আসেন বাংলাদেশে। আপনারে সব ঘুরাইয়া দেহামু আমি।
তিনি যেন সত্যি বাংলাদেশে এখন! এক আনন্দময়তার আকুতি তার চোখে মুখে ভাসছে যেন! দেশভাগে, মানুষের দেশান্তরিতে কত পরিবার যে বিচ্ছেদের অনলে জ্বলেপুড়ে মরছে অদ্যাবধি, তা পদে পদে অনুভব করতে পারি আমি হৃদয় নিংড়ে আজ!
:
বিদায়ের প্রাক্কালে মাসিমা একটু ছুঁয়ে দেখতে চায় আমাকে। বলে
- তুমি মাধবপাশা, গুঠিয়া, দুর্গাসাগর এলাকা থাইকা আইছো। আমি যেন আমার হেই গাঁয়ের ঘ্রাণ পাইতাছি তোমার শরীর থাইকা বাবা!
মাসিমাকে সান্ত্বনা দিতে নানাবিধ সত্যমিথ্যে কথা বলি!
- তুমি শুদ্ধ কথা কইও না বাবা! তুমি আমার গাঁয়ের ভাষায় একটা কথা কও। ঐ গাঁয়ের ঘ্রাণ নেই আমি এটটু!
- বাংলাদেশের চেয়ে এখানেই তো ভাল আছেন মাসিমা। মুসলিম দেশে কি হিন্দুরা ভাল থাকতে পারে?
চোখে অনেক পাওয়ারের চশমা লাগিয়ে একটা বই হাতে নেয় মাসিমা। বলে তুমি কি "এক গাঁয়ে" কবিতাটা পড়ছো কুনোদিন?
- কোনটা মাসিমা, মনে নাই আমার!
চশমার ফাঁক দিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টায় ৮০-বছরের মাসিমা আর পড়ে যায়-
:
"আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
কোলের 'পরে নিই তাহারে তুলে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।
দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি,
মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক--
তাদের বনের অনেক মধুমাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে,
তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।
আমাদের এই গ্রামের গলি-'পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে
মোদের খেতে তখন ফোটে শণ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে--
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।
:
"বুঝতে পারতাছো বাবা মোগো ঐ গ্রামের নামডা কিন্তু খঞ্জনা"! কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে যায়, আর জল গড়ায় মাসিমার শুকনো ধূসর চোখে। সত্যনারায়ণ ওর বৌ সন্তানদেরও চোখ ভিজে ওঠে কি এক অমোঘ বেদনায় এ কবিতা শুনে। এ কবিতার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আমি চেয়ে থাকি নীলাভ আাকাশের দিকে! যেন এখানে এক নিদাঘ কষ্টে রাতের নক্ষত্ররা মিশে যায় কোন দূর কুয়াশার বনে। ভালবাসার এসব মায়ামৃগ কিংবা নিত্য ফসিল তোলা দিকদর্শন ত্যাগ করে বিদায় নেই আমি! বেলগাছিয়ায় ট্রেন ধরতে হবে আমাকে যত রাতই হোক। স্মৃতিদগ্ধ অতীত পুঁথির বিবর্ণ ইঞ্জিনের মত ছেঁড়াফাঁড়া স্মৃতির মাঝেই বাইরে নামি আমি! বাংলাদেশে মাসিমার পঞ্চাশ বছর আগের ফেলে আসা জীবনে উৎসানলের কষ্টব্যথা অনুভব করি আমি রক্তাভ হৃদয়ে! তারপরো কষ্টের এক বহতা বাতাসের নিঃস্বত্ব নক্ষত্রকে সারথী করে সামনে এগুতে হয় আমাকে! সত্যনারায়ণ সাহা, তার মা আর আমরা এসব নাক্ষত্রিক নীলাভ চৌম্বক পাহাড়ের নিস্তব্ধ স্মৃতিকেই আঁকড়ে থাকি এদেশে আর ওদেশে! এবং নিয়ন নক্ষত্রমালার অনন্ত রাত্রির মতো! যেন আমরা সার্কাসের ব্যথিত অসহায় সিংহ একেকজন! জানিনা জীবনের স্বচ্ছল শাণিত নদীতে কবে আবার স্নান করবো গা ভিজিয়ে আমরা সবাই একসাথে, এক নদীতে!
(সৌজন্য: জাহাঙ্গীর হোসেন)
২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:৪৪
গেছো দাদা বলেছেন: দেখলাম। নষ্টালজিক লাগলো। ধন্যবাদ।
২| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৩
সোনাগাজী বলেছেন:
২ বাংলার মানুষের মাঝে গড়ে উঠেছে কাঁতাতারের বেড়া
২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৩৫
গেছো দাদা বলেছেন: এর জন্য দায়ী কে ?
৩| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২১
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: দেখলাম। নষ্টালজিক লাগলো। ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন।
২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৩৬
গেছো দাদা বলেছেন: আপনিও ভালো থাকবেন।
৪| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৭
কামাল১৮ বলেছেন: মন ছুয়ে গেলো।ধর্ম আমাদের পৃথক করেছে।মন একসাথে রাখতে পারে নাই।
২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৩৬
গেছো দাদা বলেছেন: একদম।
৫| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫০
বাকপ্রবাস বলেছেন: হুম, কলকাতার অনেকে পরিবার আছে, পূর্বপুরুষ বাংলাদেশে, তারা খুব ফিল করে বাংলাদেশকে, ওরা এখনা বৃদ্ধ, তাদের সন্তান নাতিদের কাছে বাংলাদেশের গল্প করে থাকে।
২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৩৮
গেছো দাদা বলেছেন: ঠিক। ওনারা বাংলাদেশ কে নিয়ে নষ্টালজিক থাকেন।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:২৮
রাজীব নুর বলেছেন: নিন এই গানটা শুনুন।