নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার অথবা অন্যদের লেখা

নর্দমার রাত, হিরন্ময় তাঁত

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-২

i am looking for the face i had before the world was made. -yeats. © নির্ঝর নৈঃশব্দ্য [email protected] ছবি আঁকি আর কবিতা লিখি

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-২ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবি মিঠুন রাকসাম এর দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম

৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১২:০৬



প্রথমদশকের উজ্জ্বলতম কবি মিঠুন রাকসাম এর কাব্যগ্রন্থ: দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম। তিনফর্মায় রচিত এটি একটি দীর্ঘ কবিতা।এটা আমার কাছে একটি কাব্যোপন্যাস মনে হয়েছে। মান্দিজাতিগোষ্ঠীর বাস্তু হারানো এবং শোষিত হওয়ার এ এক নগ্নসত্য ইতিকথা। জালদলিল করে কেড়ে নেয়া ভূমির এ যেনো হিরন্ময় দলিল।

গ্রন্থটির প্রকাশক থকবিরিম। প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা ২০১০। স্বত্ব: লেখক। প্রচ্ছদ করেছেন এম.আসলাম লিটন। দাম রাখা হয়েছে ৬০ টাকা।

কবি তার কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তার বাবাকে। তিনি উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, বুকে যক্ষ্মাকে ধারণ করে বিড়ি টানে, মদের আসরে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে আর রাকসাম গোষ্ঠীর ভিটা আঁকড়ে আছে নিজের ভেবে সেই প্রিয় মুখ যুবরাজ হাদিমা’কে।

মিঠুন রাকসামের প্রকাশিত আরো ৩টি কাব্যগ্রন্থ যথাক্রমে-- মন্ত্রধ্বনি, শিঙ্গালাগানী মেয়ে এবং যমজ স্তনের ঘ্রাণে বালকের জীবন।



এইবার আমরা পড়বো দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম:



ঘুমাতে পারি না

বালিশে হেলান দিলে ভেসে ওঠে

মান্দি গ্রাম সবুজ বালিজুড়ি

ছোট ছোট চোখ তামাতে হাত

খোঁজে তামাটে আলু পাহাড়ের ঢালে

ওরা কি তিব্বতীয়? মা’র মুখে শোনা সে কাহিনি কি তবে সত্যি?

যারা বর্ণমালা খেয়ে ফেলেছিল

ভীষণ ুধায় কাতরাতে কাতরাতে বেঁচে গিয়েছিল

সেই ভয়াল দিন কি আমার চোখে ভিড় করছে?

কেন ঘুমাতে পারি না?

যেবার মান্দি নারী কাঠগড়ায় বলেছিল ‘ও দলিল জাল, এ জমি আমার!’

হেসেছিল ভদ্রমহাজন যারা সুদের কারবার করে।

মান্দিকে বলে গারো- তবে কি উপজাতি তকমা পরে

হেঁটে এসেছিল সেদিন? নাকি নোটিশ পেয়েছিল জমি দখলদার ‘মহরালী?’

ক’ফোটা জল পড়েছিল সেদিন?

ফেরত এলে দশটা ছাগল আর পাঁচটা গরুর মাংসে

ভরে গিয়েছিল ভাটপাড়া গ্রামের থালা

তুমি কেঁদেছিলে চৌকির খুঁটি ধরে।

কে ডেকেছিল ডাকনাম ধরে, আয়াক? আয়াক?

আমি তখন ভাব স¤প্রসারণ মুখস্থ করছি

‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না’

ঢোল আর বোল ভারী করেছিল কান

চেয়ারম্যান বলেছিল ‘ঐ জমি নিয়া কাইন্দ না- আরো তো জমি আছে!’

আমাদের পোষা কুকুর যার নাম লালু

আচ্ছা করে কামড়ে দিয়েছিল শহর বানুর পাছা।

মাগির কি তেজ! পাছায় হাত দিয়ে বলেছিল

‘গারো চুদানীর কুত্তা গুয়াত কামড় দিলো গো...!’



আমাদের লালুটা সেদিন থেকে নিখোঁজ!





কবে কি শুনেছি বারবার মনে পড়ে

একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই শুনি সঙ্গমালাপ ‘কেমুন লাগে...!’

সকালে বগলে বই চেপে খ্রিস্টান স্কুলে যাচ্ছি...

লিপন, মায়া, আল্পনার সাথে চিতসাঁতার কাটছি প্যান্ট খুলে!

ভাসছি একে অপরের পিঠে চড়ে

আবার দৌড়ে যাচ্ছি মিশন স্কুলে

কোন সিস্টার কোন ফাদারের সাথে ইটিশ-পিটিশ করে

কোন ফাদার কোন মেয়ের গোপন স্বামী

কে দেখেছে কোন বাগানে চুমু খেতে

তুমুল আড্ডা হচ্ছে বার্ণাডের চায়ের দোকানে

হাইস্কুলের ম্যাডাম মায়াবড়ি রাখে ভ্যানিটি ব্যাগে

তাও হয়ে যায় জানাজানি।

মদারু রুহুল পড়ে থাকে রাস্তার একপাশে

অন্যপাশে লুঙ্গি

কলসিবাহিনী রাবেয়া খাসার ভিতর দেখে রুহুলের বিচি,

হাসতে হাসতে রাহেলা মজাক করে

‘সব বেদাংয়ের হুলই রুহুলের মত নারে রাবেয়া!’



আমার ঘুম আসে না

হালিমার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখে ছানিপড়ে

সাইকেলের বেল খুলে নিয়ে যায়, তবু হুশ থাকে না

কবে শুয়েছিলাম বড়ই গাছের তলে সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়।



আমার মিতা ছিল আরেক নিতুন।

তার সাথে রাত কাটাতাম তলপেটে হাত রেখে

সেই মিতা আজ সিঙ্গাপুরের ড্রাইভার।

আমাকে বলেছে এবার বাড়ি এলে বউ করবে এস-বদল।

সই পাতালে যেমন বদল হয় চুড়ি কিংবা নথ

কিংবা গলার হার, এ-ওকে জেফত দিয়ে খাতির করে

আমাদের খাতির হবে বউ বদলে।



অবশ্য মিতা আমায় প্রথম দেখিয়েছে নটী মাগিদের ডেরা।

কলার সরি বিক্রি করেই দৌড়...

রাত আটটা, মিতা বলেছিল

‘সাহস রাখবি, ভয় পেলে খসে যাবে’

সেই ডেরাতে কত চাচা কাকাদের দেখেছি

যারা গভীর রাতে বউকে বলতো ‘খানকি মাগি’



বালিশে হেলান দিলে মনে পড়ে

মান্দি গ্রাম চু খেয়ে বেশামাল নর-নারী

কেউ কেউ বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছে বারান্দা কিংবা বিছানা

সহসা কুকুরের ডাকে জবাব দিচ্ছে ‘কোন বানচুৎরে!’

সাথে ছিটকে যাচ্ছে ফেনা। সকালে ফের ফেনা ওঠা চু খেয়ে

যে যার কাজে যাচ্ছে। মেয়েরা আসছে দল বেঁধে ঢাকা শহরে।

যাদের স্তন কেউ ছুঁয়ে দেখেনি কিংবা যাদের ঝুলে পড়েছে

হাতে নকশা আঁকতে আঁকতে বেড়ে উঠেছে স্তন

ফুলে উঠেছে প্রসারিত যোনি।

সত্যি কি ওরা বেড়ে ওঠে?



মনে পড়ে নিকানো পাররার বাণী-‘এখানে চুদা বারণ’

অথচ অলিতে গলিতে চুদেই যাচ্ছে...

সেরিরা বলে ‘আমরা সেবা করি পুরুষের ধন, ঘ্রাণ নেই বীর্যের।’



পাঁচতলার ছাদে একা একা ভাবি

কিভাবে নগ্ন হবো অচেনা নারীর সামনে?

কিংবা মৃত্যু হলে শিশ্ন ধোবে কোনজনা? সে কি শিহরিত হবে?

যেভাবে হয়েছিল মিতা?

গভীর রাতে পর্ণো ছবি দেখে যেভাবে গ্রাম্যযুবক

শিহরিত হয়, বেড়ালের মত্ততায় হেসে ওঠে

তখন কি কুপি নিভিয়ে চলে যায় রুপালির

কাছে, যাকে সে দেখেছে সন্ধ্যায় ছাগল তাড়াতে

যে সায়া পরে এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে

রাত-বেরাতে গেয়ে ওঠে গান।

ঘুমাতে গেলে মনে পড়ে

কাউকে চিঠি লিখতে হবে

মিতা? নাকি পুতুলকে?

সে কথা ভাবতে ভাবতে মহারশির কথা চলে আসে

সারবেঁধে কাঁকড়া ধরছে মান্দি নারী

লাফিয়ে যাচ্ছে ব্যাঙ, ধরা পড়া খলসেকে মেয়ে ভেবে ছেড়ে দিচ্ছে

ওপাড়ে ধোঁয়া... হাড় ফাটার শব্দ হচ্ছে ফটাফট

কে জানে কোন চামার পুড়ছে

মান্দি নারীরা উঠে আসছে কোমরে খলই বেঁধে

পেট ফুলিয়ে দিয়েছে ধোঁয়া।



শিকারি উঠে এলে মাছেরা ভাবে আজ তাদের জন্মদিন

তাই মুখ তুলে চায়, যে গেছে তার পায়ের তলায় আরামে ঘুমায়।

পত্রমিতা রবিউল কক্সবাজার থেকে লিখেছে

‘ফেনায় ভাসে রঙিন কাঁচুলি

বালুতে ঘাম দেখবে এসো। তোকে ঘোড়ায় চড়াবো

ঢেউয়ের নীচে দেখবি বালুর স্তন

মেয়েরা ডুবে ডুবে লবণ খায়, বোঁটাসহ ডাবও পাবি।

রাতে দেখবি তারাবাতি মিটিমিটি জ্বলছে তো জ্বলছে

যেন গ্রাম্যপেত্নী রান্না করছে জলের উপর।’



চিঠি পাবার আগের দিন গোলাপি মেয়েটা

ডুবে যাচ্ছিল পুকুরে

একপাল রাজহাঁসের ভিড়ে ভাসে

ডুবে

ডুবে

ভাসে

জঙ্গু জঙ্গু বলে ডাকছিল হাত নেড়ে

জঙ্গু চুলের মুঠি ধরে নিয়ে এসেছিলো, যেন চিল

উড়ে যাচ্ছে আর নখের আঁচড়ে ছটফট করছে গোলাপি

সে কী ছটফটানি! গোলাপি নেশায় পাওয়া নবদম্পতির মতো

ছিঁড়ে ফেলছে হাত-বুক

জলের ভিতর ঘাম ঝরছে

তরতর



হাঁসেরা পালক খসিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে

সে কী জল তরঙ্গ!



গোলাপি চলে গেছে...



আমরা ডাকপিয়নকে ঘিরে ধরেছি

লাল-নীল খামের ভিতর

কালো কালো অর দেখে জানতে চেয়েছি এমন ছিলো কি

মান্দিদের বর্ণমালা? অর? নাকি আদৌ রূপকথা?

আনাল-গুনাল, তুলজাং-তুলজাং?



ঘুমাতে পারি না

লাগে বই হারানোর খোঁচা

কালের পুতুল হারিয়ে গেলে পুরো সেলফ খুঁজি

সেখানেও কাঁদিদ না পেলে মা’র কথা মনে পড়ে

কতবার সুঁই হারিয়ে ফেলেছে বাক্স থেকে কিংবা বালিশের তল থেকে

হারিয়ে গেলে টাকা মা বিড়বিড় করে চলে যায় শিম ক্ষেতে

তুলে আনে বিচিওয়ালা শিম, যেভাবে আনতো

১৯৭১ সালে বুনোসবজি সারেত

মেঘালয়ের জঙ্গল থেকে। মা তখন মেঘালয়ের অতিথি।

বাবাও করতো তাই ছাতা হারিয়ে গেলে

কচুপাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরতো

সব রাগ ঝেড়ে দিতো বৃষ্টির উপর।

আমি কি পারি ?



বইয়ের আড়তে চাপা পড়েছিল মশলার বন

তামাম দুনিয়া খুঁজে পেয়ে যাই আলির খবর

কে আলোকে ভয় পায়?

মিথ্যাকে সত্য করতে গিয়ে বিয়া ভেঙে যায় রুকিয়ার

তখন কে ডাকে ডাকনাম ধরে-- রক্কিয়া রক্কিয়া?

কেন দলিল হয়ে যায় জাল?

মান্দি নারীর বৃদ্ধাঙ্গুলি তবে কি শেখের হাতে পুনঃস্থাপিত!



দ্রিম দ্রিম বেজে চলেছে দামা

শহীদ মিনারে আদিবাসী উৎসব

পীরেনের বুকে এক পা দু পা হাজার পা

এগিয়ে চলেছে শাসনতন্ত্রের দিকে

সীমার হেমব্রম এসিড পাতায় লিখেছে ‘পীরেন! পীরেন!’

তখনও কি মান্দি নারী কাঠগড়ায়

চেঁচিয়ে বলছে

‘বাবু... ও দলিল জাল...’

শুনতে পাই ট্রাকটরের শব্দ

মুখে পান গুঁজে শেখ ব্যাটা গান গাইছে।



তবে কি সবই অসার? মুছে যাবে এসিড পাতার নাম?

কিংবা ‘পীরেন পীরেন?’

পাহাড়ি মাটির মতো য়ে যাবে দলিল?



ঘুমাতে পারি না

ঢেউয়ের শব্দ কানে লাগে

পুঁটি মাছের মতো লাফিয়ে উঠে নারী।

শব্দ শুনি দ্রিম দ্রিম, বাজে নাকারা

বাজে মাদল, শিঙ্গা ফুঁকতে ফুঁকতে হাঁটে নারী

তখন কি ইসরাফিল শিঙ্গা ফেলে ঈশ্বরের কাছে মিনতি জানায়

‘হে ঈশ্বর ওদের সংবিধান দিয়ে দাও’

নাকি গামবুট পরে পিছে পিছে দৌড়ে আসে?



ঘুমাতে গেলে বিষিয়ে ওঠে

পিঠের নীচে কার যেন হাত

দ্রুত উঠে গেলে দেখি ফুল হাতে ফিরিঙ্গি নারী।

যেন মিতা ডাকছে হাত দেখবে

ক’টা বউ, ক’টা বাচ্চা আর ক’ টাকার মালিক হবো, সব বলে দেবে



ভয়ে ভয়ে থাকি

যারা হাত দেখে তারা তো সব জানে, জানে কি?

নইলে কীভাবে বললো ‘তোমার হাতে কিছুই দেখি না,

শুকিয়ে যাওয়া বীর্যের খোলস ছাড়া’ তবে কি বলে দিয়েছিল

হারিয়ে যাওয়া গাভীন ছাগলের খবর?

নইলে এত দরদ দিয়ে পিঁড়িতে বসাবে কেন?

কেন তালুতে দেবে সুড়সুড়ি?

যেন ভোর না হতে বসে থাকা বারান্দায়

আমরা তখন কুয়াশা মেখে বসে থাকি

আগুনের চারধার, বউয়ের শাড়ি জড়িয়ে শুয়ে থাকে সেলিম

দূর থেকে ভেসে আসে আবু বকরের কণ্ঠ

‘ছিয়াশি হাজার

গ্রাম বাংলার

আবাল বৃদ্ধবনিতার

মনকে

তোলপাড় করে

মমতা সিনেমা হলে

অদ্যই শুভমুক্তি

সম্পূর্ণ রঙিন ছবি

‘অমর প্রেম!

অমর প্রেম!’

রিক্সার পিছে পিছে দৌড়ে যাওয়া, ঝুলে পড়া, নায়ক-নায়িকাকে

দেখার জন্যে লাফালাফি, তখন কি শীত থাকে?

কুয়াশাও বুঝে, মিলিয়ে যায় দূরগাঁয়ে...

সকালের রোদে আরমান পাগল দাঁড়িয়ে থাকে সড়কের পাশে

সূর্যকে বলে ‘চ্যাম খা, চ্যাম খা!’

কালো কুচকুচে শিশ্ন

ফড়িংয়ের মতো বসে থাকে ঊরুতে

রোদ পোহায়

উড়ে উড়ে হারিয়ে যায়, রাতের শেষে ফের ফিরে আসে

সূর্যকে দেখায় চ্যাম! আরমান কি সত্যি পাগল?

নাকি নিরামিষভোজির মতো নগ্নভোজি?

সূর্যকে চ্যাম দেখিয়ে সকালের আলোকে ম্লান করতে চায়?

পড়শি নারীরা কি তখন শিশুকে দুধের বোঁটা চুষতে দিয়ে

আড়চোখে তাকায়? জোরে জোরে চুষতে বলে

রেগে ওঠে ‘সাঔয়ার পুলারে নিয়া পারলাম না!’

তখন কি আরমান পাগল লাফাতে লাফাতে

ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে কাছে আসে? নাকি হারিয়ে যায়?



কোনো কোনো দিন আরমান পাগল শুয়ে থাকে কালভার্টের উপর

আকাশের দিকে মুখ করে গান গায় ‘একো ডাকো... দুইও ডাকো... তিনো ডাকোরে...’

গানের সাথে সাথে শিশ্ন নাচায়, যেন চাতক পাখির মতো কামনা করে জল।

কালভার্টের নীচে শতশত ডানকিনি ফুরুৎ-ফারুৎ করে

ধানের েেত ফুলে ওঠে শাদা শাদা দুধ। আরমান ঘুমিয়ে পড়ে।





ঘুমাতে পারি না

ফিসফিস করে ভেসে আসে সহস্র আওয়াজ

যেন ভাটপাড়া গ্রামের সমস্ত মানুষ ফুঁপিয়ে উঠছে, ঠেলছে দীর্ঘশ্বাস

ঝরছে পাতা, ঠুকাঠুকি হচ্ছে ডালে-ডালে, সকাল না হতে

দেিণর মাঠে শুরু হয়েছে মারামারি, মাথা ফেটেছে মতিন আলির

পোষা ময়নাটা বলে যাচ্ছে ‘ম-তিন! ম-তিন! ম-তিন!’



মান্দি নারী যাচ্ছে কামলা খাটতে

হু হু করে বুকে বিঁধছে লগনির কাঁটা, মতিনের রক্ত লেগে লাল হচ্ছে পা,

তবু হাঁটছে নারী, জীবনটাকে দেখতে চাচ্ছে খোলা মাঠের মতো

ঢেউ বইছে বাতাসের, দু হাত প্রসারিত করে হেসে যাচ্ছে সেনিকা, আন্তিকা কিংবা রইমুনি। ঝলমলে তারার মতো বাতি জ্বলছে রুকিয়ার ঘরে ‘আলামিন! আলামিন!’ ডাকে অস্থি’র হচ্ছে মা

খৎনা করা ছেলেটা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে মাংসের খোঁজে।

ফারুক, জামান শুয়ে আছে কর্পোরেশনের মাঠে,

যেখানে খেলার নামে মারামারি হয় কিংবা মাপা হয় উচ্চতা

সেনাবাহিনী।



পাকা সড়ক ধরে হেঁটে যাচ্ছে কোচ মহিলা

মাথায় খড়ির বোঝা, যেন বহুদিন অভুক্ত, গতরের যৌবন

শুকিয়ে গেছে শুকনা খড়ির মতো, ঠকতে ঠকতে

গলার আওয়াজ হয়ে গেছে খড়খড়ে।

হাজং পাড়ায় একদিন হাজংদরদি নেতা! বলেছিল

‘হাজং গ্রামকে আমি সোনার গ্রাম করে দেবো আমাকে যদি...’

শেষ করার আগেই পিলু হাজং বলেছিল ‘বাল খরবো!’



সব গাছ কাটা হচ্ছে, পাথরের নামে খনন হচ্ছে ভিটা, ট্রাক আর বাইকে

ভরে গেছে গ্রাম, মেয়েরা ঝর্নার ধারে যেতে ভয় পায়,

জঙ্গলে যেতে পাসপোর্ট লাগে। তবে কি পিলু হাজং জেনে গিয়েছিল?

নাকি বার্মিজ মার্কেটের ওড়নাবিহীন মেয়েদের দেখে বুঝে গিয়েছিল

কোচ মেয়েরা মুখে চন্দন মেখে দাঁড়াতে পারবে না বিপণীর সামনে?

সোনাকে পাথর, পাথরকে সোনা বানানোর কসরত

রপ্ত করেনি তারা?

ঘুম না ভাঙতেই বেয়ারা এসে জাগিয়ে দিচ্ছে

নাস্তার সময় হয়ে গেছে। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিতে না পেরে

রুমে ঢুকে পাল্লা দিচ্ছে, জিতেও যাচ্ছে। তুলে দিচ্ছে বালু।

কোচ যুবতী কি পারতো এমন সুরম্য হোটেলে এক এক করে

শিশ্নের গোড়া থেকে বালু তুলে আনতে?

নাকি বলতো ‘পাইনা! পাইনা! যাহ্ বাঙাল ধূরে যাহ্! ’



সূর্য ওঠার সাথে সাথে বাঘ যেমন সূর্যকে প্রণাম করে বলে

‘সারাদিন যেন মানুষের সাথে দেখা না হয়’ তেমনি হাজং, কোচ,

মান্দিরাও কি বলে আজ যেন কোনো মানুষের সাথে দেখা না হয়!

এই বিশ্বাস নিয়েই কি সিসিলিয়া পাতা কুড়াতে গিয়েছিল জঙ্গলে?

যখন পিঠে বোলতার মতো বুলেট বিঁধল তখন বন দেবতা কি ঘুমিয়েছিল?

নাকি প্রণামের ভাষা মনঃপুত হয়নি?

সেদিন কি বুলেট ঝরার দিন ছিল?

শরীরের সমস্ত রক্ত ঠাণ্ডা করতে পারেনি বলে কি

মুতে দিয়েছিল ফরেস্টার? নাকি কল্পনা চাকমার

জুমিয়ার গান শুনে জেগে উঠেছিল সিসিলিয়া?





একদিন আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় আগাছা। দাউ দাউ করে জ্বলে জঙ্গল

আগুনের ভেতর হেসে ওঠে অগ্নি দেবতা, সাথে সাথে

পীরেন, সরেন, চলেশ, কল্পনা চাকমা...



আগুনে পুড়ে কীট-নষ্ট বীজ, পুড়ে পুড়ে ভেসে যায় পাহাড়ি ঢলে।

সে কী ঢল...

খল খল করে হেসে ওঠে

পল্টন মোড়ে দেখা অজুফার মতো,

সেবতির মতো, যে বাড়িয়ে দেয় বুক।

একদিন যাকে দেখলে বাড়া খাড়া হতো পাঁচ গাঁয়ের,

সেই নারীর গতর বেয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে পাহাড়ি নদী

অসংখ্য ঢেউ এসে খোঁচা দিচ্ছে মজুদদারের বুক

তখন খোল-করতালের সাথে দামা-মাদলের সাথে

কোমর জড়িয়ে নাচছে মান্দি নারী ওঁরাও যুবতী।

মন্দ্রলয়ে রে রে ধরেছে মান্দি বুড়া এ যেন জনিক খামালের উঠান

সব মানুষের মুখে মদের গন্ধ, নাচতে নাচতে এলিয়ে পড়েছে বচন নকরেক, পরাগ রিছিল চুনিয়ার জঙ্গলকে চেঁচিয়ে বলছেÑ ‘মান্দিরা ধষর্ণকে বলে সিকগি জু’য়া, খাই জু’য়া, খাই দা¹া, খাই জু...’ প্রতিটি বৃরে কানে পৌঁছার আগেই গলা শুকিয়ে গেছে। আরো, আরো খেতে হবে মদ। নইলে বাসরঘরে লজ্জা পাবো, গুটিয়ে যাবো

বার্ণাডের দোকানে গিয়ে কনডম চাইতে পারব না।

কোনো ফাদার সিস্টারকে খারাপ বলতে পারব না কিংবা খাল সাঁতরে

লাল পতাকা আনতে পারব না, যেটা সূর্য উঠলে আমার হবে

যেখানে জন্ম থেকে গিল্লা খেলেছি, বৌচি খেলেছি, সে জমি খাস হয়ে যাবে না।



মোবারক কিংবা ফজল আলির মতো একহাতে লুঙ্গি তুলে

ঊরু দেখিয়ে

হেঁটে যাবো চা দোকানের সামনে দিয়ে, সঙ্গমরত কুকুর-কুক্কুরীকে দেখে আঙুল তুলে বলবো ‘কট লেগেছে!’ রাতের আসরে শিরির জামাই পালা গাইলে দশ টাকা সেলামি দেব।



তবু ঘুম না এলে ক্যান্সাররোগীর মতো ভদ্রবেশে কথা কব, পান চিবাবো,

জল খেতে খেতে এলিয়ে যাবো। তখন কি কবরে পুতা থাকবে শাল কাঠের কিম্মা নাকি বাঁশের ফালি করা যিশুর ক্রুশ? মোমবাতি জ্বলবে প্রতি সন্ধ্যায়? যার সাথে সাংসারেক মতে বিয়ে হয়েছিল মুরগির নাড়ি দেখে সে কি উপোস থাকবে? নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে নতুন শাড়ি পরে তালতলার মোড়ে?

কামনা করবে তাগড়া যুবকের মৈথুন?

ঘুমাতে পারি না

লাল পিঁপড়ার মতো ঝেঁকে ধরে, সারবেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, শুয়ে থাকে শতশত শেফালি অজুফা। কারো কারো মুখে বসন্তের দাগ, কারো কারো মুখে চন্দন লেপা। কেউ পরেছে শাড়ি কেউ পরেছে কামিজ, কেউ কেউ স্কার্ট। কেউ কেউ চুলে ঢেকেছে স্তন, কেউ কেউ পাঁচ আঙুলে যোনি ঢাকতে গিয়ে ভুলে গেছে আঙুলের সম্মিলন।



এমনি শত শত মুখ হেঁটে যাচ্ছে, বাসে- ট্রামে, রেলে পাছায় পাছা ঘষিয়ে

বলছে ‘সরি!’ ুর্ধাত শিশুকে থামিয়ে দিচ্ছে মা, লোকের ভিড়ে শিশুটির কান্না বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে

সঙ্গম অনীহা বউয়ের মতো খেঁকিয়ে উঠছে অথচ বোঁটা ফুলে উঠছে,

ভিজে যাচ্ছে ব্লাউজ, বাতাসে দুধের ঘ্রাণ পেয়ে

উড়ে আসছে চিল

রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেছে শিশু, যে মায়ের স্তন শুকিয়ে গেছে, দুধ-কলা

খেতে পায়নি বলে দুধ হয়নি। এমনি কত মাসি-পিসি-নানির দুধ খেয়ে বড় হয়েছে শিশু, ঝুলে পড়া বোঁটা চুষতে চুষতে শুয়ে পড়ে নাতি। শিশু কি বোঝে দুধের পার্থক্য? মা কি পিসির? গরু কি মহিষের? গরুর দুধ খেয়ে বড় হওয়া শিশুরা কি মানুষ খুন করে? গোঁতায়? কেন রক্ত দেখে চেঁচিয়ে ওঠে লাইলি? সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে মনে হয় সিঁড়ির নীচে অন্ধকার। অন্ধকারে তেলাপোকা উঠে আসে বুকে, চিকার শব্দে ভেঙে যায় ঘুম যুবতীরা স্তনে খুঁজে আঙুলের ছাপ যেন অন্য যুবক বুঝে না ফেলে আর নিমের বাটা শরীরে মাখে। কাচা হলুদের গন্ধে চুমা দেয়া যায় না। তখন কি মুখ ফিরিয়ে নেয় যুবক? নাকি জলের দিকে তাকিয়ে থাকে, রঙিন ফড়িং উড়ে উড়ে জলে বসতে চায় আবার উড়ে উড়ে

মিলিয়ে যায়।



চোখ বুজার আগেই ফিসফিস করে ডাকে। কে ডাকে কবিতা?

নাকি মেলায় দেখা চিকনা-চাকনা পুরুষ?

যার সাথে অকারণে দেখা হয়ে যায়। সে কি রুকিয়ার ভাষা বুঝে? নাকি

জগদিসের মতো সমকামী? নিম্নাঙ্গের দিকে তাকিয়েই থাকে...

যেন সাঁতরে বেড়ায় আর খুঁজে আনে ুধার্ত মানুষের খাবার।

নাকি কবিতা এসে মুখ বাড়ায়? নাকি ছিটকে আসা বীর্যকণা

যার সর্বশরীরে চোখ, যার প্রসারিত জিহ্বা ছুঁয়েছে জরায়ু,

সে কি শুধু ঘৃণার পাত্র? যে প্রতি রাতে খেপ মারে পাঁচ কি ছয়বার

আঙুলে ছেফ দিয়ে গোনে টাকা নাকি শিশ্ন? হাসতে হাসতে খুলে দেয় দরজার খিল?

নাকি আদিবাসী যুবতীর মতো লাজুক লাজুক কুশল বিনিময়?

কবিতা সে তো সঙ্গম-উন্মাদ নাগরের মতো ছুটবে, ডাকবে ওড়না বিছিয়ে। সে কি সত্যি কবিতা নাকি মান্দি নারী?

নাকি চাইনিজ কুড়াল? যা দিয়ে আনায়াসে ভাগ করা যায় নারীর হৃদয়,

পুরুষের মগজ। মাঝে মাঝে কবিতাকে মনে হয় ভাড়া করা পর্ণো ছবি।

লিখে লিখেও মনে হয় নতুন। যেন পুরো বাজার যাচাই করে কেনা

যুবতীর সাথে ঘোড়ার খেল। যেন দশ টাকায় পুরো দশটা সিন খুলে যাচ্ছে আর শিশ্নের আগা ধরে মোচড় দিচ্ছে

‘চ্যাম খা! চ্যাম খ্যা!



কবিতা সে কি দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া স্বামীর মতো উতলা?

যে হিশেব করে বারমাসের আর বারবার রসায়ন সৃষ্টি করে

যেন ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে ভেদ করে ব্যাকটিরিয়াবিহীন

মেঘের দেয়াল।



ঘুমাতে পারি না

নাকি ঘুমাতে দেয় না?

কেন ভাল হবার পরও যক্ষ্মারোগী বিড়ি টানে?

কেন বসে মদের আসরে? তবে কি বউ মরেছে বলে যক্ষ্মা ভালো হতে নেই?

কাশতে কাশতে বদলা নিতে চায় পূর্ণ যৌবনের?

সালসার খালি বোতলগুলো পরিহাস করলে কি শরীরে জোর বাড়ে?

নাকি নদ্দার গলির ভিতর য়ে যাওয়া ইট-পাথরের মতো

নিজেকে য়ে যেতে দেখে, বিড়ির ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে দেখে,

গ্লাস ভরতি স্কচের ভিতর য়ে যাওয়া বরফ দেখে ভাবতে থাকে

যক্ষ্মারোগই ভালো

কাশতে ভালো

তবে কি কবিতাও যক্ষ্মারোগীর মতো ধীরে ধীরে লয় পায়?

তবে কেন পূর্বপুরুষের কবিতা এই পুরুষে খারিজ হয়ে যায়?

তবে কি আমিও যক্ষ্মারোগীর মতো কবিতা লিখি? নাকি ভান করি?

ভান করতে শিখেছি বলে ধ্বজভঙ্গ লিঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি কাকলি নটীর সামনে।



‘সঙ্গম না হলে কি কবিতা লেখা যায়?’ সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মুহূর্মুহূ সঙ্গম করি কবিতা কি এসেছে আতরের ঘ্রাণের মতো ভাসতে ভাসতে?



ঘুমাতে গেলে হেসে ওঠে

মসকরা করে কবিতা

কবিতা যেন মজিবরের ম্যাজিক! যে ঝিনাইগাতীর হাটে এক তুড়িতে ভেনিস করেছিল জনাথন কোচের বিচি। শতশত লোকের ভিড়ে জনাথনের কী আর্তনাদ!

‘আমার বিচি...! আমার বিচি...! খয়ার মাখা দাঁত দেখিয়ে বলেছিল জাদুকর ‘একশত টাকা দিবি, এহনই পাবি’ শতশত লোকের আঙুলে মাজা দাঁত

থেকে বার রকমের ঘ্রাণ বেরিয়েছিল। তাহলে কবিতা কি বার রকমের ঘ্রাণ?

নাকি আমারই ছেলে?

আমারই মেয়ে?

যারা ষোল বছর থেকে

আঠার বছর থেকে

জ্ঞান হবার পর থেকে

গড়িয়ে পড়েছিল বিছানায়

মাঠে

তালতলায়

বাঁশবনে

গোসলখানায়



সেই মেয়েরা

সেই ছেলেরা

উঠে এলে ঝাঁকে ঝাঁকে

ঘুম কি হয়?



যখন মজিদ খুলে নেয় কোচ নারীদের শাড়ি

বের করে আনে সায়ার ভিতর থেকে দশ টাকা, পাঁচ টাকা, একশ টাকার

নোট! তখন কি কোচ নারীরা জানতো খেলার সাথী মজিদ

হবে বদরবাহিনীর প্রধান? জানলে তো বিচি টিপেই মেরে ফেলতো ‘জামাই-বউ ’ খেলার সময়। যেভাবে মেরে ফেলে দুই মাস, তিন মাস, চার মাসের সন্তানকে সাবান খাইয়ে, সোডা খাইয়ে, কিংবা এমআর করে।

তখন কি মজিদ আঙুল ঢুকাতে পারতো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ ’ বলে?

পারতো কি মিলিটারির নামে মান্দি বাড়ি লুট করতে?

মজিদ বদরবাহিনীর প্রধান হয়েছিল বলেই প্রথম দেখেছিল নারীগহ্বর

স্তনে লিখেছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তখন কতোটা কালো হয়েছিল নারীর মুখ?

অন্ধকার কি ঠিক মতো ঢেকেছিল ফর্সা স্তন?

নাকি হাতের তালুতে বসিয়েছিল নারীকে?

খুঁটে এনেছিল পাহাড়ি উকুন?



মজিদ বদরবাহিনীর প্রধান হয়েছিল বলেই বলতে পেরেছিল ‘মাদার চুৎ!’

নইলে লুঙ্গি খুলে দৌড়ে পালাতো একহাত দূর থেকেই।

যেভাবে মারবেল রেখে দৌড় দিয়েছিল আবু তাহের।

কুড়িয়ে এনেছিলাম গুনে গুনে দশটি মারবেল। দশটি মারবেল আর দশটি আঙুল গুনে গুনে বলেছি আমার বয়স দশ। দশ কি? দশই তো, নাচ শিখতে গিয়ে ধরতে হলো ওস্তাদের হুল, বিন্নি চালের সাথে শুকরের ভুনা খাওয়াতে পারিনি বলে নাচ শেখা হলো না। লজ্জায় শাপ দিতে হলো বন্য হাতির পালকে, যে পাল দিনের বেলা খেয়ে গেল ধান, বাকিটুকু নিয়ে গেল জাল দলিলের মালিক।

মা’র কি কান্না...

পাহাড়ি ঝর্নার মতো!

মাসি-পিসিরাও এলো, কান্নায় তাল দিলো

ছলাৎ ছলাৎ করে পুরো ভাটপাড়া হলো সংক্রামিত

পাহাড়ি ঢলের মতো জাল দলিলের জালে বিদ্ধ হলো মান্দি জনপদ।



তখন কি ঘুম থাকে? নাকি দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করে কাছারি ঘরে, যেখানে শুয়ে থাকে ফজলু মাতাব্বর। তার কি বাতের ব্যথা? নাকি অদৃশ্যের চাবি হাতে বসে থাকে? একদিন ফজলু মাতাব্বর বলেছিলো ‘হিন্দু মাইয়ার লগে ঘুমাইলে বাত হয় না’ তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছিল চেলা রফিকুল। রওনা দিয়েছিল বংশী পাড়ার দিকে...



আমরা হৈ-হাঙ্গামা শুনেছিমাত্র। ক’টা হাড়ি ফেটেছে অন্ধকারে,

সকালে শোভা রানীর খোঁজ মেলেনি। সে কি বাতের নিরাময়কারী? নাকি

ঝিনাইগাতী বাজারে বেহেস্তের টিকিট দেয়া হবে?



একবার আমাদের গাঁয়ে লাল পানি এলো

সে কী লাল টকটকা! সবাই ভাবলো আল্লার গজব পড়েছে নইলে

এমন লাল কেউ তো কোনদিন দেখেনি, তবে?

তবে কি গফুর গাঁও থেকে যখন দলে দলে শেখরা আসলো

তখনই কি আল্লা গজব সেটে দিয়েছিল?

কেন মান্দি বাড়ি মলিন হতে লাগলো?

কেন ঘুমের বদলে জেগে থাকতে হলো যুবরাজকে

কেন মশা-মাছি, গুয়ে একাকার ঘরে আটকে রাখলো রেজিনাকে?

শেষে নাম হলো আসামী রেজিনা রাকসাম!

বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি হামাগুড়ি দিয়ে ভাতের বদলে খেলো

ধান মেশানো খই

যেভাবে রায়তে খেয়েছিল কলার থোড় আর বাঁশের কোড়ল

পোষা লালুকে থামানো যাচ্ছিল না

শেখদের বাড়ির দিকে মুখ করে আগে-পিছে

ঘেউউ...

ঘেউউ...

ঘেউউ...

সে কী ডাক!



গোয়াল ঘরে ধোঁয়া দিতে গিয়ে চোখে পড়ে

বেড়ার একপাশ চুরি হয়ে গেছে, বাছুরের গলার দড়ি কাটা

পুকুরের মাছ আপনা আপনি ঢেউ তোলে

সবাই তখন অনাবাদি জমিতে সারি বেঁধে কচু লাগাচ্ছে

শিমুল আলু খেতে আসা একদল ছেলেরা হাসাহাসি করছে

গত রাতের কাহিনি শুনে

কে জানে, তাদের কেউ কেটেছিলো বাছুরের দড়ি!



পৌষের সময় গান হতো সবাই বলতো ‘চল মাগা’

নারীরূপি পুরুষ ঘুরে ঘুরে নাচছে রুমাল পেঁচিয়ে

সে কী নাচ ‘আমরা তো বাঞ্জারাম...দেখাবো নাচ গান...’

তালে তালে মাদলের ধিতাং ধিতাং, সারা গাঁ জুড়ে হুল্লোড়

শেখ আর মান্দিদের ঠেলাঠেলিতে ভেঙে যায় বারান্দার পাড়

কারো কারো গাঁদা কিংবা মাসুন্দার ডাল ভেঙে

নেতিয়ে পড়ে।



মাঘের শীত কিন্তু চারপাশ মাইকের আওয়াজে ঘুম হারাম

আজ দুধনই, কাল বনকালি, পরশু দিঘিরপাড়

ঝুমুর ঝুমুর নাচ-গানে উতলা করে মুখে মুখে শুধু এক আলাপ

কোন পাড়া ভালো সেরি এনেছে। নাটককে কেন্দ্র করে শুরু হয়

দোকানের পসরা

যেন শীতে আর নারীতে গড়াগড়ি খায় বাঁশের মঞ্চে

কৌতুহলি নারীদের হারিকেন ধরিয়ে চুপি চুপি হাঁটা আর পুরুষের ধমকানি যেন অবলা মায়েদের সখ আহাদ নাই!



শেখ পাড়ার মেয়েরা বেশি যেতো বার্ষিক বিরাট সম্মেলনে

জন্মান্ধ হুজুর আসতো পাগড়ি পড়ে সে কী ওয়াজ!

দেখতাম নারী সকল চোখের পানি আঁচলে লুকাচ্ছে

হুজুরের ওয়াজ শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে

রাব্বুল আলামিনের নাম আর বেহেস্তে যাবার সোজা রাস্তা।



দুধনইয়ে মাহফিল হলে ধরে নিয়ে যেতো বকর কিংবা হুরাই

সে এক ওয়াজ! মা-বোনদের মুখ ঢাকতে বলে সেক্স’র কথাও বলে!

আমরা মজা পেতাম। বকর তখন খৎনার কথা বলতো কলেমার কথা বলতো। নানি জেগে জেগে হয়রান হলে হারিকেন জ্বালিয়ে নিতে আসতো, আর ধুমসে বকা...



মাঝে মাঝে মনে হয় বয়স হলে বুঝি কাতর হয়ে পড়ে?

কেন অতীতের কথা বলে বলে কাঁদতো নানি?

গাঁয়ে ঝাঁকড়া বটগাছ ছিলো সেখানে প্রতিদিন বসতো অমঙ্গল পাখি

সে কী ডাক! নানি রাতের অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়তো আর খেঁকিয়ে উঠতো

পাখিটা উড়ে গিয়ে বসতো দূরে এক জিগার গাছে

যেখানে নানির সাধ্য ছিল না যাবার। পাখি ডেকে যেতো ‘টু...উ...টু...উ...’

নানির কী ছটফটানি! বলতোÑঅমঙ্গল হবে...তাড়িয়ে দে

কে শুনে কার কথা! নানি বলতো রাতে এই পাখি যার বাড়ির গাছে বসে ডাকে তার ঘরে অমঙ্গল হয়!



কে জানে যেবার নানির হুস ছিল না

রাত জেগে সেই পাখি কি ডেকে ছিলো? কেউ কি শুনেছে?

নাকি মদের ঘোরে ভুলে গিয়েছিল পাখির ডাক? নানি মারা যাবার পর

সেই পাখিটা আর কোনদিন কোথাও বসেনি কিংবা ডাকেনি

এ তো সবাই জানে। পাখিটার নাম জানি না

জানলে পাখির খোঁজে বিজ্ঞাপন দেয়া যেতো

জানা যেতো রাতে পাখি ডাকলে কি অমঙ্গল হয়?

নানি কেন ভয় পেতো? জিগা গাছটা নেই

কবে বিক্রি হয়ে গেছে, গাছের মুথা উঠিয়ে ভাগার বানিয়েছি।



নানি কি জানে আজ আমাদের বাড়ি

গাছ কিংবা তার আদরের রেজিনা রাকসামও নেই!

পাখি কি আবার ডেকেছিলো, তার আদরের রেজিনাও সারা দিলো!

সারারাত চল্লিশ পাওয়ারের বাতি জ্বালিয়ে রাখি প্রস্তুত থাকি কখন ডেকে ওঠে সেই কিম্ভূত পাখিটা!

নানির কথা ভাবলে পাখির কথা মনে পড়ে

যে পাখি জেনে যায় মৃত্যুর আগাম খবর

ডেকে ওঠে ‘টু...উ, টু...উ!’

ঘুমাতে গিয়ে মৃত্যুর ঘরঘর শব্দ শুনি

যখন কাতরাতছিলো আর আঙুরের প্রতীায় মৃত্যুকে

ছেপ দিয়ে বলেছিল ‘আ...ঙুর... আ...ঙুর...!’

তবে কি মৃত্যুর ঘোরে দেখে ফেলেছিল

নাতি আসছে আঙুর নিয়ে? তাই পাঞ্জা লড়েছে মৃত্যুর সাথে?

যখন দেখি সব বিরানভূমি, তা নিয়েও চলছে কামড়া-কমড়ি!



আধ-পাগলা মানুষটা আজও ঘুরে বেড়ায়, জীবিত নারীর চোখেছানি

ভাটপাড়া গ্রামের সাথে মিল পেয়ে যাই নারিকেলতলার,

যেখানে শুধু ভাঙন আর ঢেউ একসাথে খেলা করছে নিয়ত।

মানুষজন চেয়ে আছে উছলে পড়া জলের দিকে, ভাঙাপাড়ের দিকে

আবার সবাই মিলে গান গাইছে, লুটে পড়ছে চরের উপর

এ যেন ভাটপাড়া গ্রাম ওয়ানগালায় ঘুরে ঘুরে নাচছে বাড়ি বাড়ি

যিশুর নামে মদ খাচ্ছে, হু হু করে কেঁদে উঠছে



মদ খেলে কি স্মৃতিকাতর হয়!



একবার বাবার সাথে ভীষণ ঝগড়া হলো মা’র

সে কী ঝগড়া! ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল আহম্মদ নগর

মান্দি পাড়ায় রটে গেল বোরখা পরে পালিয়ে গেছে।

বাবার কী রাগ গলার রগ দেখা গেছে!

আমাদের খারাপ লাগেনি। জানতাম রেজিনা রাকসাম ফিরে আসবে

বলবে ‘তোমরা কেমন আছো?’ কদিন পর ফিরেও এলো

যেভাবে এলো শেরপুর জেলখানা থেকে। যখন নিজের জমির উপর দাঁড়িয়ে বুকটা হু হু করে উঠলো, রাত পোহালে এ জমি দখল হবে

ছাড়তে হবে ভিটা। তখন ঘুমের ভিতর চেঁচিয়ে উঠে

এ জমি আমার...!



রেজিনার বয়েসিরা আরামে ঘুমায় কিংবা স্বামীর

বুকের ভিতর খুঁজে নিজের অস্তিত্ব।



ভোর না হতে ছটফট করতে থাকে জবাইয়ের জন্য বাঁধা শুকরের মতো

কে দেবে টাকা? কোন গাছ কে নেবে?

কিংবা ঘরে ভালো জিনিস আছে কিনা

যা ভালো দামে হাঁকানো যায়। লোকের আনাগোনা বলে দেয়

দখল হয়ে যাবে জঙ্গল কেটে বানানো ভিটা।

বাগানে শিমুল আলুর বদলে গজিয়ে উঠবে তামাকের চারা

পুকুরে সাঁতার কাটবে একদল শেখ রমণী।

কুয়োতলায় শুকরের বদলে বাঁধা হবে ছাগল কিংবা বাছুর

প্রতিদিন শোনা যাবে আযানের ধ্বনি।



সূর্য উঠলো

রেজিনাকে মনে হলো আগুন থেকে উঠে আসা রমণী

কী তেজ! মান্ধাতামলের বটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেিণর খোলা জমিতে

যে দিক দিয়ে শেখেরা আসে পালে পালে। রেজিনা দাঁড়িয়ে থাকে দুর্গার মতো।



শেখের হাতে দলিল। রেজিনার হাতে বটি।

হাসতে হাসতে পাড়ার লোকেরা বলেছিলো

জাল দলিলে কাজ হয়! দেখলে না শেখের মুখটা কেমুন শুকিয়ে গ্যাল!

জমিমুখো হয়নি কেউ কিন্তু হাজত ঘরে যেতে হয়েছে

সপ্তায় সপ্তায়, মাসে মাসে, চেঁচিয়ে বলতে হয়েছে ‘ও টিপ আমার না বাবু...’



ভাটপাড়া গ্রামের মান্দিরা জানে

দলিলে লেখা আছে রেজিনা রাকসাম

সঠিক রায় পেয়েও গেছে রেজিনা

কিন্তু প্রকৃতি জানে কখন বাসা বাঁধতে হয়

নারীর গোপন গুহায়, য় করতে হয় জরায়ু কিংবা

জিতে যাওয়া আরশির মতো মুখ।



একদিন রেজিনা হাসতে হাসতে ফিরে আসে

ভাটপাড়া গ্রামের রাকসাম ভিটায়, উৎসুক চোখ

তাকিয়ে থাকে যুদ্ধজয়ী নারীর য়ে যাওয়া মুখের দিকে।



কে বলবে এই নারী একদিন বটি ধরেছিল

মশা তাড়াতে তাড়াতে ফুঁকেছিলো বিড়ি!



নিজের ভিটা যেখানে থাকতে গিয়ে লড়তে হলো

বুকের ভিতর পুষতে হলো জাল দলিলের ছাপ!



ঘুমাতে পারি না

বুকের উপর পাঁচটি আঙুল খেলতে খেলতে দশটি হয়ে যায়।

দশটি আঙুল খেলতে খেলতে বিশটি হয়ে যায়।

শুধু কি বিশটি? বিশ আঙুলের আত্মীয়-স্বজন,

পাড়া-পড়শি বলীর বাজনা বাজায়, যেন কলিজার কিমা ভাল

ফুসফুসের ঘ্রাণ আতর মাখানো। তাই বিশটি আঙুল হেসেই চলে

তখন কি ঘুম হয়?



সঙ্গম স্রেফ বাতিক জেনে চোখ বন্ধ করি

ঘুম আসে না!

মুখের কাছে আঙুলগুলো হেসেই চলে

মান্দি নারী চেঁচিয়ে বলছে

বাবু...ও দলিল জাল...

রায় দিও না...

রায় দিও না...!



ঘুম কি হয়?

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১০/-১

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১:০৯

আবদুল ওয়াহিদ বলেছেন:
ফাঁকিবাজী লেখা। এটাই কি তোর রিভিউ।

অসাধারণ লেগেসে। এতো চমৎকার কবিতা অনেক দিন পড়ি নাই।

২| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪০

সাদা কালো এবং ধূসর বলেছেন: আসলেই ফাঁকিবাজি রিভিউ


আমি মুগ্ধ হয়েছি কবিতায়

সত্যি বলতে সবাই সব জিনিসের ভালো রিভিউ লিখতে পারে না - এটাও মনে হয় তুমি পারবে না।

মুগ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি।

৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:৩৪

সাদা কালো এবং ধূসর বলেছেন: হুম আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে, এটা স্রেফ পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা মনে হচ্ছে। লেখাটা তুলে দেবার আগের যৎসামান্য ভূমিকা যেমন লেখে, তেমন কিছু মনে হয়।

৪| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১:২২

স্বদেশ হাসনাইন বলেছেন: মুগ্ধপাঠ

৫| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:১৭

বিধান ঋষভ বলেছেন: মিঠুরনর বইটা আগেও পড়েছি আবারও পড়লাম। দারুণ! অনেক কথাই বলা যায় বইটা নিয়ে। কিন্তু মুগ্ধতার বিপরীতে কিছু কি বলবার প্রয়োজন আছে? ধন্যবাদ নির্ঝর। নির্ঝর'দা।- বিধান সাহা

৬| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:৫১

kisuna বলেছেন: এই কবিরে আমি চিনি।

৭| ১২ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৪:১২

গ্যাব্রিয়েল সুমন বলেছেন: মুগ্ধতা। প্রিয়তে...

৮| ১২ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:৫১

নীল ফিউজিটিভ বলেছেন: হুম...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.