ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রের শৈল্পিক বিশ্লেষণ

১১ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৫

চলচ্চিত্র, একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম যা আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, এবং মানসিকতাকে প্রতিফলিত করতে পারে। চলচ্চিত্রের নান্দনিক দিকগুলোকে বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে। এর মধ্যে ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্ব (Formalist Film Theory) একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা চলচ্চিত্রের ফর্মাল উপাদান যেমন: সম্পাদনা, আলোর ব্যবহার, ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, এবং প্রতীকী দিকগুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়। এই তত্ত্বের মূল ভাবনা হলো, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবতা প্রতিফলিত না হয়ে, তার শৈল্পিক উপাদানগুলোর মাধ্যমে একটি বিশেষ নান্দনিকতা ও মানসিকতা তৈরি করা যায়।

বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্র শিল্পে ফরমালিস্ট তত্ত্বের প্রভাব ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিষয়বস্তু থেকে বেশি জোর দিয়েছেন শৈল্পিক উপাদানগুলোতে, যা দর্শকদের নতুনভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছে। তারেক মাসুদ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, রুবাইয়াত হোসেনসহ আরও কিছু বিখ্যাত পরিচালক তাদের সিনেমায় ফরমালিস্ট উপাদান ব্যবহার করে একটি নতুন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রে ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের উপস্থিতি, তার প্রভাব এবং শৈল্পিক বিশ্লেষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। লক্ষ্য থাকবে, কীভাবে এই তত্ত্বের উপাদানগুলো বাংলাদেশের সিনেমায় ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তা চলচ্চিত্রের শৈল্পিকতা এবং দর্শকের অভিজ্ঞতা গঠনে কী ভূমিকা রাখছে।

ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্ব, ১৯২০-এর দশকে রাশিয়ান চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক এবং নির্মাতাদের দ্বারা উদ্ভূত একটি তত্ত্ব, যেখানে চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী এবং তার শৈল্পিক উপাদানগুলোতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই তত্ত্বে কাহিনী বা চরিত্রের বাস্তবতা থেকে বেশি গুরুত্ব পায় সম্পাদনা, আলো, ক্যামেরার কাজ, এবং প্রতীকী উপাদান। ফরমালিস্ট তত্ত্বের মূল কথা হলো, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবতা পরিবর্তিত হতে পারে এবং তার মাধ্যমে একটি বিশেষ মানসিক এবং আবেগময় প্রভাব তৈরি করা সম্ভব।

সের্গেই আইজেনস্টাইন ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। তার মঁতাজ তত্ত্ব (Montage Theory) চলচ্চিত্রে বিভিন্ন দৃশ্য একত্রিত করার মাধ্যমে নতুন অর্থ এবং আবেগ তৈরি করার ক্ষমতা দেখিয়েছে। ফরমালিস্ট চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য শুধু কাহিনী বলা নয়, বরং দর্শকদের শৈল্পিক উপাদানের মাধ্যমে চিন্তা এবং আবেগকে প্রভাবিত করা।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে ফরমালিস্ট তত্ত্বের প্রভাব
বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্র নির্মাতারা ক্রমশ ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের উপাদানগুলো ব্যবহার করছেন তাদের সিনেমার শৈল্পিকতা এবং গভীরতা বাড়াতে। চলচ্চিত্রে ফরমাল উপাদানগুলোর জোরালো প্রয়োগ দেখা গেছে, যেখানে প্রতীক, আলো, সম্পাদনা, এবং ক্যামেরার বিশেষ কৌশল দর্শকদের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা দেয়।

তারেক মাসুদের "মাটির ময়না" (২০০২)
তারেক মাসুদের মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী গ্রামের জীবন এবং মানুষদের সংগ্রামের প্রতিফলন। এই সিনেমায় গ্রামীণ বাংলার মাটি এবং প্রকৃতি প্রতীকী রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যা জাতীয়তাবোধ এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার একটি গভীর মর্মার্থ বহন করে। ফরমালিস্ট তত্ত্বের অন্যতম প্রধান উপাদান—প্রতীকবাদ—এই চলচ্চিত্রে প্রধান ভূমিকায় ছিল।

ক্যামেরার নিরীক্ষামূলক কাজ, বিশেষ করে প্রকৃতির দৃশ্যগুলো এবং তাদের সম্পাদনা দর্শকের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। মাটি এখানে শুধু গ্রামের জীবনের অংশ নয়, বরং একটি বড় প্রতীক যা সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং দেশের অস্তিত্বকে প্রতিফলিত করেছে।

নাসির উদ্দিন ইউসুফের "আলফা" (২০১৯)
নাসির উদ্দিন ইউসুফের আলফা চলচ্চিত্রে ঢাকা শহরের একজন ভাস্করের গল্প তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে শহরের বিশৃঙ্খল জীবন এবং তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে প্রতীকী উপায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্রে ফরমালিস্ট উপাদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়, যেখানে ক্যামেরার নিরীক্ষামূলক ব্যবহার এবং আলোর প্রতীকী ব্যবহার সিনেমার প্রধান শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য।

দৃশ্যগুলোতে ক্যামেরার কৌশলী ব্যবহার এবং সম্পাদনার মাধ্যমে শহরের বিরোধিতা এবং চরিত্রের মানসিক বিপর্যয় প্রতিফলিত হয়েছে। দর্শক এখানে শুধু চরিত্রের অভিজ্ঞতা দেখেন না, বরং তার মানসিক অবস্থাও বুঝতে পারেন, যা ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।

রুবাইয়াত হোসেনের "মেড ইন বাংলাদেশ" (২০১৯)
রুবাইয়াত হোসেনের মেড ইন বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র, যা নারী শ্রমিকদের সংগ্রাম এবং তাদের সামাজিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। এখানে প্রতীকী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আলোর কৌশলী ব্যবহার এবং রঙের প্রতীকী উপস্থাপনা।

ফরমালিস্ট তত্ত্বের আলোকে, সিনেমায় প্রতীকী উপাদান যেমন লাল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। পাশাপাশি, আলোর মাধ্যমে শ্রমিকদের কঠিন জীবন এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি বিপরীতমুখী সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।

ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের আলোকে চলচ্চিত্র নির্মাণের নান্দনিকতা
বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রে ফরমালিস্ট উপাদানগুলোর মাধ্যমে একটি বিশেষ নান্দনিকতা তৈরি করা হচ্ছে। পরিচালকরা শুধুমাত্র গল্প বলার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন না, বরং প্রতিটি ফর্মাল উপাদানকে শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করে একটি মানসিক এবং আবেগময় অভিজ্ঞতা তৈরি করার চেষ্টা করেন।
ক্যামেরার কোণ এবং এর গতিশীলতা বাংলাদেশের ফরমালিস্ট চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্রে ক্যামেরার নিরীক্ষামূলক ব্যবহার যেমন আলফা-তে দেখা যায়, যেখানে ক্যামেরার গতিশীলতা দর্শকের মনের অস্থিরতা এবং চরিত্রের মানসিক বিপর্যয়কে প্রকাশ করে।

সম্পাদনা ও মঁতাজ
ফরমালিস্ট তত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সম্পাদনা। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে সম্পাদনার মাধ্যমে দৃশ্যগুলোতে একটি নির্দিষ্ট অর্থ তৈরি করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মাটির ময়না-তে দৃশ্যগুলোর মন্থর গতি এবং প্রকৃতির ছবির সংমিশ্রণ একটি প্রতীকী ধারা তৈরি করেছে।

আলো এবং রঙের ব্যবহার
আলোর প্রতীকী ব্যবহার এবং রঙের বৈচিত্র্যও ফরমালিস্ট তত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মেড ইন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রে লাল রঙের ব্যবহার শ্রমজীবী নারীদের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।

ফরমালিস্ট ফিল্ম তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের সমসাময়িক চলচ্চিত্রগুলো শৈল্পিক ও প্রতীকী উপাদান ব্যবহার করে একটি গভীর অর্থ এবং অভিজ্ঞতা তৈরি করছে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা ফর্মাল উপাদানগুলোর মাধ্যমে দর্শকের চিন্তা, আবেগ এবং অনুভূতিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। মাটির ময়না, আলফা, এবং মেড ইন বাংলাদেশ—এই চলচ্চিত্রগুলোতে ফরমালিস্ট তত্ত্বের সফল প্রয়োগ লক্ষণীয়, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের একটি নতুন ধারার উদাহরণ হিসেবে কাজ করছে।

০ টি +০/-০