নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হাসান ইকবাল-এর লেখালেখির অন্তর্জাল।

হাসান ইকবাল

.... ছেলেবেলার দুরন্ত শৈশব কেটেছে নেত্রকোনায়। আর সবচেয়ে মধুর সময় ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলি। আর এখন কাজ করছি সুবিধাবন্চিত শিশুদের জন্য একটি স্পানিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়।

হাসান ইকবাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রেম - জীবনানন্দ দাশ

০১ লা ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:২৩

প্রেম

-জীবনানন্দ দাশ






আমরা ঘুমায়ে থাকি পৃথিবীর গহ্বরের মতো —

পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে হয়েছে আহত —

একা — হরিণের মতো আমাদের হৃদয় যখন!

জীবনের রোমাঞ্চের শেষ হলে ক্লান্তির মতন

পান্ডুর পাতার মতো শিশিরে শিশিরে ইতস্তত

আমরা ঘুমায়ে থাকি! — ছুটি লয়ে চলে যায় মন! —

পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা পড়ে আছে কত —

তাদের চোখের ঘুম ভেঙে যাবে আবার কখন! —

জীবনের জ্বর ছেড়ে শান্ত হয়ে রয়েছে হৃদয় —

অনেক জাগার পর এইমতো ঘুমাইতে হয়।



অনেক জেনেছে বলে আর কিছু হয় না জানিতে;

অনেক মেনেছে বরে আর কিছু হয় না মানিতে;

দিন — রাত্রি — গ্রহ — তারা পৃথিবীর আকাশ ধরে ধরে

অনেক উড়েছে যারা অধীর পাখির মতো করে —

পৃথিবীর বুক থেকে তাহাদের ডাকিয়া আনিতে

পুরুষ পাখির মতো — প্রবল হাওয়ার মতো জোরে

মৃত্যুও উড়িয়া যায়! — অসাড় হতেছে পাতা শীতে,

হৃদয়ে কুয়াশা আসে — জীবন যেতেছে তাই ঝরে! —

পাখির মতন উড়ে পায় নি যা পৃথিবীর কোলে —

মৃত্যুর চোখের পরে চুমো দেয় তাই পাবে বলে!



কারণ, সাম্রাজ্য — রাজ্য — সিংহাসন — জয় —

মৃত্যুর মতন নয় — মৃত্যুর শান্তির মতো নয়!

কারণ, অনেক অশ্রু — রক্তের মতন অশ্রু ঢেলে

আমরা রাখিতে আছি জীবনের এই আলো জ্বেলে!

তবুও নক্ষত্র নিজে নক্ষত্রের মতো জেগে রয়!

তাহার মতন আলো হৃদয়ের অন্ধকারে পেলে

মানুষের মতো নয় — নক্ষত্রের মতো হতে হয়!

মানুষের মতো হয়ে মানুষের মতো চোখ মেলে

মানুষের মতো পায়ে চলিতেছি যতদিন — তাই,

ক্লান্তির পরে ঘুম, মৃত্যুর মতন শান্তি চাই!



কারণ, যোদ্ধার মতো — আর সেনাপতির মতন

জীবন যদিও চলে — কোলাহল করে চলে মন

যদিও সিন্ধুর মতো দল বেঁধে জীবনের সাথে,

সবুজ বনের মতো উত্তরের বাতাসের হাতে

যদিও বীণার মতো বেজে উঠে হৃদয়ের বন

একবার — দুইবার — জীবনের অধীর আঘাতে —

তবু, প্রেম, — তবু তারে ছিড়ে ফেঁড়ে গিয়েছে কখন!

তেমন ছিঁড়িতে পারে প্রেম শুধু! — অঘ্রাণের রাতে

হাওয়া এসে যেমন পাতার বুক চলে গেছে ছিঁড়ে!

পাতার মতন করে ছিঁড়ে গেছে যেমন পাখিরে!



তবু পাতা — তবুও পাখির মতো ব্যথা বুকে লয়ে,

বনের শাখার মতো — শাখার পাখির মতো হয়ে

হিমের হাওয়ার হাতে আকাশের নক্ষত্রের তলে

বিদীর্ণ শাখার শব্দে — অসুস্থ ডানার কোলাহলে,

ঝড়ের হাওয়ার শেষে ক্ষীণ বাতাসের মতো বয়ে,

আগুন জ্বলিয়া গেলে অঙ্গারের মতো তবু জ্বলে,

আমাদের এ জীবন! — জীবনের বিহ্বলতা সয়ে

আমাদের দিন চলে — আমাদের রাত্রি তবু চলে;

তার ছিঁড়ে গেছে — তবু তাহারে বীণার মতো করে

বাজাই, যে প্রেম চলিয়া গেছে তারই হাত ধরে!

কারণ, সূর্যের চেয়ে, আকাশের নক্ষত্রের থেকে

প্রেমের প্রাণের শক্তি বেশি; তাই রাখিয়াছে ঢেকে

পাখির মায়ের মতো প্রেম এসে আমাদের বুক!

সুস্থ করে দিয়ে গেছে আমাদের রক্তের আসুখ!



পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে

রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ —

ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে!

প্রেম কি আসে নি তবু? — তবে তার ইশারা আসুক!

প্রেমকি চলিয়া যায় প্রাণেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে!

ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে!



যত দিন বেঁচে আছি আলেয়ার মতো আলো নিয়ে —

তুমি চলে আস প্রেম — তুমি চলে আস কাছে প্রিয়ে!

নক্ষত্রের বেশি তুমি — নক্ষত্রের আকাশের মতো!

আমরা ফুরায়ে যাই — প্রেম, তুমি হও না আহত!

বিদ্যুতের মতো মোরা মেঘের গুহার পথ দিয়ে

চলে আসি — চলে যাই — আকাশের পারে ইতস্তত!

ভেঙে যাই — নিভে যাই — আমরা চলিতে গিয়ে গিয়ে!

আকাশের মতো তুমি — আকাশে নক্ষত্র আছে যত —

তাদের সকল আলো একদিন নিভে গেলে পরে

তুমিও কি ডুবে যাবে, ওগো প্রেম, পশ্চিম সাগরে!



জীবনের মুখে চেয়ে সেইদিনও রবে জেগে জানি!

জীবনের বুকে এসে মৃত্যু যদি উড়ায় উড়ানি —

ঘুমন্ত ফুলের মতো নিবন্ত বাতির মতো ঢেলে

মৃত্যু যদি জীবনেরে রেখে যায় — তুমি তারে জ্বেলে

চোখের তারার পরে তুলে লবে সেই আলোখানি।

সময় ভাসিয়া যাবে দেবতা মরিবে অবহেলে

তবুও দিনের মেঘ আঁধার রাত্রির মেঘ ছানি

চুমো খায়! মানুষের সব ক্ষুধা আর শক্তি লয়ে

পূর্বের সমুদ্র অই পশ্চিম সাগরে যাবে বয়ে!



সকল ক্ষুধার আগে তোমার ক্ষুধায় ভরে মন!

সকল শক্তির আগে প্রেম তুমি, তোমার আসন

সকল স্থলের’ পরে, সকল জলের’ পরে আছে!

যেইখানে কিছু নাই সেখানেও ছায়া পড়িয়াছে

হে প্রেম, তোমার! — যেইখানে শব্দ নাই তুমি আলোড়ন

তুলিয়াছ! — অঙ্কুরের মতো তুমি — যাহা ঝরিয়াছে

আবার ফুটাও তারে! তুমি ঢেউ — হাওয়ার মতন!

আগুনের মতো তুমি আসিয়াছ অন্তরের কাছে!

আশার ঠোঁটের মতো নিরাশার ভিজে চোখ চুমি

আমার বুকের পরে মুখ রেখে ঘুমায়েছ তুমি!



জীবন হয়েছে এক প্রার্থনার গানের মতন

তুমি আছ বলে প্রেম, গানের ছন্দের মতো মন

আলো আর অন্ধকারে দুলে ওঠে তুমি আছ বলে!

হৃদয় গন্ধের মতো — হৃদয় ধুপের মতো জ্ব’লে

ধোঁয়ার চামর তুলে তোমারে যে করিছে ব্যজন।

ওগো প্রেম, বাতাসের মতো যেইদিকে যাও চলে

আমারে উড়ায়ে লও আগুনের মতন তখন!

আমি শেষ হব শুধু, ওগো প্রেম, তুমি শেষ হলে!

তুমি যদি বেঁচে থাক, — জেগে রব আমি এই পৃথিবীর পর —

যদিও বুকের পরে রবে মৃত্যু — মৃত্যুর কবর!



তবুও সিন্ধুর জল — সিন্ধুর ঢেউয়ের মতো বয়ে

তুমি চলে যাও প্রেম — একবার বর্তমান হয়ে —

তারপর, আমাদের ফেলে দাও পিছনে — অতীতে —

স্মৃতির হাড়ের মাঠে — কার্তিকের শীতে!

অগ্রসর হয়ে তুমি চলিতেছ ভবিষ্যৎ লয়ে —

আজও যারে দেখ নাই তাহারে তোমার চুমো দিতে

চলে যাও! — দেহের ছায়ার মতো তুমি যাও রয়ে —

আমরা ধরেছি ছায়া — প্রেমের তো পারি নি ধরিতে!

ধ্বনি চলে গেছে দূরে — প্রতিধ্বনি পিছে পড়ে আছে —

আমরা এসেছি সব — আমরা এসেছি তার কাছে!



একদিন — একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা!

এক রাত — এক দিন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা

এক দিন — এক রাত তারপর প্রেম গেছে চলে —

সবাই চলিয়া যায় সকলের যেতে হয় বলে

তাহারও ফুরাল রাত! তাড়াতাড়ি পড়ে গেল বেলা

প্রেমেরর ও যে! — এক রাত আর এক দিন সাঙ্গ হলে

পশ্চিমের মেঘে আলো এক দিন হয়েছে সোনেলা!

আকাশে পুবের মেঘে রামধনু গিয়েছিল জ্বলে

এক দিন রয় না কিছুই তবু — সব শেষ হয় —

সময়ের আগে তাই কেটে গেল প্রেমের সময়;



এক দিন এক রাত প্রেমেরে পেয়েছি তবু কাছে!

আকাশ চলেছে তার — আগে আগে প্রেম চলিয়াছে!

সকলের ঘুম আছে — ঘুমের মতন মৃত্যু বুকে

সকলের, নক্ষত্রও ঝরে যায় মনের অসুখে

প্রেমের পায়ের শব্দ তবুও আকাশে বেঁচে আছে!

সকল ভুলের মাঝে যায় নাই কেউ ভুলে — চুকে

হে প্রেম তোমারে! — মৃতেরা আবার জাগিয়াছে!

যে ব্যথা মুছিতে এসে পৃথিবীর মানুষের মুখে

আরো ব্যথা — বিহ্বলতা তুমি এসে দিয়ে গেলে তারে —

ওগো প্রেম, সেই সব ভুলে গিয়ে কে ঘুমাতে পারে

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.