![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
৫:৩৭টা বাজে। গত পাঁচ মিনিটে তিনবার ঘরি দেখলাম। এমন কখনো হয় না। মনে হতে পারে আমার মন অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু না, মন শান্ত।
বসে আছি একটা ছোট্ট পার্কে। প্রতিদিন বিকালে এসে এখানে বসি। বাচ্চারা খেলে, বড়রা আড্ডা দেয়; দেখতে ভালই লাগে। প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকি। অধিকাংশ সময় খুব মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখি। আজকে কেন যেন দেখতে ইচ্ছা করছে না। আকাশটা পরিষ্কার। দক্ষিন-পূর্ব দিকে পাজা তুলার মত মেঘ। তার উপর সূর্যের আলো পড়ে ঝিকমিক করছে। এই দৃশ্য শুধু বিকালেই দেখা যায়। আচ্ছা সকালে দেখা যায় না কেন? হয়ত দেখা যায়, আমি কখনো দেখি নাই।
পার্কে যেই বেঞ্চিতে বসে আছি তার পিছন থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে। আমার ঠিক পিছনে সেই রাস্তার সাথে এসে একটা গলি মিশেছে।
হঠাৎ খিলখিল শব্দে হাসির শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম। গলিটা সামান্য অন্ধকার। সন্ধ্যা হয়ে আসায় গলির ভিতরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। একটা মেয়ে হেটে বের হলো। চেহারা থেকে এখনো হাসিটা মুছে যায় নি। আমি বেঞ্চের একপাশে বসা ছিলাম। মেয়েটা অন্যপাশে এসে বসলো। মিষ্টি একটা মেয়ে। বয়স হয়ত ১১/১২ বছর।
আমি আকাশ দেখা বাদ দিয়ে মেয়েটাকে দেখছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এই সময় তো সবাই ঘরের দিকে যাবে! মেয়েটা এখন কোথা থেকে আসলো!
আশেপাশে তাকালাম; মেয়েটির সাথে কেউ নেই। আমি যখন উঠে চলে আসবো তখন হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটা খুব নিচু স্বরে কথা বলছে আর মিটিমিটি হাসছে। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। ছোটবেলা আমিও এমন একা একা কথা বলতাম। মুচকি হেসে চলে আসলাম।
২
শুক্রবার।
ছুটির দিনে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে আসে বেশি। পুরো পার্কটা হৈইহুল্লোড়ে ভরে থাকে। আমার কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। আড়চোখে তাকিয়ে আছি আমার পাশে বসা মেয়েটির দিকে। গত পাঁচদিন ধরে এই কাজটাই করছি। পার্কে বসে অপেক্ষায় থাকি কখন মেয়েটা আসবে! মেয়েটার একটা নামও দিয়েছি।
মিষ্টি।
এমন চমৎকার একটা মেয়ের সাথে এই নামটাই মনে হয় ভাল মানায়। নামটা ওকে জিজ্ঞাস করলেই পারতাম। কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকে যে, বিরক্ত করতে ইচ্ছা করে না। গত কয়েকদিন ধরে আমি যে ওকে লক্ষ করছি সেদিকে তার খেয়ালই নেই। কখনো আমারদিকে তাকায় না।
শুধু আমার দিকে কেন, কোনোদিকেই তাকায় না। হাতদুটো কোলের উপর রেখে সেই হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে আর নিচু স্বরে কথা বলে। প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়ত নিজের মনে কথা বলে। পরে খেয়াল করে দেখলাম নিজের সাথে না, অন্য কারো সাথে কথা বলে।
ছোট বাচ্চারা এটা করে। নিজের মনে কথা বলার সাথী বানিয়ে নেয়। মেয়েটার পরিবার মনে হয় সময় দেয় না। গত এক সপ্তাহে তো বাবা-মা কাওকে দেখলাম না। হয়ত দুজনেই চাকড়ি করে। মানুষ শুধু টাকার পিছনে ছোটে। ভাবতে ভাবতে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম।
মেয়েটা আমার দিকে তাকালো। চোখ দুটো আষ্চার্য রকম ঠান্ডা। দেখলে মনে হয় মগজ ভেদ করে আমার মনের কথা সব পড়ে ফেলছে।
কিন্তু এরকম তো সাধারনত বড়দের হয়। কিছু অভিজ্ঞ মানুষ থাকে যারা মানুষ দেখেই ভিতর বলে দিতে পারে। এগুলো অনেকদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু এই ছোট্ট মেয়ের চোখে এমন চাহনি দেখে নিজের অজান্তেই শিউড়ে উঠলাম।
- তুমি আমাকে ফলো করো কেন?
আমি আবার কিছুক্ষণের জন্য অবাক হলাম। শীতল একটা কন্ঠস্বর।
- নাতো! আমিতো প্রতিদিন এখানে বসে থাকি।
- হ্যা, কিন্তু কয়েকদিন ধরে আমাকে ফলো করছো।
- যাহ বোকা, আমি এখানে একটু হাওয়া খেতে আসি।
- (রেগে উঠে) মিষ্টি আমাকে বলেছে তুমি আমাকে ফলো করো।
এবার আমার আরও চমকানোর পালা।
- মিষ্টি কে?
- মিষ্টিকে তুমি চিনবে না। মিষ্টি তোমাকে চেনে।
- (একটু হেসে) তাই নাকি? তো কিভাবে চেনে?
- মিষ্টি সব জানে। তুমি কি ভাব তাও মিষ্টি জানে।
- তাহলে তো মিষ্টির সাথে একটু কথা বলতে হয়। আমি কি ভাবছি একটু জানা দরকার।
- হাসছো তাই না? মিষ্টি আমাকে সব বলেছে। তোমার বাসা আমি চিনি। ১৪/১৪ তাজমহল রোড, সি-ব্লক।
কপাল ঘামতে শুরু করলো হঠাৎ করে। গলা শুখিয়ে আসছে।
- (কাঁপা গলায়) আর কি জানে মিষ্টি?
- তুমি যা জানো না তাও জানে। তুমি যে আমার নাম মিষ্টি রেখেছো এটা তুমি নিজের ইচ্ছায় রাখো নি। মিষ্টি তোমাকে বলেছে তাই রেখেছো।
হঠাৎ দেখি চারিদিকে আবছা অন্ধকার। মাঠ ফাকা। কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে বুঝতেই পারি নাই। পাশে তাকিয়ে দেখলাম মিষ্টি বসে নেই, বেঞ্চে ছেড়ে হাটতে শুরু করেছে রাস্তার দিকে। কি চমৎকার হাটা! একটা বাচ্চা মেয়ে হেটে যাচ্ছে।
আর দেরি করলাম না, বাসার দিকে হাটা শুরু করলাম। হঠাৎ অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। মনে হচ্ছে কেউ আমার পিছনে। নাহ, কেউ নেই। তারপরেও অস্বস্তি যাচ্ছে না। অন্ধকার রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার একই রকম অস্বস্তি। এবার আর পিছনে না, মনে হচ্ছে আমার পাশেই হাটছে। প্রচন্ড ভয় পেলাম।
দৌড়াতে শুরু করলাম।
সামনে বাসা দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি দৌড়াচ্ছি কিন্তু দৌড়ানোর কোনো শব্দ পাচ্ছি না। যখনই অবাক হয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকালাম তখন দেখি আমার পায়ের পাশেই একজোড়া পা একইভাবে দৌড়াচ্ছে।
সাথে সাথে জ্ঞান হারালাম।
৩
চমৎকার একটা অনুভূতি হচ্ছে। নিজের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছু অনুভব করছি না। শুধু আমি, আর কিছু নাই। চোখ মেলতে চাইলাম, পারলাম না। মাথাও নাড়তে পারছি না। বুঝতে পারলাম না কি হচ্ছে। নিজের অস্তিত্ব অনুভব করছি কিন্তু হাত-পা-মাথা অনুভব করছি না। চমৎকার অনুভূতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রচন্ড আতঙ্ক বাসা বাধছে। আমার হাত নাই, পা নাই, চোখ নাই।
আমি নাই।
আমার শরীরের কোনো অস্তিত্ব নেই।
কিন্তু আমার আছে। বিচিত্র এক অনুভূতি। আতঙ্ক ক্রমে বেড়েই চলেছে। আমার চারিদিকে শুন্যতা।
ভয়াবহ শুন্যতা।
চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না।
একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। আমার তো নাক নেই, কিভাবে গন্ধ পেলাম!!!
নাহ গন্ধটা নাকে পাইনি, অনুভব করছি।
গন্ধটা কেমন?
মিষ্টি।
হ্যা, মিষ্টি।
ধীরেধীরে তীব্র হচ্ছে।
শুনতে পাচ্ছি, "ভয় নাই। আমি আছি"
সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে।
"ভয় নাই, আমি আছি"
আতঙ্ক কেটে যাচ্ছে।
আমার আর কোনো চিন্তা নাই। সে আছে।
৪
পার্কের বেঞ্চে বসে আছি। বাচ্চারা খেলা করছে, সেদিকে খেয়াল নেই নিজের মত বসে আছি।
একটা বল এসে পায়ে লাগলো। ১৩/১৪ বছরের একটা ছেলে বল নিতে আসলো।
- ভাইয়া, বলটা দিবেন!
আমি তাকিয়ে থাকলাম। ছেলেটা বল নিয়ে চলে গেলো।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, খেলা শেষ। ছেলেটা এসে পাশে বসলো। ছেলেটার সাথে কখনো কথা হয় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি এর নাম জানি।
"নিলয়"
- ভাইয়া, আপনাকে অনেক মিষ্টি দেখাচ্ছে।
অামি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।
মিষ্টিও আমার সাথে হাসছে।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫২
ডা. অমিতাভ অরণ্য বলেছেন: অসাধারণ!