![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিলুপ্তি
আকতার হাফিজ
মানুষের মন সম্পূর্ন জীবনে পাহাড় পরিমান সুখের মধ্যে থাকিয়া , বহু আনন্দ আর স্ফূ্র্তি উপভোগ করিয়া ও ক্লান্ত হয় না ।অথচ সামান্য দঃখ-যন্ত্রনার আঘাতে ক্লান্ত হইয়া একেবারে বিষাদগ্রস্থ হইয়া পড়ে, জীবনকে অর্থহীন ভাবে, এমনকি মরিবার ইচ্ছা পোষন করে ।বাঁচিয়া থাকিলেও নিতান্ত অবজ্ঞা ভরে , নিঃসঙ্গ, উদাস আর বিষন্ন জীবন যাপন করে । এই ভাবে মনকে হীন আর দূর্বল করিয়া ফেলে যে তখন সন্মূখে অগ্রগামী হইবার শক্তি থাকে না ; নিস্তেজ , নিশ্চল জড় পিন্ডের ন্যায় পথের পাশে পড়িয়া থাকে ।হঠাৎ যদি চৈতন্যদয় হয় তবে উঠিয়া দঁাড়াইতে চায়, দঁাড়াইবার চেস্টা করে , মনকে প্রবোদ দেয় ।তবুও মন নেতিয়ে পড়ে বৃক্ষের কচি পাতার ন্যায় ।হয়তো তখন নেতিয়ে পড়া মন কে একটু সতেজ আর সামর্থবান করিয়া তুলিতে কিছু অপথ্য গ্রহন করিয়া থাকে-এমন কি কোটি টাকার হেরোইন ও দু’টাকার সিগারেট কিংবা দু’পয়্সার বিড়ি ।
মনুষ্য মনের এইরুপ প্রবৃত্তি কে অনি বরাবর ই ঘৃণা করিত ।এখন ও ঘৃণা করে, তবে তফাৎ এটুকু তখন ঘৃনা করিয়া বিরত থাকিত , আর বর্তমানে তার দাসত্ব করিতেছে ।দাসত্ব-ই বটে । দাস যেমন তাহার মনিবের শত অত্যাচার ,গঞ্জনা ভোগ করিয়াও ছাড়িয়া যায় না , যাইতে পারে না তে সিগারেটের সহস্র ক্ষতিকর কাজের নমুনা দেখিয়া, মনে প্রানে ঘৃনা করিয়া ও তাকে ছাড়িতে পারেনা । অদ্ভূত ক্ষমতা সিগারেটের !
হ ! অদ্ভুত ক্ষমতা-ই তো । এক অদ্ভুত ক্ষমতায় অন্তরের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রনা দূর করিয়া হৃদয়ে প্রশান্তি আনিয়া দেয় ।
সেই যে দিন রেনু ওর প্রেম প্রত্যাখান করিয়াছিল –ফিরাইয়া দিয়াছিল সেই দিন সিগারেট ধরিয়ছিল অনি ।হৃদয়ের যন্ত্রনা দুর করিতে ,দুঃখ ভুলিতে । ভুলিয়াছে ও ।
না, কথা সত্য নয় । ভুলিলে এই নির্জনে কেন কাঁদিবে অনি ?
দু’টাকার সিগারেট । কি-ইবা ক্ষমতা তার –দুঃ খের মতন মহান আর বিরাট শক্তি কে চিরতরে হটাইতে পারে । পারে বৈকি –সামান্য ক্ষনের জন্য । ক্ষমতা শেষ হইলেই যন্ত্রনা গুলি আসিয়া আবার হানা দেয় । এক অদ্ভুত অসহ্য ক্লান্তিতে হৃদন- মন কে অবসাদ গ্রস্থ করিয়া তোলে, সমস্ত শক্তি ধ্বংস করিয়া দেয় ।তবুও কিছু ক্ষমতা আছে বলিতে হয়-যার বলে মানুষ কে নেশা গ্রস্থ করে , মনুষ্যত্ব কে পরাজিত করে ।
হ্যাঁ মনুষ্যত্বের পরাজয় বটে ।
স্রষ্টার সেরা সৃস্টি মানুষ , যাহাকে মনুষত্বের মত অমুল্য বস্তু দান করিয়াছেন স্রষ্টা , সমস্ত কিছু করিবার ও বুঝিবার শক্তি দিয়েছেন ।সেই মানুষ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ভুলিয়া দুঃখ ভুলিতে অতি সামন্য ,ক্ষুদ্র সিগারেটের আশ্রয় নেয় । অথচ দুঃখ হচ্ছে সেই অনুভুতি যাহাকে মানিয়া লইতে পারিলে নী্রব আত্ম –তৃপ্তি পাওয়া যায়,বেচেঁ থাকায় সার্থকতা আসে ।
অথচ মানুষ দুঃখের ক্ষনিকের যন্ত্রনা সহ্য করিতে না পারিয়া দু’পয়্সার বিড়ির আগুনে ধ্বংস করিয়া দেয় । ইহা মনুষ্যত্বের বিরাট অবমাননা ,বড় কদর্য ।
অনি ইহা বাল্য কাল হইতে মনে প্রানে বিশ্বাস করিত । তাই সিগারেট এ অভ্যস্ত বন্ধু রা যখন স্বগর্বে সিগা্রেটের বহুবিদ গুনাগুন এবং সেই সব গুন হইতে তাহাদের প্রাপ্ত উপকার বর্ণনা করিত তখন অনি নিজের তৈরী এইরুপ যুক্তি প্রদর্শণ করিত । মনূষ্যত্ব কে সবার ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিত- মানুষ আর মনুষ্যত্বের জয়গান করিত ।
সিগারেটের অদ্ভুত ক্ষমতার বিষয় টি অনি এখন আর অস্বীকার করিতে পারে না । তাই আজ ক্ষমতা র কথা বলিতে ও লজ্জা নাই অনির । সিগারেটের অপর একটি ক্ষমতার পরিচয় ও অনি পাইয়াছে ।
সে পূর্বের কথা , সিগারেট খাওয়া শুরু করিবার ও দুই বছর পূর্বের । বন্ধু মহলে যাতে স্বদম্ভে বলিয়া বেড়াইতে পারে যে,- ‘আমি সিগারেট খাইনা’ সেই জন্য অনি তখন সিগারেটের ধারে কাছে ঘেঁষিত না । ঐ সময় একদিন অনিদের বাড়ীতে একজন মেহমান আসিল । সম্পর্কে অনির নানা । ভদ্র লোকের খুব সিগারেটের অভ্যাস ছিল ।রাতে অনির বিছানায় শুইতে দিয়াছিল তাহাকে ।
সেই রাতে অনি এত টুকু ঘুমাইতে পারিইয়াছিল কিনা বলিতে পারিব না । খানিক বাদে বাদে যখন ই অনির ঘুম ভাঙ্গিয়া যাইত দেখিত ঘর ভরিয়া আছে ধুয়ায় ।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হইতে ছিল অনির ।
সকাল বেলা দেখিল , টেবিলের কোণে পুরাতন খাতার স্তুপের পাশে নানার সিগারেটের প্যাকেটটা পড়িয়া আছে । খুলিয়া দেখিল একটা সিগারেট অবশিষ্ট আছে । সিগারেট খাইবে এই রুপ ইচছা কেন জানি অনির মনে জাগিয়া উঠিল । কিন্তু কেহ দেখিয়া ফেলিবে এই ভয়ে খাইল না – রাত্রে খাইবে এই ভাবিয়া লুকাইয়া রাখিল ।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে সকলে ঘুমাইয়া পড়িলে সিগারট বাহির করিল ।ম্যাচ টেবিলেই ছিল । সিগারেটে আগুন ধরাইয়া দু’ আংগুলে চাপিয়া ঠোঁটের উপর রাখিতে ই অনির সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলিয়া গেল ।
অনুভুতি টা সঠিক ব্যাখ্যা করিতে পারিবে না অনি ।শরীরের কোন এক স্থান হইতে একটা শিরশিরে অনুভুতি উৎপত্তি হইয়া সমস্ত শরীর ঘুরিয়া একেবারে মস্তিস্কে গিয়ে স্থির হয় ; আবার মস্তিস্ক হইতে সারা শরীরে ছড়াইয়া পড়ে ।যখন মস্তিস্কে গিয়ে স্তির হয় তখন অনির খুব ভাল লাগে –ভাল লাগায় চোখ দ’টি বুজিয়া আসে ।নিরবে চোখ বুজিয়া সেই সুখ টুকু কিছু ক্ষণ অনুভব করে অনি ।অনি ওর ভেতরে জন্ম নেয়া পৌরুষত্বকে এই প্রথম উপলব্ধি করিল ;যৌবনের উত্তপ্ত উন্মাদনা এই প্রথম আবিস্কার করিল । মুহুর্তে অনির মন নষ্ট জগতের দড়জায় দড়জায় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল ।কোন এক ছলনায় সহপাঠিনী অনির চিবুক ধরিয়াছিল ;সলিমের অল্পবয়স্ক বৌ-এর দুর্বোধ্য ,ঈংগিত পুর্ণ আচরণ, ভেজা কাপড়ে প্রতিবেশির নতুন বৌ-র সৌষ্ঠব বুক ,মেদযুক্ত নাভিদেশ ইত্যাদি কতকগুলি খারাপ ছবি অনির হৃদয় পটে ভাসিয়া উঠিতেছিল ।
সেই দিন অনি সিগারেটে টান দেয় নাই ।না দিক, দিলে কি হইত ? হয়ত যৌবনের উত্তাপে ওর পৌরুষত্ব আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভার ন্যায় উথাল-পাথাল করিত উদ্গী্রনের জন্যে । ওষ্ঠে স্পর্শ করাইয়া ও অনি কি কারণে সিগারেটে টান দেয় নাই তা স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিব না । তবে বন্ধু মহলে ওর মর্যাদা ক্ষুন্ন হইবে-নিশ্চ য় সে কারনে নয় ।বরং নিজের যুক্তিতে তৈরী করা আদর্শ ভুলুষ্ঠিত হইবে ,মনুষ্যত্বের পরাজয় হইবে –এই ভয়ে ।
কিন্তু কি হইল আদর্শ লালন করিয়া ?
অনি আজ পরাজিত ,লজ্জিত । এ পরাজয় রেনু দিয়েছে ।
তবু এ পরাজয় নিয়েই বাঁচিবে । শুধু রেনু কে পাইলে । হ ! লজ্জিত অনি । রেনু ওর ভালবাসা গ্রহন করে নাই – বড় লজ্জার কথা বটে ।
সেই দিনের মেয়ে রেনু । দেখিতে দেখিতে বড় হইল ।আকস্মাৎ সৌন্দর্য ওর সমস্ত শরীরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ।
বড় নোংরা ছিল রেণু ছোট সময়ে । নাকে সর্বক্ষণ সর্দি লাগিয়া থাকিত ।কান ফুঁটা করিবার পর দগদগে ঘাঁ হইয়াছিল রেণুর কানে । দেখিলে ঘৃণা ধরিয়া যাইত ।
সেই দিন অনি কি জানিত এই রেণুর জন্যেই ওকে একদিন যন্ত্রায় পু ড়িতে হইবে ? তেমন কি-ইবা রুপ রেণুর । শ্যামলা মেয়ে রেণু ।
তুবুও অনি চোখ ফেরাইতে পারে না অনি ।মুখের টানটান ত্বকে কি দিপ্তি ! কালো দুইটি চোখে কী গভী্রতা ! ঠোঁট দুইটি মোটা পুরু রেণুর । রেণুর দীর্ঘ চুল গুলি হাটু অবধি আসিয়া পরিয়াছে । যেদিন সাবানে চুল পরিস্কার করিয়া , রোদে শুকাইয়া , ঠোঁটে গাঢ় রং লাগাইয়া আলগা চুলে রেণু গ্রামে ঘুরিয়া বেরায় ; অনি মাঝে মাঝে দেবী-ই ভাবিয়া বসে ।যেন দেবী স্বরসতী ।
হ ! পূজা উৎসবে দেবীর প্রতিমার সাথে রেণুর চেহারা বহু বার মিলাইয়াছে অনি ।
তাইত রেণু কে দিবার জন্য অনি যে চিঠি খানা লিখিয়াছিল সেখানে দেবী বলিয়া ই সম্মধন করিয়াছিল –
দেবী,
“ অনেক ভাবিয়া দেবী সম্মধন ই স্থির করিলাম । কেননা ,নারী সৌন্দর্যে্র পূজা করা পৌরুষত্বের ধর্ম । সেই অর্থে নারী আরাধনার বস্তু । আর আরাধনার বস্তু কে দেবী কিংবা দেবতা জ্ঞান করাই কর্তব্য ।
যৌবনের প্রারম্ভে একটা প্রত্যাশা হৃদয়ে বাসা বাঁধিয়াছে – তোমাকে হৃদয় মন্দিরে স্থাপন করিয়া , শুধু আমি সেই নির্জন মন্দিরে একাকি তোমার আরাধনা করিব । তাইতো গোপনে তোমার মমতাময়ী মুখের একখানা ছবি হৃদয়ে আকিঁয়া –তাহার ই আরাধনা করিয়া চলিয়াছি । আমার আরাধনা কবুল করিয়া সান্নিধ্য লাভে ধন্য করিও । “
পত্র খানা সেই দিন রেণু নেয় নাই । কেন নিলেনা জিজ্ঞয়াসাও করে নাই অনি । দেড় বছরে একবার ও রেণুর সাথে কথা হয় নাই ।অনি বহুবার চেষ্টা করিয়াছে । কিন্তু ওকে দেখিলেই রেণু আড়ালে ছুটিয়া পালাইতো ।
পত্রখানা পকেটেই ছিল অনির । এত দিনে কালি মুছিয়া অস্পস্ট হইয়া গিয়াছে লেখা । ভাঁজ খুলিয়া একবার দেখিল ; তারপর ছিঁড়িয়া ফেলিলো –কি হইবে রাখিয়া ।
আজ রেণুর বিয়ে ; আর অনির সর্বোনাশ ,অনির মৃত্যু ।
কাগজের টুকরো গুলো পুকুরের জলে ছুড়িয়া ,উঠিয়া দাঁড়াইয়া অনি একটা সিগারেট ধরাইলো । আকাশে চৈত্রের পূর্ণ চাঁদ উঠিয়াছিল ।পুকুরের জলে চাঁদের আলো ঝলমল করিতেছে ।কাগজের টুকরো গুলো তখনও জলে ডুবিয়া যায় নাই । চাঁদের আলোতে চকচক করিতেছে ।
জোড় টানে একগাল ধুঁয়া টানিয়া অতপর উর্ধ্বে ছুড়িয়া অনি অনেক ক্ষণ ধরিয়া চাঁদ নিরিক্ষণ করিতে লাগিল ।
বিলুপ্তি
আক্তার হাফিজ
২৬,এপ্রিল ২০০২
প্রসঙ্গতঃ নামকরনের ক্ষেত্রে একটু সমস্যায় পরিয়াছিলাম ।প্রথমে স্থির করিয়াছিলাম ‘মৃত্যু’ রাখিব । ইহাতে অনির ভালবাসার সাথে মানুষের মনুষ্যত্বে্র যে অবক্ষয় ইদানিং লক্ষ করা যাইতেছে ,তার প্রতিনিধিত্ব করিত। বিলুপ্তি নাম ঐ এক ই বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করিবে ।বরং এতে অনির ভালোবাসার মৃত্যু্র বিষয় টি অপেক্ষাকৃ্ত কম বিবেচনা করা হইয়াছে । তার চেয়ে বর্তমানে মনুষ্যত্ব আর মানবিকতা যে ধী্রে ধী্রে বিলুপ্তি হইতেছে তার-ই প্রতি বেশি গুরুত্ব পাইবে । আমার উদ্দেশ্য –ও ইহা ।
আকতার হাফিজ
০৫.০৫.২০০২
©somewhere in net ltd.