![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাপ
আকতার হাফিজ
দেশে ভয়াবহ বন্যা উপস্থিত ।সারা দেশ ভাসিয়া গিয়াছে বানে । গ্রাম কে গ্রাম ধু –ধু করিতেছে শুধু পানি আর পানি ।মানুষের ঘরের চালায় পানি উঠিয়াছে । স্রো্তের তোড়ে ছিন্ন খড় হইয়া ভাসিয়া যাইতেছে ঘরের চালা ও বেড়া ।গ্রাম গুলির অবস্থা এমন হইয়াছে যে দেখিয়া মনেই হয় না সেইখানে একদিন লোকালয় ছিল । কোথাও কোথাও দু’ একটা কলাগাছ কিংবা বাঁশের ঝাড়ের ডগা গলা জাগাইয়া সেই লোকালয়ের অস্থিস্ত ঘোষনা করিতেছে ।মাঠ গুলির দিকে তাকাইলে মনে হয় যেন প্রবাহ মান মহাসমুদ্র ।
এই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে স্বগৌ্রবে মাথা উঁচু করিয়া শহর রক্ষয়া করিতেছে শুধু সুউচ্চ বেড়ী বাঁধ । ইহাই হইতেছে বন্যা বিতারিত গ্রাম বাসী্র একমাত্র আশ্র য় স্থল । দু’পাশের দু’দশ খানা গ্রামের সমস্ত লোক গরু –ছাগল, হাঁস-মুড়গী লইয়া ইহার উপর আশ্রয় লইয়াছে ।কোথাও তিল ধারনের জায়গা নাই টুকু নাই । কেহ কেহ বাঁধের মাটিতে জায়গা না পাইয়া আপন আপন নৌকায় স্ব্পরিবারে জলে ভাসিতেছে । দু’একজন যাহারা বাঁধে আশ্রয় লওয়া নেহায়েৎ অসম্মান বোধ করিতেছে তাহারা গরু –ছাগল বাঁধে রাখিয়া নিজেরা উঁচু বাশেঁ মাথায় মাঁচা পাতিয়া তার উপরেই দি কাটাইতেছে ।
এই নৈ্সর্গিক বিপদে মানুষ আর গৃহ পালিত পশু পাখিদের সাথে বন্য প্রানি দের ও জীবনাশংকা দেখা দিয়াছে । তাহারা জীবন বাঁচাইতে মানুষের ঘরের মাচাঁ, খড়ের গাদা কিংবা শস্য রাখিবার কলসির মধ্যে আশ্রয় লইইয়াছে ।গ্রাম বাসী্রাও এই সুযোগে শিয়াল,খাটশ আর বন বিড়াল মারিয়া ছাপ করিতেছে । দু’একটা বিশাল আকৃতির গোখড়া কিংবা দাড়াস মারার খবর ও আসিতেছে এই গ্রাম সেই গ্রাম হইতে ।
বন্যা পীড়ত দেশ বাসীর এই দুর্দশায় সরকার বহুবিদ সাহায্য পাঠাইতেছে । সাথে সাথে দেশ হিতৈষী পরহিত ব্রতী বিভিন্ন সংঘ এবং ব্যক্তি বর্গরাও সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দিয়াছে রান্না করা খাদ্য হইতে শুরু করিয়া চাল,ডা্ল , লবণ, এবং বিশুদ্ধ পানি সহ ঔষুধ পত্র সমস্তই দুস্থ দের মাঝে বিতরন করা হইতেছে । সরকার বিভিন্ন স্থানে লংগর খানা খুলিয়া বন্যা পীড়িত লোকদের থাকার এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছে । আবার অনেক মহৎ প্রাণ সংঘ থাকিরার জন্য অস্থায়ী ঘর দিতেছে ।এ প্রসংগে একটা কথা বলিয়া রাখি –এত সব দানের পেছনে দাতেদের উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন বন্টন কর্তা গন প্রকৃত দাতাদের নাম মুছিয়া আপন আপন নাম ব্যবহার করিয়া ভবিষ্যৎ জন প্রতিনিধিত্বের পথ সুপ্রসস্থ করিতেছে –ইহাতে সংশয় নাই ।প্রচার মাধ্যম গুলি তাহাদের অধিকাংশ সময় ও শ্রম ব্যয় করিতেছে বন্যর্ত মানুষের করুণ কাহিনী বর্ননা করিয়া ।কল্পনা বিলাস সংবাদ পত্র সম্পাদকের কলমের ডগা ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতেছে দঃখী জনের দুঃখ বর্ননায় ।
আজ প্রায় এক মাস হইল ওসমান ব্যাপারি ভিটে ছাড়া । বন্যা বিতারিত হইয়া অন্য সকলের মত সেও স্ব্পরিবারে বাঁধে আশ্রয় লইয়াছে । একখানি মাত্র টিনে র চালার নিচে একপাশে চার টি গরু –ভেড়া অপর পাশে তিনটি ছেলে মেয়ে নিয়ে জড়োসড়ো হইয়া থাকিতেছে । ভিটয়ায় একখানা দু’চালা ঘর আছে ওসমানের ।এবার ভাংগিয়া আবার তুলতে অনেক বেশি খরচ হইবে –এই ভাবিয়া ওসমান ঘর খানা আনেনাই ।
এক সময় ওসমানের অবস্থা মুটামুটি ভালই ছিল ।জোত জমি যা ছিল তাতে যে ফসল ফলিত ছেলে মেয়ে নিয়ে বেশ আনন্দেই বছর কাটিত । গত কয়েক বছরের নদী ভাঙ্গনে সব গিয়েছে ।শুধু মাত্র ঘর খানা নিয়ে নদী্র অপর পাড়ে দাঁড় করাইয়াছিল ।অন্যের জমি বর্গা করিয়া আর জনমুজুরী খাটিয়া সুখে -দুঃখে দিন কাটিয়া যাইতে ছিল। আবার ছোবল হানল সর্বো্নাশা বন্যা । বন্যায় উঠতি ফসলের ক্ষতি হওয়ায় ওসমান তা ঘরে তুলিতে পারে নাই ।এখন ত্রান কর্মীদের দয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাইতেছে ।
মাঝে মাঝে ই নৌকা করিয়া ফেলে আসা ঘর খানা দেখিয়া আসে ওসমান ।একবার ঘর দেখিতে গিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া ওসমান আতংকিত হইয়া গেল । চিৎকার শুনিয়া আশে পাশের দু’একজন লোক ছুটিয়া আসিল । এমনি করিয়া ব্যাপারটা দূর গ্রাম পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িলো ।
লোকজ়ন আসিয়া যা দেখিলো তাতে তাহারেও ‘বাপারে বাপ’ ডাক ছাড়িলো । মস্ত বড় এক সাপ ঘরের ঢালার ফোকড়ের মধ্যে ঢুকিয়া এই মাথা ঐ মাথা জুড়িয়া বসিয়া আছে ।
উপস্থিত সকলেই সাপ টাকে চিনিতে ব্যর্থ হইলো । ফোস-ফাস গর্জন শুনিয়া একজন বলিলো গোখড়া , অন্য জন বলিল দাড়াস । কিন্তু তৃ্তীয় জনের যুক্তি তে কোন টাই টিকিলো না । কারণ গোখড়া কিংবা দাড়াস কোন টাই এত বড় হয়না ।সব শেষে ইহাই জন সম্মতি পাইল যে , উহা পাহাড় হইতে নামিয়া আসা কোন সাপ যা সচরাচর সমতলে দেখা যায় না । গ্রামের বৃ্দ্ধ বললো, তাহার বয়সে সে নাকি এত বড় সাপ দেখেন নাই ।
এই রুপ বহুবিদ বাকবিতন্ডার পর কিভাবে উহাকে মারা হইবে সে উপায় উৎঘাটনে সকলে ভাবিতে লাগিল। কেহ কেহ বল্লম, জুতি ,টেটা ইত্যাদি দিয়ে পেটে খোচা মারিয়া বিধিয়ে ফেলতে পরামর্শ দিল । কিন্তু আসন্ন বিপদের বিপদাশংকায় কেহ ই তা করিতে সাহস করিল না । কে একজন সদুপদেশ দিয়ে পুলিশে খবর দিতে বলিল ; তাহারা নাকি দূর হইতে গুলি ছুড়িয়া উহার পেট ফুটা করিয়া দিবে । এই রুপ ফন্দি ফিকির শুনিয়া অবলা জীব টা হয়তো অধঃমুখে অশ্রু বিসর্জন করিতেছে ।কিন্তু উহার হিংস্রতার কথা ভাবিয়া উহাকে প্রশ্রয় দেয়ার কথা কেহ ভাবিতে পারিল না ।
এতক্ষণ চুপ থাকিয়া গৃহকর্তা ওসমান যা বলিল তাতে সকলে নিরুৎসাহিত হইলো । ওসমান বলিল, দাদারা পোকা মাকড় মারনের কাম নাই
,ও তো আমাগো কোন ক্ষতি করেনাই । ব্যাডায় বিপদে পড়ছে , এই সুমায় ওর সর্বোনাশ করা আমাগো বালো অইবো না ।কথা গুলো বলিবার সময় ওসমানের চোখে –মুখে একটা ভয়ের ছাপ ফুটিয়া উঠিলো । ওসমানের ধারনা জন্তু টা কোন স্বর্গীয় দেবতা । পরম শক্তি শালী ।ইচ্ছা করিলেই বড় ধরণের অনিষ্ট করিতে পারে । পাছে অতি আদরের বউ ছেলে মেয়ে হারাইতে হয় ।
ওসমানের কথা শুনিয়া উপস্থিত লোকজন ভাবিল , কথা মন্দ নয় – অযথা উহার ক্ষতি করিয়া লাভ কি ? বেচারা বিপদে পড়িয়া আশ্রয় লইয়াছে । একে একে লোকজন চলিয়া গেলো । বহু দুরের লোকজন ও নৌকা করিয়া জন্তু টাকে দেখিতে আসে । ভয়ংকর জন্তু টাকে দেখিয়া মনে আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরিয়া আসে ।
মাস দু’এক এর মধ্যে জল নামিয়া গেল । অধিবাসিদের ভিটা মাটি জাগিয়া ঊঠিলো । শষ্যের মাঠ বুক ঠেলিয়া উঠিলো। নদীর চরার বালি আবার চিক চিক করিয়া উঠিলো । বন্যা এখন অতীতের গল্পের মতন কৃ্ষকের চোখে ভাসে ।কেবল ভাঙ্গা সড়ক আর ব্রীজ গুলো সর্বো্নাশা বন্যার সাক্ষী হইয়া দাঁড়াইয়া আছে । লোকজন ফিরিয়া যাইতেছে আপন আপন গৃহে – নতুন করিয়া ঘর সাজাইতে ; মাঠে শষ্য ছড়াইতে । বন্যা তাহাদের কে নিরাশ করিতে পারে নাই ।
ওসমান ও ফিরিয়া আসে ঘরে ।বানের পানির সাথে ভয়ং কর জন্তু টাও ওসমানের ঘর ছাড়িয়া আপন স্থানে চলিয়া গিয়াছে । অনেক দিক পর স্বস্থির সাথে স্ত্রী –পুত্র লইয়া ঘরে গা রাখিলো ওসমান । প্রশান্তিতে দু’চোখ বুজিয়া আসিতেই হঠাৎ উপরের দিকে বাতির আলোতে কি যেন চক চক করিতে দেখিয়া ওসমান দৃষ্টি প্রসারিত করিল । ভয়ে ভয়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়া ওসমান যা দেখিলো তা সে কিছুতেই অন্তর কে বিশ্বাস করাইতে পারিলো না । তবুও বিশ্বাস করিতে হইল । কারণ লোকের মুখে ‘সাপের মাথার মণি’ র কথা অনেক শুনিয়াছে । ফোস ফোস জন্তু টা হয়তো তাহার আশ্রয় দাতার প্রতি কৃ্তজ্ঞতার নিদর্শন স্ব রূপ অতি মুল্যবান বস্তু টি রাখিয়া গিয়াছে ।
অল্প দিনের মধ্যে ওসমানের অবস্থার পরিবর্তন হইলো।বাড়িতে বড় বড় ঘর উঠিলো ।তালুকের পর তালুক কিনিতে লাগিলো।
বতরের সময় যখন কাতারে কাতারে শষ্য সাজিয়ে রাখে সেই স্তুপ কৃত শষ্য রাশির দিকে তাকিয়ে ওসমান তৃপ্তির হাসি হাসে ।দক্ষিণের পুকুরে বিকেলে যখন মাছের দল এপার ওপার ছুটাছূটি করে ওসমান তখন আপন হাতে মাছের খাবার ছিটায় আর তণ্ময় হইয়া অতীতের কথা ভাবে । চোক্ষু যুগল চিকচিক করিয়া ওঠে ওসমানের ।
সেই বছর মাঠে প্রচুর শষ্য উৎপাদিত হইলো । রাশি রাশি ধান উঠিলো কৃ্ষকের ঘরে । কৃ্ষকের মুখে হাসি ফুটিয়া ঊঠিলো। সকলে তখন বন্যার ভয়াবহতার কথা ভুলিয়া উহার ঔন্দ্রজালিক উৎপাদন ক্ষমতার জয় গান করিতে লাগিলো ।
©somewhere in net ltd.