নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বই কিনুন,বই পড়ুন ।বই পড়লে বই লিখতে পারবেন ।

আকতার হাফিজ

আকতার হাফিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কয়েকটি ছোট গল্প

২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৫১

ভিন্ন মানবতা
আকতার হাফিজ
শ্রাবনের শেষ দিনে বন্ধু কে চিঠি লিখিতেছিলাম । চিঠির বিষয় বস্তু তেমন গুরুত্ব পুর্ণ নয় ।
সাদা কাঁশ ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়ে অত্যন্ত সাদা মাঠা ভাবে বন্ধু কে বেড়াতে আসতে লিখেছিলাম । পত্র খানা তে শব্দের আড়ম্বরতা যেমন ছিল না ,তেমনি ভাষার দৃঢ়তাও ছিল না ।তবে মৃদু অভিমানের সুর ছিল ।
............যদি মনে চায় শেস বারের মত আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসিস ।যদি না আসিস ,পরে আফসোস করলে তখন আমার কিছুই করার থাকবে না । আজ শ্রাবনের শেষ । সামনে দুই মাস –ভাদ্র- আশ্বিন । বাইশ বছরের স্মৃতি ময় জগৎটি যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে ,তাতে কার্তিক মাসে এসে হয়তো দেখবি আমাদের বাড়ী নাই – শৈশব কৈশরের সেই গৃহ প্রাঙ্গনে ফেঁনায়িত ঘোলা জলের অবিরাম খেলা চলছে ।
বন্ধু টি সেদিন আসে নাই ।সে দোষ আমার ও না বন্ধুর ও নয় ।বন্ধু টি হয়তো বিশ্বাস করে নাই কিংবা ভাবতে ও পারে নাই এত দ্রুত আমাদের বাড়ী টা পদ্মায় বিলীন হয়ে যাবে ।আর আমিতো কল্পনা বিলাসি ।নিজের সাহিত্য জ্ঞান জাহির করার জন্য কলমে রক্ত ঝরিয়েছিলাম । বন্ধুটি যখন আসলো তখন আমাদের বসত ভিটার অর্ধেক নদী গর্ভে ।ঘরহীন ,বৃক্ষ শুন্য ভিটা খাঁ খাঁ করছে ।ঘর বলতে ছনে ছাওয়া রান্নারঘর টিই শধু স্বগৌ্রবে দাঁড়িয়ে আছে ।আকাশ থেকে আঝোর ধারায় বারি বর্ষণ হচ্ছে ।একটানা উত্তরী বাতাসে নদীর শাঁ শাঁ গর্জ ন ।ঘর গুলির শুন্য ভীটা আর গৃহের ছোট্ট অঙ্গন টুকু তে লোক জনের চলাচলে হাটুঁ পরিমান কাঁদা জমে উঠেছে ।বহু অধিবাসির মৃত্যুর স্মৃতি বাহক বাড়ী গুলি আজ যেন নিজেই মরে গেছে । এক একটা বাড়ী যেন মৃত লাশ ।একদা প্রাণ চঞ্চল আলো ঝলমল বাড়ী গুলির এই নির্জীব ,করুণ বিভৎস মুর্তি দেখলে মায়া হয় ,বিষাদে বুক ফেটে আসে । সেদিন বন্ধুর চোখে জল দেখেছিলাম আমি ;কিন্তু সান্তনা দেয়নি ।
পরবর্তী দু’দিনে পুরো বসত ভীটা টি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেল । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ীর উঠানে ফেনায়িত ঘোলা জলের উন্মত্ত নৃত্য দেখলাম ।
সেদিন থেকে আমাদের পরিচয়ে নতুন শব্দ যোগ হল-নদী ভাঙ্গা মানুষ । লজ্জার পরিচয় এটা । এ পরিচয় অবহেলার ; করুণার । এ যেন সমাজে এক নতুন শ্রেণীর উদ্ভব।এরা সমাজ চ্যুত ।ধর্মে, সংস্কৃতিতে ,জীবন যাপনের নিজস্ব বৈশিষ্টে এরা যেন সতন্ত্র এক প্রজাতি –জগতের প্রতিষ্ঠিত সভ্য সমাজে এদের কোন স্থান নাই ।
এ পরিচয় নিয়ে আমিও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি না । আত্মীয় ,বন্ধু যাদের সাথে স্নেহ ভালোবাসায় দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক তারাও আজ করুনা করে । তাই ইচ্ছা কৃ্ত ভাবে সকল কে এড়িয়ে চলি ।এমনকি কোন মেয়ে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকালে তার প্রতি শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকাই ।এই একটি মাত্র কারনে সহপাঠিনির দীর্ঘ একবছ্রের সকাতর চোখের প্রেম নিবেদন এড়িয়ে চলেছি । আরো এ্কটি কারন আছে সেটি হল সন্দেহ ।নিজের পক্ষের সুবিধা জনক দিক গুলিকে সন্দেহের চোখে বিবেচনা করার অভ্যাস আমার চিরদিনের । হাইস্কুল পড়ুয়া সরল কিশোরী মেয়ে বিবর্ণ মুখে লজ্জাতুর চোখের ভাষায় ভালোবাষা বুঝাতে চাচ্ছে ,সেটা বুঝতে আমার আড়াই বছর সময় লাগে । সেই আমি অনার্স পড়ুয়া ,জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মেয়ের কাতর চোখের প্রেম নিবেদন কিভাবে বিশ্বাস করবো ?বর্ণনার সুবিধার্থে তার একটা নাম ব্যবহার করব ।নুরজাহান ।কারণ এরা হল জগতের আলো ,মমতার অনন্ত আধার ।সংসারে এদের কদর আছে ।নুরজাহানের চেহারায় দ্বৈততার অপুর্ব মিশ্রন । কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটতে দেখলে মনে হয় তেজদীপ্ত এক নারী ;প্রীতিলতা কিংবা বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরী । মুখে তাকালে বাংলার চিরন্তন স্নেহ ময়ী নারীর প্রতিচ্ছবি-ই দেখা যায়।
সেদিন ক্লাস শেষে নাজরুল হলের দিকে হাঁটছি । দেখলাম ,আরেকটা মেয়ের সাথে নুরজাহান বসে আছে ।হেঁটে ওদের কে অতিক্রম করলাম ।এই সময় শুনলাম পেছন থেকে ডাকছে –শুনো। দাঁড়ালাম । নুরজাহানের প্রস্তাবে হাঁটতে লাগলাম । নুরজাহানের এতদিনের চোখের অব্যক্ত কথা গুলি এই মুহুর্তে ভাষা পেলো।আর আমার সকল সন্দেহের অবসান হল। আমরা তত ক্ষণে রাজেন্দ্র বট মুলে । সাথের বান্ধবী টি কখন পেছনে সরে গেছে টের পাইনি ।স্পষ্ট , আবেগ শুন্য নুরজাহানের ভাষা। নুরজাহানের আবেগ হীন প্রেম নিবেদনে আমিও ভেতরে কোন রকম শিহরণ অনুভব করলাম না। এটা বোধ হয় নিয়ম-সরাসরি স্পষ্ট ভাষায় প্রেম নিবেদন শোনার চাইতে এনিয়ে বিনিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বিবর্ণ মুখের প্রেম নিবেদন শোনা বেশি আনন্দের ;বেশি উপভোগের।
আমি বললাম , আমাদের বাড়ী নেই ,জানো তো ? নদীতে ভেঙ্গে গেছে ।
জবাবে নুরজাহান একটা হাসি হাসলো যার অর্থ বুঝাতে বহু ব্যাখ্যা প্রয়োজন ।মুখে শুধু বলল,আমি সব জানি ।
-তাহলে ?
-অতসব শুনতে চাই না ।আমাকে ভালোবাসো কিনা সেটা শুনতে চাই ।যেদিন তোমাকে ভালবেসেছি তখন তোমাদের বাড়ী ছিল।সব ছিল।আজ নেই। আর সেটা বোধ হয় আমার-ই জন্যে ।
-তোমার জন্য মানে ?
- হ্যাঁ, ধরে নিতে পারো খোদা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন ।তুমি মেধাবী ,চেহারাও সুন্দর ;এছাড়া আর অনেক গুন ই আছে । সেই সাথে অনেক সম্পদ ; পারিবারিক ঐতিয্য সব ই ছিল । আমার রুপ নাই, গুন ও নাই ।শুধু বাবার টাকা আছে।তোমার আর আমার সম্পদের অনুপাত ৩ঃ১ । আজ তোমার বাড়ী নাই । এখন সম্পদের অনুপাত ২ঃ১ ।সেদিন সম্পদের এত ব্যাবধানের কারণে তোমার ভালবাসা চাইবার সাহস পাইনি । আজ ব্যবধান কমায় ভালোবাসা চাইবার সাহস টুকু অন্তত পাচ্ছি ।ভালবাসার অধিকার দেয়া না দেয়া তোমার ইচ্ছা ।তবে তোমার ভালবাসা পেলে জীবন্ টা ধন্য হবে , জীবন আনন্দের হবে , সুখের হবে।
নুরজাহানের দরদ ভরা সরল ভাষায় কথা গুলো শুনে কখন যে চোখে পানি এসে গিয়েছে টের পাইনি ।যখন টের পেলাম তখন নুরজাহানের আংগুল আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছে ।স্বম্বিত ফিরে পেয়ে পেছনে সরে গেলাম । লজ্জিত নুরজাহান নত মস্তকে নির্বাক দাঁড়িয়ে । আমি দ্বিতীয় বার নুরজাহানের চোখে তাকাতে পারলাম না ।হাঁটতে শুরু করলাম ।
নুরজাহান একবার বলল-যাচ্ছো ?
আড়ষ্ট মুখে শুধু বললাম-হ্যা ।
- আমাকে কি বললে ?আমি বললাম –আজ চলি ।
পরের দিন নুরজাহান কলেজে এলো না ।আমি ভেতরে শুন্যতা অনুভব করলাম । একটা অবর্ননীয় কষ্টে ভেতর টা ভেঙ্গে যেতে লাগল। পরের দিন ও নুরজাহান এলো না । কেমন একটা ক্লান্তি ভর করলো আমার মধ্যে। নুরজাহান কে একটু দেখার জন্য ভেতর টা ছট ফট করতে লাগল।এভাবে প্রতিদিন প্রত্যাশা করি নুরজাহান কলেজে আসবে ।কিন্তু নুরজাহান কলেজে আসে না ।সাথের সেই সেই মেয়েটিকে ডেকে নুরজাহানের কথা জিজ্ঞেস করব সে সাহস ও নাই। নুরজাহান কলেজে এল পুরো এক সপ্তাহ পরে।
ওকে দেখে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল।অতি উৎসাহে নুরজাহানের কাছে গেলাম ।কিন্তু নুরজাহানের ভিন্ন মুর্তি ।লজ্জা পাবার ভঙ্গিতে আমাকে এড়িয়ে চলে ।দূরে চলে যায় ।অজানা আশংকায় মন আমার ছটফট করে উঠল। ক্লাস শেষে নুরজাহান দ্রুত কাম্পাস ত্যাগ করতে চেষ্টা করছিল।আমি দ্রুত হেঁটে কলেজ মাঠের মাঝামাঝি নুরজাহান কে থামালাম ।
কাতর কন্ঠে ভয়ে ভয়ে বললাম –তোমার সাথে কথা আছে ।
নুরজাহান এক মুহুর্ত ভাবল ।গম্ভীর অথচ রাগ হীন ,অভিমান হীন নুরজাহানের মুখ ভঙ্গিমা।আস্তে শুধু বলল-এসো ।
দু’জনে পাশাপাশি হাটছি ।কেউ কথা বলছি না । দু’জনেই চুপচাপ। সাইন্স বিল্ডিং এর পেছনে এসে পাশাপাশি বসলাম । অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। নুরজাহান বলল,কি বলবে বলে ডেকে আনলে ,কিছুই বলছো না ।আমার তাড়া আছে –বাসায় যাবো।
এবার নুরজাহানের চোখে করূণ দৃষ্টিতে তাকালাম ।কথা বলতে পারলাম না।নুরজাহান ওর চোখ সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল। আমি নিজের অজান্তেই হাতবাড়িয়ে নুরজাহানের মুখ ধরতে গেলাম যাতে ও চোখ সরিয়ে না নেয়।কিন্তু নুরজাহানের মুখ স্পর্শ করতে সাহস পেলাম না । নুরজাহান সেটা বুঝতে পেরে চোখ সরিয়ে নিলো না ।বললাম ,তোমার মত মেয়ের ভালবাসা পাবার যোগ্যতা আমার নাই।বাকি টা কাতর চোখের ভাষায় বুঝাতে চাইলাম।নুরজাহান কি বুঝল জানি না ।শুধু অনেকক্ষণ আমার চোখে তাকিয়ে রইল।আমি বললাম,আমাকে ছেড়ে যাবে নাতো কোন দিন?
এইবার দেখলাম নুরঝানের চোখ ফেঁটে জল গড়িয়ে পড়ল।আমি জল মুছাইলাম।আমার ডান হাত খানা নুরজাহান ওর দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরে চোখ টিপে বাকি জল টুকু বের করল।জল ফোঁটা গড়িয়ে ঘাসের উপর পড়ল।পরপর আরও কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল ।আমি দেখলাম । বললাম , দুঃখের জল গড়িয়ে যাক ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.