![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জানতে চাই, জানাতে চাই মানুষের অনুভুতির এপিঠ ওপিঠ
(রচনাটি তিন পর্বে বিভক্ত)
কয়েকদিন আগে আমার এক পুরোনো ছাত্রের সংগে দেখা। ছেলেটার ফিল্ম সেন্স বেশ ভাল, তার মাথায় অহরহ দারুণ দারুণ সব কনসেপ্ট ঘোরে। কিন্তু সে এখন পর্যন্ত একটাও শর্টফিল্ম বানায়নি। কারণটা জানতে চাওয়াতে সে উত্তর দিল, “আমি আসলে ঠিক বুঝতেছি না আমার ১০ জনের জন্যে সিনেমা বানানো উচিৎ নাকি ১০০ জনের জন্যে।” অর্থাৎ বোদ্ধা দর্শকদের জন্যে নাকি সাধারণ দর্শকদের জন্য? অন্য কথায় আর্ট ফিল্ম বা বক্তব্যধর্মী নাকি বানিজ্যিক বা বিনোদনধর্মী?
সন্দেহ নেই, জটিল সংশয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চায় এমন অনেক তরুণের মাঝেই এমন সংশয় প্রকট ভাবে রয়েছে। সংশয় মানুষের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের সবচেয়ে বড় বাঁধা হতে পারে। সব ধরনের যোগ্যতা থাকার পরেও অনেকেরই দেখা যায় শুধুমাত্র এটা করা উচিৎ নাকি ওটা করা উচিৎ, এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত আর কাজেই নামা হয় না। আমার নিজের জীবনেও এমনটা হয়েছিল। অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি কাজ শুরু করার জন্যে সংশয় দূর করা অত্যন্ত জরুরী।
এখানে বিষয় মোট চারটি- শিল্প, বক্তব্য, বিনোদন এবং ব্যবসা। আলোচনার সুবিধার জন্যে বিষয়গুলোকে একটু আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষন করা যাক।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে শিল্প বলতে অনেকেই বোঝেন এমন কিছু সিনেমা যা কেউ কেউ বুঝবেন কিন্তু সবাই বুঝবেন না। শিল্প প্রেমিকরা গর্বের সাথে দাবী করে থাকেন, শিল্প মুষ্টিমেয় লোকের জন্যে, সবার জন্যে নয়। এই ধারনার পিছনে কিছু ইতিহাস রয়েছে। সুদূর অতীতে, যখন দাস প্রথা শুরু হয়নি, তখন প্রত্যেকটা মানুষকে তার জীবিকার কাজে দিনভর ব্যস্ত থাকতে হত। পরবর্তীতে যখন দাস প্রথা চালু হল, তখন সম্পদশালী লোকদের হাতে কিছু অবসর সময়ের সৃষ্টি হল। সেই অবসরকে উপভোগ করার জন্যেই শুরু হয় আয়োজন করে সাহিত্য, সংগিত, চিত্রকলা ইত্যাদির চর্চা। আর তাই স্বাভাবিক ভাবেই শিল্পের সোল এজেন্সি চলে যায় মুষ্টিমেয় কিছু বিত্তবানদের হাতে। যারা কিনা একটা বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন ভাবতে পারবে, একটু একটু করে কাব্য বা সংগিতের অন্তরালের প্রকৃত কাব্য বা সংগিতটিকে খুঁজে বের করতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, নিজেরদের সাথে সাধারণ মানুষের তফাৎ তৈরী করতে শিল্পকে ইচ্ছাকৃত ভাবে দুর্বোধ্য করে তোলার প্রবনতাও তাদের মাঝে দেখা যায়।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে, একই সময়কালে স্রেফ অবসর কাটানো বা জাতে উঠবার উদ্দেশ্যে নয়, বরং শুধু মাত্র প্রাণের তাগিদে গ্রামে গঞ্জের সাধারণ মানুষ বা মুটে মজুর আর নৌকার মাঝিদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে জারি সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী আর নকশি কাঁথার মত উন্নত মানের শিল্প। যা শোনা মাত্রই বা দেখা মাত্রই মানুষের অন্তরের গভীরে আসন গেড়ে বসে। দিনের পর দিন গবেষনা করে, একটু একটু করে মর্ম উদ্ধার করার প্রয়োজন পড়ে না।
শিল্পের ব্যাখ্যায় আরেকটা বিষয় রয়েছে যা চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, কোন কিছুকে আপনি যতটা আকর্ষনীয় বা দৃষ্টি নন্দন করে তুলতে পারবেন সেটা তত বড় শিল্প হয়ে উঠবে। মানে, “আমার খারাপ লোককেই ভাল লাগে”- এই বাক্যটা শিল্প নয়। কিন্তু, “আমার চোক্ষে কি হায় দোষ কইরাছে, রাতের বেলা দেখি আলো। সবাই যারে মন্দ বলে তারে লাগে ভাল”- এটা শিল্প। “হেমলেট, তোর তরোয়ালে ধার নাই। তুই কোন কামেরই না”- এটা শিল্প না। “হ্যামলেট ব্যর্থ তুই, তরবারি তো কান্নার শিশিরে শুধু ক্ষয় প্রাপ্ত, ধারহীন মরিচার গ্রাস”- এটা শিল্প। এই বিচারে, আপনি আপনার চলচ্চিত্রে যা-ই দেখান না কেন, সেটাকে যদি সাজিয়ে গুছিয়ে দেখাতে পারেন, তো সেটাই শিল্প। হোক না সেটা এ্যাকশন ছবি বা রোমান্টিক ছবি অথবা পর্নোগ্রাফি।
প্রশ্ন জাগতে পারে সুন্দর করে দেখালেই যদি সেটা শিল্প হয়, তাহলে তো সুন্দর করে বানানো পর্নোগ্রফি দেখাটাও হালাল কাজ। ঠিক এইখানে এসেই শিল্পের পাশাপাশি বক্তব্য বিষয়টি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আপনি কি উদ্দ্যেশে শিল্প সৃষ্টি করছেন সেটার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক ক্রিমিনাল মাস্টার মাইন্ড হত্যাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে খুন করা ভাল কাজ। শিল্প যেমন ইতিবাচক হতে পারে তেমনি নেতিবাচকও হতে পারে। অবাক হচ্ছেন? একটা উদাহরণ দেই, যেহেতু আলোচনাটা চলচ্চিত্র নির্ভর তাই চলচ্চিত্র থেকেই উদাহরণ টানছি। ঘটনাটি একটি এনিমেশন সিরিজে দেখা- ইয়াং জাস্টিস, সিজন ১।
খাপে ভরা মন্ত্রপুত একটি তরবারী, যা কেউই খাপ থেকে বের করতে পারে না। প্রবাদ আছে, এই তরবারিটি শুধু মাত্র সে-ই ব্যবহার করতে পারবে যার রয়েছে পিওর হার্ট বা খাঁটি হৃদয়। অনেকেই চেষ্টা করে কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন সেই তরবারিটি কেউই ব্যবহার করতে পারে না। অবশেষে বদমাশ টাইপের এক লোক এসে অনায়াসে সেই তরবারিটি খাপ থেকে খুলে নিল। সবাই অবাক। এই লোক তো অপরাধী, তার হার্ট তো কোন ভাবেই পিওর নয়, তবে সে কিভাবে এটা ব্যবহার করতে পারে? লোকটি দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘বলা হয়েছে খাঁটি হৃদয় বা পিয়র হার্ট, আমার হার্ট হচ্ছে পিওর ইভল, মানে খাঁটি শয়তান হৃদয়।’ অর্থাৎ এখানে বিষয়টা শুভ বা অশুভ নিয়ে নয়। বিষয়টা খাঁটিত্ব নিয়ে। সেটা খাঁটি ফেরেস্তাও হতে পারে আবার খাঁটি শয়তানও হতে পারে। শিল্প হচ্ছে কোন বিষয়ের ‘মানের গভীরতা’ মাত্র। ‘বিষয়টা’ এখানে বিবেচ্য নয়। মানটাই বিবেচ্য।
বাচ্চা ছেলেদের কার্টুন ছবির উদাহরণ দিলাম বলে অনেকেই হয়ত বলবেন, কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি। ঠিক আছে, এবার তাহলে বাস্তব জীবন থেকে একটা উদাহরণ দেই। আচ্ছা, বলেন তো, প্রকৃতিগত ভাবে নারী পুরুষের সব চেয়ে আরাধ্য বা কাংক্ষিত বিষয়টি কি? যা জীবনকে পূর্ণাঙ্গ করতে পারে বা সুখে ভাসিয়ে দিতে পারে। আবার প্রকৃতিগত ভাবেই নারী পুরুষ সংক্রান্ত সব চেয়ে জঘন্য অপরাধটি কি? যা মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দেয় বা জীবনটাকে জর্জরিত করে দেয়। দুটো প্রশ্নেরই উত্তর একটাই- সেক্স। উভয়ের তৎপরতায় যা ভালবাসা, শুধু এক জনের তৎপরতায় তা ধর্ষণ। বউয়ের সাথে যৌনতায় কোন পাপ নেই। কিন্তু পতিতার সাথে যৌনতা মহাপাপ। অর্থাৎ স্বয়ং ‘যৌনতা’ আসলে ভাল বা মন্দ নয়। এটা স্রেফ মানব মানবীর দেহের আদিমতম একটা প্রক্রিয়া মাত্র, যার ভাল মন্দ র্নিধারণ করে ঘটনার প্রেক্ষাপট। একই ভাবে শিল্পও কোন কিছুকে প্রকাশ করার একটা উন্নততর প্রক্রিয়া মাত্র, যা সহজেই মানুষের মনের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পারে। যা প্রবেশ করল তা ভালও হতে পারে, আবার খারাপও হতে পারে। এখানে শিল্পের কোন দায় নাই। দায়টুকু চলচ্চিত্র নির্মাতার।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন চলচ্চিত্রে খারাপ কিছুকে সাদামাঠা ভাবে উপস্থাপন করলে যতটা ক্ষতিকর হতে পারে শিল্পসম্মত ভাবে উপস্থাপন করলে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ শৈল্পিক বিষয়, সাদামাঠা বিষয়ের চেয়ে অনেক জোরালো ভাবে মানুষের মনে আসন গেড়ে বসতে পারে। একটু ভাবেন, রাইফেলের বুলেট একটি ক্ষতিকর বস্তু। আবার অনেক সাধনা করে বানানো পারমানবিক বোমাও ক্ষতিকর। কিন্তু দুটোর ক্ষতির মাত্রা স্পষ্টই দুই রকম। যে জিনিসটাকে যতটা সাধনা বা মমতা দিয়ে বানানো হয় তার প্রভাবনী ক্ষমতা তত বেশী হয়। সেটা ভাল হলে ভাল আর খারাপ হলে খারাপ।
এখানে আমার স্কুল জীবনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তখন আমি ক্লাশ ফোর কি ফাইভে পড়ি। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরেছি। আব্বা জানতে চাইল, ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে? আমি হাত পা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘দারুন।’ আব্বা মৃদু হেসে আবারও প্রশ্ন করল, ‘দারুণ ভাল, নাকি দারুণ খারাপ?’ সেই প্রথমবারের মত মাথায় ঢুকল দারুণ শব্দটা ‘খুব ভাল’ অর্থে ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দারুণ মানে শুধুই ‘খুব’ বা ‘অনেক’। এটা ভাল বা খারাপের সামনে যুক্ত হয়ে তাদের মানের তীব্রতা বাড়ায় মাত্র।
চলবে....
২য় পর্ব - Click This Link
৩য় পর্ব - Click This Link
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:২২
মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: চমৎকার...চলুক!