![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জানতে চাই, জানাতে চাই মানুষের অনুভুতির এপিঠ ওপিঠ
(রচনাটি তিন পর্বে বিভক্ত)
প্রথম পর্ব- Click This Link
যাহোক, বক্তব্য বা ম্যাসেজ নিয়ে অনেকেরই অনেক ধরনের অভিমত রয়েছে। বাংলা সিনেমার অনেক পরিচালককে আমি বুক ঠুকে বলতে শুনেছি, “আমার সিনেমায় এন্ডিংয়ে তো সত্যেরই জয় হয়। তাহলে আমার সিনেমা খারাপ হবে কেন?” আমার গুরু ক্যামেরাম্যান আব্দুস সামাদ এর সুন্দর একটা উত্তর দিয়েছিলেন। যদি কোন সিনেমায় নায়িকা পাক্কা আড়াই ঘন্টা ধরে আধ লেংটা হয়ে থাকে, তারপর শেষের ১৫ মিনিটে মাথায় ঘোমটা টেনে বলে, আমি বুঝতে পেরেছি উশৃংখল জীবন যাপন করা উচিৎ নয়। আজ থেকে আমি সমাজের আদব কায়দা মেনে চলব- তবে দর্শকের উপরে সিনেমার শেষ ১৫ মিনিটের প্রভাব পড়বে নাকি প্রথম আড়াই ঘন্টার? সিনেমার পরিসমাপ্তি ভাল না মন্দ সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল শেষ পযর্ন্ত সিনেমার কোনটা দর্শকের উপরে প্রভাব ফেলতে সমর্থ হচ্ছে। কারণ, সেটাই আপনার সিনেমার বক্তব্য বা মেসেজ।
বক্তব্য নিয়ে আরো একটা জটিলতা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন সিনেমার মাঝে তিনি যে বক্তব্য দেবেন তা দেখে সাথে সাথেই মানুষ তা মেনে নেবে বা প্রভাবিত হবে। না ভাই, সিনেমা দিয়ে এটা সম্ভব নয়। আপনি যদি তাৎক্ষনিক ভাবে ফল পেতে চান তবে রাজনীতিতে নামেন। জনসভায় ভাষণ দেন। দেখবেন শত শত লোক আপনার কথায় উত্তেজিত হবে, এ্যাকশনে নামবে। আর যদি সাংস্কৃতিক কোন উপায়ে আপনি জনগণকে উত্তেজিত বা জাগরিত করতে চান তাহলে ডুকুমেন্টারী বানান, ফল পাবেন। কিন্তু চলচ্চিত্র বা নাটক ভিন্ন একটি ব্যাপার। এখানে তাৎক্ষণিক ফল আপনি পাবেন না। কারণ চলচ্চিত্রে একটি কাহিনি থাকবে। সেই কাহিনির কোন এক ভাঁজে আপনার বক্তব্যটি লুকানো থাকবে। দর্শক হয়ত দেখার সময় বুঝবেও না সে কি দেখল। কিন্তু আর্সেনিকের মত তা একটু একটু করে শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। মিছিল মিটিং সভা সেমিনারে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া গেলেও সেই ফলাফলের স্থায়িত্ব সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু নাটক সিনেমায় পাওয়া ম্যাসেজ অনেক ধীরে কাজ করলেও তার স্থায়ীত্বকাল দীর্ঘ তো বটেই অনেক ক্ষেত্রে তা স্থায়ীও। ব্যাপারটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই।
তখন আমি একটি পত্রিকায় চাকরী করতাম। দেড় মাস হল বেতন পাইনি। তাই মেজাজ গরম। রিকশা করে তাজমহল রোড থেকে কলেজ গেট এসেছি। ভাড়া সে সময় ছিল ৫ টাকা। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা ৬ টাকা দাবী করে বসল। বললাম ‘ন্যায্য ভাড়া ৫ টাকা। আপনি যদি এক টাকা আমার কাছ থেকে চেয়ে নেন তো সেটা আলাদা বিষয়।’ কিন্তু বুড়োর সেই একই কথা, ৬ টাকাই নাকি তার পাওনা। এবং এক সময় সে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘আমার পরিশ্রমের টাকা, দিবেন না মানে?’ এবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে গেল। আমিও চেঁচালাম, ‘ওই মিয়া, তোমার পরিশ্রমের টাকা তো আমার কি চুরির টাকা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাধার খাটুনি খাটি। তারপরও ঠিক মত বেতন পাই না.....’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে “আমার পরিশ্রমের টাকা” বলে রিকশাওয়ালা আমার উপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার কারণ কি বামপন্থী রাজনৈতিকদের মিছিল, মিটিং, সভা, সেমিনার? বামপন্থী রাজনীতিবিদদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, পুরো আশির দশক জুড়ে কোন এক বস্তির ছেলে, কোন শিল্পপতির মেয়েকে প্রেম করে, অনেক লড়াই করে, শেষে বিয়ে করতে সমর্থ হচ্ছে এই জাতীয় সিনেমা যদি এই দেশে এবং পাশ্ববর্তী দেশে তৈরী না হত তবে কি শ্রমিক শ্রেনীর জনতার মাঝে এই পরিবর্তটুকু আনা সম্ভব হত?
এককালে শ্রমিকরা সহজে মুখ খুলত না। নিরবে সহ্য করে যেত। এখন গার্মেন্টেসের বেতন একদিন দেরী হলেই তারা প্রতিবাদ করে। এর পিছনে বাম রাজনীতির কিছু অবদান তো আছেই। কিন্তু কাজের বেটি রহিমার সাথে বাড়ির মালিকের ছেলের প্রেম, অথবা ‘গরীরের রাজা’ টাইপের কেউ দূর্নীতিগ্রস্থ কোন মন্ত্রীকে চৌরাস্তার মোড়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিল অথবা কোন রিকশাওয়ালা তাকে অসম্মান করার শাস্তি হিসাবে কোন ধনীর বেয়াদপ মেয়েকে পুরো একমাস নিজেদের বস্তিতে রেখে থালা বাসন মাজতে বাধ্য করল এবং শেষে সেই বেয়াদপ মেয়ে বুঝতে পারল জীবন আসলে কি, এই জাতীয় সিনেমাগুলো যে দরিদ্র শ্রমিক সমাজকে সাহসী হতে সাহায্য করেছে এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। যদিও এই পরিবতর্নটা আসতে এক দশকেরও বেশী সময় লেগেছে।
আরেকটি উদাহরণ দেই। ‘কুতুবের খাস কামরা’ নামে আমার লেখা একটি রম্য মঞ্চ নাটক আছে। কুতুব আলীর বউ মারা যাওয়ার পরে সংসারে আর মন নেই। তার তিন ছেলে তিন ধরনের। তারাই সংসার চালায়। এই প্রেক্ষাপটে তিন ছেলের মাঝ থেকে আমি বেশ কিছু বক্তব্য প্রদানের চেষ্টা করেছিলাম। ছেলেরা ঠিক মত সংসার চালাতে পারছে না দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই কতুব আলী শেষে আবারও সংসারের হাল ধরে। নাটক শেষে এক ছেলে আমাকে তার অনুভুতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলল, ‘আসলে বাবা হতে গেলে এমনই হতে হয়।’ তার মন্তব্যে আমি ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমি লিখবার সময় ছেলেদের নিয়েই মাথা ঘামিয়েছি। বাবাকে নিয়ে নয়। কিন্তু আমার নিজের অজান্তেই এখানে আরো একটা মাত্রা যুক্ত হয়েছে। ছেলেটির চোখ মুখ দেখে আমার মনে হয়েছে সে যখন বাবা হবে তখন সে এই বিষয়টা মনে রাখবে। ব্যাস, আমার ঐ নাটকটা থেকে অর্জন এইটুকুই। একটু ভাবেন, একজন মানুষ... মাত্র একজন মানুষ যদি বাবা হিসাবে আজ পাল্টে যায়, কাল তার সন্তানরা ভিন্নতর জীবন পাবে। সেই থেকে তার সন্তানেরা, তার থেকে তারও সন্তানেরা। নাটক সিনেমায় বক্তব্য এভাবে কাজ করে। সরাসরি বা তাৎক্ষনিক নয়, ঘুরিয়ে কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী।
অর্থাৎ বক্তব্য থাকবে বিনোদনের আড়ালে। প্রশ্ন করতে পারেন কেন, বক্তব্য সরাসরি থাকলে ক্ষতি কি? ভাই, আপনাকে পাল্টা একটা প্রশ্ন করি, স্কুলে শিক্ষকদের পরমর্শ বা উপদেশ কি আপনি কখনও তৃপ্তি নিয়ে শুনেছেন? নাকি আপনার অফিসের বস বা কোন সিনিয়ার আপনাকে আগ বাড়িয়ে উপদেশ দিলে আপনি আবেগে আপ্লুত হয়ে যান? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় অধিকাংশ মানুষের উত্তরই হবে “না”। তাহলে ভাই, সিনেমাতে আপনি কেন দর্শকদের অমৃত বচন শোনাতে চাচ্ছেন? সারাদিন ধরে খাটা-খাটুনি করে মানুষ সিনোমা দেখতে বসে মনের চাপ কমানোর জন্য, একটু হালকা হওয়ার জন্যে। এই রকম একটা মুহূর্তে তাদের সদা সত্য কথা বলিবে, একবার না পারিলে দেখ শতবার অথবা নারী মাতা, নারী ভগ্নী, তাদের কখনও কামানার দৃষ্টিতে দেখিও না জাতীয় সদুপদেশ কি পরিমাণ বিরক্তির উদ্রেগ ঘটাতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ অপ্রিয় হলেও সত্য তারা তখন নারীকে মাতা বা ভগ্নি হিসাবে নয় বরং প্রেয়সী হিসাবে দেখতে চায়।
জানি, অনেকেই আমাকে খাঁটি বাংলা ভাষায় গালি দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ভাই, আমার কথা শেষ হয়নি। আমি সততার বিরুদ্ধে নই, নারীদের সম্মান করার বিরুদ্ধেও নই। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হল, সিনেমায় একটা কাহিনী থাকে। সেই কাহিনিটি স্বয়ং অনেক কিছু বলে দিতে পারে। তাহলে আপনি কেন অহেতুক বকবক করতে যাবেন? এমন একটা কাহিনি বানান যাতে করে মানুষের সত্য কথা বলার আগ্রহ জাগে। মেয়েদের সম্মান করার ইচ্ছা জাগে। হয়ত সেই সিনেমায় একবারও সত্য কথা বলার তাগিদ থাকবে না। অথবা মেয়েদের সম্মানের পরামর্শও দেয়া হবে না। কারণ, পরামর্শ দিতে দেখলেই মানুষ বিরক্ত হয়। আর বিরক্ত হলেই সে আর আপনার সিনেমা দেখবে না।
আপনার সিনেমা দেখে যদি মানুষ মিথ্যাকে বর্জন করে। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা বন্ধ করে তবেই আপনি সফল, আপনার সিনেমা সফল। ‘স্লোগান’-এ আপনি কি বলছেন সেটাই মূল ব্যাপার। কিন্তু ‘সিনেমা’-য় দর্শকের মাঝে সেই বক্তব্যের প্রভাব বিস্তার করাটাই মূল ব্যাপার। এখন আপনাকে যদি সম্পূর্ণ উল্টোটা দেখিয়েও তা করতে হয়, তো করবেন। আমি যুদ্ধ বিরোধী বেশ কয়েকটা সিনেমার নাম বলতে পারব যার পুরোটাই যুদ্ধে ভরা। ব্যালেড ফর আ সোলজার, অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েষ্টার্ন ফ্রন্ট, গ্লাডিয়েটর এই সবগুলা সিনেমাতেই যুদ্ধকে ছাপিয়ে মানুষের প্রতি ভালবাসাই প্রধান হয়ে উঠেছে। এবং এই সিনেমাগুলোর কোথাও “ভাই, যুদ্ধ করবেন না। আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস” জাতীয় কোন ডায়লগই একবারের জন্যেও ছিল না।
চলচ্চিত্রের বক্তব্য বা বিষয় বস্তু নিয়ে আরেকটি অভিযোগ রয়েছে- “ভাল কোন বিষয় নিয়ে সিনেমা বানালে তো মানুষ দেখে না।” কথাটা একেবারেই সত্যি নয়। আপনার সিনেমা, নাটক বা উপন্যাসটা মানুষ দেখছে না বা পড়ছে না কারণ, হয় আপনার বক্তব্যটা ভাল ছিল না অথবা আপনি ভাল মত সিনেমাটা বা উপন্যাসটা নির্মাণ করতে পারেন নাই। বলতে পারেন, মানুষ পর্নোগ্রাফী কেন দেখে? হলিউডে বছরে যত সিনেমা তৈরী হয় তার তিন ভাগের দুই ভাগই পর্নোগ্রাফী। একই বিষয়, তারপরও এত দর্শক কেন? কারণ, বিষয়টা আদিম এবং সরাসরি আমাদের জীবনের সাথে জড়িত। তাই এর আকর্ষন বা আবেদন কখনওই শেষ হয় না। প্রশ্ন হল এটাই কি এক মাত্র বিষয় যা আদিকাল থেকে আমাদের জীবনের সাথে জড়িত? জানি বেশীর ভাগ পাঠকই বলবেন “আদিম ব্যাপার তো একটাই- সেক্স”। না ভাই, আরো অনেক আদিম ব্যাপার আমাদের জীবনে আছে। অবাক হচ্ছেন? উদাহরণ দেই, আপনার মা কি এই পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যে তার সন্তানকে নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসেন? আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠর আগে কি এই পৃথিবীতে কেউই দেশের জন্যে জীবন দেয় নাই? ৯০-এ যে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে সেটাই কি পৃথিবীর প্রথম কোন শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ? আপনারা কি প্রতিদিন বাসে অফিস যাওয়ার সময় দেশের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেন না? একই তো আলোচনা, তারপরও প্রতিদিন কেন করেন? কারণ, সেক্সের মত দেশপ্রেমটাও সেই আদিমকাল থেকেই আমাদের চেতনার মাঝে বাসা বেঁধে আছে। একটু ডানেবাঁয়ে তাকালেই দেখবেন এমনই অনেক বিষয় আছে যা আদিকাল থেকে আমাদের সাথে জড়িত।
নিজেকে একটু প্রশ্ন করে দেখেন পর্ণোগ্রফির মত নিষিদ্ধ একটা অদিম বিষয় যদি মানুষকে এতটা আকৃষ্ট করতে পারে তবে মায়ের ভালবাসা, মানুষের প্রতি মমতা বা দেশ প্রেমের মত আদিম বিষয়গুলো নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো কেন মানুষকে আকৃষ্ট করবে না? মেনে নিচ্ছি, সেক্সের মাঝে প্রাকৃতিক কিছু আকর্ষন রয়েছে যা অন্য বিষয়গুলোতে নেই বা থাকলেও সেটাতে হয়ত আমরা সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারছি না। আর ঠিক এখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা।
চলবে...
৩য় পর্ব - Click This Link
২| ১২ ই জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:২৬
তেলাপোকা রোমেন বলেছেন: নিজেকে একটু প্রশ্ন করে দেখেন পর্ণোগ্রফির মত নিষিদ্ধ একটা অদিম বিষয় যদি মানুষকে এতটা আকৃষ্ট করতে পারে তবে মায়ের ভালবাসা, মানুষের প্রতি মমতা বা দেশ প্রেমের মত আদিম বিষয়গুলো নিয়ে বানানো সিনেমাগুলো কেন মানুষকে আকৃষ্ট করবে না?
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:২৮
মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: পর্দার পেছনের নন্দনতত্ত্ব চমৎকারভাবে বলেছেন...চলতে থাকুক!