নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১০ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ২:০১


ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা


(৭)

বে

অনেক দিন আগেকার কথা,পূর্বদিকের কোন এক দেশে বুড়ো এক সুলতান ছিল,যার সুন্দরী রানীদের একজন ছিল চীন দেশের মেয়ে।সুলতান ছবি,কালিগ্রাফী,কলা শিল্পের প্রচন্ড ভক্ত ছিল।হায়,অস্বাভাবিক,অবিশ্বাস্য যা ঘটলো,তা বলার মত না,এক সময় সুলতানের আগের পক্ষের ছেলে,চীন দেশী রানীর সাথে প্রেমে মত্ত হয়ে,দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে থাকতো।

সুলতানের ছেলে তার নিষিদ্ধ সম্পর্ক বাবার কাছে জানাজানির ভঁয়ে এমনই চিন্তিত ছিল,যে প্রাসাদের ষ্টুডিওতে নিজেকে ছবি আঁকাতে মগ্ন হয়ে থাকতো,যা অন্য কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব না।যন্রনা আর বিরহের ছোঁয়ায় ছবিগুলোও ছিল অতুলনীয়,কারও পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না যে সেটা কোন নাম করা ওস্তাদের ছবি না,সাধারণ এক শিল্পীর আঁকা ছবি।

সুলতানের কাছে ছবিগুলো ছিল অবিশ্বাস্য স্বর্গীয় তুলির ছোঁয়ায় সাজানো আর তার চীন দেশীয় রানীরও মন্তব্য ছিল, ‘অপূর্ব,বেহেশতের ছোয়ায় সাজানো’।রানী একসময় এটাও বললো, ‘সময়ে হয়তো কেউ জানবে না ছবিটা কার আঁকা,তাই ছবিতে হয়তো নাম লেখাটাই যুক্তিযুক্ত’।সুলতান উত্তর দিল, ‘ছবিতে নাম দিলে সে তো অযথাই কৃতিত্ব নিবে,নামকরা ওস্তাদদের পদ্ধতিতে আঁকা ছবিগুলোকে তার পদ্ধতি হিসাবে।আর তাতে এটাও বলা হবে ঐ ছবিগুলোতে লুকানো আঁকার খুঁত’।রানী দেখলো সুলতানকে রাজী করানো তার পক্ষে কোন ভাবেই সম্ভব হবে না,সে ষ্টুডিওতে সুলতানের ছেলেকে কোন ভাবে রাজী করালো।

প্রেমে অন্ধ সুলতানের ছেলে,তখন শয়তানের প্ররোচনায় নিজের নাম গাছ আর ঘাসের মধ্যে এমন ভাবে লুকিয়ে লিখলো যা সহজে চোখে পড়ার কথা না।প্রথম ছবিটা হুসরেভ আর শিরিনের।দ্বিতীয়টা হুসরেভ আর শিরিনের বিয়ের পরের ছবি,যেখানে হুসরেভের প্রথম পক্ষের ছেলে শিরিনের রুপে মুগ্ধ হয়ে অন্ধ প্রেমে,রাতের অন্ধকারে জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে তার বাবাকে চাকু দিয়ে খুন করে।

ছবিটা দেখে সুলতানের মনে হলো, ‘ছবিটাতে কোথাও যেন একটা খুঁত আছে’,ছেলের সই তার দৃষ্টিতে আসেনি তখনও।ছবিটা দেখে তার মনে হলো এ ধরণের প্রতিফলন কোন ওস্তাদের হাতে হতে পারে না,তাই একটা ভঁয় তার মনে তখন ওটা কোন গল্প বা কিংবদন্তীর কাহিনী না,বরং বাস্তব কিছু একটা।সব কিছু উপলদ্ধ করার আগে জানালা দিয়ে তার ছেলে ঢুকে বিরাট একটা ছোরা সুলতানের বুকে ঢুকিয়ে দিল।



মিম

কেজভিনের রাশীদউদ্দীনের নিজের কথায় বলা,প্রায় দুইশ পঞ্চাশ বছর আগে কাজভিনে কালিগ্রাফী,অঙ্কন শিল্পের প্রচলন আর প্রিয়তা বেশ ভালই ছিল।কাজভিনের ক্ষমতাশালি সুলতানের রাজত্ব ছড়ানো ছিল প্রায় চল্লিশটা দেশে,বাইজাইন্টাইন থেকে সুদুর চীন পর্যন্ত।হয়তো শিল্প সাহিত্য ছিল তার ক্ষমতার উৎস,কিন্ত দুঃখের বিষয় এটাই যে সুলতানের কোন ছেলে ছিল না।তার মৃত্যুর পর যাতে সারা সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো না হয়ে যায় তাই শাহ একজন যুবক দক্ষ শিল্পীর সাথে,তার ষ্টুডিওর দুই ওস্তাদ শিল্পীর একটা প্রতিযোগীতার বন্দোবস্ত করলো,বিজয়ী হবে তার মেয়ের ভবিষ্যতের স্বামী।
রাশীদউদ্দীনের কথায় প্রতিযোগিতার নিয়ম ছিল খুবই সহজ,শিল্পীর সবচেয়ে ভাল ছবিটাই নির্ধারণ করবে বিজয়ী।শিল্পীরা বুঝলো এর মানে ছবিগুলো আঁকা দরকার পুরানো ওস্তাদদের পদ্ধতিতে,তিনজন শিল্পী আঁকলো বহুল প্রচলিত বেহেশতের ছবি,সুন্দরী দাঁড়িয়ে একটা পাইন গাছ আর দারুবৃক্ষের ছায়ায়,ছূটে বেড়াচ্ছে কটা খরগোস,চাতক পাখী,যেন ভালবাসা হারানো দুঃখভরা মনে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে।

তাদের একে অন্যের জানা ছিল না সবার একই ছবি পুরোনো পদ্ধতিতে আঁকা,শুধু একজন শিল্পীর নাম নার্গিস ফুলের বাগানে লুকিয়ে লেখা ছিল।ও তো এক গহনীয় অপরাধ,সে জন্য তাকে শাস্তি হিসাবে কাজিন থেকে চীনে পাঠানো হলো নির্বাসনে।আবার নতুন করে প্রতিযোগীতা আরম্ভ হলো,দুই শিল্পী আবার ছবি আঁকলো,যেন একটা কবিতা,
ছন্দে ছন্দে ছূটে গেছে এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে।এবার দুজনের ছবির বিষয় বস্ত এক সুন্দরীর বাগানে ঘোড়ায় ঘুরে বেড়ানোর।একজন শিল্পী তার জানায় বা অজানায় যে ভাবেই হউক,ঘোড়ার নাক,চোখ,মুখ চীনা অবয়বের সাথে মিলিয়ে আঁকলো,এটা শাহ আর তার মেয়ে দুজনের কাছেই মনে হলো ত্রুটিতে ভঁরা।এটা ঠিক যে শিল্পী ছবির কোথাও তার নামটা সই করেনি,তবে তার এমন কিছু একটা করা যা ছবিটার সৌন্দর্য অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছে।শাহ ছবিকে, ‘ত্রুটিপুর্ন আর দূষিত’,করার জন্যে তাকে বাইজেন্টাইনে থেকে নির্বাসনে পাঠালো।তবে রাশীদউদ্দীনের গল্পে বলা একটা বিশেষ ঘটনা যে যুবক শিল্পীর সাথে যদিও শাহের মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো,তবে বিয়ের আগের দিন ও শাহের মেয়ে বিষন্ন চোখে তাকিয়েছিল নবীন শিল্পীর ছবিটার দিকে,যে তার স্বামী হতে যাচ্ছে।

সন্ধ্যায় মেয়ে শাহকে বললোঃ
‘এটা সত্যি ওস্তাদেরা সুন্দরীদের ছবি আঁকতো চীনা পদ্ধাতিতে,এটা পুরোনো দিনের একটা নিয়ম যা সময়ে বদলায়নি তেমন একটা।তবে শিল্পীরা তাদের পচ্ছন্দের মানুষের ছবি তুলে ধরার জন্যে ছবির কোন না কোন অংশে সেটার একটা ছাপ রেখে দিত।ছবির রং,আঁকারে প্রকাশ পেত এমন একটা ছাপ রাখতো যা তার প্রেমিক ছাড়া আর কারও পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব ছিল না।আমি সারাদিন ধরে ছবিটা দেখলাম কোথাও আমাকে বা আমার চিহ্নের কিছুই খুঁজে পেলাম না।ছবির শিল্পী,সে একজন উন্নতমানের শিল্পী হতে পারে,তবে এ ছবিতে আমার জন্যে কোন ভালবাসা নেই, এ ছবিতে আমি নেই কোথাও’।সবকিছু শোনার পর শাহ বিয়েটা বাতিল করে দিল।

‘তাই,এই তৃতীয় উপমায় আমরা এটুকু বুঝতে পারি,নিয়ম ভঙ্গ করেই নতুন পদ্ধতির উদ্ভব’,সিয়াহ বললো।‘আর প্রেমের আবেগে ভেসে যাওয়া শিল্পীর,প্রকাশ তার ছবির কোন না কোন জায়গায় আবেগের জোয়ারে ভেসে আসে’।

‘না’,বেশ আত্মবিশ্বাস আর গর্ব নিয়েই বললাম।‘সুন্দরীর মুখটা দিয়ে প্রকাশ ওস্তাদ শিল্পীর
ভালবাসার সুর,ছবিটাতে আসলে কোন খুঁত নেই,নতুন এক ভাবে তুলে ধরা শিল্প।কেন না ছবি আঁকতে আঁকতে সবাই একসময় শুধু ঐ বিশেষ সুন্দরীর মুখটাই এঁকে যাবে’।

আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম,দেখলাম সিয়াহ যে এত মনোযোগ দিয়ে উপমাগুলোর কথা শুনছিল,তার মনটা তখন বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়া আমার বৌ এর দিকে।

‘প্রথম গল্পটা বলে যে “নিয়ম,পদ্ধতির চাকায় আটকানো মন”,নিয়ে আসে ত্রুটি’।আমি বললাম।‘দ্বিতীয় গল্পটায় বলা যে নিখুঁত ছবি তার নিজের প্রকাশ সেখানে শিল্পীর সই বা চিহ্ন দিয়ে জানান দেয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই,আর তৃতীয় গল্পটা প্রথম আর দ্বিতীয়র সংমিশ্রনের নতুন এক আলাপ।
তাই এটা স্পষ্ট যে, ‘সই ‘,আর ‘পদ্ধতি’,আর কিছু না নোংরা ভাবে ত্রুটিপুর্ন কাজকে জাহির করা’।

এই মানুষটা,যাকে আমি ছবি আঁকা নিয়ে এত গল্প বললাম,কতটুকু জানা আছে তার,এ ব্যাপারে? ‘এই গল্পগুলো বলে দেয় আমি,কে’?

‘অবশ্যই’,সে বললো,বেশ জোর দিয়েই।

তা হলে আমাকে বোঝার চেষ্টা করো না অন্য কারও চোখ দিয়ে,আমাকে নিজেকে নিয়ে বলার সূযোগই বা দিলে কেন?আমিও তো কাজভিনের পুরোনো ওস্তাদদের মতই ছবিতে একই ভাবে রুপ আর নানান রংএ সাজিয়ে দিতে পারি।একটুঁ হেসেই বললাম,আমি হয়তো ঐ ধরণের ওস্তাদদের চেয়ে কোন অংশে কম না।সিয়াহর এই দর্শন বা পর্যবেক্ষনের কারণটা আমার ঠিক জানা নেই-তবে যতদূর সম্ভব মনে হয়,এটা জারিফ এফেন্দীর অর্ন্তধান নিয়ে।

সিয়াহ আমার কাছে জানতে চাইলো,যৌনতা আর শিল্পকলার সংমিশ্রনের ভাল,খারাপ নিয়ে।

আমি কাজ নিয়ে বেশ ব্যাস্ত থাকি,আনন্দও খুঁজে পাই আমার কাজে,বেশীদিন হয়নি বিয়ে করেছি এ এলাকার একজন সুন্দরীকে।যখন ছবি আঁকায় ব্যাস্ত থাকি না,তখন ব্যাস্ত থাকি পাগলের মত বৌ এর সাথে যৌনসঙ্গমে,তারপর উতসাহে,উচ্ছাসে,আনন্দে আবার কাজে ব্যাস্ত হয়ে যাই।তবে ঠিক সেটা আমার উত্তর ছিল না।
‘এটার উত্তর খুব একটা সহজ না’, আমি বললাম, ‘শিল্পীর অনুপ্রেরনা প্রকাশ প্রায় তার সাথে যৌনতার আনন্দে,উচ্ছাসের স্রোতে ভেসে যাওয়ায়,আবার ম্লান হয়ে আসে তার তুলির আঁচড় যৌনতার উচ্ছাস,আনন্দ হারায় যখন’।আমি এটা যোগ করতে ভুলিনি শিল্পীর প্রতিভার কারণ খুঁজতে গিয়ে মানুষ অনেক মিথ্যা,অপবাদও বিশ্বাস করে,হয়তো সিয়াহও তার বাইরে না।

সে বললো,যে ছবিগুলোর উপরে আমি কাজ করছি,সেগুলো যদি দেখাতে আমার আপত্তি না থাকে,তাকে ষ্টুডিওর কাজে টেবিলে নিয়ে বসালাম,চারপাশে কালি,কাগজ,ব্রাশ,
ছড়ানো।সিয়াহ পরখ করছিল দুই পাতার ছবিটা,আমাদের সুলতানের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কথা নিয়ে যা,আর ছবির পাতা দুটা শাহজাদার মুসলমানীর অনুষ্ঠানের।
ছবির সুলতানের সামনে বসে থাকা বন্দীদের যন্ত্রনার মুখ,ছবি আঁকার সময় সে দিন টেবিলের পাশের লাল গদিতে বৌ বসে ছিল,তার ধপধপে মার্বেল পাথরের উরু,আর তার হাতটা আদর করছিল আমার লিঙ্গকে।

দুই পাতার ছবিতে ছিল সুলতানের মহানুভবতার দৃশ্য,যেখানে জেলের আসামি,
ঋণ শোধ করতে না পারার বন্দীদের দোষ মওকুফ করে,তাদের মুক্তি দিচ্ছে।বসে থাকা সুলতান কার্পেটের,পাশে ব্যাগের মধ্যে রুপার মোহর,যেন আমিও ছবির একটা অংশ।সুলতানের পেছনে,প্রধান খাজাঞ্চী হাতের হিসাবের খতিয়ান পড়ে যাচ্ছে পাওনাদারদের নাম,পরিমান।পাওনাদাররেরা গলার শেকলে একে অন্যের সাথে বাঁধা,দূর্দশা আর যন্ত্রনার সুর তাদের কারও চোখের কান্নায়, কারও মুখে,কারও ভুরুর ভেঙ্গে পড়া চেহারায়।গান বাজনার লোকজনের চেহারায় হাল্কা লালের ছোঁয়া,মুখে হাসি,কবিতা আর গানের আনুষ্ঠানিকতার পর যখন মহান সুলতান সকলের হাতে নানান ধরণের উপহার তুলে দিচ্ছে।যদিও এটা প্রথমে আমার পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না,তবে পরে আমি এই দৃশ্যে আমি শেষ আসামীর বৌকে ছেঁড়া বেগুনী পোষাকে,একজন সুন্দরীকে রং ঝরে যাওয়া কাপড়ে আর দুঃখ সাজানো চোখে যোগ করি।এই লম্বা ভুরুর সিয়াহ আমি বোঝাবো যে শেকল বাঁধা আসামীদের ছবি কেন দুই পাতায় ছড়ানো,ছবিতে লাল রং এর প্রাধান্যের কারণ-আমি বলবো ছবিটা দেখতে দেখতে বৌ এর মন্তব্য আর আমার যুক্তি ব্যাখা বৌ এর কাছে-তবে সিয়াহ সেগুলোর ধারেকাছে না যেয়ে জিজ্ঞাসা করলোঃ

আমার কি কোন ভাবে জানা আছে হতভাগা জারিফ এফেন্দী কোথায়?

হতভাগা বলতে গিয়ে কি বোঝানোর ইচ্ছা ছিল,তার?আমি বলিনি জারিফ এফেন্দী,
প্রতিভা ছাড়া একজন শিল্পী,যার কাজ ছিল শুধু নকল করে যাওয়া,ও ছিল পয়সার জন্যে ছুটে যাওয়া এক শিল্পী,অনুপ্রেরনা আর অর্ন্তনিহিত চোখটা নেই যার,তাকে কি শিল্পী বলা যায়!‘না,তেমন কিছু আমার জানা নেই’,বললাম।
আমি অনেক সময় ভেবেছি ইরজুরুমের মোল্লার অন্ধ ভক্তদের,পাগলামির শিকার জারিফ?
সে দিকে না গিয়ে আমি বললাম, ‘না,তবে কি ব্যাপার’?

ইস্তাম্বুলের এই দূর্গতি,দারিদ্র,নানান ধরণের কেলেঙ্কারী যার দাসত্বে ভুগছে সারা শহর,তার একমাত্র কারণ,আমরা সরে গেছি ইসলাম থেকে,আমাদের নবীর শিক্ষা থেকে,আমরা অবিশ্বাসীদের শিল্প,আঁচারের দিকে ঝুকে গেছি,আমরা ছবি আঁকছি,গান বাজনাঊ মত্ত হয়ে আছি।এটাই ইরুজুমের মোল্লা সাহেবের বক্তব্য,কিন্ত তার বিপক্ষের মানুষজন সুলতানকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে ইরুজুমের লোকজন সুফীদের বাড়ীঘর যেখানে গানবাজনা হয় সেখানে গোলমাল করছে,ভেঙ্গে দিচ্ছে,দরবেশদের মাজার।তাদের তো জানাই আমি ইরুজুমের মোল্লা সাহেবের বিপক্ষে না,তবু কেন জানি একটা লুকোনো ধারণা যেন আমিই জারিফ এফেন্দীর অর্ন্তধানের জন্য দায়ী।

হঠাৎ একটা কথা মনে হলো,বেশ কদিন ধরেই এই প্রতিভাহীন,অথর্ব কিছু শিল্পী আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছে আমি আর কিছু না একজন খুনী।ইচ্ছা হচ্ছিল কালির সম্পুর্ন দোয়াতটা সিয়াহর মাথায় ঢেলে দিতে,যে ঐ সব বদনামকারীদের কথা বিশ্বাস করে এখানে প্রশ্ন করার জন্যে ছুটে এসেছে।

সিয়াহ আমার কাজের ষ্টুডিও খুঁটে খুঁটে দেখে মনে একটা ছবি এঁকে নিচ্ছিল,দেখছিল আমার কাঁচি,চাকু,সিরামিকের বাটির হলুদ রং,আপেল যা মাঝে মাঝে আমি কামড়ে ধতই কাজ করার সময়,ষ্টোভের একপাশে রাখা কফির কেটলী,না ধোঁয়া কফির কাপ কটা,
চেয়ারের গদি,জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া আলোর ছটা,আয়নাটা যেখানে আমি মাঝে মাঝে নিজেকে দেখি,আমার সার্ট,এককোনে পড়ে থাকা বৌ এর শাল যেন সিয়াহর আসার কথা শুনে তাড়াহুড়া করে ফেলে গেছে।

যদিও আমার মনের কথা্ সিয়াহকে খুলে বলিনি,তবে আমার ছবিগুলো,এই ঘর,চারপাশের সব কিছুতেই ছড়ানো ছিল আমার আবেগ,কথা যা সিয়াহর চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়।আমার এই ঔদ্ধত্যে হয়তো অনেকেই ভুরু কুচকাবে,তবে এটা ঠিক এখানে আমিই সবচেয়ে বেশী পয়সা উর্পাজন করি,সে হিসাবে নিঃসন্দেহে আমিই এখানকার শ্রেষ্ঠ শিল্পী।আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ ছবি আঁকাকে একটা আনন্দের প্রকাশ হিসাবেই তৈরী করেছে,তাই সারা পৃথিবীটা সেটাতে আনন্দ খুঁজে নেয় যারা পারে।



আমাকে সবাই ডাকে, ‘বক’


জোহরের সময়ে দরজায় একটা ধাক্কা শুনলাম।দেখি আমার ছেলেবেলার বন্ধু,সিয়াহ।
আমরা কোলাকুলি করে একে অন্যকে অভিনন্দন জানালাম,তার সারা শরীর শীতের ধাক্কায় বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে,ওকে তাড়াতাড়ি ভিতরে আসতে বললাম।ওকে জিজ্ঞাসাও করিনি,বাড়ীটা কি ভাবে খুঁজে পেল সে।এনিষ্টে নিশ্চয় তাকে পাঠিয়েছে আমাকে জারিফ এফেন্দীর অর্ন্তধান সমন্ধে প্রশ্ন করার জন্যে।দেখলাম ওস্তাদের অনুমতিও ছিল তার কাছে,যাতে সে প্রশ্ন করতে পারে।‘তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি,ওস্তাদ ওসমানের মতে প্রতিভাবান শিল্পী আর সাধারণ শিল্পীর সাথে পার্থক্য ধরা পড়ে, “সময়ে”।এ সমন্ধে তোমার কি মন্তব্য,একটুঁ বলবে আমাকে’?


ছবি আর সময়

অনেকদিন আগেকার কথা,এটা মোটামুটি সবারই জানা,মুসলমান শিল্পীরা,এমন কি পুরোনো আরবের ওস্তাদেরা যখন উপলদ্ধি করলো,অবিশ্বাসীদের মত তাদের নতুন ভাবে ছবি আঁকার পদ্ধতিটা,ভবঘুরে শিল্পী বা দুর্বোধ কেরানীর মত ছবি আঁকা।নতুন শিল্পীরা ছবিতে যদিও সময়ের প্রকাশ নিয়ে গর্ব করতো,কিন্ত তাদের ছবিটা তবুও ছিল ছন্দবিহীন,
অনেকটা কেরানীর কলমের কথা,নতুনত্ব নেই তুলে ধরা পুরোনো এক গল্প।তারপর নতুন এমন কিছু একটা আসলো,যা ছবি আঁকার জগতটাকে সম্পূর্ন বদলে দিল,সেটা নিয়েই এখন কিছু বলছি।


সময় আর ছবি নিয়ে তিনটা গল্প

আলিফ

প্রায় তিনশ পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা,যখন বাগদাদের পতন হলো মোঙ্গলদের হাতে, সারা শহরের লুটপাট চলছিল,সফর মাসে ইবনে সাকির,শুধু বাগদাদ না সম্পূর্ন আরব,এমন কি মুসলমান রাজত্বের একজন খ্যাতনামা কালিগ্রাফার,যদিও বয়সে যুবক,তবু এর মধ্যে গোটা বাইশ বই এর অনুকরন শেষ করেছে,বেশির ভাগই পবিত্র কোরানের অনুকরন,যার কিছু হয়তো পাওয়া যাবে পৃথিবীর সব নামকরা লাইব্রেরীতে।ইবনে সাকিরের বিশ্বাস ছিল এ বইগুলো থাকবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত,তাই সময়ের চিরন্তন একটা ভাব ছড়ানো ছিল তার মনে।সে রাতের অন্ধকারে মোমবাতির আলোতে তার শেষ করা ঐতিহাসিক বই এর পাতাগুলো একের পর এক দেখছিল,এখন যদিও সে গুলো আমাদের কাছে অজানা,কদিনের মধ্যেই যা মোঙ্গল হুলাগু খানের হাতে পুড়ে,ধ্বংস হয়ে চলে গেল টাইঘ্রিস নদীতে।

আরবের ওস্তাদ কালিগ্রাফাররা যুগের পর যুগ চোখকে বিশ্রাম দিতো সবসময় ভুলেও সূর্যের দিকে দেখতো না কোন সময়,পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে থাকতো যাতে আলোর প্রচন্ডতায় হঠাৎ অন্ধত্ব না আসে তাদের দৃষ্টিতে।দুই দিন পরে সেই ইবনে সাকির খলিফার মসজিদের মিনারে উঠে দেখলো হুলাগু খানের সৈন্যদের হাতে বাগদাদের মানুষের নিষ্ঠুর হত্যা,শিশু,মহিলা,বুড়ো,যুবকের কোন বাছবিচার ছিল না,ধর্ষন,লুটপাট-টাইঘ্রিস নদীর পানি লাল রক্তে আর ঐ বইগুলোর লাল রং এ।সে অবাক হয়ে ভাবছিল তার এত সুন্দর আর কষ্ট করে নকল করা কোরান শরীফ ঐ অত্যাচারে কোন সাহায্য করতে পারে নি।ইবনে সাকুর এর পর প্রতিজ্ঞা করলো,কালিগ্রাফী তার জন্যে না,মনের যন্ত্রনা তুলে ধরার জন্যে কলম আর কালির বদলে তুলে নিল ছবি,তুলির আঁচড়ে এঁকে গেল খলিফার মসজিদের মিনার থেকে দেখা মানুষের কান্না,হতাশা,যন্ত্রনার সুর।ইসলামের রেনেসাঁর তিনশ বছরের জৌলুষের পর্বের কৃতিত্ব,ঐ সময়ের,কৃতিত্ব ইবনে সাকুরের,মোঙ্গল অধিকারের,যা আমাদের সরিয়ে নিয়ে গেছে পুতুল পূজারী আর খৃষ্টান,চীনা শিল্পীদের পদ্ধতি থেকে।এটা থেকে এটুকু বলা যায় অনন্ত সময়ের যে ছবিটা একজন কালিগ্রাফারের মনে আঁকা-সেটা ফুটে উঠলো লেখার সৌন্দর্যে না ছবির প্রকাশে।এটার প্রমান এটাই যে পুরোনো বই থেকে ছিঁড়ে নিয়ে একই ছবি অন্যান্য বই এ ব্যাবহার করা হয়েছে,বইগুলো বদলে গেছে গল্পে কথায়,তবে ছবিগুলো তাদের সৌন্দর্য নিয়ে টিকে আছে,আল্লাহর পৃথিবীতে-যা চিরতরে টিকে থাকবে।


০০০০০০০০০




(

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:৪৮

রাজীব নুর বলেছেন: মাই নেম ইজ রেড আমি পড়েছি। অথচ আপনার পোষ্ট দেখে কিছুই মনে করতে পারছি না। এর কারন কি?

২| ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৩২

ইল্লু বলেছেন: হয়তো বা ভোঁতা কলমের ধাক্কা।এর আগের ৬ টা পর্ব ছিল ২০২২ সালে।
ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.