নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইল্লু

ইল্লু › বিস্তারিত পোস্টঃ

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২৪ শে জুলাই, ২০২৩ রাত ১:৪২

ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা





(১৫)

আমি আজরাইল-আমি মৃত্যু



আমি মৃত্যু,তবে আমাকে ভঁয় পাওয়ার কোন কারণ নাই,আমি তো এখন শুধুই একটা ছবি।তবুও কেন জানি দেখছি সকলের চোখে বেশ একটা ভঁয়,ওটাই স্বাভাবিক।যদিও তোমরা সবাই জান আমি বাস্তব কিছু একটা না-তবুও কেন জানি তোমরা ভাবছো সত্যি সত্যিই হয়তো আজরেল,মৃত্যুর সাথে দেখা হলো তোমাদের,এটা অবশ্য আমাকে বেশ আনন্দ দেয়।শুধু তাই না,ছবিটা দেখেও সেই মুহুর্তে,ভঁয়ে অনেকে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলে,এটা হাসির কথা না,মৃত্যুর সামনাসামনি হলে সবচেয়ে সাহসী বিদ্রোহী মানুষেরাও মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।সেই কারণেই শিল্পীরা যখন যুদ্ধের মাঠের ছবি আঁকে তখন সেখানে রক্ত,অস্ত্রশস্ত্র,হেলমেট প্রাধান্য পায় না,বরং পচা শরীর আর পেশাব পায়খানা ছবির একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
জানি এই প্রথম তোমাদের দেখা মৃতুর ছবি।বছর খানেক আগে,একজন লম্বা,পাতলা,রহস্যে
ভঁরা বুড়ো,যুবক এক শিল্পীকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল আর সেখান থেকেই উদ্ভব হলো,আমার এই ছবির।দোতলা বাড়ীটার আলো আধারী ঘরটায় শিল্পীকে বিশেষ ভাবে মশলা দেয়া তৈরী করা চা দিয়ে,বুড়ো নীল দরজার ঘরটায় হিন্দুস্থান থেকে দামী কাগজ,খরগোসের লোমের ব্রাশ,নানান ধরণের সোনার পাতা,হাতীর দাঁতের কলম দিয়ে বললো,ছবিটা শেষ হলে তাকে ভালই টাকা পয়সা দেয়া হবে।
‘তুমি ফেরেশতা আজরাইল,জান কবজ করার দায়িত্ব যে ফেরেশতার,মৃত্যুর একটা ছবি আঁকবে’,বুড়ো বললো।
‘জানি না মৃত্যুর ছবি কি ভাবে আঁকবো,ও ব্যাপারে আমার কোন অভিজ্ঞতা নাই,
অভিজ্ঞতা ছাড়া অনুভুতি,আবেগ আসবে কোথা থেকে’?তবু ও সেই প্রতিভাবান শিল্পী মৃত্যুর একটা ছবি এঁকে দিল সময়মত।
উৎসাহী বুড়ো বললো, ‘দেখা শুধু শিল্পীর উপলদ্ধির উৎস না,কল্পনার রাজ্যও তৈরী করে দেয় একটা ছবি’।
‘হয়তো,হয়তো না,একটা ছবির সত্যিকারের চেহারাটা তুলে ধরার জন্যে পুরোনো দিনে ওস্তাদ শিল্পীরা সেটা যে কতবার আঁকতো তা হিসেবের বাইরে।যত দক্ষই একজন শিল্পী হোক না কেন,প্রথমবার যে কোন ছবি আঁকলে সেটা তার কাছে নিজের ছবিটাও একজন শিক্ষানবীশের ছবির মতই মনে হবে।উপলদ্ধি একপাশে সরিয়ে রেখে যদি মৃত্যুর ছবি আঁকি,সেটা হবে অনেকটা আমার মত একজন শিল্পীর মৃত্যুর সমকক্ষ’।
‘এমন ও হতে পারে,হয়তো মৃত্যুর সেই ছবি নিয়ে যাবে তোমাকে উপলদ্ধির নতুন এক জানালায়’,বুড়ো মানুষটা বললো।
‘অভিজ্ঞতায় একটা ছবির সৌন্দর্য ফুটে উঠে না,আর তাতে আমাদের দক্ষতাও বাড়ে না।অভিজ্ঞতার অভাব,জানার আকাঙ্খা আমাদের মনে দক্ষতা আনে’।
‘ও দক্ষতা নিয়েই তুমি মৃত্যুর ছবি আঁকতে পার’।
এ ভাবে দুজনে বেশ কিছু সময় বাদানুবাদ করলো,মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটছিল দুজনেই,
অজানা কোন এক সুত্র তুলে ধরে চলছিল,নতুন ওস্তাদ শিল্পীদের প্রতিভার প্রশংসা।তাদের বাদানুবাদ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম,জানি সেটা হয়তো কফির দোকানের অন্যান্য শিল্পীদের কাছে একেবারেই নীরস মনে হতো।
আলোচনার বিষয়বস্ত ছিলঃ
‘শিল্পীর প্রতিভা তাকে কি নতুন দৃষ্টিকোন দেয়,দক্ষতার তুলির আঁচড়ে যা সে তুলে ধরতে পারে ছবির আঙ্গিকে’?প্রশ্ন করলো দক্ষ হাতের,স্বচ্ছ চোখের শিল্পী,উত্তরটা জানা ছিল তার,তবু তার জানার ইচ্ছা ছিল অন্য দৃষ্টিকোন থেকে।
‘ভেনিসে একজন শিল্পীর ছবি আঁকার দক্ষতার মাপকাঠি হলো,শিল্পীর ছবি আঁকার অন্যন্য ভঙ্গী আর পদ্ধতি,একেবারেই নতুন কোন দিন দেখা যায়নি’,বুড়ো মানুষটা বললো।
‘ভেনিসের লোকজনের মৃত্যু হয় ভেনিসের জীবনের মতই’,শিল্পী আমার ছবিট শেষ করার পরে উত্তর দিল।
‘কিংবদন্তী আর ছবির বিশেষত্ব একটার সাথে আরেকটার পার্থক্যে না,বরং শিল্পীর সার্থকতা সেখানে,যেখানে আমাদের চোখে হবে সেটা যেন জানা আমাদের’।
আলোচনার ফল যা দাঁড়ালো,সেটা ভেনিসের মানুষ আর ওটোমান সাম্রাজ্যের মানুষদেরর মধ্যে মৃত্যুর উপলদ্ধির পার্থক্যটা,আজরাইল আর অন্যান্য ফেরেশতাদের কাফেররা কোনদিনই তাদের তুলির আঁচড়ে তুলে ধরতে পারবে না।কমবয়সী দক্ষ এই ওস্তাদ শিল্পী শ্যেন উপলদ্ধির আবেগে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল,কিন্ত তার ধারণা ছিল না আমি কি,কি ভাবে আমাকে টেনে আনা যায় কাগজের খাঁচায়।

চালাক আর হিসাবী বুড়োর প্রতারনায় কমবয়সী ওস্তাদ শিল্পীর মানসিক ইচ্ছাটা আরও জোরদার হলো,আলোআঁধারী ঘরটায় টিমটিম করা বাতিতে বুড়ো লোকটা তাকিয়ে ছিল শিল্পীর চোখে।

শিল্পী বললো, ‘ভেনিসের শিল্পীদের তুলিতে মৃত্যুকে এঁকে দেয়া মানুষের রুপে,আমাদের কাছে সে ফেরেশতা আজরাইল।হ্যা,মানুষের চেহারায় দিয়ে যেমন ফেরেশতা জিব্রাইল আমাদের সম্মানিত পয়গম্বরের হাতে আল্লাহর বানী তুলে দিচ্ছে।আপনি এটা নিশ্চয় বোঝেন’?

দেখলাম তরুন শিল্পী যার হাতে আছে আল্লাহর দেয়া অভাবনীয় প্রতিভা,আমাকে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরার জন্যে অসহিষ্ণু হয়ে ছিল,শয়তান বুড়োর প্ররোচনায়ঃকিছু একটা আঁকার ইচ্ছা ছিল তার,যা সকলের অজানা।
‘মৃত্যু সমন্ধে কিছুই জানা নাই আমার’,যুবক শিল্পী মন্তব্য করলো আবার।
‘মৃত্যু আমাদের সকলেরই জানা’,বুড়ো মানুষটা বলল।
‘আমরা ভঁয় করি তাকে,তবে আর কিছু জানা নাই আমাদের’।
‘তা হলে তোমার হাতে এখন সেই ভঁয়টা আঁকার দায়িত্ব দিলাম’,বুড়ো মানুষটা বললো।

শিল্পী আমাকে আঁকা আরম্ভ করলো,ঘাড়ে সুড়সুড়ি,আঙ্গুলগুলো নিশপিশ করছে,ব্রাশ তুলে ধরার জন্যে,একটা কলম টেনে আনার জন্যে।তবে সে ছিল একজন সত্যিকারের
শিল্পী,সে চায়নি এই অস্বস্তিতে তার চিন্তাধারা যেন ধোঁয়াটে হয়ে যায়।

বুড়ো লোকটা বুঝতে পেরে তরুণ শিল্পীকে,ইমাম আল-গাজ্জালী,আল-সুইয়ুতি,আর আল-জেইভজিইয়ের লেখা পড়ে উদ্ধুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল।

তরুণ ওস্তাদ শিল্পী তার তুলির ছোঁয়ার চমকে একটা পোট্রেট তুলে ধরলো,ভঁয়ে ভঁয়ে তোমার হাতে ধরা সেটা এখন।শিল্পীর চোখে মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাজার দশেক ডানা আছে যা ছড়ানো বেহেশত থেকে পৃথিবীতে,পুর্ব থেকে পশ্চিমে।তার মতে ঐ ডানাগুলো বিশ্বাসীদের সহজেই পৌঁছে দেয় ইহলোক থেকে পরলোকে,আর পাপী,বিদ্রোহীদের শরীর ভেদ করে চরম যন্ত্রনায় জানান দেয় মৃত্যুর ভয়াবহ চেহারাটা।মোল্লাদের কাছ থেকে তার শোনা আল্লাহর ফেরেশতা যখন কারও জীবন নিতে আসে,তার সাথে থাকে হিসাবের খাতা,সকলের নাম আছে সেখানে,তবে কারও কারও নাম থাকবে কালো কালি দিয়ে দাগানো।একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও জানা নাই সেই বিশেষ মুহুর্তটাঃসেই সময়টা যখন আসে,আল্লাহর সিংহাসনের পাশের গাছটা থেকে একটা পাতা ঝরে যায়।শিল্পীর চোখে যদিও আমি ভয়াবহ কিছু একটা,তবে আমার একটা মন আছে যার বোঝার ক্ষমতাও আছে।পাগল বুড়ো বলছিলঃমৃত্যু,আজরাইল-একটা মানুষের কাছে যখন আসে,যার আত্মার এ জগত থেকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,তার পাশে একটা আলো ছড়ায় যা মানুষের চোখে পড়ে না,সেই জন্যেই শিল্পীর তুলিতে আমি আলোয় ছড়ানো একটা চরিত্র।অস্থির বুড়ো আবার কিছুটা অংশ পড়ছিল ইমাম আল-গাজ্জালীর বই থেকে,শোনা যায় পুরোনো দিনে কবর থেকে চুরি করার সময় ডাকাতদের দেখা,কবরে কোন লাশ ছিল না,সেখানে কাঁটায় ভর্তি,আর আগুন আর গলানো শিশায় ভর্তি মাথার খুলি।সবকিছু শুনে শিল্পীর তুলি আমাকে এমন ভাবে আঁকলো যা দেখে কারও ভঁয় না পেয়ে উপায় নাই।

শিল্পী অবশ্য অনুশোচনা করছিল ছবিটা আঁকার জন্যে,কারনটা ছবির ভয়ানক রুপটা না,বরং সাহস করে ছবিটা আঁকার জন্যে,আর অজানাকে জানার একটা নতুন চেহারায় তুলে ধরার অপরাধবোধ।আর নিজের কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল কোন কোন সময় একজন সন্তান নিজের বাবার কাছেও একজন লজ্জার পাত্র।জানি না কেন ঐ তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী আমার ছবি আঁকার জন্যে অনুশোচনা করছিল?

১)হতে পারে মৃত্যুর ছবি তার মনের সম্পূর্ন দক্ষতা নিয়ে আঁকা হয়নি।এর মধ্য অনেকের কাছেই জানা আমার অভাবনীয় সৌন্দর্য,ভেনিস আর হেরাতের শিল্পীদের তুলিতে আমার ছবি দেখে সেটা বোঝাই যায়।আমি নিজেও কিছুটা বিব্রত হয়ে গেছি,তরুন ওস্তাদের তুলির আমার করুন চেহারাটা আমাকে কিছুটা বিব্রত করছিল,ওটা তো আমার সম্মানিত চেহারা না।

২)বুড়োর প্ররোচনায় তাড়াহুড়া করে ওস্তাদ শিল্পী যে ভাবে আমাকে আঁকলো,সেটা অনেকটা যেন ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরনে।তার মন খারাপ হওয়ার কারণটাও বুঝলাম,অনুশোচনা এটা ভেবে যে ঐ ছবিতে পুরোনো ওস্তাদদের অসম্মান করা হলো নাকি ছবিতে।

৩)হয়তো কিছুটা অভিভূত হয়ে গেছে সে,অনেকটা অবুঝ নবীন শিল্পীদের মত,তবে মৃত্যু,আজরাইলের চিন্তা তো কোন হাসির ব্যাপার না।

এখন ঐ ওস্তাদ শিল্পী,মনের দুঃখে রাতের রাস্তায় এলেমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ায় অস্থির মনে,অনেকটা সেই চীনা শিল্পীর মত,যার ধারণা ছিল সেই ছবির বাস্তব রুপ।



আমি এসথার


লালমিনার আর কালো বিড়ালের বিলেজেকের লাল,বেগুনী কাঁথা,সকাল সকাল আমি নানান কাপড়চোপড়ে দিয়ে ফেরীর বাক্স ভর্তি করা আরম্ভ করলাম।পর্তুগালের কাপড়,চীনের সবুজ সিল্ক যার কাটতি তেমন একটা ছিল না,সাথে চোখ জুড়ানো নীল সিল্ক।মানুষের মনটা টানতে হবে কোন এক ছলায়।শীতটা প্রচন্ড তাই গরম মোজা,উলের জ্যাকেটও ছিল।কম্বলটা যখন খুলবো রকমারী সুন্দর কাপড়চোপড় দেখে কার না মনটা নেচে উঠবে। দামী সিল্কের রুমাল,চামড়ার ব্যাগ,হাতে কাজ করা ধোয়ামোছার কাপড়ও ছিল সাথে,
মেয়েরা যারা শুধু গল্প করার জন্যে আমাকে ডাকে,এগুলো তাদের জন্যে।ফেরীর ব্যাগটা তুলে দেখি,বেশ ভারী হয়ে গেছে,অত কিছু হয়তো বেড়ানো সম্ভব হবে না।কি রেখে কি নিব ভাবছি,তখন দরজায় একটা ধাক্কা শুনলাম।নেসিম দরজা খুলে বললো,আমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করছে।বুড়োর রক্ষিতা,হাইরিয়ে,মুখটা একটুঁ লাল হয়ে আছে,সে আমাকে চিঠি হাতে তুলে দিল।‘চিঠিটা সেকুরে দিল’,এমন ভাবে ফিসফিস করে বললো যেন চিঠিটা তারই দেয়া,আর তার চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বোকা চাকরানীকে বললাম সোজা বাড়ী চলে যেতে,যেন কেউ তাকে না দেখে।নেসিমের চোখেমুখে কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা আটকে ছিল।ফেরীর বাক্স তুলে বের হলাম,কোন এক ফাঁকে চিঠিটাও দিতে হবে।
‘সেকুরে,ওস্তাদ এনিষ্টের মেয়ে,প্রেমের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে।একেবারেই পাগল হয়ে গেছে,হতভাগা মেয়ে’,নেসিমের কৌতুহল মেটানোর জন্যে বলে একটুঁ খিলখিল করে হেসে বের গেলাম।সত্যি কথা বলতে কি সেকুরের জন্যে আমার দুঃখই হচ্ছিল,তার অনুভুতি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে চাইনি।অদ্ভুত সুন্দরী এক মেয়ে,গাঢ় কালো চোখ,ধবধবে মাখনের মত একটা শরীর।

বেশ তাড়াতাড়ি করে ইহুদীদের পাড়া ছেড়ে গেলাম,শীতের সকালে দেখে মনে হচ্ছিল আরও পুরোনো ভেঙ্গে পড়া একটা পাড়া।অন্ধ ফকিরকে পার হয়ে হাসানদের গলিতে চীৎকাঁর করে ডাক দিচ্ছিলাম, ‘ফেরীওয়ালা’।

‘মোটা ডাইনী,চীৎকাঁর না করলেও তোমার পায়ের শব্দেই আমি তোমার বুঝতে পারি,এটা আমার মোটা ফেরীওয়ালা ছাড়া আর কিছু না’,ফকিরটা বললো।‘অকেজো অন্ধ’,আমি বললাম, ‘হতভাগা তাতার।আল্লাহ তোমাকে তোমার অপরাধের জন্যেই অন্ধ করেছে।যে শাস্তি তোমার প্রাপ্য আল্লাহ তোমাকে সেই শাস্তিই দিবে’।
সাধারণত তার কথাবার্তায় আমি কোনদিনই রাগি না।
হাসানের বাবা দরজা খুলে বের হলো,আবখাজিয়ান বেশ উঁচু বংশের লোক তারা।
‘দেখি আজকে কি বিক্রি করছো’?
‘তোমার আলসে ছেলেটা কি এখনও ঘুমাচ্ছে’?
‘কি ভাবে ঘুমাবে,ও তো তোমার খবরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’।
বাড়ীটা সবসময় এতই অন্ধকার থাকে,যে মনে হয় আমি একটা কবরে ঢূকছি।সেকুরে আমাকে কোনদিন এই বাড়ী নিয়ে প্রশ্ন করেনি,তবে আমি সবসময় তাকে বলতে দ্বিধা
করিনি,এই জঘন্য জায়গায় ফিরে না আসার জন্যে।এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একসময় সেকুরে এই বাড়ীর বৌ ছিল,আর তার চঞ্চল ছেলেদের এই বাড়ীতেই এতগুলো দিন শেষ করে গেছে।এই বাড়ীতে শুধু ঘুম আর মৃত্যুর গন্ধ,পাশের ঘরে গেলাম আমি সেটা আরও অন্ধকাঁর।
নিজের হাতটাকেও সেখানে দেখা যায় না।আমি হাসানকে চিঠিটা দেয়ার সুযোগও পেলাম না,অন্ধকারে হঠাৎ কোথা থেকে সে আমার হাত থেকে চিঠিটা ছোবল দিয়ে নিয়ে গেল।বরাবর আমি যা করি,চিঠিটা পড়ার সূযোগ দিয়ে সরে গেলাম।কিছুক্ষন পর মাথা তুলে হাসান জিজ্ঞাসা করলো, ‘আর কিছু নাই’,যদিও সেটা জানাই ছিল তার, ‘বেশ বড় একটা চিঠি’।

হাসান জোরে জোরে পড়ছিল, ‘সিয়াহ এফেন্দী,তুমি আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই আস,ভালই সময় কাটাও আমার বাবার সাথে।আমি এটাও জানি তুমি আমার বাবার বই এর একটা লাইনও এখনও লেখনি।তোমার কোন আশা পূর্ন হবে না ঐ বই শেষ হওয়ার আগে’।

চিঠি হাতে হাসান আমার দিকে তাকিয়ে ছিল,যেন সবকিছু আমার অপরাধ।আমি এই নীরবতার সম্পূর্ন বিপক্ষে।‘চিঠিতে তার বিয়ে,তার স্বামী ফিরে আসার কোন কথা বলেনি,কেন’?হাসান জিজ্ঞাসা করলো।‘আমি কি ভাবে জানবো,চিঠিটা তো আমি লিখিনি’,আমি বললাম।‘সেকুরে মনের কথাগুলো জানার খুবই ইচ্ছা আমার ’,এটা বলে সে আমার হাতে ১৫টা রুপার মোহর তুলে দিল।
‘অনেক মানুষ যত তাদের টাকা হয় ততই কৃপন হয়ে যায় তারা,তুমি সে ধরণের না’,
আমি বললাম।
এই মানুষটার বুদ্ধি আর চমক,চালাকি আর শয়তানী ছেড়ে অনেক সময় তাকে একটা ভাল মানুষ হিসাবে তুলে ধরে,এখন বুঝতে পারি এত কিছুর পরেও সেকুরে কেন তার চিঠি পড়ে।
‘সেকুরের বাবার বইটা কি নিয়ে লেখা হচ্ছে’?
‘জানি না,তবে আমাদের সুলতান বইটার সব খরচ দিচ্ছে’।
‘শিল্পীরা একে অন্যকে খুন করছে এই বইটার জন্যে’,হাসান বললো, ‘শুধু কি মোহরের লোভে,আমাদের পবিত্র ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে?অনেকে বলে একবার এই দেখলেই তুমি অন্ধ হয়ে যাবে’।
এমন ভাবে হেসে হাসান কথাগুলো বললো,যাতে আমার কোন কিছু ভাবার দরকার ছিল না আর।যতই যা হউক তার কথার ভঙ্গীতে বোঝা যাচ্ছিল বিচলিত হওয়ার তেমন কিছু নাই।খেপে গেলে চিঠির বাহককে অনেকেই গালাগালি করে,তবে মেয়েরা সে ক্ষেত্রে জড়িয়ে কাঁদে।
‘তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী’,আমাকে কিছুটা খুশী করার জন্যে হাসান বললো, ‘এই টুথপেষ্টটা দিবে ঐ বোকা লোকটাকে,দেখি সে কি বলে’।
ভাবছিলাম বলবো, ‘সিয়াহকে তুমি যত বোকা ভাবছো,ঠিক তা না’,এ সব ক্ষেত্রে এক প্রেমিককে আরেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে ঈর্ষা জাগালে আমার কাছে বেশি পয়সা আসার কথা,তবে দেখে মনে হলো,হাসান রেগেমেগে চীৎকাঁর করে উঠবে।‘তোমাদের রাস্তার পাশের অন্ধ তাতার ফকিরটা,খুবই অভদ্র আর জঘন্য সব মন্তব্য করে’।
ঐ ফকিরটার সাথে আবার যাতে বাদানুবাদ না হয় তাই রাস্তার অন্যদিকে হেটে মুরগীর বাজার দিয়ে যেতে হলো।মুসলমানেরা মুরগীর পা আর মাথা খায় না কেন?ওরা হলো অবাক করা একটা জাতি!আমার দাদী,তার আত্মার শান্তি হোক,বলতো পর্তুগাল থেকে আসার পর এখানে মুরগীর পা এতই সস্তা ছিল যে অবিশ্বাস্য,আর সেটা সিদ্ধ করে খেত দাদী মা।
হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম এক মহিলা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে সাথে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে তার ক্রীতদাসী।মহিলার চোখেমুখে একটা গর্বিত ভাব,আভিজাত্যের বড়াই,হয়তো কোন পাশার বৌ বা মেয়ে হবে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবছিলাম সেকুরের বাবা যদি তার বই নিয়ে এত ঢুবে না থাকতো,সেকুরের স্বামী সাফাভিদের যুদ্ধ থেকে সম্পদ নিয়ে ফিরে আসতো,এই যন্ত্রনার জীবন কাটাতো না,হতভাগী মেয়েটাকে।
সিয়াহর বাড়ীর রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে,বুকটার ধুকধুকানি বেড়ে গেল,আমি কি চাই সেকুরে এই লোকটাকে বিয়ে করুক?এতদিন ধরে আমি তো হাসান আর সেকুরের সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাচ্ছি,এমন কি সিয়াহ আর সেকুরের দূরত্ব তৈরী করতেও দ্বিধা করিনি।সিয়াহর মনের কথাটা কি?সিয়াহ সবদিক দিয়েই একটা যোগ্য মানুষ,তবে সেকুরের মন বোঝা খুবই দুষ্কর ব্যাপার ছাড়া।
‘ফেরীওয়ালা…’।
প্রেমিকদের চিঠি দেয়া নেয়া যার সাথে মেশানো আছে একাকীত্ব,পুরুষ খোঁজার স্বপ্ন,তাতে আমার ব্যাবসার আনন্দের চেয়ে অনেক বেশী।হতাশা মেশানো চিঠি পড়ার সময়ও তাদের চোখেমুখের আশা আনন্দের সাথে আর কিছুর সাথে তুলনা করা সম্ভব না।
তার স্বামীর ফেরা নিয়ে কোন কিছু না বলে,সেকুরের সর্তকবানী, ‘অযথা কোন আশা করো না’,সেকুরর ঐ কথায় সিয়াহর আশা আরও বেড়ে গেছে।আনন্দের সাথে দেখলাম সিয়াহর চিঠি পড়ার দৃশ্যটা,এত খুশি সে তখন যেন অন্য আরেক স্বপ্নের আকাশে যদিও অজানা ভয় ছিল তার চোখে মুখে,সে ছুটে গেল চিঠির উত্তর দিতে।আমি তখন এক চালাক ফেরীওয়ালার মত বাক্স খুলে সিয়াহর বাড়ীওয়ালীকে চামড়ার ব্যাগ বিক্রি করার চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।
‘এটা পারস্যের ভেলভেটের চামড়া দিয়ে তৈরি’।
‘আমার ছেলে মারা গেছে পারস্যের যুদ্ধে’,বাড়ীওয়ালী বললো, ‘তা কাঁর চিঠি সিয়াহর কাছে নিয়ে যাচ্ছ’?বাড়ীওয়ালীর মনের কথাটা বোঝাই যাচ্ছিল,হয়তো ভাবছে তার আইবুড়ো মেয়ে বা পরিচিত অন্য কাঁরও মেয়েকে সিয়াহর গলায় ঝুলানোর জন্যে।‘না তেমন কারও চিঠি না’,আমি বললাম, ‘ওর এক গরীব আত্মীয়,বায়রাম পাশার হাসপাতালে আছে,চিকিৎসার জন্যে তার কিছু টাকা দরকার’।
‘তাই নাকি’,অবিশ্বাসের সাথে বাড়ীওয়ালী প্রশ্ন করলো, ‘কে সেই হতভাগা লোকটা’?
‘আপনার ছেলে কি ভাবে মারা গেছে’,কেন জানি একটু রেগে জিজ্ঞাসা করলাম।
আমরা দুজন দুজনকে দেখছিলাম একে অন্যের শত্রু হিসাবে,মহিলা বিধবা একা,তার জীবন হয়তো বেশ কষ্টের।তোমরা কেউ যদি এসথারের মত ফেরীর ব্যাবসা করো,তা হলে জানতে পারতে,শুধু টাকাপয়সা,ক্ষমতা,রসাল প্রেম কাহিনী এগুলোই মানুষের কৌতুহল জাগায়।তা ছাড়া আর যা আছে দুঃশ্চিন্তা,ঈর্ষা,ছাড়াছাড়ি,একাকীত্ব,বিদ্বেষ,কান্না আর গুজব,সীমা ছাড়ানো দারিদ্র।এগুলো কোনদিন বদলায় না,যেমন বাড়ীর আসবাবপত্র,রং হারানো পুরোনো গালিচা,রান্না ঘরের হাড়ি চামচ,চূলার পাশের ছাই এর গামলা,বিধবার একাকীত্ব আর পুরানো তলোয়ার,চোরদের ভঁয় দেখানোর জন্যে।
সিয়াহ তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বললো, ‘ফেরীওয়ালী’,বাড়ীওয়ালী যেন শুনতে পায় সে ভাবেই জোরে জোরে বলছিল সিয়াহ, ‘শোন এটা নাও,আমাদের রুগীকে দিবে।তার যদি কোন কিছু বলার থাকে আমাকে জানাতে বলবে,আর হ্যা আমাকে পাবে ওস্তাদ এনিষ্টে এফেন্দীর বাড়ীতে,ওখানেই সারাটা দিন কাটাবো’।
সিয়াহর এই লুকোচুরি খেলার কোন দরকাঁর নাই,এ রকম তরুণ সাহসী একটা মনের কোন কিছু লুকানো,চিঠি দেয়া,সিল্কের রুমাল দেয়া,কি যায় আসে।নাকি ওর মনটা সত্যি সত্যিই ঝুকে আছে বাড়ীওয়ালীর মেয়ের দিকে?কোন কোন সময় আমি সিয়াহকে একেবারেই বিশ্বাস করি না,কেন জানি মনে হয় ও সেকুরেকে ঠকাচ্ছে।সেকুরের বাড়ীতে সারাদিন কাটানোর পরও সেকুরেকে ইঙ্গিত করার সাহস হয়নি,সাহস হয়নি হাত বাড়িয়ে সেকুরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে।বাড়ী থেকে বার হয়ে দেখি ব্যাগে ১২টা রুপার মোহর,আর একটা চিঠি।চিঠিটায় কি লেখা জানার এতই ইচ্ছা ছিল যে,হাসানের বাড়ীর দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম।শাকসব্জীর ব্যাবসায়ীরা বাঁধাকপি,গাঁজর,সবাই নিজের সব্জীর ডালি নিয়ে বসে আছে।তরতাজা শাক দেখেও অপেক্ষা করার ইচ্ছা হলো না আমার।

০০০০০০০০০

(১৫)

আমি আজরাইল-আমি মৃত্যু



আমি মৃত্যু,তবে আমাকে ভঁয় পাওয়ার কোন কারণ নাই,আমি তো এখন শুধুই একটা ছবি।তবুও কেন জানি দেখছি সকলের চোখে বেশ একটা ভঁয়,ওটাই স্বাভাবিক।যদিও তোমরা সবাই জান আমি বাস্তব কিছু একটা না-তবুও কেন জানি তোমরা ভাবছো সত্যি সত্যিই হয়তো আজরেল,মৃত্যুর সাথে দেখা হলো তোমাদের,এটা অবশ্য আমাকে বেশ আনন্দ দেয়।শুধু তাই না,ছবিটা দেখেও সেই মুহুর্তে,ভঁয়ে অনেকে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলে,এটা হাসির কথা না,মৃত্যুর সামনাসামনি হলে সবচেয়ে সাহসী বিদ্রোহী মানুষেরাও মানসিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।সেই কারণেই শিল্পীরা যখন যুদ্ধের মাঠের ছবি আঁকে তখন সেখানে রক্ত,অস্ত্রশস্ত্র,হেলমেট প্রাধান্য পায় না,বরং পচা শরীর আর পেশাব পায়খানা ছবির একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়ায়।
জানি এই প্রথম তোমাদের দেখা মৃতুর ছবি।বছর খানেক আগে,একজন লম্বা,পাতলা,রহস্যে
ভঁরা বুড়ো,যুবক এক শিল্পীকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল আর সেখান থেকেই উদ্ভব হলো,আমার এই ছবির।দোতলা বাড়ীটার আলো আধারী ঘরটায় শিল্পীকে বিশেষ ভাবে মশলা দেয়া তৈরী করা চা দিয়ে,বুড়ো নীল দরজার ঘরটায় হিন্দুস্থান থেকে দামী কাগজ,খরগোসের লোমের ব্রাশ,নানান ধরণের সোনার পাতা,হাতীর দাঁতের কলম দিয়ে বললো,ছবিটা শেষ হলে তাকে ভালই টাকা পয়সা দেয়া হবে।
‘তুমি ফেরেশতা আজরাইল,জান কবজ করার দায়িত্ব যে ফেরেশতার,মৃত্যুর একটা ছবি আঁকবে’,বুড়ো বললো।
‘জানি না মৃত্যুর ছবি কি ভাবে আঁকবো,ও ব্যাপারে আমার কোন অভিজ্ঞতা নাই,
অভিজ্ঞতা ছাড়া অনুভুতি,আবেগ আসবে কোথা থেকে’?তবু ও সেই প্রতিভাবান শিল্পী মৃত্যুর একটা ছবি এঁকে দিল সময়মত।
উৎসাহী বুড়ো বললো, ‘দেখা শুধু শিল্পীর উপলদ্ধির উৎস না,কল্পনার রাজ্যও তৈরী করে দেয় একটা ছবি’।
‘হয়তো,হয়তো না,একটা ছবির সত্যিকারের চেহারাটা তুলে ধরার জন্যে পুরোনো দিনে ওস্তাদ শিল্পীরা সেটা যে কতবার আঁকতো তা হিসেবের বাইরে।যত দক্ষই একজন শিল্পী হোক না কেন,প্রথমবার যে কোন ছবি আঁকলে সেটা তার কাছে নিজের ছবিটাও একজন শিক্ষানবীশের ছবির মতই মনে হবে।উপলদ্ধি একপাশে সরিয়ে রেখে যদি মৃত্যুর ছবি আঁকি,সেটা হবে অনেকটা আমার মত একজন শিল্পীর মৃত্যুর সমকক্ষ’।
‘এমন ও হতে পারে,হয়তো মৃত্যুর সেই ছবি নিয়ে যাবে তোমাকে উপলদ্ধির নতুন এক জানালায়’,বুড়ো মানুষটা বললো।
‘অভিজ্ঞতায় একটা ছবির সৌন্দর্য ফুটে উঠে না,আর তাতে আমাদের দক্ষতাও বাড়ে না।অভিজ্ঞতার অভাব,জানার আকাঙ্খা আমাদের মনে দক্ষতা আনে’।
‘ও দক্ষতা নিয়েই তুমি মৃত্যুর ছবি আঁকতে পার’।
এ ভাবে দুজনে বেশ কিছু সময় বাদানুবাদ করলো,মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটছিল দুজনেই,
অজানা কোন এক সুত্র তুলে ধরে চলছিল,নতুন ওস্তাদ শিল্পীদের প্রতিভার প্রশংসা।তাদের বাদানুবাদ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম,জানি সেটা হয়তো কফির দোকানের অন্যান্য শিল্পীদের কাছে একেবারেই নীরস মনে হতো।
আলোচনার বিষয়বস্ত ছিলঃ
‘শিল্পীর প্রতিভা তাকে কি নতুন দৃষ্টিকোন দেয়,দক্ষতার তুলির আঁচড়ে যা সে তুলে ধরতে পারে ছবির আঙ্গিকে’?প্রশ্ন করলো দক্ষ হাতের,স্বচ্ছ চোখের শিল্পী,উত্তরটা জানা ছিল তার,তবু তার জানার ইচ্ছা ছিল অন্য দৃষ্টিকোন থেকে।
‘ভেনিসে একজন শিল্পীর ছবি আঁকার দক্ষতার মাপকাঠি হলো,শিল্পীর ছবি আঁকার অন্যন্য ভঙ্গী আর পদ্ধতি,একেবারেই নতুন কোন দিন দেখা যায়নি’,বুড়ো মানুষটা বললো।
‘ভেনিসের লোকজনের মৃত্যু হয় ভেনিসের জীবনের মতই’,শিল্পী আমার ছবিট শেষ করার পরে উত্তর দিল।
‘কিংবদন্তী আর ছবির বিশেষত্ব একটার সাথে আরেকটার পার্থক্যে না,বরং শিল্পীর সার্থকতা সেখানে,যেখানে আমাদের চোখে হবে সেটা যেন জানা আমাদের’।
আলোচনার ফল যা দাঁড়ালো,সেটা ভেনিসের মানুষ আর ওটোমান সাম্রাজ্যের মানুষদেরর মধ্যে মৃত্যুর উপলদ্ধির পার্থক্যটা,আজরাইল আর অন্যান্য ফেরেশতাদের কাফেররা কোনদিনই তাদের তুলির আঁচড়ে তুলে ধরতে পারবে না।কমবয়সী দক্ষ এই ওস্তাদ শিল্পী শ্যেন উপলদ্ধির আবেগে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল,কিন্ত তার ধারণা ছিল না আমি কি,কি ভাবে আমাকে টেনে আনা যায় কাগজের খাঁচায়।

চালাক আর হিসাবী বুড়োর প্রতারনায় কমবয়সী ওস্তাদ শিল্পীর মানসিক ইচ্ছাটা আরও জোরদার হলো,আলোআঁধারী ঘরটায় টিমটিম করা বাতিতে বুড়ো লোকটা তাকিয়ে ছিল শিল্পীর চোখে।

শিল্পী বললো, ‘ভেনিসের শিল্পীদের তুলিতে মৃত্যুকে এঁকে দেয়া মানুষের রুপে,আমাদের কাছে সে ফেরেশতা আজরাইল।হ্যা,মানুষের চেহারায় দিয়ে যেমন ফেরেশতা জিব্রাইল আমাদের সম্মানিত পয়গম্বরের হাতে আল্লাহর বানী তুলে দিচ্ছে।আপনি এটা নিশ্চয় বোঝেন’?

দেখলাম তরুন শিল্পী যার হাতে আছে আল্লাহর দেয়া অভাবনীয় প্রতিভা,আমাকে তুলির আঁচড়ে তুলে ধরার জন্যে অসহিষ্ণু হয়ে ছিল,শয়তান বুড়োর প্ররোচনায়ঃকিছু একটা আঁকার ইচ্ছা ছিল তার,যা সকলের অজানা।
‘মৃত্যু সমন্ধে কিছুই জানা নাই আমার’,যুবক শিল্পী মন্তব্য করলো আবার।
‘মৃত্যু আমাদের সকলেরই জানা’,বুড়ো মানুষটা বলল।
‘আমরা ভঁয় করি তাকে,তবে আর কিছু জানা নাই আমাদের’।
‘তা হলে তোমার হাতে এখন সেই ভঁয়টা আঁকার দায়িত্ব দিলাম’,বুড়ো মানুষটা বললো।

শিল্পী আমাকে আঁকা আরম্ভ করলো,ঘাড়ে সুড়সুড়ি,আঙ্গুলগুলো নিশপিশ করছে,ব্রাশ তুলে ধরার জন্যে,একটা কলম টেনে আনার জন্যে।তবে সে ছিল একজন সত্যিকারের
শিল্পী,সে চায়নি এই অস্বস্তিতে তার চিন্তাধারা যেন ধোঁয়াটে হয়ে যায়।

বুড়ো লোকটা বুঝতে পেরে তরুণ শিল্পীকে,ইমাম আল-গাজ্জালী,আল-সুইয়ুতি,আর আল-জেইভজিইয়ের লেখা পড়ে উদ্ধুদ্ধ করার চেষ্টা করছিল।

তরুণ ওস্তাদ শিল্পী তার তুলির ছোঁয়ার চমকে একটা পোট্রেট তুলে ধরলো,ভঁয়ে ভঁয়ে তোমার হাতে ধরা সেটা এখন।শিল্পীর চোখে মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইলের হাজার দশেক ডানা আছে যা ছড়ানো বেহেশত থেকে পৃথিবীতে,পুর্ব থেকে পশ্চিমে।তার মতে ঐ ডানাগুলো বিশ্বাসীদের সহজেই পৌঁছে দেয় ইহলোক থেকে পরলোকে,আর পাপী,বিদ্রোহীদের শরীর ভেদ করে চরম যন্ত্রনায় জানান দেয় মৃত্যুর ভয়াবহ চেহারাটা।মোল্লাদের কাছ থেকে তার শোনা আল্লাহর ফেরেশতা যখন কারও জীবন নিতে আসে,তার সাথে থাকে হিসাবের খাতা,সকলের নাম আছে সেখানে,তবে কারও কারও নাম থাকবে কালো কালি দিয়ে দাগানো।একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও জানা নাই সেই বিশেষ মুহুর্তটাঃসেই সময়টা যখন আসে,আল্লাহর সিংহাসনের পাশের গাছটা থেকে একটা পাতা ঝরে যায়।শিল্পীর চোখে যদিও আমি ভয়াবহ কিছু একটা,তবে আমার একটা মন আছে যার বোঝার ক্ষমতাও আছে।পাগল বুড়ো বলছিলঃমৃত্যু,আজরাইল-একটা মানুষের কাছে যখন আসে,যার আত্মার এ জগত থেকে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে,তার পাশে একটা আলো ছড়ায় যা মানুষের চোখে পড়ে না,সেই জন্যেই শিল্পীর তুলিতে আমি আলোয় ছড়ানো একটা চরিত্র।অস্থির বুড়ো আবার কিছুটা অংশ পড়ছিল ইমাম আল-গাজ্জালীর বই থেকে,শোনা যায় পুরোনো দিনে কবর থেকে চুরি করার সময় ডাকাতদের দেখা,কবরে কোন লাশ ছিল না,সেখানে কাঁটায় ভর্তি,আর আগুন আর গলানো শিশায় ভর্তি মাথার খুলি।সবকিছু শুনে শিল্পীর তুলি আমাকে এমন ভাবে আঁকলো যা দেখে কারও ভঁয় না পেয়ে উপায় নাই।

শিল্পী অবশ্য অনুশোচনা করছিল ছবিটা আঁকার জন্যে,কারনটা ছবির ভয়ানক রুপটা না,বরং সাহস করে ছবিটা আঁকার জন্যে,আর অজানাকে জানার একটা নতুন চেহারায় তুলে ধরার অপরাধবোধ।আর নিজের কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল কোন কোন সময় একজন সন্তান নিজের বাবার কাছেও একজন লজ্জার পাত্র।জানি না কেন ঐ তরুণ প্রতিভাবান শিল্পী আমার ছবি আঁকার জন্যে অনুশোচনা করছিল?

১)হতে পারে মৃত্যুর ছবি তার মনের সম্পূর্ন দক্ষতা নিয়ে আঁকা হয়নি।এর মধ্য অনেকের কাছেই জানা আমার অভাবনীয় সৌন্দর্য,ভেনিস আর হেরাতের শিল্পীদের তুলিতে আমার ছবি দেখে সেটা বোঝাই যায়।আমি নিজেও কিছুটা বিব্রত হয়ে গেছি,তরুন ওস্তাদের তুলির আমার করুন চেহারাটা আমাকে কিছুটা বিব্রত করছিল,ওটা তো আমার সম্মানিত চেহারা না।

২)বুড়োর প্ররোচনায় তাড়াহুড়া করে ওস্তাদ শিল্পী যে ভাবে আমাকে আঁকলো,সেটা অনেকটা যেন ভেনিসের শিল্পীদের অনুকরনে।তার মন খারাপ হওয়ার কারণটাও বুঝলাম,অনুশোচনা এটা ভেবে যে ঐ ছবিতে পুরোনো ওস্তাদদের অসম্মান করা হলো নাকি ছবিতে।

৩)হয়তো কিছুটা অভিভূত হয়ে গেছে সে,অনেকটা অবুঝ নবীন শিল্পীদের মত,তবে মৃত্যু,আজরাইলের চিন্তা তো কোন হাসির ব্যাপার না।

এখন ঐ ওস্তাদ শিল্পী,মনের দুঃখে রাতের রাস্তায় এলেমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ায় অস্থির মনে,অনেকটা সেই চীনা শিল্পীর মত,যার ধারণা ছিল সেই ছবির বাস্তব রুপ।



আমি এসথার


লালমিনার আর কালো বিড়ালের বিলেজেকের লাল,বেগুনী কাঁথা,সকাল সকাল আমি নানান কাপড়চোপড়ে দিয়ে ফেরীর বাক্স ভর্তি করা আরম্ভ করলাম।পর্তুগালের কাপড়,চীনের সবুজ সিল্ক যার কাটতি তেমন একটা ছিল না,সাথে চোখ জুড়ানো নীল সিল্ক।মানুষের মনটা টানতে হবে কোন এক ছলায়।শীতটা প্রচন্ড তাই গরম মোজা,উলের জ্যাকেটও ছিল।কম্বলটা যখন খুলবো রকমারী সুন্দর কাপড়চোপড় দেখে কার না মনটা নেচে উঠবে। দামী সিল্কের রুমাল,চামড়ার ব্যাগ,হাতে কাজ করা ধোয়ামোছার কাপড়ও ছিল সাথে,
মেয়েরা যারা শুধু গল্প করার জন্যে আমাকে ডাকে,এগুলো তাদের জন্যে।ফেরীর ব্যাগটা তুলে দেখি,বেশ ভারী হয়ে গেছে,অত কিছু হয়তো বেড়ানো সম্ভব হবে না।কি রেখে কি নিব ভাবছি,তখন দরজায় একটা ধাক্কা শুনলাম।নেসিম দরজা খুলে বললো,আমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করছে।বুড়োর রক্ষিতা,হাইরিয়ে,মুখটা একটুঁ লাল হয়ে আছে,সে আমাকে চিঠি হাতে তুলে দিল।‘চিঠিটা সেকুরে দিল’,এমন ভাবে ফিসফিস করে বললো যেন চিঠিটা তারই দেয়া,আর তার চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
চিঠিটা হাতে নিয়ে বোকা চাকরানীকে বললাম সোজা বাড়ী চলে যেতে,যেন কেউ তাকে না দেখে।নেসিমের চোখেমুখে কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা আটকে ছিল।ফেরীর বাক্স তুলে বের হলাম,কোন এক ফাঁকে চিঠিটাও দিতে হবে।
‘সেকুরে,ওস্তাদ এনিষ্টের মেয়ে,প্রেমের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে।একেবারেই পাগল হয়ে গেছে,হতভাগা মেয়ে’,নেসিমের কৌতুহল মেটানোর জন্যে বলে একটুঁ খিলখিল করে হেসে বের গেলাম।সত্যি কথা বলতে কি সেকুরের জন্যে আমার দুঃখই হচ্ছিল,তার অনুভুতি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে চাইনি।অদ্ভুত সুন্দরী এক মেয়ে,গাঢ় কালো চোখ,ধবধবে মাখনের মত একটা শরীর।

বেশ তাড়াতাড়ি করে ইহুদীদের পাড়া ছেড়ে গেলাম,শীতের সকালে দেখে মনে হচ্ছিল আরও পুরোনো ভেঙ্গে পড়া একটা পাড়া।অন্ধ ফকিরকে পার হয়ে হাসানদের গলিতে চীৎকাঁর করে ডাক দিচ্ছিলাম, ‘ফেরীওয়ালা’।

‘মোটা ডাইনী,চীৎকাঁর না করলেও তোমার পায়ের শব্দেই আমি তোমার বুঝতে পারি,এটা আমার মোটা ফেরীওয়ালা ছাড়া আর কিছু না’,ফকিরটা বললো।‘অকেজো অন্ধ’,আমি বললাম, ‘হতভাগা তাতার।আল্লাহ তোমাকে তোমার অপরাধের জন্যেই অন্ধ করেছে।যে শাস্তি তোমার প্রাপ্য আল্লাহ তোমাকে সেই শাস্তিই দিবে’।
সাধারণত তার কথাবার্তায় আমি কোনদিনই রাগি না।
হাসানের বাবা দরজা খুলে বের হলো,আবখাজিয়ান বেশ উঁচু বংশের লোক তারা।
‘দেখি আজকে কি বিক্রি করছো’?
‘তোমার আলসে ছেলেটা কি এখনও ঘুমাচ্ছে’?
‘কি ভাবে ঘুমাবে,ও তো তোমার খবরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে’।
বাড়ীটা সবসময় এতই অন্ধকার থাকে,যে মনে হয় আমি একটা কবরে ঢূকছি।সেকুরে আমাকে কোনদিন এই বাড়ী নিয়ে প্রশ্ন করেনি,তবে আমি সবসময় তাকে বলতে দ্বিধা
করিনি,এই জঘন্য জায়গায় ফিরে না আসার জন্যে।এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একসময় সেকুরে এই বাড়ীর বৌ ছিল,আর তার চঞ্চল ছেলেদের এই বাড়ীতেই এতগুলো দিন শেষ করে গেছে।এই বাড়ীতে শুধু ঘুম আর মৃত্যুর গন্ধ,পাশের ঘরে গেলাম আমি সেটা আরও অন্ধকাঁর।
নিজের হাতটাকেও সেখানে দেখা যায় না।আমি হাসানকে চিঠিটা দেয়ার সুযোগও পেলাম না,অন্ধকারে হঠাৎ কোথা থেকে সে আমার হাত থেকে চিঠিটা ছোবল দিয়ে নিয়ে গেল।বরাবর আমি যা করি,চিঠিটা পড়ার সূযোগ দিয়ে সরে গেলাম।কিছুক্ষন পর মাথা তুলে হাসান জিজ্ঞাসা করলো, ‘আর কিছু নাই’,যদিও সেটা জানাই ছিল তার, ‘বেশ বড় একটা চিঠি’।

হাসান জোরে জোরে পড়ছিল, ‘সিয়াহ এফেন্দী,তুমি আমাদের বাড়ীতে প্রায়ই আস,ভালই সময় কাটাও আমার বাবার সাথে।আমি এটাও জানি তুমি আমার বাবার বই এর একটা লাইনও এখনও লেখনি।তোমার কোন আশা পূর্ন হবে না ঐ বই শেষ হওয়ার আগে’।

চিঠি হাতে হাসান আমার দিকে তাকিয়ে ছিল,যেন সবকিছু আমার অপরাধ।আমি এই নীরবতার সম্পূর্ন বিপক্ষে।‘চিঠিতে তার বিয়ে,তার স্বামী ফিরে আসার কোন কথা বলেনি,কেন’?হাসান জিজ্ঞাসা করলো।‘আমি কি ভাবে জানবো,চিঠিটা তো আমি লিখিনি’,আমি বললাম।‘সেকুরে মনের কথাগুলো জানার খুবই ইচ্ছা আমার ’,এটা বলে সে আমার হাতে ১৫টা রুপার মোহর তুলে দিল।
‘অনেক মানুষ যত তাদের টাকা হয় ততই কৃপন হয়ে যায় তারা,তুমি সে ধরণের না’,
আমি বললাম।
এই মানুষটার বুদ্ধি আর চমক,চালাকি আর শয়তানী ছেড়ে অনেক সময় তাকে একটা ভাল মানুষ হিসাবে তুলে ধরে,এখন বুঝতে পারি এত কিছুর পরেও সেকুরে কেন তার চিঠি পড়ে।
‘সেকুরের বাবার বইটা কি নিয়ে লেখা হচ্ছে’?
‘জানি না,তবে আমাদের সুলতান বইটার সব খরচ দিচ্ছে’।
‘শিল্পীরা একে অন্যকে খুন করছে এই বইটার জন্যে’,হাসান বললো, ‘শুধু কি মোহরের লোভে,আমাদের পবিত্র ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক কিছু লেখা হচ্ছে?অনেকে বলে একবার এই দেখলেই তুমি অন্ধ হয়ে যাবে’।
এমন ভাবে হেসে হাসান কথাগুলো বললো,যাতে আমার কোন কিছু ভাবার দরকার ছিল না আর।যতই যা হউক তার কথার ভঙ্গীতে বোঝা যাচ্ছিল বিচলিত হওয়ার তেমন কিছু নাই।খেপে গেলে চিঠির বাহককে অনেকেই গালাগালি করে,তবে মেয়েরা সে ক্ষেত্রে জড়িয়ে কাঁদে।
‘তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী’,আমাকে কিছুটা খুশী করার জন্যে হাসান বললো, ‘এই টুথপেষ্টটা দিবে ঐ বোকা লোকটাকে,দেখি সে কি বলে’।
ভাবছিলাম বলবো, ‘সিয়াহকে তুমি যত বোকা ভাবছো,ঠিক তা না’,এ সব ক্ষেত্রে এক প্রেমিককে আরেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে ঈর্ষা জাগালে আমার কাছে বেশি পয়সা আসার কথা,তবে দেখে মনে হলো,হাসান রেগেমেগে চীৎকাঁর করে উঠবে।‘তোমাদের রাস্তার পাশের অন্ধ তাতার ফকিরটা,খুবই অভদ্র আর জঘন্য সব মন্তব্য করে’।
ঐ ফকিরটার সাথে আবার যাতে বাদানুবাদ না হয় তাই রাস্তার অন্যদিকে হেটে মুরগীর বাজার দিয়ে যেতে হলো।মুসলমানেরা মুরগীর পা আর মাথা খায় না কেন?ওরা হলো অবাক করা একটা জাতি!আমার দাদী,তার আত্মার শান্তি হোক,বলতো পর্তুগাল থেকে আসার পর এখানে মুরগীর পা এতই সস্তা ছিল যে অবিশ্বাস্য,আর সেটা সিদ্ধ করে খেত দাদী মা।
হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম এক মহিলা ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে সাথে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে তার ক্রীতদাসী।মহিলার চোখেমুখে একটা গর্বিত ভাব,আভিজাত্যের বড়াই,হয়তো কোন পাশার বৌ বা মেয়ে হবে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবছিলাম সেকুরের বাবা যদি তার বই নিয়ে এত ঢুবে না থাকতো,সেকুরের স্বামী সাফাভিদের যুদ্ধ থেকে সম্পদ নিয়ে ফিরে আসতো,এই যন্ত্রনার জীবন কাটাতো না,হতভাগী মেয়েটাকে।
সিয়াহর বাড়ীর রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে,বুকটার ধুকধুকানি বেড়ে গেল,আমি কি চাই সেকুরে এই লোকটাকে বিয়ে করুক?এতদিন ধরে আমি তো হাসান আর সেকুরের সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাচ্ছি,এমন কি সিয়াহ আর সেকুরের দূরত্ব তৈরী করতেও দ্বিধা করিনি।সিয়াহর মনের কথাটা কি?সিয়াহ সবদিক দিয়েই একটা যোগ্য মানুষ,তবে সেকুরের মন বোঝা খুবই দুষ্কর ব্যাপার ছাড়া।
‘ফেরীওয়ালা…’।
প্রেমিকদের চিঠি দেয়া নেয়া যার সাথে মেশানো আছে একাকীত্ব,পুরুষ খোঁজার স্বপ্ন,তাতে আমার ব্যাবসার আনন্দের চেয়ে অনেক বেশী।হতাশা মেশানো চিঠি পড়ার সময়ও তাদের চোখেমুখের আশা আনন্দের সাথে আর কিছুর সাথে তুলনা করা সম্ভব না।
তার স্বামীর ফেরা নিয়ে কোন কিছু না বলে,সেকুরের সর্তকবানী, ‘অযথা কোন আশা করো না’,সেকুরর ঐ কথায় সিয়াহর আশা আরও বেড়ে গেছে।আনন্দের সাথে দেখলাম সিয়াহর চিঠি পড়ার দৃশ্যটা,এত খুশি সে তখন যেন অন্য আরেক স্বপ্নের আকাশে যদিও অজানা ভয় ছিল তার চোখে মুখে,সে ছুটে গেল চিঠির উত্তর দিতে।আমি তখন এক চালাক ফেরীওয়ালার মত বাক্স খুলে সিয়াহর বাড়ীওয়ালীকে চামড়ার ব্যাগ বিক্রি করার চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।
‘এটা পারস্যের ভেলভেটের চামড়া দিয়ে তৈরি’।
‘আমার ছেলে মারা গেছে পারস্যের যুদ্ধে’,বাড়ীওয়ালী বললো, ‘তা কাঁর চিঠি সিয়াহর কাছে নিয়ে যাচ্ছ’?বাড়ীওয়ালীর মনের কথাটা বোঝাই যাচ্ছিল,হয়তো ভাবছে তার আইবুড়ো মেয়ে বা পরিচিত অন্য কাঁরও মেয়েকে সিয়াহর গলায় ঝুলানোর জন্যে।‘না তেমন কারও চিঠি না’,আমি বললাম, ‘ওর এক গরীব আত্মীয়,বায়রাম পাশার হাসপাতালে আছে,চিকিৎসার জন্যে তার কিছু টাকা দরকার’।
‘তাই নাকি’,অবিশ্বাসের সাথে বাড়ীওয়ালী প্রশ্ন করলো, ‘কে সেই হতভাগা লোকটা’?
‘আপনার ছেলে কি ভাবে মারা গেছে’,কেন জানি একটু রেগে জিজ্ঞাসা করলাম।
আমরা দুজন দুজনকে দেখছিলাম একে অন্যের শত্রু হিসাবে,মহিলা বিধবা একা,তার জীবন হয়তো বেশ কষ্টের।তোমরা কেউ যদি এসথারের মত ফেরীর ব্যাবসা করো,তা হলে জানতে পারতে,শুধু টাকাপয়সা,ক্ষমতা,রসাল প্রেম কাহিনী এগুলোই মানুষের কৌতুহল জাগায়।তা ছাড়া আর যা আছে দুঃশ্চিন্তা,ঈর্ষা,ছাড়াছাড়ি,একাকীত্ব,বিদ্বেষ,কান্না আর গুজব,সীমা ছাড়ানো দারিদ্র।এগুলো কোনদিন বদলায় না,যেমন বাড়ীর আসবাবপত্র,রং হারানো পুরোনো গালিচা,রান্না ঘরের হাড়ি চামচ,চূলার পাশের ছাই এর গামলা,বিধবার একাকীত্ব আর পুরানো তলোয়ার,চোরদের ভঁয় দেখানোর জন্যে।
সিয়াহ তাড়াতাড়ি ফিরে এসে বললো, ‘ফেরীওয়ালী’,বাড়ীওয়ালী যেন শুনতে পায় সে ভাবেই জোরে জোরে বলছিল সিয়াহ, ‘শোন এটা নাও,আমাদের রুগীকে দিবে।তার যদি কোন কিছু বলার থাকে আমাকে জানাতে বলবে,আর হ্যা আমাকে পাবে ওস্তাদ এনিষ্টে এফেন্দীর বাড়ীতে,ওখানেই সারাটা দিন কাটাবো’।
সিয়াহর এই লুকোচুরি খেলার কোন দরকাঁর নাই,এ রকম তরুণ সাহসী একটা মনের কোন কিছু লুকানো,চিঠি দেয়া,সিল্কের রুমাল দেয়া,কি যায় আসে।নাকি ওর মনটা সত্যি সত্যিই ঝুকে আছে বাড়ীওয়ালীর মেয়ের দিকে?কোন কোন সময় আমি সিয়াহকে একেবারেই বিশ্বাস করি না,কেন জানি মনে হয় ও সেকুরেকে ঠকাচ্ছে।সেকুরের বাড়ীতে সারাদিন কাটানোর পরও সেকুরেকে ইঙ্গিত করার সাহস হয়নি,সাহস হয়নি হাত বাড়িয়ে সেকুরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে।বাড়ী থেকে বার হয়ে দেখি ব্যাগে ১২টা রুপার মোহর,আর একটা চিঠি।চিঠিটায় কি লেখা জানার এতই ইচ্ছা ছিল যে,হাসানের বাড়ীর দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম।শাকসব্জীর ব্যাবসায়ীরা বাঁধাকপি,গাঁজর,সবাই নিজের সব্জীর ডালি নিয়ে বসে আছে।তরতাজা শাক দেখেও অপেক্ষা করার ইচ্ছা হলো না আমার।

০০০০০০০০০

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুলাই, ২০২৩ দুপুর ১:২১

রাজীব নুর বলেছেন: সামুতে লিখে লিখে টাইপিং স্প্রীড বাড়াচ্ছেন?

০৩ রা আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:৩৭

ইল্লু বলেছেন: অনেকটা।তা ছাড়া সময়ের সাথে খেলাধুলাও হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.