নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার ঝরে পড়া শব্দগুলোর আস্তানা!

জীবনের চরম সুখের মুহূর্তে চোখ মেলে দেখি আমার পাশে জনতার ভীড়, কিন্তু যখন এক ঝাঁক শকুন আমার মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে থাকে তখন আমি বড়ই একা।।

মুহম্মদ ইমাম উদ্দীন

ভালবাসি আমার দেশকে। ভালবাসি বিজ্ঞান। [email protected]

মুহম্মদ ইমাম উদ্দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

"তেজস্ক্রিয়তা" বন্ধু নাকি শত্রু!!!

১৪ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯

বাংলা ব্যাকরণ শাস্ত্রে বিপদ শব্দটির সমার্থক শব্দ হিসেবে তেজস্ক্রিয়তা শব্দটা যোগ করে দিলে বোধ হয় অযৌক্তিক কিছু হবেনা। তেজস্ক্রিয়তা কতটুকু বিপদজনক হতে পারে তা ইতিমধ্যেই সে মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শব্দটা কানে বাজলেই সবার চোখে ভেসে উঠে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের ফলে ছড়িয়ে পড়া সেই তেজস্ক্রিয়তার হিংস্র রূপ। এছাড়াও ফুকুশিমায় পারমাণবিক চুল্লী দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার ভয়ঙ্কর রূপের কথা মানুষ এখনও ভুলেনি। প্রকৃতিতে লুকিয়ে থাকা এই ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তাকে কানে ধরে সর্বপ্রথম যিনি লোক-সম্মুখে তুলে এনেছিলেন সেই ভদ্রলোকটি হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেল। যদিও ধারনা করা হয় হেনরি বেকরেল এর অনেক আগে ১৮৫৭ সালেই তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন আবেল নিপসে দ্য সেন্ট-ভিক্টর। কিন্তু তা তেমন প্রকাশিত হয়নি বলে সবাই ভুলে গেছে। ১৮৯৬ সালের একদিন বিজ্ঞানী হেনরি বেকরেল এক্সরে নিয়ে গবেষণা করছিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এক প্রকার বিশেষ ভেদন শক্তি সম্পন্ন রশ্মি নির্গত হচ্ছে। সাথে সাথে তিনি লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে নেমে পড়লেন গবেষণায় এবং বুঝার চেষ্টা করলেন জিনিসটা আসলে কি? এতে তিনি আরো লক্ষ করেন, যে মৌল থেকে এই রশ্মি নির্গত হয় তা সম্পূর্ণ অন্য একটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত না হওয়া পর্যন্ত এই রশ্মি নির্গমন হতেই থাকে। তাঁর নামানুসারে এর নাম দেওয়া হয় বেকরেল রশ্মি। পরবর্তীকালে মাদাম কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়ারে কুরির গবেষণায় দেখা যায় রেডিয়াম, থোরিয়াম ও পোলনিয়ামের মত ভারী ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস থেকেও একই ধরনের বেকরেল রশ্মি নির্গত হয় যা এখন তেজস্ক্রিয় রশ্মি হিসেবে পরিচিত। যে সমস্ত মৌল থেকে এ তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় তাদের তেজস্ক্রিয় মৌল বলে। আর তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের এ ঘটনাকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রধানত তিন প্রকার। আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি। আলফা কণিকা বায়ুর মধ্যে ২-৩ সেন্টিমিটারের বেশি যেতে পারেনা। এমনকি সামান্য কাগজের বাধাও টপকাতে পারে না। আবার বিটা কণিকার ভেদন শক্তি আলফা কণিকার চেয়ে বহুগুণ বেশি। এটি বায়ুর মধ্যে কয়েক ফুট পর্যন্ত যেতে পারে। তবে এলুমিনিয়ামের পাত টপকানোর সাধ্য এর নাই। গামা রশ্মি কিন্তু আলফা কিংবা বিটার মত কোন কণিকা নয়। এটি একটি তড়িৎ চুম্বক তরঙ্গ। ফলে এর ভেদন শক্তিও প্রচুর কারণ এর গতিবেগ আলোর বেগের সমান। তবে সীসার তৈরি কোন প্রশস্ত দেওয়াল দিয়ে একে আটকানো সম্ভব।







কেউ যদি ধারনা করে থাকে পারমাণবিক বিকিরণের বিপদ শুরু হয়েছে ১৯৪৫ সালের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনারপর থেকেই, তবে তাঁদের ধারনা ভুল। কেননা রঞ্জন তাঁর এক্সরে আবিষ্কারের আগে এবং বেকরেল তাঁর তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের আগে থেকেও কিন্তু পৃথিবীর প্রাণীকুল তেজস্ক্রিয়তার

স্বীকার হতো। এর সবটা দান করত প্রকৃতি। যেমন খনিজ, বায়ুমণ্ডল, মানবদেহ ও মহাজাগতিক রশ্মি ইত্যাদি। বলতে গেলে পৃথিবী যখন থেকেই তার অস্তিত্ব লাভ করেছে তখন থেকেই তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধারণ করেছে। এ তেজস্ক্রিয়তা প্রধানত ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি থেকে আসে। সাধারণত যে মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা ৮২ এর বেশি, সেগুলোই তেজস্ক্রিয় হয়ে থাকে। এগুলোর আবার কই মাছের প্রাণ। আয়ুষ্কাল অনেক লম্বা। উদাহরণস্বরূপ ইউরেনিয়ামের অর্ধায়ু ৪৫০ কোটি বছর। অর্ধায়ু মানে সে সময় যে সময়ে কোন তেজস্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এ তেজস্ক্রিয়তা বিভিন্নভাবে ক্ষতি করতে পারে। তবে সামান্যমাত্রার তেজস্ক্রিয়তা আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু কত মাত্রার তেজস্ক্রিয়তা আমাদের জন্য নিরাপদ তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না। এটা নির্ভর করে উৎস থেকে দূরত্ব, মানুষের বয়স, শারীরিক কাঠামো, বিকিরণের গ্রেড, সময় ইত্যাদির উপর। এগুলোর উপর ভিত্তি করে তেজস্ক্রিয়তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি ও বস্তু বিশেষে বিভিন্ন রকম হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মানবদেহে ছড়ালে তা বিভিন্ন টিস্যুর ক্ষতি করে থাকে। এটি মানবদেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সান্নিধ্যে থাকলে মানবদেহে নানা ধরনের ক্যান্সারের সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় স্ট্রনসিয়াম-৯০ এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আমাদের অস্থির প্রধান উপাদান ক্যালসিয়াম। স্ট্রনসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের মাঝে রয়েছে ব্যাপক মিল। ফলে ক্যালসিয়ামের সাথে মিল থাকায় স্ট্রনসিয়াম-৯০ যখন আমাদের শরীরে প্রবেশ করে তখনই তা হাড়ে গিয়ে জমা হয়। এতে সৃষ্টি হতে পারে মারাত্মক অস্থির ক্যান্সার। আবার তেজস্ক্রিয় স্ট্রনসিয়ামের সাথে তেজস্ক্রিয় সিজিয়ামকে তুলনা করা যেতে পারে। তেজস্ক্রিয় সিজিয়াম-১৩৭ প্রজননিক বিকৃতি ও ক্যান্সার উভয় প্রকার বিপদের জন্য দায়ী। তবে তেজস্ক্রিয় স্ট্রনসিয়াম প্রজননিক বিপত্তি ঘটাতে পারেনা। কারণ এর থেকে নির্গত দুর্বল বিটা রশ্মি জননকোষে পৌছাতে পারেনা। কিন্তু তেজস্ক্রিয় সিজিয়াম-১৩৭ থেকে নির্গত হয় অতি ভেদক গামারশ্মি। ফলে জননকোষের ক্ষতি করতে তার নিকট অবস্থানের প্রয়োজন পড়েনা। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে কোন রোগে আক্রান্ত হলে সহজে প্রতিহত করা যায়না। তাছাড়া যে কেউ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের প্রভাবে মানসিক বিকার এমনকি বিকলাঙ্গতার স্বীকারও হতে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল এর ক্ষতিকর প্রভাব বংশ পরম্পরায়ও পরিলক্ষিত হয়।







তেজস্ক্রিয়তার বিপদ ও ভয়ঙ্কর দিকগুলো বারবার উল্লেখ করে তার বদনাম করাও কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা। কারণ এর অনেক উপকারিতাও রয়েছে। মানবজাতির উপকারে বিভিন্ন কাজে তেজস্ক্রিয়তাকে ব্যবহার

করা হয়। যেমন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে ফিউশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে টারবাইন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ক্যান্সার রোগের বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে একটা পদ্ধতি হল রেডিও থেরাপি। এতে গামা রশ্মি দিয়ে ক্যান্সার সেলের মৃত্যু ঘটিয়ে চিকিৎসা করা হয়। অন্ধকারে ঘড়ির সময় দেখার সুবিধার্থে এতে তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামের সাথে জিঙ্ক সালফাইড মিশিয়ে ঘড়ির কাঁটা ও নম্বরে প্রলেপ দেওয়া হয়। এছাড়াও সাবমেরিন ও মহাশূন্যযানে জ্বালানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের পরিমাপ বিশ্লেষণ করে জীবাশ্মসংক্রান্ত নমুনা ও শিলাখন্ডের বয়স নির্ধারণ থেকে শুরু করে উদ্ভিদের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ এবং খনিজ পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ সম্ভব হয়। তাছাড়া তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে মাটি, পানি ও বায়ুর দূষণ-মাত্রা নির্ণয় সম্ভব। জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে অধিক ফলনশীল ও কীটপতঙ্গের আক্রমণ প্রতিরোধক শস্য উৎপাদনে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন জটিল রোগ যেমন এইডস, ক্যান্সার ইত্যাদির চিকিৎসা-জনিত গবেষণায় তেজস্ক্রিয় বস্তু ব্যবহৃত হয়। এভাবেই মানবজাতির উপকারে শিল্পক্ষেত্রে, চিকিৎসাক্ষেত্রে, কৃষিক্ষেত্রে, ঔষধশিল্পে ইত্যাদি ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।



সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভালো খারাপে মিলেই তেজস্ক্রিয়তা। এর উপকারিতা অপকারিতা দুটোই রয়েছে। তাই লেখার শুরুতে বাংলা ব্যাকরণে বিপদ শব্দটির সমার্থক শব্দ হিসেবে তেজস্ক্রিয়তাকে যোগ করার যে প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম সেটাও ফিরিয়ে নিলাম। এখন প্রশ্ন হল তেজস্ক্রিয়তা আমাদের বন্ধু হয়ে সাহায্য করবে নাকি শত্রু হয়ে ধ্বংস করবে? সাধারণত কেউ আমাদের বন্ধু হবে নাকি শত্রু হবে তা নির্ভর করে আমরা তার উপর কিরকম ক্রিয়া করছি তার উপর। আমরা কারো উপর যেরকম ক্রিয়া করব সেও সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে। অতএব পরিশেষে বলা যায় ভবিষ্যতে মানুষের ব্যবহারের উপরই নির্ভর করছে তেজস্ক্রিয়তা বন্ধু হবে নাকি হবে শত্রু...



তথ্যসূত্রঃ ১।উইকিপেডিয়া

২।Atomic Radiation Dangers by H.W. Heckstall smith

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.