নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

১৯৯৩ সালের মার্চ মাসের এক রাতে আমার জন্ম। কার চোখে চোখ রেখে আমার চোখ ফোটা জানা নেই। কিন্তু জন্মের পর থেকেই একটা রোগ পেয়ে বসেছে,কারণে অকারণে রেগে যাওয়া।\nবোকা সোকা মানুষ, সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলি, এ কারণে খেসারতটা প্রতিনিয়ত দিতে হয়।

অচিকীর্ষু বালক

আমি নি:সঙ্গ, রিক্ত ও নিঃস্ব এজন মানুষ। দেয়ার মত আমার কিছু নেই, আছে শুধু হৃদয় এবং হৃদয়ের অশ্রু। আমার হৃদয় শুধু ভালোবাসতে পারে এবং ভালোবাসা অনুভব করতে পারে। আমার চোখ শুধু অশ্রু ঝরাতে পারে এবং অশ্রুর ভাষা বুঝতে পারে। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো এবং আমার ভালোবাসা গ্রহণ করো। আমি চাই, তুমি আমার চোখের একবিন্দু অশ্রু গ্রহণ করো এবং আমাকে তোমার চোখের একটি অশ্রুবিন্দু দান করো।কিন্তু যে পৃথিবীতে ফুল হয়েছে বাণিজ্যের পণ্য, সেখানে এক ফোঁটা ভালোবাসার কিংবা একবিন্দু অশ্রুর কী মূল্য! চাহিদা এখন হৃদয়ের নয়, হৃদপিণ্ডের। চাহিদা এখন মানুষের নয়, মানুষের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের।

অচিকীর্ষু বালক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরিবর্তন (ছোটগল্প)

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৫৭

রইস কোরে! গণি মিয়ার নতুন ঘরডা দেখছছনি? বিদেশ থেইকা আইসা অল্পদিনেই কেমন বড় ও সুন্দর ঘর তুলছে। মাইয়াডারেও বিয়া দিছে বড় ঘরে। আর এহনে দুই হাত দে মুখ ঢাকে। আমার বশিরডা যে কবে বড় অইবো, বিদেশ যাইয়্যা টাকা কামাইবো। আমেনাডাও তো বয়স কম অইলোনা। এইবার ওরো তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। আল্লায় জানে, এক জনমে এত্তকিছুর পার পাওয়া যাইবো কি না!
উঠোনে খেজুর পাতার পাটিতে বসে কেরানী সমশের তার ভাইকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলে। সে কোন উত্তর দেয়না। ভাতিজার দিকে কেবল তাকিয়ে থাকে। বশির তখন নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো চাঁদ দেখায় নিমগ্ন। দক্ষিণের মৃদু হাওয়ায় পাতাগুলো গুটি গুটি নড়ছিলো। যেন হারমনিয়ামের রিড একের পর এক নড়ে যাচ্ছে। বাবার মুখে নাম শুনে সে ফিরে তাকায়। টাকা কী জিনিস এই ছোট্ট বশিরের এখনো তা জানার কথা নয়। হয়ত জানেওনা। তবে এটুকু নিশ্চয় সে বুঝে নিয়েছে, টাকা অনেক কাজের জিনিস। এটা দিয়ে সব করা যায়। এটা না থাকলে কিছুই হয়না। যে করেই হোক এটা তাকে অর্জন করতেই হবে। বাবার টাকা-টাকা-টাকা সম্ভবত এই বয়সেই ছেলেটাকে টাকার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল।
জ্যোৎস্না-ধোয়া প্রতিটি রাতে সমশের উঠানের নারকেল গাছটির নীচে বসত। ভাইকে লক্ষ্য করে ছেলেটির দিকে ইশারা করে বলতো, “আমার বশিরডা যে কবে বড় অইবো, বিদ্যেশ যাইয়া ট্যাকা কামাইবো? হগ্গল ট্যাকা তো ঐ গণি মিয়াই নিয়া আইলো।” এভাবে এক চাঁদ ডোবে ওঠে আরেক চাঁদ, চাঁদের এই ওঠা-ডোবা বশিরের বয়স বাড়িয়ে দেয়। ঐ চাঁদটি যদি আর না উঠতো কিংবা না ডুবতো। ঐ চাঁদটি আর ছেলেটির শৈশবেই তাকে প্রাণবন্ত রাখতো। শৈশবের পরবর্তী অবস্থা তাকে বিমর্ষ করতো না। বশির যখন ছয় বছর বয়সে উপনীত হলো তখন তার বাবা সমশের তাকে গ্রামের প্রাইমারীতে ভর্তি করে দিলো। ঐ প্রাইমারীতেই সে কেরানীর কাজ করে। আটটা বাজলে এখন দু’জনে একসাথে ইশকুলে যায়। সমশের গিয়ে প্রবেশ করে ছোট্ট কামরায় দফতরে, গুটিকতক মানুষের মাঝে, আর বশির গিয়ে বসে বড় বাঁশের ঘরে তার মত আরো অনেক ছেলের মাঝে। হাসি খেলায় লেখায় পড়ায় ওর পুরো সময় কাটে পরম আনন্দে। বাবা বসে থাকে বিমর্ষ হয়ে। ছুটির সময় যখন ওরা একত্র হয় উভয়েই তখন অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ছেলের হাসির রেশ তখনও বজায় থাকে। বাবাকে আচ্ছন্ন করে রাখে চিন্তার বিমর্ষতা। তাই ফিরতি পথে ওদের কোন কথা হয়না দীর্ঘ নিঃশ্বাস ও চটুল চাহনি ছাড়া।
বশির ভাল ছাত্র, জ্বলজ্বলে রেজাল্টে সে প্রাইমারী পাস করে। আমেনাও তখন মেট্রিকে ভাল রেজাল্ট করে। মেয়েটাকে পাত্রস্থ করার জন্য বাবা তখন উৎকণ্ঠিত। পূর্ণিমার এক রাতে উঠানের সেই গাছটির নীচে বসে স্ত্রীকে বলে, “আমেনার মা মাইয়াডাতো ডাঙ্গর অইয়া উঠলো, অহন আর বিলম্ব করা চলে না। একটা বিহিত করতেই অইবো। তাছাড়া বশিরের খরচ বাইড়া যাইবো। আগের খরচ বহন করা কি আর এহন সম্ভব অইবো। পুলাডা যে কবে কামাই শিখবো! মোটেই কামাই রোযগার করতে পারবো কি না হেইডাই বা ক্যা জানে। আমরা তো নিজেই নিজের পায়ে দাঁড়াইছি। এহনকার পুলাপান কি তা পারবো? কেরানীর কাজ করে সমশের গর্বিত, গর্বভরে কথাগুলো বলল। স্ত্রী শুধু মাথা ঝুকায়, তার কোন অর্থ বোঝা গেল না। সমশের নিজে কোন অর্থ বুঝতে পারলো কি-না, সেটাও বোঝা গেল না। তবে বশির এখন কিছু কিছু কথা বুঝতে পারে। সে এখন বুঝতে পারে টাকা কী। টাকা কী কাজে আসে, টাকা না থাকলে যে মানুষের কী অবস্থা হয়, মানুষের চিন্তা-চেতনা কেমন হয় সেটা ও হয়তো কিছু কিছু বুঝে। ও এখন হাইস্কুলের শিক্ষার্থী। একদিন ইশকুল থেকে ফিরে বলল, মা বাবারে কইয়া দিয়েন আমি আর ইশকুলে যাম না। আমি এহন থেক্যাই রোযগার করুম, গণী মিয়ার মত ধনী অমু। মা তো অবাক! মা অশিক্ষিতা হলেও এটুকু বুঝতে পারেন শিক্ষা ছাড়া কামাই করা যায় না, মানুষ হওয়া যায় না। তাই সে ছেলেকে বোঝালো। কাজ হলো না। বশির ইশকুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলো। স্কুলের সময় হলে সে তখন চকে গিয়ে ছালি উঠায়। কড়া-প্রতি পাঁচ টাকা পায়। এতেই সে খুশী, মায়ের উপদেশ শুনে না। অবশেষে বিষয়টা ওর বাবাকে জানানো হলো। সে রেগে যায়। কড়া করে বলে দেয়, অয় ইশকুলে যাবি, না হয় বাড়ি থেইক্কা যাবি। দুইডার একটা করনই লাগবো। কামাইর জন্য আমি আছি। তোর অহনি অত চিন্তা করন লাগবো না।
সমশেরের এই আচরন থেকে নিশ্চিত বলা যায় না, সে বুঝতে পেরেছিলো কিনা তার এই টাকা টাকা এবং টাকার চিন্তাই এতদিন পর বশিরের মধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। টাকার লোভ তাকে শিক্ষার প্রতি বিরূপ করে তুলেছে। তবে আজকের কথাগুলো বশিরের কাজে আসে, সে বাড়িতেই থাকে, আবার নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে, সব কিছু আবার স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকে। চলতে থাকে আমেনার বিয়ের কথাও।
এরই মাঝে একদিন সমশের জানতে পারে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ। এক মাস পরই তাকে অবসর নিতে হবে, কেরানীর পদ থেকে। কাজটি যেমনই হোক সমশের এই পদ নিয়েই তুষ্ট ছিলো, বরং ছিল গর্বিত। তার চেয়ে বড় কথা এই পদটি দ্বারা তার জীবিকা নির্বাহ করতো, ছেলে মেয়ের লেখা পড়া ও ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হতো, তাই সংবাদটা সমশেরকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলে। সে একবারে মুষড়ে পড়ে। সব কিছুতে কেমন যেন অনশন ভাব শুরু হয়ে যায়।সময়ের আগেই স্কুলে রাওয়ানা হয়, কিন্তু ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছতে পারে না।ক্লাস শেষে বিল পিটায় কেমন একটা নিস্তরঙ্গ শব্দ শোনা যায়। সব কিছুতেই স্থবিরতা এসে গেছে, চলায় কাজে সব কিছুতে। এমন সময় একদিন উপরের অফিস থেকে সমশের কে তলব করা হলে যথা সময়ে সে উপস্থিত হয়। সাহেব তাকে গোল্ডেন অফার দিলেন, বললেন, “তোমার বয়স তো পড়ে গেছে। একা আর কত দিন টানবে সংসারের ঘানি। এবার মেয়েটিকে তোমার সহযোগী রূপে গ্রহণ করো।” সমশের চুপ করে কিছু সময় ভাবে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে, “স্যার পোলাডা ছোট, মায়্যাডার বিয়ার বয়স অইছে, এই অবস্থায় তো করবার কিছুই দেখতাছিনা। তা ছাড়া ম্যাইয়াডারই কোন কাজে লাগামু, মাইনষেই কি কইবো? সাহেব কি যেন চিন্তা করে, চোখদু’টো কপালে দুলে বললেন, “হ্যাঁ, একটা উপায় আমি তোমার জন্য করতে পারি। তোমার মেয়েকে তোমার পথে চাকুরি দিয়ে দিতে পারি। তখন দেখবে তোমার কষ্ট ঘুচবে, মেয়ের অটোমেটিক বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। সরকারী চাকুরে মেয়ে বলে কথা! তবে তোমার একটু করণীয় আছে, পেনশনের টাকাটা তুমি আর তুলবে না। অন্যথায় তোমার মেয়েকে আর চাকুরিটা আমি দিতে পারবো না। তা ছাড়া তুমি যদি পেনশন গ্রহণ করো, তাহলে ক’দিনেই তা ফুরিয়ে যাবে। সন্তানদের জন্য তুমি কিছু করে যেতে পারবে না। মৃত্যুর পর তারা তোমাকে অভিসম্পাত করবে। কবরে তুমি সুখ পাবে না। আর যদি মেয়েটাকে চাকুরি দিতে পারো তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে। কোন দিন অর্থ কষ্ট হবে না। তুমিও কবরে শান্তি পাবে। সাহেবের কথা শুনে সমশের যেন সম্বিত ফিরে পায়। সে ধীরে ধীরে মাথা ঝুকায়, সম্মতি প্রকাশ করে এবং হয়ত কিছুটা গর্বও বোধ করে, মেয়ে তার কেরানী হয়েছে, সরকারী চাকুরী পেয়েছে, এটাকি আর চাট্টিখানি কথা!
কিছু দিন পর সমশের অবসর গ্রহণ করে, শুরু হয় আমেনার কর্মজীবন। তার সুদ্ধ পরিবারের অন্যদের অবজ্ঞাপূর্ণ কেরানীর জীবন। যে জীবন ব্যক্তিকে আবদ্ধ রাখে, বিমর্ষ করে সে জীবন। আমেনার এবার বড় বড় ঘর থেকে ঘন ঘন বিয়ে আসে। সমশের চোখ কান নাড়ে না। স্ত্রীকে বলে, অর বয়সতো কেবল বাইশ, এহনই বিয়া দিবার কী হইল? কিছু দিন পর আরো বড় ঘর থেইকা বিয়া আইবো। তহন বিয়া দিমু। আমেনার মা উত্তরে বলেন, মেট্রিকে পরীক্ষার সময় যে মাইয়্যা ডাঙ্গর আছিল, যে মাইয়্যার বিয়া ‍দিবার জইন্যে পাগল অইয়া গেছিলা অই মাইয়্যা এখন খুকী অইয়া গেল? সমশের বলে, তুমি আলি বেশী বুঝো। অরে যদি চাকরি না দিতাম, দুইলাখ টাকা পাইতাম। এখন আর বিয়া দিলে চলুম কেমনে? হেই ট্যাকা পামু কনে। আমেনার মা লজ্জায় আর কথা বলে না। চুপ হয়ে যায়।
স্কুল থেকে ফিরে বশির বলে, আব্বা! পাড়ার পুলাহানে কয়, তোর সাতে দোস্তি নাই। তোর বাপে মাইয়্যার কামাই খায়, ট্যাকার লোভে মাইয়্যার বিয়া দেয় না। সমশের বলে, “পরের ঘাড়ে বসে খাসতো টের পাস না। ওরে চাকরি না দিলে আমি দু’লক্ষ ট্যাকা পাইতাম। ক, ঐ ট্যাকা আমারে ক্যেরা দিবো?”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.