নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি রক্ত বন্যা দেখিনি কোথাও,\nদেখেছি চোখের কান্না।\nসে অশ্রু ফোটায় ম্লান হয়েছে\nহীরা, মতি, মণি, পান্না।

মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া

আমি রক্ত বন্যা দেখিনি কোথাও, দেখেছি চোখের কান্না। সে অশ্রু ফোটায় ম্লান হয়েছে হীরা, মতি, মণি, পান্না।

মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ বিভাজন

১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৮

এক



ঘনঝুপ ঘেড়া জায়গাটার আড়াল থেকে হঠাত্ করেই ভেসে আসে খিলখিল হাসির শব্দ ।তারপর ধুপধাপ ,হুটোপুটি ।গোমড়ামুখে একটি কন্ঠ ,"তোর সাথ আর কোনদিন খেলবনা , তুই বড্ড পাঁজি"



মিনু তখনও হেসেই চলেছে । একটানা ।খিলখিলিয়ে বিরামহীনভাবে ।হাসতে হাসতে মুখ চেপে বালির উপরই শুয়ে পড়ে ও । বিলু এবার যেন একটু রেগে যায় , "আমার জামাটা নোংরা করে ভারি তো হাসা হচ্ছে না ? মাকে গিয়ে কি বলব ? আবার কি ধুয়ে দিবে ?"

শেষে যেন একটু নরম হয়ে আসে গলাটা ।একটু কাঁদো কাঁদোও ।সামনে বালি দিয়ে গড়া ঘরগুলোর ধ্বংসস্তুপ দেখে চোঁখ ফেঁটে জল আসে ওর ।

কত কষ্টেই আজ জলদি জলদি পড়া শেষ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ও ।

পুরো বিকেলটা ধরে বালি দিয়ে কত যত্নেই না ঘরগুলো গড়েছিল ।শুধু কি তাই ?

যত্ন করে তার সামনে বানিয়েছিল বালির পাহাড় ।একটা গোলাঘরও ছিল তার খেলার রাজ্যে ।সেটাতে আবার মিহি বালির চালও ।

এইসময়ই কোত্থেকে পাজি মিনুটা এসে মায়া করে ফুসলে ওর সাথে খেলতে চাইল ।

ও ভাবল আহা খেলুক না ।বিস্তর তো কাজ বাকি এখনও । রান্নাবান্নাও বাকি । সেটা মেয়েটার ঘাড়েই চাপানো যাবেখন ।

বড় দেখে কয়েকটা কচুপাতা ছিড়ে মিনুকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে সে চলল দস্তুর মত বাজার করতে ।রীতিমত দরদাম করেই বাজার করবেও ।সারাটা বন জুড়েই তো কত গাছ ,এগুলোই ওর বিক্রেতা ।খদ্দেরতো কেবল ও ।পছন্দ হলেই হল ।পাতার টাকা দিয়ে কিনে নিবে ।কোমরে ওর বিস্তর কাঁঠাল পাতার টাকা গোজা আছে ।

ডুমরা গাছে ফল ফলেছিল ।সেখান থেকে কিছু পেরে কচু পাতায় মোড়াল বিলু ।বন বাদার ঘুরে আরও জোগার করল ,টমেটোর মত লাল জংলী গাছের গোটা, বিস্তর পাতার শাক ,রুটির মত পাতা ,ফুলকপির মত ছোট ছোট বিস্তর ফুল ।

মিহি দেখে বেশ খানিক বালি নিতেই ভরে ফেলল কচুপাঁতাটা ।

পাতাটা যথাসম্ভব বাজারের ব্যগের মত নিয়ে ,বুড়ো বুড়ো ভাব করে ফিররে বিলু ।

: বুঝলে গিন্নি বাজারে যা দাম ..

কচুপাতাটা সামলে রেখে বাবার মত করে কথাটা পাড়ল ও ।বলেই আচমক লজ্জায় লাল হয়ে গেল ।পাতার ঝুপে মুখে লুকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল ।



মিনু কিন্তু গেল ভারি রেগে ।ধমাধম বালি ছুড়ে একেবারে ময়লা ভুত বানিয়ে দিল বিলুকে ।ঘুরগুলো ভেঙে করল একসার ।মিহি বালি আর সদ্য আনা বাজারগুলোও ছুড়ে ফেলল কোথায় ।

আর তারপরই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল ।



সে হাসি যেন আর থামতেই চায়না ।যেন ভারি মজার একটা কান্ড ঘটিয়েছে ও ।সাধের খেলার এই অবস্থা দেখে ভারি কান্না পায় বিলুর ।চোখের বাঁধভাঙা জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে ।একটা কাঠি নিয়ে বেশ করে মাটি খুটতে লাগল ও ।

: ওগো কর্তা রাগ করেছো ?

মিনুর ঢঙের কথা শুনে শরীরটা রাগে জ্বলসে যায় বিলুর ।

ইচ্ছে হয় ঘুসি মেরে ওর নাকটা থ্যাবড়া করে দিতে ।

রাগ সামলাতে আরও জোরে জোরে মাটিতে আচর কাঁটে ও ।



: ওরকম ঘর আমি কত গড়ি ।কত ভাঙিও রোজ ....

একটু যেন হাসি কমে ।দম নিয়ে বলে মিনী ।

মন ভুলাতে চেষ্টা করে বিলুর ।

বিলু ওর দিকে তাকায়না ।তার দৃষ্টি তখনও তার ভাঙ্গা ঘরের বালির স্তুপের উপর ।

: আমার এখুনি চাই ..এখুনি বানিয়ে দিবি ..

মুখ শক্ত করে বলে ও ।

একটু যেন আড়ি কাটে ।শুনে মিনু আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ।তারপর বলে ,

: না ..আজকে আর ঘর ঘর খেলবনা ।চল তোকে আজ আমার পুতুল দেখাই ।জানিস ..আবার এত্তগুলো পুতুল ...

দু হাত প্রসারিত করে একটা বৃহত্ পরিমান বুঝাতে চেষ্টা করে মিনু ।

চোখদুটো এবার বড় বড় হয়ে যায় বিলুর ।আড়িও সে বিস্ময়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়ে ।

: এত্তগুলো ...

রাগ ,অভিমান ছাপিয়ে বলে ও।

মিনু মাথা নেড়ে সায় দেয় ।

বলে ,

: চলন এখন ,দেখলেই বুঝবি ..

মিনুদের বাড়িতে কোনদিন যায়নি বিলু ।ভারি ভয় করে ওর ওদিকে যেতে ।মা বলেছে ওদিকে নাকি রাক্ষসরা থাকে ।গেলেই খপ করে ধরে কাঁচাই খেয়ে ফেলবে ।

: ভয় কি ! চলনা ..

ওর ভয়টা মিনু যেন বুঝতে পারে ।তাই তাড়া দেয় ।

: রাক্ষসরা ধরে খেয়ে ফেলবে না তো ?

বিলুর প্রশ্নটা শুনেই আবারও খিলখিলিয়ে হেসে উঠে মিনু ।

: আমার কি হবে গো ...আমার কর্তা যে ভারি ভীতুর ডিম ।

ভেঙচি কাটে মিনু ।তারপর বলে ,

: ওসব ভয় নেই চল ..

: সত্যি বলছিস ! যদি রাক্ষস এসে পড়ে বাচাতে পারবি তো আমায় ?

হাটতে হাটতে প্রশ্নটা করে বিলু ।

: ওমা সেকি কথা !

ভারি অবাক দেখায় মিনুর মুখটা,

: মেয়েরা আবার ছেলেদের বাঁচায় নাকি ? তুই রাজপুত্রদের গল্প জানিস না ?

কথাটা মানতেই হয় বিলুর ।

ও রোজ গল্প শুনে মায়ের কাছে ।রাজপুত্র আর রাজকন্যার গল্প ।কতবার যে রাক্ষসরা রাজকন্যাকে ধরে নিয়ে যায় ।আর প্রতিবারই রাক্ষসদের আচ্ছা ধরে ধোলাই দিয়ে রাজকন্যাকে ফিরিয়ে আনে ।কিন্তু তারপরও খুব একটা সাহস পায়না বিলু ।

রাজপুত্রদের কাছে তো ঢাল তলোয়ার থাকে ।ওর কাছে তো কিছুই নেই ।তাছাড়া মারি ছোট ।গল্পের রাজকুমাররা সবাই হয় বড় বড় । তারপরও হাটা থামায়না বিলু । পুতুলের প্রতি ওর ভারি লোভ ।বাবাকে কতবার বলেছে ।বাবা কিনে দেয়নি ।

হিন্দু পাড়ার মোটকু দাশুদের বাড়িটায় পাশ ঘেসে কুমোর পাড়া পেরিয়ে কয়েকটা বাড়ির ঘিঞ্জিটা এড়িয়ে একটা প্রকান্ড বাড়ি ।মিনুদের বাড়িই এটা ।বিলু চোখ বড় বড় করে তাকায় চারদিকে ।এতবড় ঘর হতে পারে ওর জানা ছিলনা । ও চিরদিন ভাবতো সব ঘরই ওদের কুড়োটার মত ।এমনকি রুপকথার গল্পে রাজপ্রাসাদগুলোকেও সে ঐরকম জাকজিক্যময় কিছু একটা মনে করত ।

মিনু ওকে টেনে ঘরে নিয়ে যায় । খাটের নিচ থেকে টেনে বের করে ইয়াবড় একটা বাকসো ।থড়ে থড়ে সেটাতে সাঁজানো কত পুতুল !

ছেলে পুতুল , মেয়ে পুতুল জোড়ায় জোড়ায় । বুড়ো দাদু ,দাদী ,মা ,বাবা পুতুল ।জমকালো পোশাক পড়া একটা রাজপুতুলও বেশ আয়েশ করে বসে আছে সিংহাসনে ।

আর তার পাশেই শাড়ি পড়া রানী ।অবাক না হয়ে পারেনা বিলু ।



পড়ন্ত বিকেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে চোখ বড় বড় করে একটা ঘরের দিকে তাকায় ও ।ইয়া বড় বড় কয়েকটা পুতুল রাখা ।সেগুলোর গলায় ,সামনে থালায় আবার নানারঙের ফুল রাখা ।এ বাড়িতে এসে অবধি বিস্ময়ের মধ্যেই আছে বিলু । আজব বাড়ি তো মিনুদের ।এ বাড়িতে বড়রাও পুতুল নিয়ে খেলে নাকি ?



দুই



দুপুরে পড়তে আজ মনেই ধরছিল না বিলুর ।বই মেললেই ঝপাত্ করে চোখের সামনে ভেসে উঠছে মিনুদের বাড়িতে দেখা সেই পুতুলগুলোর ছবি ।

: বিলু খেতে আয় ..

মায়ের ডাকে আনন্দে প্রায় লাফিয়েই উঠছিল ও ।পাশে কিতাব পড়া রত বাবার তাকাতেই আবার চুপসে গেল সে ।বাবার এ তাকানো ওর বড্ড চেনা ।

এরমানে , এই পড়াটা শেষ না করে উঠা নয় ।

বিলু অবশ্য এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি ।বাবা ওকে রোজ দু বেলা করে পড়তে বসান ।

বাবা আবারও কিতাব থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকলো ।মুখভর্তি দাড়ি ,গোঁফ ছোট করে ছাটা ,মাথায় ছোট চুল সেখানে একটা টুপি ।

চোখদুটো কেমন যেন ছলোছলো থাকে বাবার ।কিন্তু তারপরও বাবার এই দৃষ্টিকে বড্ড ভয় পায় ও ।

: আলিফ ,বে ,তে ,ছে ..

বাবাকে শুনাতেই একবার জোরে জোরে পড়ে বিলু ।তারপরই থমকে দাড়ায় ।একটা ছড়া মনে পড়ে ওর ।

আলিফ ,বে ,তে ,ছে

মুন্সী আইছে ভাত দে ।



ভারি মজার ছড়া । ওর বাবাকেই সবাই মুন্সী বলে ডাকে ।কলীম মুন্সী ।

এ পাড়ার যে বড় মসজিদটা আছে বাবা সেখানকার ইমাম ।সকাল বেলায় মক্তবও পড়ান ।



পড়া শেষ করে কোনমতে হুড়মুড় করে নাকে মুখে কটা ভাত গোঁজে দিয়ে একছুটে গিয়ে হাজির হয় মিনুদের বাড়ি ।



থমথম করছে চারদিক ।এত খালি খালি কেন আজ ? বড় উঠোনটা পেরিয়ে সদর দরজায় উকি দেয় বিলু ।মিনুকে এখন খোঁজে পাওয়াইতো দুষ্কর হল ।

ইতস্তত করে পিছনের দিকে একটু উকি দেয়ে ও ।

একদল মানুষ জটলা হয় কি যেন একটা দেখছে দাড়িয়ে ।কুমোর পাড়ার দাশু ,রবি ,নবীনদেরও দেখা যায় সেখানে ।সেখানে গিয়ে ভয়ে ভয়ে উকি মারে ও। একটা লোক খরের মধ্যে কাঁদা গুলিয়ে আরেকটা বড় পুতুল বানাচ্ছে ।

ওখানে মিনুরও দেখা মেলে ।

ওকে দেখে একটু হাসে ।তারপর বলে , এসো ।



তিন



: ওরকম মস্ত পুতুলটা কি তোর জন্যেই গড়ছে নাকি রে ?

: ওমা কি বলো ? ওটা কি পুতুল নাকি ?

মিনুর উত্তর শুনে ভারি রাগ হয় বিলুর ।ও নিজ চোখে দেখে এসেছে ।লোকটা খড়ের মধ্যে কাঁদা দিয়ে মস্ত একটা পুতুল গড়ছে ।

: আমি যে দেখে এলাম ..

একটু ঝাঝালই শুনায় ওর গলাটা ।

: ও ..ওটাতো প্রতিমা ।দেবী ।সামধে পুজো কিনা ..

: পুজো কি ?

বিলুর অবাক গলা ।

: ওমা ..তুমি তো ভারি বোকা ! পুজো কি তাও জানোনা ।

বিলু চুপ করে থাকে ।ও আসলেই বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানে না ।

মিনু ওকে সব খোলে বলে ।

: তোরাও বুঝি তাহলে সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যাস ?

সব শুনে বিজ্ঞের মত করে বলে বিলু ।

: শোন ,বোকা কর্তা কি বলে ।আমরা নামাজ কেন পড়ব ?আমরা তো হিঁদু ।



মিনুর কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।দুনিয়া বড় আজব জিনিস ঠেকে ওর কাছে ।এতো জাত বেজাতের হুরোহুরি সম্পর্কে আগে ওর কোন ধারনাই ছিলনা ।



চার



সপ্তাহখানেক পরের কথা ।ঘরে ঢুকে একবার চারদিকে তাকিয়ে নেয় বিলু ।কেউ নেই ।চুপচুপ এবার চৌকির নিচে ঢুকে যায় ।ঘুমছি জঞ্জালের ভেতরে হাতরে হাতরে কি যেন খোঁজে ।না পেয়ে চষ্ণল হয়ে উঠে ও । বাক্সটা এবার টেনে বাইরে নিয়ে আসে ।নেতানো কাপড়গুলো তো ঠিকই আছে ।

বাবার ভাঙা ফাউন্টেন পেনটাও আছে ।ছেড়া নেতা কয়েকটা বই ,নারকেলের শক্ত খোলস ,একটা পরিত্যাক্ত কাঁচের বোতল ।সব ঠিক আছে ।কেবল পুতুলটাই নেই ।বাকসোটা যথাস্থানে রেখে বেরিয়ে আসে ও ।মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেছে ।গলা শুকিয়ে কাঠ ।

তবে কি পুতুলটা বাবার হাতে পড়ে গেছে ?

কথাটা ভাবতেই সব আঁধার দেখে ও ।দুদিন আগে পুজোর দিন মিনু ওকে পুতুলটা দিয়েছিল ।

ভয়ে সেটাকে কত যত্নেই না লুকিয়েছিল সে ।তারপরও যে কিভাবে বাবা ওটার খোঁজ পেলেন ভেবে পায়না ও ।

কাঁপা কাঁপা পায়ে হাটা শুরু করে । চৌকিটার পাশ ঘেসে বই পত্রের সেলফটা এড়িয়ে খাবার ঘরের শেষ মাথায় দরজায় এসে দাড়ায় ও ।

রান্নাঘরে মা রাঁধছেন ।

: কিরে বিলু ! গেছিলি কোথায় ?

মায়ের প্রশ্নে থমকে দাড়ায় ও ।তীরতীর করে কেঁপে উঠে কচি ছোটজোড়া ।দ্রুত পায়ে মায়ে কোলে মাথা দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে শেষে ।



: বিল্লাল হোসেন ..

আজকাল বিলুকে পুরো নাম ধরে কেউ ডাকেইনা ।কেবল বাবা ছাড়া ।বাবা ওকে যখন ডাকেন পুরো নাম ধরেই ডাকেন ।

তাই সকাল সকাল ডাকটা শুনে গলা শুকিয়ে এলো ওর ।হঠাত্ করেই চোখের সামনে ঝাপটা মারল কালকের দৃশ্যটা ।বাকসো থেকে পুতুলটা হাওয়া ,ঘোরে মধ্যে হেটে যাওয়া এবং মায়ে কোলে মাথা দিয়ে কেঁদে উঠা ।

বাবা হাঁটে গিয়েছিলেন কাল ।অনেক রাতে ফিরেছেন ।তাই আর দেখা হয়নি ।

: বিল্লাল হোসেন ..একটু এইদিকে আসো ..

আবারও বাবার চড়া গলা কানে আসে ওর ।ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়ায় ।খাবার ঘরের পাশে ছাপড়া মত বারান্দা লাগোয়া একটা ঘর ।সেটাতে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার পাতা ।চারদিকে আলমারীতে ঠাসা নানা হাদিস ,কোরআন সম্পর্কিত কিতাবে ।

একটা চেয়ার বসে ঝিমোচ্ছেন বাবা ।ওকে দেখে মাথা তুলে বসেন ।

: শুনেছি ইদানিং নাকি তোমার হিঁদু পাড়ায় বেশ যাতায়াত ।বাড়িতে মুর্তি এনে পুজোও শুরু করেছ দেখলাম ।

বিলী চুপ করে ঠাই দাড়িয়ে থাকে ।বাবার সামনে তার কিছুই বলার নেই ।আড়চোখে একবার বাবার দিকে তাকাল ও । বাবার মুখটা রাগে তীরতীর করে কাঁপছে ।



পাঁচ



সেদিনের পর থেকে আরও বেশি সাবধানী হয়ে যায় বিলু ।

মিনুর সাথে খেলতে এখন খুব কমই ওদের বাড়ি যায় । তবে খেলা যে বন্ধ আছে ,তা নয় ।

বিলুদের বাড়ি ঘেসে মেঠোপথটা চলে গেছে বাঁয়ে ।সে পথ বরাবর কিছুখন হাঁটলে যেখানে বড় বটগাছটা দেখা যায় তার পাশ ঘেসে একটা জঙ্গলমত ঝুপের ধার ঘেসে পথটা গিয়ে পড়েছে নদীর পাড়ে ।সেখানে এখন বেশ উচু আর অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুটেছে কাঁশবন ।তার মধ্যিখানে একটুকু ফাঁকা জায়গা ।আজকাল এটাই বিলুর প্রিয় খেলার জায়গা ।মিনুও আসে রোজ ।কোনদিন পুতুল ,কোনদিন কানামাছি ,কোনদিন আবার লুকোলুকি ।

মাঝে মাঝে মিনু লুকিয়ে তার বাবার দাবা ঘরটাও নিয়ে আসে ।

দাবা খেলাটা একটা আশ্চর্য বিলু কাছে ।নিজেকে বেশ যোদ্ধা যোদ্ধা মনে হয় ।নিয়ম কানুন ঠিক জানা নেই দুজনের একজনেরও ।তা না থাকুক ।গম্ভিরমুখে বিকেলভর চলে ওদের দাবা খেলা ।

আজ তেমনি একটা দিন । বিলুর ঘোড়াকে আড়াই ঘর এগিয়ে দিয়ে মিনুর হাতিটাকে সরানোর জন্য মুখিয়ে আছে ।

: তুই বড্ড দেড়ি করিস !

মিনুর দেড়ি দেখে বড্ড রাগ হয় বিলুর ।মিনু চুপচাপ ।অসতর্কভাবে হকচকিয়ে দান চালে ।

: এই দিলাম ..

রুক্ষ একটা স্বর যেন কানে বারি মারে বিলুর ।

কি হল আজ মিনুর ? আসা অবদি মুখটা কেমন মলিন ওর ।



গোমড়া মুখের রহস্য ফাঁস হল পরদিন ।সেদিন পুতুল খেলার দিন ।কিন্তু খালি হাতে এলো মিনু । তেমনি গোমড়া মুখ ,একটুও হাসি নেই তাতে ।চোখদুটো যেমন ছলছল ।যেন একটু নাড়া পেলেই উছলে পড়বে ।

চুপচাপ ,নিশ্চুপ যেন সবকিছু ।কাশবনের ফুলে বাতাসের দোলায় খেলছিল দুটো ফড়িং ।হঠাত্ করেই তীব্র বাতাসের ঝাপটায় একটা পড়ল উল্টে ।

: পুতুল যে আনলিনা আজ ?খেলবিনা ?

মিনু চুপ ।ঠায় দাড়িয়ে আছে । ।ওর ভারি মায়া হয় ।

: বাবাকি বকেছে ,গিন্নি ?

তারপর একটু থেমে বলে ।একটু যেন রসিকতার পায়তার খোঁজে ।

: উহু ..

কাজ হয়না ।মিনু তেমনি মুখ গোমরে বসে পড়ে ।

: তবে ?

মিনু আবার চুপ ।

: মাস্টার মশাই বকেছে ?

: না ।

বিলু আর প্রশ্ন খোঁজে পায়না ।বোকার মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।



: আমরা কাল কলকাতা চলে যাব ।

হঠাত্ করেই কথাটা কানে আসে বিলুর ।চুপচাপ মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে ।একটা শব্দও খোঁজে পায়না সে কোথাও ।যেন মুহুর্তেই সব ফুরিয়ে মিলে গেছে কোথাও ।

: এ দেশ নাকি মুসলমান হয়ে গেছে , হিঁদুদের আর থাক চলবেনা !সবাই চলে যাচ্ছে কলকাতা !বাবাও তাই কালকে আমাদের নিয়ে চলে যাবে ।

: যাহ ! তা আবার হয় নাকি রে ?

অবিশ্বাসের স্বর ঝরে পড়ে বিলুর কথায় ।

দেশকি মানুষ যে তার মুসলমান আর হিঁদু ?সহসা এক বিস্ময় ঠেকে কথাটা বিলুর কাছে ।

: বাবা সব জোগার জন্তর করে ফেলেছেন ..

এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়ে বিলু । আর কথা বেরোয়না মুখ থেকে । কাঁশফুল বাতাসে দোলে চলে ।একে অপরের গায়ে হেলে পড়ে এক মহা সমারোহে খেলায় মত্ত হয়ে পড়েছে তারা ।পাতার ফাঁকে বাতাসের এক মৃদু গুঞ্জন হঠাত্ হঠাত্ শা ..শা করে চলে যায় ।

মিনু এবার উঠে দাড়ায় ।বিলু ওদিকে তাকায় না ।আনমনে নদীর জলে হেলেপড়া টকটকে লাল সুর্যটাকে দেখে ।মিনু ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে ।কাঁশফুলের নড়াচড়া যেন মিলিয়ে যাচ্ছে সে তাল রেখে ।বিলু দাড়াতে চায় ,রুখতে চায় মিনুকে ।কিন্তু কেন যেন তা আর হয়ে উঠেনা ।ওর মুখটা বাবার মত থরথর কাপছে ।টকটকে লাল হয়ে উঠেছে চেহাড়া ।প্রচন্ড রাগ চমে উঠছে মনে । ঠিক কাঁদের প্রতি এ রাগ তা নিজেও সহসা বুঝে উঠতে পারেনা ও ।

: মিনু ...

সমস্ত শক্তি দিয়ে ডেকে উঠে ও ।

মিনু কাঁশফুলের ঝুপের আড়ালে থমকে দাড়ায় ।কান পেতে থাকে বাতাসে ।

: হোক মুসলমান দেশ !হয়ে যাক দেশ মুসলমান তবু তুই যাসনা ...

ফুঁপিয়ে উঠে বিলু ।ঠোটে ঠোট চেপে কান্না থামায় ।

: দেশ ভাগ হলে হোক ,তুই আমি ভাগ হতে পারবনা !

মিনু চুপ করে দাড়িয়ে শুনে ।বাতাসের গতি বাড়ছে ।সুর্যটাও অনেকটা হেলে পড়েছে পুব আকাশে ।ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে চারদিক ।

: আমি তোকে বড় হয়ে বিয়ে করব মিনু ..

একটু থামে বিলু ।তারপর বলে ,

: যদি বাবা রাজি না থাকে তাও ..

বাতাসটা হঠাত্ করেই পড়ে যায় ।থমকে দাড়ায় কাঁশফুলকো ।অন্ধকারটা আরেকটু ঝেকে এসেছে ।স্থির ফুলগুলোকে দুলিয়ে বিলুর সামনে এসে দাড়ায় মিনু ।

চুপচাপ সময় বয়ে চলে ।

: আমাকে যেতেই হবে কর্তা ...

সহসা কথাটা বলে আর দাড়ায় না মিনু ।কাঁশফুলগুলোকে দুমড়ে মুচরে মাড়িয়ে ছুঁটতে শুরু করে সে ।

পেছন থেকে বিলুর গলা ভেসে আসে ,

: যা ..যেখানে যাবি তোকে ঠিকই আমি বড় হয়ে খোঁজে নিয়ে আসব ..ঠিক দেখিস !

মিনু থামেনা ।দৌড়তে দৌড়তেই বিড় বিড় করে বলে , দেখব আমার কর্তার মুরোদ কদ্দুর !

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০৭

সমুদ্র কন্যা বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন। তবে প্রচুর টাইপো আছে। ঠিক করে নিবেন সময় করে।

১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৩৯

মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া বলেছেন: হুম ।লিখছি সময় মনে হয় ঠিকই লিখেছি, পরে পোস্ট করে পড়ে দেখি আসলেই প্রচুর টাইপিং মিসটেক আছে । পড়ার জন্য ধন্যবাদ !

২| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১১

শূন্য পথিক বলেছেন: ভালো লাগলো...

০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩৫

মোঃ জাবেদ ভুঁইয়া বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.