![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রঙের দুনিয়ায় আমি এখনও ছাত্র,তবে শখের বশে লেখক, সাংবাদিক, অনুবাদক আবার কখনো আরও অনেক কিছু।
শায়খ সাঈদ হালবী। শাম অঞ্চলের ইতিহাসখ্যাত আলেম ও পন্ডিতগণের একজন অন্যতম। তার অভ্যাস ছিল- দরস দানকালে তিনি তার দু পা সামনের দিকে ছড়িয়ে বসতেন। ছাত্ররা তার দু পাশে বসে সবক নিতো।
একদিন তার দরস চলাকালে মিসর শাসকের পুত্র ইবরাহীম বাশা এসে উপস্থিত হলেন। তিনি এসে মজলিসের সামনের অংশে শায়খের সামনে বসে পড়লেন। অথচ শায়খ সাঈদ হালবী তখনও পা ছড়িয়ে শাহী ভঙ্গিতে বসে আছেন। এভাবে বসেই তিনি অগণিত ছাত্র-শাগরিদকে পড়াচ্ছেন।
শাসকপুত্রের আগমনেও তার মধ্যে কোনো নড়াচড়া দেখা গেলো না। তিনি তাকে সম্মান জানাতে দরস ছেড়ে ব্যতিব্যস্ত হলেন না। ব্যাপারটি শাসকপুত্র যুবরাজ ইবরাহীমকে অবাক এবং ব্যথিত করল। তিনি ভাবলেন, শায়খ আমার প্রভাব-প্রতিপত্তি সম্পর্কে হয়তো অবগত নন। তাকে আমার সম্পর্কে কিছুটা জানানো প্রয়োজন।
দরস শেষে যুবরাজ চলে গেলেন। যাওয়ার পরপরই তিনি শায়খ সাঈদ হালবীর নামে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা হাদিয়া পাঠালেন। তিনি ভাবলেন, স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে শায়খ পুলকিত হবেন। আগামীতে তিনি উপস্থিত হলে তাকে তোয়াজ করবেন। পা গুটিয়ে স্বাগত জানাবেন।
রাজপুত্রের দূত এক হাজার স্বর্ণমুদ্রার সুসজ্জিত তোহফাথলি নিয়ে শায়খের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সালাম জানিয়ে যুবরাজের হাদিয়া পেশ করলেন।
শায়খ বুঝে ফেললেন। যুবরাজ তাকে স্বর্ণমুদ্রার মোড়কে কিনে নিতে চাচ্ছেন। শাসক এবং শাসক পরিবার এভাবেই জ্ঞানীদের কাছ থেকে সম্মান-সমাদর কিনে নিয়ে থাকেন। তাই বলে আমার কাছেও?
তিনি এ থলি ফেরত দিলেন। দূতকে বলে দিলেন, তোমার যুবরাজ সাহেবকে বলে দিও, যে লোক পা ছড়িয়ে বসে থাকে, সে হাদিয়া তোহফা দেখলে তার হাতও ছড়াবে, এতো সহজ নয় । আমার পা প্রলম্বিত কিন্তু হাত প্রার্থিত নয়।’ দূত ফিরে এলো। তিনি যা দেখলেন- তাতে তার জ্ঞান হয়েছে- এ মানুষ কেনা-বেচার জন্য নয়।
আরেকটি ঘটনা।
আব্বাসী খলীফাদের মধ্যে একজন প্রতাপশালী শাসক আবু জাফর মানসুর। একদিন তিনি আব্দুল্লাহ বিন তাউস এবং মালেক বিন আনাসকে তার রাজসভায় আমন্ত্রণ জানালেন। এ দুজন মানুষ হাদীস ও ইলমী জগতে তৎকালে বিখ্যাত প্রাজ্ঞজনদের মধ্যে অন্যতম। শাহী আমন্ত্রণ পেয়ে তারা দুজন যথাসময়ে রাজদরবারে এসে উপস্থিত হলেন।
খলীফা আবু জাফর মানসুর এ দুজন শায়খকে পেয়ে খুশী হলেন। সসম্মানে তাদেরকে নিজের পাশে বসালেন। খলীফা জানতেন, আব্দুল্লাহ বিন তাউসের বাবা তাউস ইয়ামানী ছিলেন বিখ্যাত হাদীস বর্ণনাকারী। তার অসংখ্য হাদীস মুহাদ্দিসগণের কিতাবসমূহে সংরক্ষিত এবং গ্রহণযোগ্য। তাই প্রথমে তিনি আব্দুল্লাহ বিন তাউসের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বাবা আপনার কাছে যেসব ভালো বিষয় বর্ণনা করেছেন- সেখান থেকে অনুগ্রহ করে আমাকে কিছু শোনান।
খলীফার অনুরোধ পেয়ে আব্দুল্লাহ বিন তাউস তাকে একটি বর্ণনা শোনালেন। তিনি তার দিকে তাকিয়ে বলছেন, আমার বাবা বলেছেন, নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন অনেক বেশি যন্ত্রণাময় শাস্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন শাসকও অন্তর্ভুক্ত- যাকে আল্লাহ পাক শাসনক্ষমতা দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি তার শাসনে মানুষের উপর অন্যায়-জুলম করেছেন।’
প্রতাপশালী খলীফার মুখের উপর এমন কঠিন উপদেশ! রাজদরবারের সবাই তো বটেই- আব্দুল্লাহ বিন তাউসের সঙ্গী মালেক বিন আনাসও থমকে গেলেন। গোটা সভাজুড়ে নিরবতা ছেয়ে গেল। এই বুঝি চোখ গরম করে খলীফা তার রাগের সামান্য প্রকাশ করবেন এবং ইশারায় তার সামনেই আব্দুল্লাহর গর্দান উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিবেন। তৎকালে সামান্য তুচ্ছ কারণে রাজদরবারে চোখের ইশারায় দেহ থেকে মাথা উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটতো। চিকচিকে তলোয়ার হাতে জল্লাদ শাহী আসনের পেছনে সদা প্রস্তুত থাকতো।
সেদিনের সেই ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে মালিক বিন আনাস বলতেন, আব্দুল্লাহর বর্ণনা শেষ হওয়া মাত্র আমি আমার গায়ের কাপড় টেনে গুটিয়ে নিলাম, যাতে আব্দুল্লাহর শরীর থেকে ছিটে আসা রক্ত আমার কাপড়ে ছিটে না আসে। কারণ, আমি নিশ্চিত ছিলাম, খলীফাকে জালেম বলার ইঙ্গিতপূর্ণ এমন বর্ণনা শোনার পর আবু জাফর মানসুর তার মেজাজ ঠিক রাখতে পারবেন না। তার নির্দেশে এখনই আব্দুল্লাহর ঘাড় থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন হবে। ফিনকি থেকে রক্ত ছুটবে প্রবল বেগে। তার রক্ত যেন আমার কাপড়ে না লাগে, তাই কাপড় টেনে গুটিয়ে বসলাম।
কিন্তু না! খলীফা কিছুই বললেন না। রাজদরবারের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে খলীফার চেহারাপানে। খলীফার মুখ গুরুগম্ভীর। যেন তিনি আচ্ছন্ন হয়ে আছেন পরকালের ভয়াবহতায়। তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ভাবনার অতলে ডুবে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তারা দু জন সালাম দিয়ে বিদায় নিলেন। সহি সালামতে ফিরে এলেন।
সেকালে রাজদরবারে ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বেঁচে আসা বিরল মাত্র কয়েকটি ঘটনার মধ্যে এটিও অন্যতম।
©somewhere in net ltd.