![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
..................বিশাল যন্ত্রণার অর্থ হচ্ছে বিশাল শুদ্ধতা ৷৷ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
বাংলার মসলিনের প্রকারভেদ
ঢাকার তাঁতে প্রস্তুত সুতি কাপড় কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল ৷ একদিকে যেমন নবাব-বাদশাহদের উপযুক্ত সূক্ষ্মতম মসলিন তৈরী হতো, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ রায়তদের ব্যবহারোপযোগী মোটা কাপড়ও তৈরী হতো ৷ সে হিসেবে বিচার করলে ঢাকার তৈরী সুতি কাপড়কে কয়েকটি সাধারণ ভাগে ভাগ করা যায় মসলিন, মাঝারি রকমের কাপড়, মোটা কাপড় ও মুগাসিল্ক মিশ্রিত সুতি কাপড় ৷ রঙ এবং বুনন প্রণালির পরিপ্রেক্ষিতেও মসলিন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল যেমনঃ ডোরাকাটা, মসৃণ (plain), চারকোনা চিত্র বিশিষ্ট বা ছক কাট (chegued) এবং রঙ করা ৷ সূক্ষতা, ব্যবহারিকতা ও বুননের পরিপ্রেক্ষিতেও মসলিনের বিভিন্ন নাম ছিল যেমনঃ আব-ই-রওয়ান, শবনম, জামদানি ও সরবন্দ ৷ এর মধ্যে আবার নওয়াব-বাদশাহদের জন্য তৈরি মসলিন এক-একটি বিশেষ নামে পরিচিত ছিল ৷ যেমন-মোগল বাদশাহ ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য তৈরি মসলিনকে মলবুস খাস বা খাসবস্ত্র (অর্থাৎ বাদশাহর জন্যই বিশেষভাবে তৈরী) বলা হতো এবং বাংলার সুবেদার ও নওয়াবদের জন্য তৈরী মসলিমকে বলা হতো সরকার-ই-আলা ৷ আঠারো ও উনিশ শতকে মলবুস খাস মলমল খাস নামেও পরিচিত ছিল ৷
মলবুস খাস বা সরকার-ই-আলা কোনো বিশেষ রকমের কাপড়ের নাম নয় বরং যে সব কাপড় মোগল বাদশাহ বা বাংলার নওয়াবদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল তার বুনন, রঙ ও সূক্ষতার বিচারে বিভিন্ন রকমের ও বিভিন্ন নামের হলেও ওই একক নামেই পরিচিত ছিল ৷ একে এক প্রকার দরবারি পরিভাষা বলা চলে ৷
সাধারণত একখানি মসলিন ২০ গজ লম্বা ১ গজ চওড়া ছিল ৷ মসলিনের ওজন মূল্য এবং সূক্ষ্মতা বিচারের সময় এই পরিমাণই আদর্শরূপে গন্য ছিল ৷ প্রত্যেক টুকরা মসলিনের সুতার সংখ্যা নির্ধারণ করা যেত এবং এর হিসাবের জন্য সুতা গণনা করবার নিয়ম ছিল ৷ সানার দাঁতের সংখ্যাই টানা সুতার সংখ্যা হিসাবে গণ্য হতো ৷ যদিও প্রকৃতপক্ষে টানা সুতার সংখ্যা সানার দাঁতের সংখ্যার দ্বিগুণ থাকত ৷ কারণ সানার প্রত্যেক দাঁতের সঙ্গে দুইটি করে সুতা বাঁধা থাকত ৷ আবার মসলিনের মূল্য নির্ধারণের সময় তার ওজন, দৈর্ঘ্য ও সুতার সংখ্যা বিচার করা হতো ৷ যে কাপড় যত বেশী দীর্ঘ এবং যত বেশিসংখ্যক সুতা বিশিষ্ট হয় অথচ ওজনে কম হয় তাই সূক্ষ্মতম এবং উৎকৃষ্টতম বিবেচিত হতো এবং তার মুল্যও সর্বোচ্চ নির্ধারিত হতো ৷ আগাগোড়া একইরকম সূক্ষ্ম বানা সুতার তৈরী মসলিন খুব কমই পাওয়া যেত , একমাত্র মলবুল খাস বা সরকার-ই-আলাই এর ব্যতিক্রম ছিল বলে মনে হয় ৷ করণ প্রয়োজনমাফিক পর্যাপ্ত পরিমাণ লাভের জন্য অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম সুতা মাঝে মাঝে চালিয়ে দিত ৷ এ জন্য ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরা মসলিনকে অর্ডিনারি, ফাইন, সুপার ফাইন এবং ফাইন সুপার ফাইন ইত্যাদি কয়েক ভাগে ভাগ করে নিত ৷
মলমল খাস
মোগল আমলের মলবুস খাসই আঠারো শতকে বা তার পরবর্তী সময়ে মলমল খাস নামে পরিচিতি পেয়েছিল ৷ এখনো ফাইন কোয়ালিটি সুতি কাপড়কে মলমল নামেই পরিচিত হতে দেখা যায় ৷
খাস-এ ১৮০০ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত সুতা ব্যবহৃত হতো এবং সাধারণত মলমল খাস আধা টুকরায় তৈরী হতো অর্থাৎ এর দৈর্ঘ্য ছিল ১০ গজ ও প্রস্থ ১ গজ ৷ ১৮৫১ সালে ইংল্ডেনের বিখ্যাত প্রদর্শনীর মসলিনের ওজন ছিল মাত্র আট তোলা ৷
ঝুনা
ঝুনা শব্দটি হিন্দি শব্দ ঝিনা (অর্থ-সূক্ষ্ম বা সরু) ৷ এ কাপড় সূক্ষ্ম জালের মত ছিল যে পরিধান করলে দেহ নগ্নপ্রায় থাকত ৷ ইহা দৈর্ঘ্যে ২০ গজ ও প্রস্থে ১ গজ এং প্রায় ১০০০ টানা সুতা থাকত, ওজন ছিল প্রায় ২০ তোলা ৷ এ কাপড় বিদেশে রপ্তানী হত না, মোঘল দরবারে ও ধনী-বিত্তশালীদের হেরেমের মেয়েরা ব্যবহার করার রেওয়াজ ছিল এছাড়াও নর্তকী ও গায়িকারাও ঝুনা কাপড় ব্যবহার করত ৷
রঙ্গ
রঙ্গও ঝুনার মতো জালী মসলিন ৷ এতে প্রায় ১২০০ সুতা থাকত এবং এর দৈর্ঘ্য ২০ গজ ও চওড়া ১ গজ ছিল এবং ওজন প্রায় ২০ তোলা ছিল ৷
আব-ই-রওয়ান
ফার্সি শব্দ আব (পানি) ও রওয়ান ( প্রবাহিত ) থেকে আব-ই-রওয়ান নামের উৎপত্তি ৷ এ কাপড় এত সূক্ষ্ম ও পাতলা বুননী বিশিষ্ট ছিল যে ঢাকার তাঁতিরা আব-ই-রওয়ান বা প্রবাহিত পানি নাম দিয়ে এর সূক্ষ্মতা ও উৎকর্ষের প্রমাণ করত ৷ আব-ই-রওয়ান সাদা জমিনে নকশাবিহীন ( plain ) মসলিন ও এর দ্বারা পরিধেয় জামা ইত্যাদি তৈরী হতো ৷ লম্বায় ২০গজ এবং চওড়ায় ১ গজ ছিল এবং সুতার সংখ্যা ৭০০ থেকে ১৪০০ পর্যন্ত উঠানামা করত ৷ ওজন ছিল প্রায় ২০ তোলা ৷
সরকার-ই-আলি
বাংলার নওয়াবের জন্য মসলিনকে সম্মান সূচকভাবে সরকার-ই-আলি বলা হতো ৷
খাসসা
খাসসা ফার্সি শব্দ ও এর দ্বারা মিহি ও সূক্ষ্ম মসলিনকে বুঝাতো ৷ এর প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবর' তে ৷ আঠারো ও উনিশ শতকে সোনারগাঁর জঙ্গলবাড়ীর জঙ্গল খাসসা বিশেষ প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল ৷
শবনম
মিহি বুননী বিশিষ্ট এ মসলিনকে শবনম বা ভোর বেলার শিশির নাম দিয়েছিল ঢাকার তাতীরা ৷
তনজেব
ফার্সি শব্দ তন (দেহ) ও জেব (অলংকার) অর্থাৎ দেহের অলংকার নামে এ সাদা জমিনের মসলিন কাপড় দৈর্ঘ্যে ২০ গজ ও প্রস্থে ১ গজ ছিল ৷
তরান্দাম
তরান্দম শব্দ আরবি তরাহ্ (মত) ও ফার্সি আন্দাম (দেহ) থেকে এসেছে ৷
ময়ন-সুখ
ইহা মিহি বুননীর ন্য প্রসিদ্ধ ছিল ও গলার রুমাল ( neck-kerchief ) রূপে ব্যাবহৃত হত ৷
বদন-খাস
বদন (শরীর) থেকে নামকরণ, বুনন খুব গাঢ় বুনটের (close texture) ছিল না, দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ গজ পর্যন্ত ও চওড়া ১ ১/২ গজ ছিল ৷
সর-বন্দ
ফার্সি শব্দ সর (মাথা) ও বন্দ ( বাঁধা ) থেকে উৎপন্ন যা মাথার পাগড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হত দৈর্ঘ্যে ২০ গজ ও চওড়ায় ১-১ ১/২ গজ ছিল ৷
সর-বুটি
ফার্সি শব্দ সর (মাথা) ও বুটি বা বুটিদার থেকে এ নামকরণ যা পরিমাণ ও ব্যবহরে অনেকটাই সর-বন্দের মত ছিল ৷
কামিছ
আরবি শব্দ কামিছ ( জামা ) থেকে উৎপত্তি ৷ সেকালের মুসলমানদের কোরতা তৈরীতে কামিছ মসলিন ব্যবহৃত হত যা দৈর্ঘ্যে ২০ গজ ও চওড়ায় ১ গজ ছিল ৷
ডোরিয়া
ডোরাকাটা বা দাড় বিশিষ্ট মসলিনকে ডোরিয়া বলা হত ৷ সাধারণত ভোগা বা সিরঞ্জ জাতীয় তুলা থেকে উৎপন্ন মসলিন ছেলেমেয়েদের জামা বনানো হত ৷
চারকোনা
চারকোনা বিশিষ্ট ছককাটা ডিজাইন করা মসলিনকে চারকোনা বলা হত ৷ চারকোনা ও ডোরিয়া ওজন ও সুতার সংখ্যা প্রায় সমান ছিল পার্থক্য শুধু বুননীতে ৷
জামদানী
যেসব মসলিনে নকশা করা হত তার নামই জামদানী ৷ তবে এখনকার জামদানি নিকৃষ্ট সংস্করণ ৷ বংশপম্পরার মানসম্পূন্ন তাতী, সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পূর্ণ কাটুনী ও উৎকৃষ্টমানের কার্পাস উৎপাদন, যথাযথ পরিবেশের অভাব, রাষ্টের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ধীরে ধীরে এই গৌরবময় তাঁত শিল্পকে অবলুপ্তির দিকে নিয়ে যায় ৷
মুসলিনের পুরনো পাশ্চাত্য বিজ্ঞাপন
সতেরো শতকের প্রথম দিকে পর্তুগিজরা পরে আর্মেনিয়ান, ইরানি, তুরানি,
মোঘল, পাঠান ও এই শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে ওলন্দাজ, ইংরেজ, ফরাসি কোম্পানি ঢাকা শহরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে মসলিনের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন যুগের সূচনা করে ৷
কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল, অনন্যা ম্যাগাজিন
১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৭
জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন: মন্তব্যের ও পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা ৷
১৷ ১৭৭০ সালে উইলিয়াম বোল্ট তার consideration of indian affiars-এ আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে এ মুখরোচক গল্পটি লিখেছেন ৷
২| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:২১
বৃত্তবন্দী শুভ্র বলেছেন: অসাধারন ভাবে তথ্যগুলোকে একসাথে সাজিয়েছেন। শুভ কামনা
১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:৪৮
জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন: কৃতজ্ঞতা ৷
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৫৬
মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: চমৎকার তথ্যবহুল পোস্ট। ভাল লাগা রইল।
শুনেছি ইংরেজরা নাকি মসলিন বুননে দক্ষ কারিগরদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিত যেন তারা আর এটা বুনতে না পারে!!
মসলিনের কথা শুনলেই আমার দুটো পাঠ স্মৃতি মাথায় ঘোরেঃ
১. একদা মোঘল সম্রাট আউরঙ্গজেব পরিমিত পরিমাণ বস্ত্র পরিধানের অভাবে তাহার কন্যাকে ভর্ৎসনা করিলেন। তাহার কন্যা তৎক্ষনাৎ তাহার প্রতিবাদ করিয়া বলিল সে সাত প্রস্থ বস্ত্র দ্বারা অঙ্গ আবৃত করিয়াছে। বস্তুত ইহাই ছিল মসলিনের সূক্ষ্মতার নিদর্শন।
২. একটি দীর্ঘ (নির্দিষ্ট পরিমাণ মনে নাই) মসলিন কাপড় নাকি একখানা দিয়াশলাইয়ের বাক্সে অনায়াসে ভাজ করে রাখা যেত।
বাঙ্গালির সেই সুদিন কোথায় গেল ??