নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুন্দর

জীবনে প্রাণ আসুক। প্রতিটা মুহূর্তকে আমরা সুন্দর করে তুলি।

জাহেদ মোতালেব

বই পড়া ও ভ্রমণ

জাহেদ মোতালেব › বিস্তারিত পোস্টঃ

থুতু

২১ শে জুন, ২০১১ দুপুর ২:২১



ফজু নিপুণভাবে দেয়াল গাঁথছে। কন্নি দিয়ে ইটের ফাঁকে, উপরে মশলা নানা কায়দায় সমান করে দেয়। তার হাত ঘোরানো দেখার মতো। মাথা কাত করছে, ডান চোখ কুঁচকে তা পরখ করছে। কখনো হয়তো হেলপারকে তাড়াতাড়ি মশলা আনতে বলছে। সিমেন্ট ও বালির মিশ্রণে তৈরি মশলায় বদনা থেকে পানি ঢেলে নরম করছে। মনটা ফুরফুরে। গুণগুণ করে কিসব যেন গাইছে। মাঝে মধ্যে চোখ যায় দূরের নারকেল গাছে।

মনে ফুর্তি। দেয়াল গাঁথলেই এমন হয়। আজ আসার সময় ছেলে গলা জড়িয়ে ধরে আপ্পা দিয়েছিল। ছেলের আদুরে মুখ মনে পড়ে।

হেলপার মুখ তুলে তাকায়। সরসর করে বাঁশের পাতা নড়ে। গায়ে লাগে হালদা নদীর বাতাস। পাড়ায় উলুধ্বনি দেওয়া হচ্ছে।

এবার কাজ ছাড়তে হয়। এক রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে। গরুর ডেকা হাম্বা ডাকে। গাভী চোখ বড় করে তাকায়। গরুর বাচ্চাটা যেন ডাকছেÑ বা-বা-আ-আ-। সে সব গোছগাছ করে। হেলপাররা কড়াই, কন্নি, কোদাল ধোয়। জুগিপাড়ায় সুরেশের ঘরের কাজ করছে আজ তিনদিন। আগামীকালের জন্য হেলপারকে কয়েকটা নির্দেশনা দিয়ে শার্টটা গায়ে দেয়।

বিশ্বরোড দিয়ে নেতা যাচ্ছেন রাস্তা উদ্বোধন করতে। দীর্ঘদিন নাকি ভূজপুরবাসী অবহেলিত। তিনি এটা আর হতে দেবেন না। তার আগমন উপলক্ষে গেইট হয়েছে অনেকগুলো। দেয়ালে চিকা মারা হয়েছেÑ সিংহ পুরুষ আলাউদ্দিন ভাই/সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। তিনি এসেছেন, জনগণের সুবিধার জন্য রাস্তাটা নারীর গালের মতো মসৃণ করে দেবেন। এলাকার লোকজনকে তিনি খুব ভালোবাসেন। হালদার ব্রিজ পার হলেন। পেছনে তার ক্যাডার বাহিনীর গাড়ি। সামনে পাজেরোর নরম সিটে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছিলেন তিনি। লোক দেখে হাত নাড়েন। দাঁত দেখিয়ে হাসেন।

মিস্ত্রি নদীর পাড়ে ওঠে। সে লম্বা। যখন হাঁটে আকাশ ছুঁয়ে হাঁটে। হাঁটা তার কাছে গভীর এক আনন্দ। পেছনে থাকা হেলপার মিস্ত্রির পদক্ষেপ ও বড় বড় পা দেখে। পাড় ছেড়ে তারা রাস্তায় উঠল। সন্ধ্যা আঁধার মাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্বরোডে দেখল গাড়ির বহর। মাইকে নেতার নামে ফুল ফুটছে। এক ক্যাডার বলছে, ভূজপুরবাসী এবার দেখবে উন্নয়ন কাকে বলে।

গাড়ির বহর থেমেছে। পথসভায় নেতা বক্তৃতা দেবেন। নেতার মুখ দেখে ফজু মিস্ত্রির চেহারা পাল্টে যায়। পাশের থানায় নেতার বাড়ি। এবার এ আসনে নির্বাচন করবেন। লোকে এতদিন বলাবলি করছিল, আমাদের এরকম অতিথি পাখির দরকার নেই। কেননা একাত্তরে মুক্তিদের মারার জন্য মুসলিম লীগার এ নেতার একটি জল্লাদখানা ছিল।

কেউ খেয়াল করে না, ফজু গরগর করছে। বাবা ঘৃণায় যা উচ্চারণ করতো তা-ই করে, রাজাকারের বাচ্চা। ভাবল, চেহারায় তো সুন্দর। কাজে কেন অমন হতচ্ছাড়া? দেয়ালে সিমেন্ট লেপ্টে দেওয়ার মতো থুতু ছুঁড়ে দিল দূর থেকে।

থু! শব্দ হয়েছিল। কয়েকজন ক্যাডার তা দেখে ফেলে। তারা চড় চাপড় মেরে ফজুকে নেতার পায়ের কাছে নিয়ে আসে। নেতার পায়ে তার মাথা জোরে চেপে ধরে। বলে, মাপ চা চুদানির পোয়া।

নেতার চোখে কেউ তাকালে হিন্দু বাড়ি জ্বালানোর সময় যে ক্রোধ ছিল তা দেখতে পেত। সর্বদা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী বাকচতুর নেতা কিছু বলেন না। বোবার ভান ধরে কৌতুকের রঙ্গে ক্যাডারদের তৎপরতা দেখেন। ক্যাডাররা নেতাকে মহানুভব বানানোর জন্য বলে, স্যার, মাফ করে দেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর নেতা করুণার স্বরে বলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ক্যাডার বাহিনী তো বিয়াদবি সহ্য করতে পারে না। দূরে নিয়ে ফজুর ঘাড় ধরে। মার, কাট, বানা খই। কিল ঘুষি লাথিতে মেতে উঠে সবাই। কয়েকজন পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে বন্দুকের নল দেখে।

ছোটবেলা থেকে কাজ করতে করতে তার ইটশরীর। তবুও মুখ ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। মাথার এক জায়গায় ফেটে গেছে। হাঁটু, পিঠ, কানের লতিতে রক্ত।

বাবা ছিল রাজমিস্ত্রি। তাকে করাতে চেয়েছিল পড়ালেখা। কিন্তু পড়ালেখার দিকে মোটেই মন ছিল না। দিনরাত সে বাবার কন্নি নিয়ে মনে মনে দেয়াল গাঁথত। তাই কয়েক ক্লাসের বেশি পড়া হয় নি। মা ছেলেকে পড়ালেখা করানোর চেষ্টা করেও পারে নি। তা শেষ হয়ে গেছে কন্নির গুঁতায়। রাগ করে মা তাকে ডাকত, কন্নিমিস্ত্রি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকাররা দাদাকে মেরে ফেলেছিল। রাজাকারের প্রসঙ্গ এলেই বাবা শূন্যে থুতু ছুঁড়ে মারত। একসময় সেও বাবার দেখাদেখি তা করত। বাবা বলত, রাজাকার কখনো ভালো হয় না। তারা মহিষজোঁক। বাবা ছিল দক্ষ রাজমিস্ত্রি। বাবা ছিল ঘোর আওয়ামী লীগ। বাবাকেও রাজাকারের দলের লোকেরা মেরে ফেলেছে। বাবার কথা ভাবছিল। নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আর ক্রোধে তার নাকের ছিদ্র বড় হচ্ছে। সে মনে মনে বলে, আমি পাঁচ সুতা লোহার পিলার। আমাকে তোরা ভাঙতে পারবি না। সে কন্নি, উলুম, হাতুড়ি, ছেনি, ইট, ডাই, কোরাবারির কথা ভেবে নিজেকে চঞ্চল রাখতে চায়।

নেতা কোনো কথা বলছেন না। লোকে তামাশা দেখে। তারা দেখে, ছেলেটির মাথার তালু পোড়া, একটি বড় কপাল। বড় বড় দুটি চোখে রাজ্যের বিহ্বলতা। মোটা মোটা ঠোঁট দুটি আরো ফুলে গেছে। চোখের চাহনি বোকা-সোকা। লোকের দিকে শিশুর মতো তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো আওয়াজ নেই।

ফজু বদদোয়া দেয়, নেতা অন্ধ হয়ে যাক। ক্যাডারদের হাতে ঘা হোক।

কাক পশ্চিম দিকে উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যেতে যেতে সন্ধ্যাকে গাঢ় করে দিয়ে গেছে। খালে চাঁই বসায় এক মহিলা।

হাড্ডিগুড্ডি অনেকক্ষণ ভেঙে ক্যাডাররা তাকে চাঁদের গাড়িতে উঠায়। যেন চাঁদে নিয়ে যাবে। তারা তাকে বাঁধে।

নারায়ণহাটে রাস্তা উদ্বোধন হবে। হওয়ার কথা ছিল বিকালে। নেতা বিশেষ কাজে আটকে পড়ায় দেরি হয়ে গেছে। তারা উল্লাসে স্লোগান দেয়, আলাউদ্দিন ভাই আসছে/ভূজপুর জাগছে।

নেতার নাম আলাউদ্দিন। কেউ ডাকে আলা। কেউ ডাকে ভোলা। কেউ টিপ্পনি কাটে, হুঁশের আলাভোলা। ফজুদের বাড়ির রহম পাগলা তার কথা উঠলে বলত, রাজাকার/চামিচুত গরি গু খার। তিনি নেতা। চমক জাগানো কথার জন্য আলোচিত। প্রচুর টাকার মালিক। লোকে বলে, ধরতে গেলে বাংলাদেশ তাদেরই। কেউ কেউ এতে মজা পায়। যাক একটা বাপের বেটা তা হলে দেশে আছে। অনেকে জানে, এ নেতা কখনো সোজা পথে চলে না। অনেকে ক্ষোভে নেতাকে ‘কাউঅর গু’ ডাকে।

রাস্তার কাজ উদ্বোধনের পর জনসভায় নেতা বক্তৃতা করেন, পুলিশ, র‌্যাব লাগবে না, সন্ত্রাস দমন করার জন্য আমিই যথেষ্ট। বিপক্ষ দলের উদ্দেশে বলেন, ত্রিশজন লিস্টে আছে। তাদেরকে ক্রসফায়ার দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তওবা পড়ে নাও।

নেতার বক্তব্য জিপের মেঝেতে দলামোচড়া করে বাঁধা ফজুর কানে তীরের ফলা হয়ে ঢোকে। সে মনে মনে বলে, কুত্তার বাচ্চারা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত।

যাওয়ার সময় তারা তাকে লাথি মেরে বিবিরহাটে ফেলে দেয়। সে তিন রাস্তার মাথায় পড়ে। ইটের কণায় কপাল ফেটে যায়। রক্ত গড়িয়ে পড়ে। ঠোঁট বালুমাখা। থুতু ফেলে। রক্তমাখা থুতু পায়ে পড়ে। জীবন কি রক্তমাখা থুতুর মতো! সে ভাবে, থুতুর অনেক কেরামতি আছে। উপরের দিকে ছুঁড়লে তা নিজের গায়ে পড়ে। নেতার দিকে ছুঁড়লে গায়ে লাথি পড়ে। পানিতে ছুঁড়লে কাকিলা মাছ খেয়ে ফেলে।

কয়েকজন দৌড়ে আসে। জিজ্ঞেস করে, কি হয়ি য্যা?

হালার পোয়ার মুখুত ছেপ দিই। বিধ্বস্ত কণ্ঠে এখনো রাগের কণা লেগে আছে।

তই?

আরেকজন রস করে, মইষুর শিঙে না গরুর শিঙে গুতা দিয়ুছ?

তারা তাকে ধরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। খবর ছড়িয়ে পড়লে লোকজন এসে ভিড় করে। শুনে কেউ সহানুভূতি জানায়, মার খাওয়ায় কেউ খুশি হয়। ডাক্তার ডেটলে ঠোঁটের কেটে যাওয়া অংশ মুছে দেয়। মাথায়, চোখের পাশে, চিবুকে, হাঁটুতে, ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। রসিকজন তাকে বাহবা দিয়ে সুন্দরপুরের রিকশায় তুলে দেয়। কি একটা চিন্তা করে নিজেও ফজুর পাশে উঠে বসে।

তাকে দেখে বাড়ির সবাই দৌড়ে আসে। ঘটনা শুনে মা নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোর বলবলা আল্লা কমাক।

চাচা বলে, হিতের গাত মুতি দিলি ভালা হইতু। তারপর এসে ফজুর পাশে বসে। বেড়ায় ক্যালেন্ডারে বনসাই বটের দিকে তাকায়। ভাইপোর হাত ধরে। কিছু একটা বলতে চেয়েও বলে না। কিছুক্ষণ পর ঘরে গিয়ে বিড়ি ধরায়। কয়েকটা টান দেয়। যেন গভীর ভাবনায় মগ্ন। ফজু মার খাওয়ায় আদতে সে খুশি হয়েছে। বিড়বিড় করে বলে, উচিত কাম হইয়ি। হিতের বাড় বাড়ি গেয়িল।

মা মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। নেতাকে ঝাঁটার বাড়ি মারে।

বউ নীরবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর দৃঢ়তা শাশুড়ি এক পলক দেখে।

চার বছরের পিন্টু তখন জোনাকির মতো জ্বলে নিভে, জ্বলে নিভে ধীরে ধীরে কাছে আসে। বাবাকে দেখে। বাবার পায়ের ব্যান্ডেজে হাত রেখে ভ্যা করে কেঁদে দেয়। ফুলে ফুলে কাঁদে। উপুড় হয়ে ছেলেকে তুলতে গিয়ে ফজু বুকে ব্যথা পায়। দাদী নাতিকে জড়িয়ে ধরে। চোখ মুছে দেয়।

কান্না কণ্ঠে পিন্টু বলে, কনে মাইয্যি?

দাদী বলে, রাজাকারে।

বাবা, লাজাকাল কি কলে?

মা ভারী স্বরে বলে, মানুষ খায়।

ফজু তখন টিকটিকির পোকা গিলে খাওয়া দেখে। কারেন্ট চলে গেল। বাবা কডে? পিন্টুর কান্না কান্না স্বর। মা হারিকেন ধরায়। সে খাটে উঠে বাবার পাশে বসে। বাবার বুকে মাথা রেখে হারিকেনের আলো দেখে। মা’র ছায়া দেখে। বেড়ায় হাতের ছায়া দিয়ে রাক্ষস বানায়। ভাবে, রাক্ষস গিয়ে রাজাকারকে খেয়ে ফেলুক।

ফজুর গা ব্যথায় টনটন করছে। বলে, কুত্তার বাচ্চাঅল বুকুর হাড্ডি ভাঙি দিয়ি। হাঁটু দশ মণি পাথর হয়ে আছে। চোখজুড়ে ঘুম আসে। নিজেকে ফিরে পাওয়ার জন্য সে কোথাও চলে যেতে চায়। কন্নি দিয়ে ইটের কোনা ভাঙার মতো ব্যথা ভাঙতে চায়। কাল কাজ করা যাবে না। চাল-ডালের দাম বেশি। পানি খেয়ে কলজে ভরাতে ইচ্ছে হয়। বহুদূরে কি শেয়াল ডাকছে? রাত কত হলো? হঠাৎ সে ভয়ে চমকে ওঠে। আহ শব্দ করে। নেতা মনে হয় উঠানের কোণে মরা কাঁঠাল গাছের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যথা হজম করতে দাঁতে দাঁত চিপে।

ফুট ইঞ্চি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় তাকে। টেপ দিয়ে, সুতা দিয়ে মাপে। কণা পরিমাণ বাঁকা হতে পারবে না। কেমন করে সূক্ষ্মভাবে কাজ করতে হয় জানে। এসব হিসাব করে, বিচার বিশ্লেষণ করে আনন্দ পায়। সে আসলে সূক্ষ্মতার মানুষ। তা আরো গাঢ় করেছে শাহাদাত ভাই। কমিউনিস্ট মানুষ। শাহাদাত ভাই মাঝে মধ্যে গ্রামে আসে। মানুষ, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, শ্রেণী, বৈষম্য ও সমাজ বিষয়ে তার কাছে শিখেছে। সেও জানতে চাইত কমিউনিস্ট মানুষ বেশি নেই কেন।

শাহাদাত ভাই মানুষের অন্ধতা এবং পৃথিবীর ক্ষমতাবানদের নোংরামির গল্প বলত।

ব্যথায় সর্ব অঙ্গ কাঁদতে চায়। ব্যথার ওপর রাগের প্রলেপ দেয় সে। তখন বউ আসে মলম নিয়ে। বউয়ের কান্না কান্না চোখের বাষ্প উড়ে এসে মনে হয় আরামের ছেঁক দিচ্ছে। তার লোহার মতো শরীরে মলম মাখে বউ। স্বামীর ব্যথার শরীরে মলমের সাথে সে মায়াও মেখে দেয়। তার চোখে ক্রোধ। ক্রোধগুলো ফোঁটা ফোঁটা গলে ব্যথার জায়গায় মিশে যায়।

ফজু বউয়ের হাত ধরে চুপচাপ বেড়ার দিকে চেয়ে থাকে। কারেন্ট এখনো আসে নি। বউ হাতে হাত বুলিয়ে দেয়। একটু পর ওষুধ খাইয়ে দেয়।

শুতে গিয়ে অনুভব করে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথা ভুলতে সে মনে মনে ইট সিমেন্ট দিয়ে দেয়াল গাঁথে। রাজাকার নেতার মুখ, হাত ইটের ফাঁকে গেঁথে দেয়।

ব্যথার ঘোরে পড়ে সে আবার ধুরুংকূলে ডাংগুলি খেলতে যায়। গুলি মেরে ডাঙের দশ বিশ ত্রিশ গুনতে গুনতে খালের পানির কাছে চলে যায়। পানিতে দেখে নিজের রক্তাক্ত ছায়া। তখন অনেক ছায়া এসে পানির স্বরে বলে, এই নেতা বাংলাদেশের সকল দুই নম্বরির মালিক। বাংলার খারাপ সবকিছুর সাথে সে জড়িত। মানুষের ভাগ্য চুয়িংগামের মতো চিবিয়ে খায়। ছায়ারা বলে, নেতা এমন লম্বা আর ফরসা, মনে হয় বিদেশি।

পিন্টু শোয় দাদীর পাশে। আজ বাবার পাশে শোবে বায়না ধরেছে। মা ধমক দিলে ফোঁফায়। তার মন কেমন করে। সে চায় বাবার ব্যথা ভুলিয়ে দিতে। বাবার জন্য তার কাঁদানি আসে। রাতে মা তাকে দাদীর পাশে শুইয়ে দিতে যায়। ঘুম ভেঙে যায় তার। বুঝতে পারে সে মা’র কোলে। পা ছুঁড়ে কাঁদে আর মা’র পিঠে কিল মারে। অভিমানে ঠোঁট ফোলায়। ঠিক করে সকালে মা’র সঙ্গে কথা বলবে না।

ঘুমাতে ঘুমাতে বিভ্রমে পড়ে ফজু। কে যেন তাকে ব্যথার ট্যাবলেট আনতে পাঠাচ্ছে। লোকটা বলছে, নেতারে আল্লা কি দিই বানাইয়ি এক্সরে গরি চন পরিবু। তারাতারি যা। সে দেখে, নেতা এসেছে মুখে আলগা দাড়ি লাগিয়ে। গায়ে জোব্বা। হাতে লাঠি। নেতাকে সালাম করছে এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। বাম পায়ে নেতার পাছায় সজোরে লাথি মারে।

আবার ঘুমিয়ে পড়লে দেখে হাঁটতে বসতে মুখে থুতু নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। থুতু নাড়ায়, পুকুরে থুতুর গতি চর্চা করে। আগে গোসল করতে লাগত ৫ মিনিট। এখন ১৫/২০ মিনিটে হয় না। পেছনে নিজেকে বাঁকিয়ে আবার সামনে এসে থুতু ছোঁড়ে। লোকেরা তার কাণ্ড কারখানা দেখে হাসে, রহমইত্যের পোয়ারে পঅলে পাইয়ি। তারা বলে, তোর নেতা নতুন দলে নাম লিখিয়ে হীরার আংটি হাতে দিয়ে ভাষণ দিতে এসেছে।

আবার উল্টো সে দাড়িওয়ালা। সে নেতা হয়ে গেছে। এক পা ড্রামে তুলে কুকুরের মতো মুতছে। দেহ নড়ে, সরে, ভেঙে ভেঙে খান খান হয়। সে তখন খানসেনা খোঁজে। তার বদলে দেখে রাজাকার খ্যাকখ্যাক হাসছে। বাঁশে বাঁশে ঘষা লাগার শব্দ শোনে। ঘুমের মধ্যেই বউকে ধাক্কায়।

কী? বউ ঘুমপাতালি উঠে জিজ্ঞেস করে।

কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বলতে পারে না। একটু পর বোঝা যায় পানির কথা বলছে।

বউ পানি এনে দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আধা ঘণ্টা পর আবার ওঠে। বলে পেশাব করব। ব্যথার জন্য নড়তে পারে না। বউ চিলমচি আনে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই পিন্টু উঠানের মরা কাঁঠাল গাছকে মারে। বলে, বাবা, ন কাইন্দু। আঁই নেতালে মালিল।

দাদী হাসে। কাণ্ড দেখার জন্য বউকে ডাকে। মা এলে সে মায়ের দিকে তাকায় না। মা ছেলের অভিমান বুঝতে পেরে কাতুকুতু দেয়। পিন্টু হেসে ফেলে।

পিন্টু গতকাল শোনা আয়রে আয় টিয়ে/নায়ে ভরা দিয়ে বলে বলে একটা প্রজাপতির পেছনে দৌড়ে। প্রজাপতিটা সাদা-কালো। সে দৌড়ে বাবাকে দেখতে যায়। আস্তে করে বাবার পাশে বসে। উঠে দরজার সামনে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আবার থু থু করে। দাদী জিজ্ঞেস করে, কারে দিস?

সে গম্ভীর স্বরে বলে, নেতালে।

কিল্লে?

পিন্টু কিছু বলে না।

দাদী বলে, নেতা হইলু ছেঁড়া কানি/আইও নেতার কান টানি।

কথার সুরে সে হেসে ফেলে।

দাদী অবাক চেয়ে থাকে। স্বামীর কথা মনে পড়েছে। নাতির চোখে স্বামীর চোখের ছায়া। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। ফজু শুনে ছেলেকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। একটা হাত বাম গালে লাগিয়ে রাখে। তার হাতে এক ফোঁটা পানি পড়ে। ফজু চমকে ছেলের চোখের দিকে তাকায়। ছেলের চোখে বেদনা দেখে তার বেদনাগুলো দূরে সরে যায়। সে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

পিন্টু তখন বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, লাজাকাল ধলি কিল মাইয্যুম।

দৌড়ে পিন্টু বাইরে যায়। মুখ হাত না ধোয়া কয়েকজন ছেলের সঙ্গে মরিচ খেলা খেলে। মরিচকে ছোঁয়ার জন্য সবাই দৌড়ায়। যে ছুঁতে পারবে সে আবার মরিচ হবে। তখন সবাই তাকে ছুঁতে চাইবে। একটা ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে পিন্টু আছাড় খায়। হাতে বেত কাঁটা ফোটে। রক্ত বের হতে দেখে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে আসে। মুখ হাত না ধুয়ে অসময়ে খেলতে যাওয়ায় মা একটা চড় মারে। তারপর হাত ধরে দেখে। কাঁটা ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে। সুই দিয়ে গুঁতিয়ে বের করতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। রক্ত বের হয় চিকন ধারায়। পিন্টু কাঁদে।

সকালবেলার ঝলমলে রোদ সুপারি গাছের পাতায় খেলা করতে দেখে ফজুর মন ভরে ওঠে। মা’র মুখের দিকে তাকায়। মা’র পেকে যাওয়া চুল দেখতে দেখতে ঠিক করে বাবার মতোই থাকবে সে।

রোদের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মা তাকে শোনাত, বাবা আদম ৯০ হাত লম্বা ছিল। তখনকার মানুষ সবাই ছিল লম্বা। আখেরি জমানার মানুষ ছোট হয়ে গেছে।

কিশোরকাল থেকে সে একটা আনন্দ বয়ে বেড়াত। লম্বা হওয়ার আনন্দ। সবার চেয়ে সে লম্বা। সবাই তার মাথার নিচে। ছোটবেলায় বাবা মারা গেলেও এই আনন্দে সে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখতে থাকে। সাহস ও শক্তিকে বাড়িয়ে রাখে।

বউ মুখ ধোওয়ার জন্য পানি আনে। ব্যথা একটু কমেছে। মা চিতই পিঠা বানাচ্ছে। গন্ধ আসছে নাকে। কলাপাতায় টুনটুনি ডাকছে।

ফজু দরজার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের রঙ দেখে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পিন্টু থুতুর গোলা বানাচ্ছে। পাতলা থুতুকে ফু দেয়। গোলা জিহ্বার আগা থেকে সরে উড়ে যায়।

কল্পনায় পিন্টু দেখে থুতুর গোলা উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। উড়ে গিয়ে নেতাকে ঢেকে ফেলছে। এ ভেবে সে আরো গোলা বানায়। ছেড়ে দেয় সূর্যের মুখের দিকে। কিন্তু একটুখানি গিয়ে তা ফেটে যায়।

গলা টেনে ফজু ডাকে, পিন-টু।

পিন্টু দৌড়ে এলে সে কিছু বলে না। ছেলের বাম চোখের তিলটির দিকে তাকায়।

খাবার এনে বউ দেখে স্বামী উঠে দাঁড়িয়েছে। ফজু তখন দুই বাহু মৃদু ঝাঁকিয়ে শরীরের আন্দাজ বুঝতে চেষ্টা করছিল। স্বামীর কোয়া কোয়া বাহুর দিকে তাকায়। তার ভালো লাগে। সে ধোঁয়া-উঠা চিতই পিঠা এগিয়ে দেয়।



ফেব্র“য়ারি ২০০৮

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৯:৫৩

িনদাল বলেছেন: ভাল লাগল :)

২| ৩০ শে জুলাই, ২০১১ রাত ১১:১২

জাহেদ মোতালেব বলেছেন: thanks.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.