![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রবিবার বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি গেলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। চারপাশে এত এত সবুজ আর নীরবতা, সময়গুলো ভরে ওঠে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মা ডাক দেয়। বাবলু, একটা জিনিস দেখ।
এখনো মুখ ধোইনি। চোখ কচলে বাইরে গেলাম। মা ইশারায় বলে, ওটা কি দেখ।
দেখলাম, পেয়ারা আর ছাতিমগাছের পাশে ছোট একটা গাছ উঠছে। মুহূর্তে ঘুমভাব কেটে গেল। গাছটার পাশে বসলাম। গোড়াটা গাছেরই মতো। ডালগুলোও তেমন। কিন্তু পাতার জায়গায় লাল নীল সবুজ হলুদ ছোট ছোট বেলুন ফুটে আছে। এ রকম অদ্ভুত গাছ কখনো দেখিনি।
পুকুর ঘাট থেকে ছোট ভাই বলল, তুলে ফেল।
যাহ। মা তাকে মৃদু ধমক দেয়।
আমি বলি, দেখা যাক কি হয়। কয়েকটা কাঠি দিয়ে ঘিরে রাখ।
মা আজ পরোটা বানিয়েছে তেল ছাড়া। বাবা সকাল সকাল খেয়ে দোকানে চলে গেছে।
মা, বলে আমি হাসি।
কি হয়েছে?
তোমার মেয়ে এসেছে।
মা বুঝতে না পেরে আমার দিকে তাকায়।
মেয়ের জন্য তোমার খুব শখ ছিল। মনে হয় গাছ হয়ে সে তোমার কাছে এসেছে।
যা বাঁদর।
বাঁদর বললে হবে না। ওটাকে যতœ করে রাখবে। বর্ষা আসতে আসতে দেখবে ওটা তোমাকে মা ডাকছে।
মা চড় মারতে হাত বাড়ায়। আমি মাথা সরিয়ে নিই।
এরপর আমার কলেজ শুরু হয়ে গেল। শহরে চলে এসেছি। মার ‘মেয়ের’ কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
ছুটিতে প্রায় বিশ-পঁচিশ দিন বাড়িতে ছিলাম। রেগুলার পেপার পড়া হত না। মা’র আঁচলের গন্ধে মুগ্ধ থাকতাম। পুরনো বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা আর খালপাড়ে, মাঠে-ঘাটে ঘুরে সময় কাটিয়েছি।
আমাদের স্কুলের ইতিহাস স্যার ছিলেন তুখোড়। একদিন বলেছিলেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। স্যার বুঝিয়ে বলেন, পরিবারের ক্ষেত্রে এক প্রজন্ম খারাপ অবস্থায় থাকলে আরেক প্রজন্মে তা পাল্টে যায়। কোনো মানুষের দিন একরকম থাকে না।
কি কারণে যেন কথাগুলো মনে গেঁথেছিল। বিভিন্ন পরিবারের অবস্থা দেখে তা নিয়ে ভাবতাম। এবার শহরে এসে দেখলাম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর ফিরে এসেছে।
গণজাগরণ মঞ্চে এসে উপলব্ধি করলাম মানুষের শক্তি। মানুষ কী হতে পারে তা আমার মর্মে গেঁথে গেল। স্লোগানে স্লোগানে জনতার সাথে মিশে গিয়েছিলাম। রাতে ঘুমাতে গেছি। মনের মধ্যে শুধু স্লোগান। স্লোগানে সব পাল্টে যায়। দেখি, পিঠাগাছের বুড়ি হেঁটে আসছে। মুখে মুচকি হাসি।
বুড়ি আমাদের উঠানে ওই গাছটির পাশে আরাম করে বসে। মাকে বলে, এক খিলি পান দাও। মা পানদানিতে ছেঁচে পান এনে দেয়। বুড়ি গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মা বলে, গাছটার নাম কি?
গাছ? ওটার নাম ধরো গে চিঠিগাছ। তারপর বুড়ি ঝোলা থেকে গাছ বের করে আমাদের দেয়। বলে, এগুলো হলো গিয়ে চিঠিগাছ। তোমরা সবাই যতœ করে রোপণ করবে।
ফোকলা দাঁতের বুড়ি পান চিবিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে, মনে কর, ছোটবেলা। চাঁদের আলো ঝরে পড়ছে। যেন আনন্দ ঝরছে। তোরা গোল হয়ে বসেছিস। আমার পিঠাগাছ থেকে তোদের জন্য পিঠা নিয়ে এসেছি। পিঠা খেয়ে তোরা চিঠিগাছের চিঠি পড়া শুরু করলি। ছোটদের স্বপ্ন রং আর ইচ্ছে রঙের চিঠি। একজন কি লিখেছে জানিস?
আমরা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকাই।
বুড়ি চিঠি পড়ে : ‘বাবা, মুক্তিযুদ্ধে তুমি শহীদ হয়েছ। মৃত্যুর আগে তুমি মাকে লিখেছিলে, আমি মারা গেলে ক্ষতি নাই। আমার প্রিয় দেশটা যেন স্বাধীন ও সুন্দর থাকে। বাবা, আমি কি তোমার অপদার্থ ছেলে? এতটুকু লড়াই করতে পারব না! খুব পারব। তুমি দেখ বাবা, দেশের মর্যাদা আমরা রক্ষা করবই। Ñতোমার আদরের ধন।’
আমরা চিঠিগাছের চিঠি পড়ি। এক মেয়ে লিখেছে, ‘মাগো, আমার প্রিয় মা, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তোমার মুখ। কত স্বপ্ন, আশা, ভরসা সেই মুখে। মা, তোমার স্বপ্নমাখা মুখের রং চারদিকে ছড়িয়ে দিতে লড়াইটা আমাদের করতে হবে। Ñতোমার দুষ্টুনি।’
আরেকটা চিঠিতে ছেলে বাবাকে লিখেছে, ‘বাবা, পেয়ারাগাছে ফুল এসেছে। পেয়ারাফুল দেখলেই তোমার হাসিমুখ মনে পড়ে। তোমাকে তো দেখিনি। তাহলে তোমার হাসিমুখ কোথায় দেখলাম? ওই যে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে মা’র সাথে ছবিটা তুলেছিলে, সেটা প্রায় দেখি। তোমার মুখটা দেখলেই ফুল ফুল গন্ধ পাই।’
বুড়ি বলে, শান্তির জন্য কি করতে হয় জান?
আমরা তখন মনে মনে চিঠি লেখা শুরু করেছি। লেখার মাঝখানে বলি, কী?
শান্তির জন্য দরকার মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। নিজের ভেতরের শক্তি ও বিশ্বাসকে দৃঢ় করতে হবে।
আমরা মুষ্টিবদ্ধ করি দুই হাত। ছেলেমেয়ে সবাই গোল্লারে বলে দৌড় দিই। চাঁদের আলোয় আমরা গোল্লাছুট খেলি। খেলতে খেলতে নতুন দিন আসে। সূর্য ওঠে। আমাদের একজন বলে, সূর্য ফোটে। আমরা চিঠিগাছে চোখ রাখি। সূর্যের ছোঁয়ায় বেলুনপাতা মেলে দেয় ডানা। গাছে নতুন চিঠি ফোটে। চিঠিগুলো সব মন ছুঁয়ে যায়। যে পড়ে সে বোঝে একাত্তর কী, বাংলাদেশ কী। তাকে কেউ আর ঘোলাতে পারে না। গাছ তো মায়ের মতো। সে মিছে বলে না।
বেলুনগুলো পাতার মতো পাতলা। বেলুনের সাথে লাগানো আছে চ্যাপটা পাতা। সূর্যের আলো পেয়ে তা খুলে গেছে। অদৃশ্য কোনো কারিগর আমাদের পড়ার জন্য খুলে দিয়ে গেছে। লাল, নীল আর সবুজ বেলুন। বেলুনপাতায় লেখা আছে চিঠি।
১৯৭১। ভয়ংকর একটা সময় ছিল তখন। মানুষ মুক্তির জন্য যুদ্ধ করেছে। লাখে লাখে প্রাণ হারিয়েছে। সেই যুদ্ধের যারা নায়ক, তাদেরকেই লেখা হয়েছে তা।
বুড়ি বলে, অনেক বছর পর চিঠি পেয়ে যোদ্ধারা অভিভূত। এতদিন তারা মনোকষ্টে ছিল। আফসোস করত, কেন স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছি? স্বাধীনতার মানে তো এরা বুঝে না। আর আজ বলছে, আসলে বোঝে। এতদিন তাদের মনে ছাইচাপা ছিল বলে বুঝতে পারেনি। এখন ছাই ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারা শুনতে পাচ্ছে গর্জন। সেই গর্জন তাদের নিয়ে যায় একাত্তরে। আহা একাত্তর। একাত্তর শব্দে জাদু আছে। দুঃখও আছে অনেক। রক্ত আর অশ্র“ আছে। আজ চিঠি পেয়ে তাদের চোখের পানি নতুন করে ঝরে পড়ে। সেই পানির স্রোতে নদী হয়ে যায়। রক্ত ধুয়ে মুছে যায়। মুছে যাওয়া দিনগুলো তাদের ডাকে।
এক রাতে তারা আসে। ছাতিমগাছের পাশে এসে দেখে কয়েকটা চিঠিপাতা। চিঠিপাতা ছাতিমফুলের সাথে কথা বলছে। ছাতিমের সুবাসে চিঠিপাতার পাখা গজায়। একেকটা পাতা ওড়ে। প্রতিজ্ঞা, শপথ আর স্বপ্নমাখা সেইসব অক্ষরে শিকড়, ডালপালা গজায়, পাতা আর ফুল আসে।
লাল বেলুনের চিঠিপাতা নীল বেলুনের পাতার সাথে কথা বলে। ফুলেরা সুবাস নিয়ে ওড়ে। পাশের নিমগাছ আর বাদামগাছের সাথেও কথা বলে। বাদামগাছের নতুন পাতা তাদের বাড়িতে চিঠিগাছকে, তার ফুলকে আমন্ত্রণ জানায়। চিঠিফুল দুষ্টুমি করে ওড়ে। উড়তে উড়তে পাখি হয়ে যায়, মানুষ হয়ে যায়। মানুষ হওয়া নাকি খুব মজার।
একদিন এক চিঠিফুল আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এল। সে যে মেজমামার ভেতর দিয়ে আসবে তা কি আমরা জানতাম! মেজমামা মুক্তিযোদ্ধা। মামার শরীরটা ছিল ইয়া বড়। ছোটবেলায় আমরা মামাকে বলতাম তালগাছ। একেকটা আঙুল আমাদের হাতের মতো মোটা ছিল। আমরা মামার আঙুলগুলো মটকানোর চেষ্টা করতাম। মামা শুয়ে শুয়ে হাসতেন।
মামার বাহুগুলোকে মনে হতো গাছের একেকটি ডাল। না জানি কত শক্তি আছে তার মধ্যে। আমাদের সাথে যখন পাঞ্জাবি রাক্ষস আর তাদের ছানাপোনা বাঙালি রাক্ষসদের গল্প করতেন, অবাক হয়ে শুনতাম। পুরো বুঝতাম না। বড় হয়ে জেনেছি বাঙালি রাক্ষসদের আরেকটা নামÑরাজাকার।
বাজারের কমলা বিক্রেতা, গিমা শাক বিক্রেতা, লইট্টা, ছুরি শুটকি বিক্রেতা, মাছ কাটা লোকটা, চশমার দোকানের বুড়াটা, ছোলেমানি খোয়াবনামা বিক্রেতার মধ্যেও ভিড় করেছে চিঠিপাতা। চিঠি তাদের মনের ফাঁকে ফাঁকে ওড়ে। বড় অশ্বত্থগাছটির ফাঁক দিয়ে আসা রোদের সাথে কথা বলতে চায়। কিংবা গোল্লাছুটের মতো দৌড়াতে চায়। সিঁড়ির গোড়া থেকে মাছের গন্ধ আসছে। মাছি উড়ছে। গন্ধ আর মাছি উড়তে উড়তে ছাতিমগাছের পাশে আসে। ওখানে তাদের দেখা হয় চিঠির সাথে। চিঠি হাসে। চিঠিপাতার রং ছোট্ট মিষ্টি মেয়ের মতো। মেয়েটার হাতের লেখা লজেন্সের মতো রসালো আর মিষ্টি। সে লিখেছে : ‘প্রিয় বাংলাদেশ, আর কতদিন ক্ষত বিক্ষত হবে তোমার স্বপ্ন?’
কেউ কথা বলে না। তারপরও অনেক কথা হয়। সেইসব কথা গাছের শিরায় থেকে যায়। শিরায় আঁকা থাকে একটি চিঠি। কে লিখেছে আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা লিখেছেন, মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের এই সংগ্রাম। বাংলাদেশের মানুষকে স্তব্ধ করা যাবে না। কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ। লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত।
পাড়ার বুড়াটা এসে খনখনে স্বরে বলল, তোমরা কিসের প্রস্তুতি নিচ্ছ?
আমরা সাবধান হয়ে যাই। বুড়া মুসলিম লীগ করত। এখনও সুযোগ পেলে আইউব খানের গুণগান গায় আর বাংলাদেশের কপালে ঝাঁটা মারে। বলি, আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাব, তার প্ল্যান করছি।
একজন অনুচ্চ স্বরে বলে, যাইবেন নি।
কেন?
আইউব খানরে সেলাম করতে।
কানে কম শোনে, তাই বুড়া চোখ-ঠোঁটের ইশারা দেখে বুঝতে চায় কথাগুলো। আমাদের হাসিমুখ তার ভালো লাগে না। চিঠিগাছ উপড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
বাড়ি গেলাম বৃহস্পতিবার। গাছটা ভালো করে দেখে, তার গা ছুঁয়ে ঘরে ঢুকলাম। মা’র মুখটা একেবারে অন্যরকম। এত উজ্জ্বল মুখ, মন ভরে যায়। নাস্তা করার পর মা শিম ফুল খেতে দেয়। ময়দা দিয়ে বানানো শিম ফুল কডর কডর করে চাবাই।
মা বলে, সেদিন একটা স্বপ্ন দেখলাম।
অপরূপ সুন্দর একটা মেয়ে তোমার কাছে বেড়াতে এসেছে?
যাহ, তোর শুধু ফাজলামি।
তুমি তো সবসময় ভদ্র আর বুদ্ধিমতী একটা মেয়ের স্বপ্নে বিভোর থাক।
রাখ তোর দুষ্টুমি। শোন, দেখলাম শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে আমার কাছে এল। বলল, মা, তোমার স্বপ্ন থেকে আমি এসেছি। মেয়েটা ওই গাছের কাছে গেল। ছুঁয়ে দেখল, হাত বুলাল, কাঁদল। হাত বুলাতে বুলাতে দেখলাম গাছটার সাথে মিশে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে বলল, মা, আমি আছি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই গাছটির কাছে গেলাম। হাত বুলালাম। মনে হলো মেয়েটির ছোঁয়া পাচ্ছি।
কোনো কথা না বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। কথাটা মাকে বলি না, ওই গাছটাকে আমার মেজমামা মেজমামা মনে হয়েছে।
ফেব্র“য়ারি-মার্চ ২০১৩
(লিটলম্যাগ স্বরে প্রকাশিত)
©somewhere in net ltd.