নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জলছবি

যদি মানুষ না হই তবে যেন আবার জন্ম নিই মানুষ হয়ে. . .

জোবায়ের মিলন

আমি মানুষ। মানবিক বোধই যার যোগ্যতা।

জোবায়ের মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সরকারকে এক্ষুণি সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা নেবার যেভাবে নেবার

০৬ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৩:২৪

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সেনাশাসন জারির পর নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক কার্যকলাপ সীমিতভাবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় সেনাশাসকেরা, সেটা ১৯৭৬ সাল। তার আওতায় ‘ঘরোয়া রাজনীতি’র জন্য সরকারের কাছে অনুমতি নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রায় ৯০টি দলের আবেদনের মধ্য থেকে ২১টি দলকে রাজনীতি করার অনুমোদন দেওয়া হয়। জামায়াতে ইসলামী আবেদন করেও অনুমতি পায়নি, গতকালের আলোচনায় তা উল্লেখ করেছি। কিন্তু কেন জামায়াতে ইসলামীকে দলগতভাবে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তার কোনো ব্যাখ্যা আমরা এখনো জানি না। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এম জি তোয়াবের নেতৃত্বে ইসলামি জলসার নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামপন্থীদের সমাবেশের এবং শক্তি প্রদর্শনের কোনো ভূমিকা ছিল কি না, সেটা তৎকালীন নীতিনির্ধারকেরা বলতে পারবেন; সম্ভবত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলিল-দস্তাবেজে তার কিছু ব্যাখ্যা থাকতেও পারে। জামায়াতে ইসলামীর এই ভূমিকাই ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বরে জারি করা রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশের (দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮) ৩ ও ৪ অনুচ্ছেদের আবশ্যকতা তৈরি করেছিল কি না, সেটাও আমাদের খুঁজে দেখা দরকার। সে সময়কার সরকারি কর্মকর্তারা চাইলে এ বিষয়ে আমাদের অবহিত করতে পারেন। ১৯৭৯ সালের ২৫ থেকে ২৭ মে প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে দল হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়। তত দিনে অবশ্য আইডিএলের ছত্রচ্ছায়ায় মুসলিম লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ছয়জন নেতা সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং দলের ভেতরে জামায়াত পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদও ঘটেছে।

১৯৭৬ সালের পিপিআর হলো জামায়াতের প্রথম আইনি স্বীকৃতির ভিত্তি। দ্বিতীয়বার আইনি স্বীকৃতি ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের সুপ্রিম কোর্ট যখন সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে, তখন আপনা-আপনি যে সংবিধান বহাল হয়ে যায়, তাতে অনুচ্ছেদ ১২ ও ৩৮ দুই-ই ছিল। দুই-ই দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি করে তোলে। বিশেষ করে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দলের দেওয়া গঠনতন্ত্র যেভাবে জামায়াতে ইসলামীর বর্ণনা দিয়েছিল, তা ছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের পরিপন্থী। কিন্তু ২০১১ সালের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনী ৩৮ অনুচ্ছেদকে সংবিধানে পুনঃস্থাপিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও ধর্মভিত্তিক দল গঠনে কোনো রকম বাধা-নিষেধ আরোপ না করার মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরেক দফা আইনি বৈধতা লাভ করে। অনেকেরই মনে থাকবে যে এ সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে অনেকেই বক্তব্য দিয়েছিলেন, এর মধ্যে সরকারি দলের নেতারাও ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী গোড়া থেকেই সুস্পষ্টভাবে সে ধরনের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল যে এই পদক্ষেপ নিলে কেবল জামায়াতে ইসলামী নয়, আরও অনেক ইসলামপন্থী দলই নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারি দলই শুধু নয়, সমাজের অন্যান্য মহলেও আপত্তি ছিল। কিন্তু এ কথা ভুলে যাওয়ার অবকাশ নেই যে এটা জামায়াতে ইসলামীর দ্বিতীয় আইনীকরণ।

ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রধান লক্ষ্য হলো ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এটা জামায়াতের সব ধরনের দলীয় প্রকাশনায় আছে, নেতারা বলে এসেছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা দলের আদর্শিক গুরু মওলানা আবুলআলা মওদুদির রাজনৈতিক বক্তব্যের একটা অন্যতম দিক। এমনকি সেই রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, সে বিষয়ে তাঁর লেখায় এবং তাঁর উত্তরসূরি গোলাম আযমের লেখায় স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। এই আদর্শিক দিকটির ভিত্তি হলো রাষ্ট্রের আদর্শের সঙ্গে ধর্মকে একীভূত করে ফেলা। ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই সম্পর্কের আইনি ও সাংবিধানিক দিকটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেনাশাসক জেনারেল এরশাদের করা ১৯৮৮ সালের অষ্টম সংশোধনীতে। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতার ধারে-কাছে না থাকলেও তাদের অন্যতম একটি আদর্শ এইভাবেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পরও আদর্শিকভাবে, আইনিভাবে, সংবিধানসম্মত উপায়ে একটি ধর্মভিত্তিক দলের আদর্শকে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিণত করা হবে, তা ছিল অকল্পনীয়, এর কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। কিন্তু অষ্টম সংশোধনী বাতিলের কারণে এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে এই সম্পর্কে বিচ্ছেদ টানা যেত। কিন্তু তার পরিবর্তে ব্যবস্থাটির মৃতপ্রায় শরীরে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট করেই রাষ্ট্রধর্ম বহাল রয়েছে এবং সম্ভবত তাকে ভবিষ্যতে সংশোধনের পথও রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে এ দেশে কেবল যে ইসলামপন্থীদের শক্তিকেই খুশি করা হয়েছে তা নয়, জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক অবস্থান যে অগ্রহণযোগ্য নয়, তা-ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

ফলে আজকে যখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি উত্থাপিত হয়, তখনো আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে এই দলীয় আদর্শের বিযুক্তির প্রশ্নটা দেখতে পাই না। এখন যখন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা হচ্ছে, তখন এটা সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে ইসলামপন্থী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে না। দাবির ভিত্তি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দলটির মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ ও গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। এ প্রসঙ্গে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বেশ কয়েকটি দল নিষিদ্ধ করার উদাহরণ দেওয়ার কারণ এখানেই। সেটা করা হলে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামী বলে কোনো দল গঠনের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল যেমন কেবল একটি দলকে নিষিদ্ধ করেনি, করেছিল বেশ কয়েকটি সংগঠনকে, তেমনি এ ধরনের পদক্ষেপ নিলে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় একই ধরনের ভূমিকা পালনকারী অন্য দলগুলোকেও নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন হবে, তাদের শক্তিশালী সংগঠন থাকুক অথবা না থাকুক। সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকারের আগ্রহ ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির বিষয়টি স্পষ্ট করা খুবই দরকার। প্রাসঙ্গিকভাবে এটা মনে করা দরকার, আজকে বিএনপি যদিও নিশ্চিতভাবেই জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবির পেছনে দাঁড়াবে না, একসময় বিএনপির সাংসদেরা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এই দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মুলতবি প্রস্তাব আলোচনায় বিএনপির সাংসদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ জামায়াত-শিবির প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আজকে যারা ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করতে চায়, আজকে যারা এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, এই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিকে চিরতরে নিষিদ্ধ করার জন্য আমি আপনার কাছে দাবি জানাব।’ তাঁর দাবির পক্ষে বিএনপির অনেক সদস্য বক্তব্য দিলেও কোনো আইনি বা সাংবিধানিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষমতাসীন বিএনপি বা বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তাব ছিল না। আমাদের এও বোঝা দরকার যে এমনকি ট্রাইব্যুনালে বিচারের মাধ্যমেও যদি জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়, তবে জামায়াতের কর্মীদের, বিশেষত যারা কোনোভাবেই ১৯৭১ সালের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয়, নতুন দল করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

অন্যদিকে, জামায়াতকে যদি প্রচলিত আইন ব্যবহার করে নিষিদ্ধ করার কথা সরকার বিবেচনা করে, তবে তার জন্য ১৯৭৮ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ৩ ও ৪ ধারার প্রয়োগ একটি পথ কিংবা সন্ত্রাস দমন আইন ব্যবহার করা যেতে পারে। এর পক্ষে দেশে প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন সময়ে, জামায়াতের সহিংস কার্যকলাপ জননিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি হয়েছে বলে সরকার দাবি করতে পারে। এসব আইনের যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন, তাতে করে সম্ভবত দলটির আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আদালতের প্রসঙ্গটি তোলার একটা অন্যতম কারণ হলো, গোটা মহাদেশে যে দুবার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তার একবার সরকার স্বল্পসময়েই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, আরেকবার আদালতের রায়ে জামায়াত রাজনীতিতে ফিরেছে। প্রথম ঘটনা পাকিস্তান আমলে; আইয়ুব খানের জারি করা মুসলিম পারিবারিক আইনসংক্রান্ত অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়। বছর শেষ হওয়ার আগেই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ভারতে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বেআইনি কার্যকলাপ (নিবারণ) আইন ১৯৬৭-এর আওতায়। জামায়াতে ইসলামী এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হলে এলাহাবাদের হাইকোর্ট সরকারের পক্ষে রায় দেন, কিন্তু দেশের সুপ্রিম কোর্ট ৭ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে বাতিল করে দেয় ।এই অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা আবশ্যক যে এ ধরনের অভিযোগে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে চাইলে সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণে সতর্কতা অবলম্বন করে এবং প্রস্তুতি নিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব পদক্ষেপের জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির এবং ঝুঁকি নেওয়ার প্রস্তুতি আছে কি না, তা সরকারই ভালো বলতে পারবে।

আলী রীয়াজ: রাজনৈতিক ইসলামবিষয়ক গবেষক। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ইসলামিস্ট মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ: এ কমপ্লেক্স ওয়েব (২০১০), ফেইথফুল এডুকেশন: মাদ্রাসাজ ইন সাউথ এশিয়া (২০০৮), গড উইলিং: দ্য পলিটিকস অব ইসলামিজম ইন বাংলাদেশ (২০০৪)। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.