![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে বাঁচাও প্রভু উদার। হে প্রভু! শেখাও – নীচতার চেয়ে নীচ পাপ নাহি আর।
দেশ-বিদেশের বহু মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা এই দুই মানুষের পরিচয় জানতে চেয়েছেন আমার কাছে, নানা প্রশ্ন করেছেন। আমি অনেক চেষ্টা করে এখনো কোনো সূত্র খুঁজে পাইনি। এঁদের পরিচয় নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেই অন্য হাজারো স্বজন, যাঁরা উদ্ধারকর্মীদের কাছে প্রিয় স্বজনকে ভিক্ষা চাচ্ছিলেন, তাঁদের আর্তনাদ মনে পড়ে যায়। বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে। এখনো আমার জানা নেই ওই দুজনের পরিচয়। তাঁরা কারা, তাঁদের সম্পর্ক কী?
ঘটনার দিন পুরো সময় আমি ঘটনাস্থলেই ছিলাম। দেখছিলাম রানা প্লাজা ঘিরে আহত আর স্বজনদের আতঙ্কভরা চোখ, শ্রমিকের লাশ আর উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতা। এসব দেখতে দেখতে যখন মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত বোধ করছি, ঠিক সেই সময় এই দুই লাশের মুখোমুখি হই। ২৪ এপ্রিল দিবাগত রাত প্রায় দুইটা। ভবনের পেছনের একটা অংশে আটকে পড়েছিলেন ওই দুজন লোক। তাঁদের শরীরের নিচের অংশ ধ্বংসস্তূপের ভেতর। মৃত পুরুষটির চোখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে অশ্রুর মতো। প্রথমে দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কী দেখছি আমি, মনে হলো এ যেন খুব চেনা দৃশ্য। খুব চেনা আপন কেউ। শেষ মুহূর্তে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি ওঁদের জীবন। ওঁদের স্বপ্ন।
যতবার ওই ছবির দিকে তাকাই ততবার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আরও শত শত লাশের মধ্যে এই দুজনও যেন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। যেন ওই দুই মৃত মানুষ আমায় চিৎকার করে বলেন, আমরা কেবল সংখ্যা নই কিংবা সস্তা শ্রমিক বা সস্তা প্রাণ নই, আমরা তোমাদের মতোই মানুষ, তোমাদের জীবনের মতোই আমার জীবনও আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে মূল্যবান। আমাদের স্বপ্নেরও দাম আছে।ঢাকার বাইরে, সাভারে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে শত শত নারীর লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়। তাঁদের মৃত্যুর বিবর্ণতার পিঠে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ছিল পরনের সালোয়ার-কামিজ আর শাড়ি। আর তখন রাজধানীতে ইসলামি চরমপন্থীরা বাস পোড়াচ্ছেন, দোকানপাটে লুটতরাজ চালাচ্ছেন এবং হামলা চালাচ্ছেন পুলিশের ওপর। তাঁদের প্রধান দাবি: একটি ইসলামি রাষ্ট্র, যেখানে নারীরা থাকবেন পুরুষ থেকে আলাদা।
কিন্তু তাঁরা অনুধাবন করতে পারেননি যে এসব নারীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল সম্পদ আসে। বাংলাদেশের মূল আয়ের উৎস পোশাকশিল্প। এর মাধ্যমে এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার অর্জিত হয়। আর পোশাকশিল্পের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছেন নারী-কর্মীরা। হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে এসব নারী নিজের জীবিকার বাইরেও অনেকের জীবিকা টিকিয়ে রাখছেন; অথচ তাঁদের শ্রম-নিরাপত্তার রেকর্ড ভীতিকর।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুই নারীনেত্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। এর পরও দেশটি, যা আমার স্বদেশ, নারীর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
।
নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন বা নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণকাজ, এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। এতে দেশের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন ঝুঁকির মুখে। রানা প্লাজার ভবনধসের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে (এক হাজার ১২৭ জনে পৌঁছেছে)। এর আগে একটি পোশাক কারখানা ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় আটজন বা এর বেশি লোক মারা যান।
জীবনভর মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে আমি যা দেখেছি, তা হচ্ছে—বিভিন্ন সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে জটিলতা যেমন বাড়ছে, এর সূত্র ধরে অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। এতে আবার বৈচিত্র্য রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক অধিকার, নারীর অধিকার, শ্রম অধিকার।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের অধিকারের মধ্যে যোগসূত্রটি আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান: নারীর অধিকারের সঙ্গে শ্রম অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে নারীর অধিকার, বিবেকের স্বাধীনতার সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে বিবেকের স্বাধীনতা। আরও রয়েছে ব্লগারদের যা খুশি লেখার স্বাধীনতা। রয়েছে জীবনের ভয় না করে নারী ও পুরুষের কাজ করে যাওয়া।
মানবাধিকার বিশ্বজনীন। বাংলাদেশের কি এই দৃষ্টিভঙ্গি, সাহস আর রাজনৈতিক ইচ্ছা আছে—চার দশক আগে স্বাধীনতার সময় তারা যেমনটি করেছিল, সে রকম আজ মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার পুরোপুরি সম্পন্ন করবে? ১৯৭১ সালে আমার দেশের মানুষ কেবল ধার্মিকদের জন্যই লড়েনি, অধার্মিকদের জন্যও লড়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা কেবল সাম্প্রদায়িক বৈষম্য দূর করার জন্য লড়িনি, লৈঙ্গিক বৈষম্য দূর করতেও লড়েছি। ১৯৭১ সালে আমরা সব মানুষের অধিকারের জন্য লড়েছি।
কিন্তু বাংলাদেশে সবার জন্য অধিকার অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতি, রাজনৈতিক ফায়দা লোটা ও বিশ্বজনীন মানবাধিকারের অবমাননা। যখন আমি কেবল নিজের অধিকার দেখব, আপনারটা নয়, তখন কোনো মানবাধিকারই নিরাপদ নয়।
©somewhere in net ltd.