নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখা লিখি করতে যেমন ভাল লাগে, তেমনি ভাল লাগে ভাল ভাল লিখা পড়তে।

জয় আজাদ

আজাদ জয়

জয় আজাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

তুলি

১৭ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৫৩


২৫-০৫-১৭
সিগারেটটা মুখে নিয়ে পকেটে লাইটার হাতড়াচ্ছি। টুক করে চোখের সামনে লাইটারের আগুন জ্বালিয়ে দিল একটা ফর্সা হাত। ডিজাইন করা নেইলপলিশের হাতটাতে একটা ব্রোঞ্জের ব্রেসলেট ইংরেজি অক্ষরে ‘জে প্লাস টি’ লিখা। অফিস শেষে সন্ধ্যেটা অফিসার্স ক্লাবে কাটাই, পুল টেবিল শেষ করে বাহিরে বারান্দায় দাড়ীয়ে ছিলাম, একটা সিগারেট টানবো বলে। আজ সন্ধায় মুশুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে।

আমি তখন স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল মেয়েটার নাম তহমিনা আখতারা বানু। নামটা ওর খুব অপছন্দের তাই দাদির দেয়া ডাক নামটাই ও সকলকে বলত “তুলি”। মাথা ভর্তি কোকড়া ঝাকড়া চুল, ছোট্ট মুখটাতে বড় বড় টানা টানা চোখ তুলতুলে গাল। সেই গালে সারক্ষণ কিছু না কিছু ধরে আছে শীতে বরই, গরমে লিচু, আমলোকি, আর এগুলো না পেলে হয় পেয়ারা, নয়তো চকলেট। ভিষণ রকমের শুকনা পাতলা মেয়েটার সাথে মাথার চুল গুলো একদম বেমানান। আমার আর তুলির বেশ ভাব, লিখাপড়া খেলাধুলা ইভেন ঝগড়াতে আমার তুলিকে চাই। ও খুব ভাল ঝগড়া করতে পারত, তুলি আমরা খুব ভাল বন্ধু। আমরা একই পাড়ায় একই বিল্ডিংএ থাকতাম, ওর বাবা আর আমার বাবা একই কোম্পানিতে চাকরি করত।

বছরখানেক আগে হঠাৎ করে স্ট্রোক করার কারনে তুলির বাবাকে কোম্পানি জোর করে অবসর দিয়ে দেয়। যখন আমরা ক্লাস ফোর-এ পড়ি তখন চাচি মানে তুলির আম্মা মারা যায়, ওদের কাছের আত্মীয়স্বজন তেমন কেউ নেই। তুলির বাবা তার দূর সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের মেয়েকে বাসায় এনে রেখেছিলেন। তুলির সেই দূর সম্পর্কের বোনের নাম ছিল পাপড়ি। পাপড়ি আপু গত বছর অনার্স শেষ করে এক টেলিকম কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকেছিল সব সময় নাইট ডিউটি করতো, তাতে নাকি সেলারি ভাল দেয়। ভীষণ চটপটে মেয়ে দারুন স্মার্ট। আম্মু বলত স্মাট বলেই এত তাড়াতাড়ি ভাল চাকুরি পেয়েছে, নয়তো ভাল চাকুরি পেতে, এ যুগে ডজনে ডজনে সেন্ডেল ক্ষয় হয়ে যায়। তুলিটাও আপুর মত হতে চায়, দেখছি দিন দিন চালচলন পোশাক আসাক সব পাপড়ী আপুর মত হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্কুল থেকে একই রিক্সায় বাসায় ফিরতাম আমি গল্প করতাম আর ও শুনতো, কত গল্প কমিক্সের ফ্লাশ গোর্ডেন, হারকিউলিস, সিরিয়ালের নাইটরাইডার, ভিন্ন ভিন্ন কত গল্প। তুলিদের তেমন টাকা পয়সা ছিল না। ওর বাবা একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারের কাজ করতো। বাবার ভাল চাকুরি না থাকলে যা হয়। আম্মু বলতো জমান টাকায় মানুষের কি দিন যায়। মাঝে মাঝে স্কুলের বেতন দিতে ওর সমস্যা হতো। ফ্ল্যাট বাসাটা শুধু ওদের নিজস্ব। আম্মু পাপড়ি আপুকে বলে তুলিকে আমার সাথে স্কুলে পাঠাত। আম্মু তুলিকে খুব পছন্দ করতেন, কিন্তু চটপটে স্বভাবের জন্য বাবা খুব একটা পছন্দ করতেন না।

একদিন খুব সকালে কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে, বাবা দরজা খুলে কার সাথে যেন কথা বলেই জামাটা হতে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ পরে আম্মুও বেরিয়ে গেলেন। আমি রুম থেকে বের হয়ে বুয়াকে জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে? বুয়া বলল ৩ তলার চাচা আজকে ভোরে মারা গেছে। আমার মাথাটা বো করে ঘুরে উঠে, তুলির বাবা মারা গেছে। আমিও ছুটলাম ওদের বাসায়। আমাদের পাড়ার মসজিদের ঈমাম সাহেব কাফনের কাপড় পরাচ্ছিলেন আর তুলি তার রুমের দরজায়, আমি ওর পার্শ্বে গিয়ে দাড়ালাম। একদম চুপ, চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও পড়ছে না, একদম পাথরের মত দাড়ীয়ে আছে তুলি। কিছুক্ষণ পর পাপড়ি আপু অফিস থেকে বাসায় ফিরে, আপুর নাইট ডিউটি। এই ঘটনা দেখ সেও হতবম্ভ হয়ে গেছে। সেদিন জোহরের নামাজের পরে তুলির বাবার দাফন হলো শহরের পুরাতন গোরোস্থানে। সেই সপ্তাহটা পুরই তুলি স্কুলে যায়নি, একা একা আমার স্কুল যেতে ভাল লাগত না। প্রতিদিন ওদের বাসায় গেছি কিন্তু তুলির সাথে দেখা হয়নি, ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দেয়া।

পরের সপ্তাহে স্কুলে গিয়ে দেখি তুলি এসেছে, চেহারায় বাবা হারানোর কোন চিহ্ন নেই। আমার সাথে গল্পে গল্পে বলল, সে খুব তাড়াতাড়ী অনেক বড়লোক হবে, টাকা পয়সার সমস্যা সব শেষ হয়ে যাবে, ও থখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে ঘুরে বেড়াবে এক একা। তুলি প্রায়ই টাকা পয়সা, অর্নামেন্টস, পোশাক আর পাপড়ী আপুর বন্ধুদের দেওয়া দামি দামি গিফট নিয়ে কথা বলতো। আমার এসব ভাল লাগত না। ও স্কুলের বড় বড় ছেলেদের সাথে কথা বলে নিজে নিজে কোচিং যায় রাত করে বাসায় ফিরে। একদিন স্কুলের গেটে এক আঙ্কেল ওকে ড্রোপ করে দিয়ে গেল। আমি রাগে গিয়ে বললাম, তোর জন্য বাসার সামনে কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম আর তুই মানুষের গাড়ীতে কেন? ওই লোকটা তোর কে হয়? ও আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে ক্লাসে ঢুকে যায়। আমি পাপড়ি আপুর কাছে অভিযোগ করলে, আপু আমাকে তুলির ব্যপারে নাক গলাতে নিষেধ করে দিলেন। মন খারাপ করে বাসায় ফিরে এলাম। একবার চিন্তা করলাম আম্মুকে বলি, পরে ভাবলাম বাবা মারা গেছে একটু সময় লাগবে ঠিক হতে খামখা আম্মুকে টেনশন দিয়ে লাভ কি। সামনে ফাইনাল পরিক্ষা আমি লিখাপড়া নিয়ে নিজের মত ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। তুলি আর আমার সাথে স্কুলে যায় না, কথাবার্তা হয় তবে আগের মত না, ওর হেয়ালিপনা কথাবার্তা আমার ভাল লাগে না। তুলি বদলে গেছে, ও আর আগের মত নেই। দুরে সরে যাচ্ছে আমার তুলি, হ্যা আমার তুলি। ও যতই দুরে সরে যাচ্ছে আমার মনে ওর জন্য টান যেন ততই বাড়ছে, দিনরাত মনের মধ্যে শুধু তুলি তুলি। আর তুলিকে আমি চাই সেই আগের মত সহজ করে।

একদিন বাণিজ্য মেলায় গেছি ঘুরতে ঘুরতে একটা জিনিষ আমার চোখে পড়ল, বিভিন্ন রকম অর্নামেন্টে এক দোকানে নাম খোদাই করে লিখে দিচ্ছে। আমি একটা ব্রেসলেট কিনে তাতে বড় বড় ইংরেজি অক্ষরে লিখিয়ে নিলামআমার আর তুলির নামের প্রথম অক্ষর। সুন্দর করে গিফট র্যা প করে পরের দিন স্কুলে তুলিকে দিলাম। ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল এটা কি? আমি বললাম আমার ভালবাসা চিহ্ন। হাসতে হাসতে তুলি মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, আমার খুব লজ্জা করছিল তাই আমি পালিয়ে যাই ওর সামনে থেকে। এরপর একদিন ওর মন খারাপ দেখে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কললাম মন খারাপ কেন? ও বলল, নতুন জিনিষের খুব চাহিদা সামাল দিতে দিতে ক্লান্ত মন খারাপ না। ওর এরকম হেয়ালি কথা গুলো আমার মাথায় ঢোকে না, তবুও ওর সাথে থাকার চেষ্টা করি। একদিন স্কুলের গেটে একা দাড়ীয়ে আছে দেখ এগিযে গেলাম আমাকে দেখে তুলি বলে, তোর ছেলে মানুষি গুলো ছাড় তো, আমাকে পাহারা দিতে হবে না। সত্যি ভালবাসিস, আচ্ছা কি মানে বুঝিস তুই ভালবাসার? তুইতো নিজেই বাপের উপর চলিস আমাকে পুষবি কি করে, বলেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চলে গেল।

দেখা হলেই সেই তাচ্ছিল্য ভরা হাসিটা ওর মুখে লেগে থাকতো। আমি তুলির সামনে তেমনটা যেতাম না, শুধু দুর থেকেই দেখতাম আর মনে মনে ভাবতাম মানুষ কেন এভাবে বদলে যায়। বোর্ড এক্সামে তুলির সিটটা আমার রুমে পড়েছে। প্রায় পাঁচ মাস পর আমি এক অন্য তুলিকে দেখলাম, ও সেই হাড় জিরজিরে তুলি নেই চমৎকার রুপসী এক নারীতে পরিনত হয়েছে একদম পরিদের মত দেখতে। আমি হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি দেখ, হাত দিয়ে আমার গালে আদর করে বলল, ওরে আমার সাধের হিরো, এখনও লাইনে অনেক ভিড় এই জীবনে তোর কোন চান্স নেই। তবে, তোর উপহারটা মরার আগ পর্যন্ত ফেলব না, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ, বলে হাতে পরা ব্রেসলেটটা দুলিয়ে দুলিয়ে দেখাল। ব্রেসলেটটা তুলির হাতে দেখে কিছু না বুঝেই আমি মহা খুশী। বোর্ড এক্সাম এর শেষ দিনে পরিক্ষা শেষে ক্লাস থেকে বের হয়ে তুলিকে অনেক খুজেছি পাইনি। ওরা ফ্ল্যাটটা বেচে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। একদিন রাতের টিভির খবরে দেখি শহরের এক অভিজাত হোটেলে স্থানীয় কিছু স্কুলের মেয়েদের সাথে শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীদের আটক করেছে পুলিশ, নোংরা কাজ করছিল। মেয়ে গুলোকে পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় একনজর চোখে পড়ল হাতের ব্রেসলেটটা ‘জে’ প্লাস ‘টি’ লিখা। হঠাৎ করেই তুলির হেয়ালি গুলো সব আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। তুলির সাথে আর দেখা হয়নি গত পনের-ষোল বছর হবে।
-- আজাদ জয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.