নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছাইয়ের নেই আগুনের ভয়

জুলিয়ান সিদ্দিকী

জগতের সব কাজই আমি পারি না। অনেক কাজে অলস হলেও লিখতে কখনও ক্লান্তি বোধ করি না। এতে করে আমার সময়গুলো ভালো কাটে।

জুলিয়ান সিদ্দিকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নদীর সেই সন্ধ্যাটির কাছে

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৩৭

জীবনের প্রথম দিকের ঘটনাগুলোর কথাই হয়তো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মনে রাখে আমৃত্যু। যেগুলো নানা অভিজ্ঞতার ভান হয়ে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায় মনের প্রবেশ পথে। আর তাই হয়তো সব মানুষ নৈঃসঙ্গ্যের অন্ধকারে ছাওয়া ঊষর সময় অতিক্রম করার মুহূর্তে একবার হলেও মনে করে সে সব ঘটনার কোনো একটি। হোক না সে ঘটনা আনন্দ কিংবা বিষাদের। কখনো কখনো সুদীর্ঘকাল পর জীবনের প্রথমভাগের বিষাদের কোনো ঘটনার কথাই মনে দিয়ে যেতে পারে কিঞ্চিৎ আনন্দ বা সুখের শিহরণ। আর এভাবেই কখনো কখনো একান্ত নিজের ভেতর কমলা যখন ভাবনার নানা কোণ থেকে অবলোকন করে স্মৃতিতে প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া ফেলে আসা দিনগুলোকে, তখন বেশ উজ্জ্বল হয়েই একজন হারান মাঝি দোলা দিয়ে যায় তার ভাবনার ছোট্ট নদীটিতে।



হরিনারায়ণের আটা-কলের পরিত্যক্ত আটা বা গমের গুঁড়ো ঝাঁট দিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতে করতে তেমন একটি কথাই ভাবছিল কমলা। যখন মেঘনার বুকে সারা বছরই জল থৈ-থৈ করত। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে খোঁয়াড়ে বন্দী মোরগ ডেকে ওঠার আগেই শোনা যেত বাবা তিরু জলদাসের দরাজ কণ্ঠস্বর, আমি বার হইতাছিরে মরুনি। তর কাফর সামলা!



বাবা তিরু জলদাস যেদিন নৌকায় যেতেন সেদিন অবধারিত ছিল তখনই শয্যা ছেড়ে উঠে পড়া। তিনি বাড়ি ফেরার সময় কন্যার জন্যে সওদা করে নিয়ে আসতেন অজস্র চাঁদ-কণা। কমলাও তাই শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ত সে কণ্ঠস্বরের উষ্ণ আহ্বানে। তখন নিদ্রা জড়িত কণ্ঠে কিছু না কিছু একটার বায়না থাকত তার, যা পরে মনে করতে পারত না সে। কিন্তু সন্ধ্যার খানিক পর বা ঘুমিয়ে গেলেও বাবার হাঁক-ডাকে জেগে উঠে দেখত তার জন্য দু এক পদের আনন্দের ঝিলিক।



কমলা মাসি কি ঝিমাস?



না গো মামু!



ঝাঁট দিয়ে জমা করা পরিত্যক্ত আটা অথবা গমের গুঁড়ো তুলে নিয়ে বটু পালের ক্যাশ বাক্সের সামনে রাখা কাটা ড্রামে ফেলে কমলা। তখনই তার মনে হয় যে, দিনকে দিন মানুষের মন ছোট হয়ে যাচ্ছে। এক সময় যে সমস্ত পরিত্যক্ত উপাদান নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না, কালে কালে তা যেন মূল্যবান হয়ে উঠছে। কোনো গৃহস্থ ঘরের বউ বা কন্যা ঝাট দেওয়া কিছু গবাদিপশুকে খেতে দিয়েছে এ রকম দৃষ্টান্ত তার বিগত জীবনে দেখেনি সে। অথচ এমন ধরনের আবর্জনাই এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি বিশ টাকা দরে। সময় কেমন অদ্ভুত, যে নিজেকে বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুকেই বদলে দিয়ে যায় অবলীলায়। আর তেমনই একটি সময় বদলের ঘূর্ণিপাকে বদলে গিয়েছিল তার নিয়তিও। সেই সঙ্গে বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়েছিল জলদাস পাড়ার আরো অনেকের জীবন।



প্রথম যখন তাদের গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে ফাটল দেখা দিয়েছিল, তার আগে গ্রামের কোনো অংশ মেঘনার পেটে গিয়েছে বলে শুনতে পায় নি কেউ। গ্রামের ভেতর ফাটল দেখে প্রথম কপাল চাপড়ে কেঁদে উঠেছিলেন তার ঠাকুরদা দুর্গা জলদাস। বিলাপের স্বরে ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন, আর থাকতো না রে জলদাসের ভিডা-বাড়ির চিন! আর দুর্গা জলদাসের ভবিষ্যৎবাণীকে প্রতিষ্ঠা দিতেই যেন অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে দুর্বিনীত মেঘনা উদরসাৎ করে ফেলেছিল একশ-বিশটি পরিবারসহ পুরো জলদাস পাড়া।



একটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার একমাত্র সাক্ষী হয়তো সে নয়, কিন্তু সময়ের বিভিন্ন-মুখি ধাক্কায় কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তা আর বলতে পারবে না সে। গ্রামের বারুই জলদাসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল বলে পুরো ব্যাপারটি ঘটতে দেখেছে চোখের সামনেই। পরিচিত কারো সঙ্গেই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি তার তা ও হিসেবের দিক দিয়ে অনেক বছর হতে চলল। তবে বারুই জলদাসের দিদি সীতার ছেলে বিমলের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল সরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সে তাকে দেখেও চিনতে পারে নি বা চিনতে চায় নি ইচ্ছে করেই। তাই কিছুটা অভিমান কিছুটা সংকোচ তাকে বাধা দিয়েছিল সেধে নিজের পরিচয় দিতে। তা ছাড়া পরিচয় দিয়েই বা কী এমন হতো এতকাল পর? মামীকে চিনতে পারলেও কর্ম বা সামাজিক অবস্থানের কারণে হয়তো সম্পর্কটি প্রকাশ্যে স্বীকার করা সম্ভব হতো না বিমলের পক্ষে।



কমলা!



আগের চাইতে আরো জোরালো শোনা যায় বটুর বিশ্রী কণ্ঠস্বর।



বটু পালের ইদানীংকার আচার ব্যবহার ভাল লাগে না কমলার। বলতে গেলে নাক টিপলে দুধ বের হবে এমন ছেলে তুই তোকারি করে কথা বলে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় এক চড়ে ব্যাটার কানের গোড়া ফাটিয়ে ফেলে। কিন্তু প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক যেখানে, সেখানে কিছুটা হলেও নমনীয় হয়ে থাকা জরুরি। আড়ালে আবডালে হরিনারায়ণ তাকে যতটাই তোয়াজ করুক, সন্তানের পক্ষ নিয়ে তাকে হেনস্থা করতে হয়তো মোটেও দ্বিধা করবে না। অকালে পেকে যাওয়া বদ ছেলেটার কারণে পনের-বিশ দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছে সে। অনেকদিনই ভেবেছে কাজে আর আসবে না। কিন্তু এখানে যে-কতক্ষণ কাজ থাকে তা করবার পর হরিনারায়ণের সংসারে টুকটাক ফাই-ফরমাস ধোয়া-মোছার কাজ করে বলে আর মাঝে মধ্যে একান্ত নিজের জরুরি প্রয়োজন মিটে যায় বলে বলতে গেলে সে পাল বাড়ির ভিটে কামড়ে পড়ে আছে।



বটু পাল লুঙ্গির গিঁট খুলে ফের শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বলে, বাবায় আইজগা আইতাছে। আমি লঞ্চঘাটে থাকমু। কিছুক্ষণ বাদে তুইও তালা দিয়া যাইস গা। বলতে বলতে সে বাইরে বেরিয়ে যায়।



বটু চলে যাওয়ার সঙ্গে ক্যাশ বাক্সের পাশের খালি জায়গাটাতে গিয়ে বসে কমলা। আঁচল খুলে ঝেড়ে নিয়ে মুখ-হাত মুছে সেটা ফের কাঁধের ওপর দিয়ে পিঠের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। একবার তার মনে হয় ঘরের সার্টার দুটো নামিয়ে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়লে ভাল হতো। একটু আগে আগে বের হতে পারলে কিছুটা ঘুর পথ হলেও বাবুলকে দেখে যেতে পারত। তিনদিন হয়ে গেল ছেলেটা পানসা রোগে আক্রান্ত হয়ে আটকা পড়ে আছে ঘরে। আর কেউ না থাকলেও গম ভাঙানোর কাজ বা বায়না ধরতে সমস্যা হয় না। কিন্তু বাবুল ছাড়া একা মেয়েমানুষ হয়ে সে কাজের দায়িত্ব নিতে তেমন একটা ভরসাও পায় না। তা ছাড়া নারী বলেও মেশিন চালানোতে তার দক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারটা কারো কাছে তেমন একটা মূল্যায়িত হয় নি। নয়তো সে কি এ পর্যন্ত কিছুটা হলেও কাজের ব্যাপারে জ্ঞান অর্জন করে নি?



প্রায় বিশ বাইশ দিন হলো হরিনারায়ণ ভারতে গেছে চিকিৎসা করাতে। এ দিকে বেশ কদিন ধরেই শরীরে এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। যা মৃদু হলেও এ পাশ ও পাশ করছে ঘন ঘন। সে অস্বস্তি কখন যে তীব্র হয়ে তাকে অস্থির করে তুলবে তা নিয়েও মনে মনে খানিকটা বিব্রত বলা যায়। নিঃসন্তান কমলা বয়সের দিক দিয়ে আটচল্লিশের শেষ ধাপে চলে গেলেও মাঝে মাঝে অকস্মাৎ নিদ্রা-ছুট নিজেকেই যেন চিনতে পারে না। তখন অবাক হয়ে ভাবে যে, এ বয়সে দেহ কাতরতা কতটা স্বাভাবিক? নাকি নিঃসন্তান বা নিঃসঙ্গ বলেই এমনটা বেশি বোধ হয়? তার মতো কি আর কোনো রমণীর অতটা দেহ কাতরতা আছে? অবশ্য শ্বশুর শাশুড়িকে এমন বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই দেহ-সম্পর্কহীন কাল কাটাতে দেখেছে। হতে পারে শাশুড়ি অথবা শ্বশুর কিংবা দুজনেই উপযুক্ত সময়ের আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিলেন।



এ নিয়ে বারুই মাঝে মাঝে মজা করে বলতো, বাবা হইলো গিয়া সাধু-সন্ত মানুষ। এক বউয়ে বিশ্বাসী থাকতে গিয়া অকালে বুড়া হইয়া গেছেন! বাবায় যে আমার উনিশ বচ্ছরের বড় হেই কতা কি জানস?



এক বউয়ের বিশ্বাসী থাকলে কী সমস্যা? বলে, কমলা ফের বলে উঠেছিল, আফনে কি আমার বিশ্বাসী থাকতেন চান না?



কমলার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ হেসেছিল বারুই।



অন্ধকারের গাঢ়তায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাতের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করতে করতে অপেক্ষা করছিল কমলা আর দ্বিধান্বিত মনে ভাবছিল যে, কী এমন হাস্যকর কথাটি বলে ফেলেছে সে?



অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়ে অন্ধকারেই বারুইর গায়ে হঠাৎ চিমটি কেটে বলে উঠেছিল কমলা, এমন কইরা হাসনের কথাডা কী কইলাম আমি?



বারুই তখন ফিচ ফিচ শব্দে হাসতে হাসতে শোয়া থেকে উঠে বসে তাকে আলতো ঠেলে বলেছিল, হোন ব্যাক্কল বেডি! ব্যাডা-বেডিরা হইল দুই কিসিমের। দাও আর ক্ষুরের মতন। দাওয়ের যেমন বেশি কাজে ধার বাড়ে, হ্যামন বেশি কাজ হউক আর কাজ না-ই হউক ক্ষুরের ধার কমতে থাকে।



এরপর আরো কথা আর ঘটনার মিশেল দিয়ে ব্যাপারটি বোঝালেও দা আর ক্ষুরের তুলনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে নি কমলা। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছিল যে, পুরুষের লাম্পট্যের পক্ষে হাজারো যুক্তি থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে সবই বলতে গেলে উলটো। কিন্তু মনে মনে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল যে, ক্ষুর ব্যবহার করা আর না করার সঙ্গে তার ধার কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। শান দিলে ক্ষুরের কর্ম ক্ষমতা বাড়লেও নারীর একটা সময় আসে যখন শানের অবস্থাও থাকে না। অথচ অনেক পুরুষ ষাট-সত্তরেও যুবতী স্ত্রীকে তুষ্ট রাখতে পারে।



তোমার মেশিন ঠিক আছেনি মাসি? বলে, দাঁত বের করে হাসে রামকুমার সাহার ছোট ভাই গণেশ।



হারামজাদার পুত! বলে, মনে মনে একবার গালি দিয়ে মুখ তুলে কমলা জিজ্ঞেস করে, কয় বস্তা?



এক বস্তা।



মাল আনছস?



রেজেকের পুতে আনতাছে।



কতক্ষণে আনবো? আমি যাইতাছি, ঘর তালা দিমু।



আর মিনিট দশেক বও মাসি। মালডা বুইজ্যা পাইয়া যাও!



একবার আড় চোখে গণেশের চকচকে দৃষ্টি অনুসরণ নিজের বুকের দিকে তাকায় কমলা। আর সঙ্গে সঙ্গে আঁচল টানতে সঙ্কোচ হচ্ছিল বলে সে উঠে মেশিনের আড়ালে চলে যায়। নিচ থেকে উপরের দিকে চওড়া হয়ে যাওয়া মেশিনের ওপরকার চৌকোণা টিনের চোঙটির মুখে ঢাকা দেওয়া চটের বস্তাটা টেনে নামায়। তখনই এক ফাঁকে ঘুরে গণেশের দিকে পিঠ দিয়ে আরো কয়েক রকম গাল দিতে দিতে আঁচল টেনে বুক ঢাকে ভালো মতো। গণেশ ছাড়া আর কারো সামনে শরীর নিয়ে অতটা অস্বস্তিতে ভুগতে হয় না তাকে। অথচ এ বদমাশটার চোখের সামনে নিজেকে কেমন নাঙা নাঙা মনে হতে থাকে।



তখনই গণেশ হঠাৎ বলে ওঠে, আমি যাই মাসি, আমিন আইতাছে!



কমলা ফিরে গনেশকে দেখতে না পেলেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভ্যান চালিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে আমিন। সরু দড়ি দিয়ে মুখ বাঁধা গমের বস্তাটি মেশিনের গোড়ায় ফেলে দিয়ে ভ্যান টেনে নিয়ে আবার বেরিয়ে যেতে যেতে কমলার উদ্দেশ্যে সে বলে, বাবুইল্যারে কইয়া রাইখ্যেন হাইঞ্জালা আইমু!



তিনদিন ধরে যে বাবুল অসুস্থ এ কথা বলার সুযোগ পায় না কমলা। তার আগেই ভ্যান নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় রেজেকের ছেলে আমিন।



একবার হতাশ দৃষ্টিতে গমের বস্তা আর মেশিন-মটর-সুইচ এসবের দিকে তাকায় কমলা। দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছে বলে, প্রতিটা কাজের খুঁটিনাটি স্বচক্ষে দেখা আছে তার। কাজগুলো কেবল নিজের হাতেই কখনো করা হয় নি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কিছু একটা নিয়ে ভাবে যেন। তারপরই আঁচলটা টেনে খুলে নিয়ে বুকে পিঠে ভালো মতো জড়িয়ে প্রান্তটা কোমরে গুঁজে নিয়ে এগিয়ে চলে বাইরের দিকে। কিন্তু সে বাইরে বের না হয়ে এক হাতে টেনে বড় সার্টারটা নামিয়ে দিতেই ঘরের ভেতরটা প্রায়ান্ধকারে ছেয়ে যায়। পাশের সরু দরজার মতো খোলা অংশ দিয়ে যতটুকু আলো আসছিল তাই যেন তার জন্যে যথেষ্ট ছিল। তাই হয়তো ফিরে এসে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বস্তার বাঁধন খুলে একটি মাঝারি আকারের প্লাস্টিকের বাটি দিয়ে আরেকটি বড়সড় বালতিতে গম ঢালতে থাকে। তারপর বালতিটি প্রায় পূর্ণ হয়ে গেলে দু হাতে তুলে গমগুলো ঢেলে দেয় চওড়া মুখের টিনের চোঙটিতে। বার কয়েক এমন করে চোঙটি গমে পূর্ণ হয়ে প্রায় উপচে পড়ার মতো হলে সে থামে।



এরপর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, বাবুলের বাকি কর্মকাণ্ড। মটর আর হলারের চাকার সঙ্গে জুড়ে থাকা মোটা আর ভারি ফিতেটাকে বার কয়েক আগুপিছু করে টেনে টেনে দু যন্ত্রের জড়তা দূর করে নেয় সব সময়। তারপর টিনের বেড়ার গায়ে লাগানো বড় সুইচটার লাল বোতামে চাপ দিয়ে পাশের ছোট হাতলটা টেনে নিচের দিকে নামিয়ে দেয়।



বাবুলের কর্মকাণ্ড ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই কখন মটর চালু করে দেয় বুঝতে পারে না কমলা। অকস্মাৎ মটর আর হলারের চাকতির যুগপৎ ঘরঘর শব্দে ভয় পেয়ে মাগো বলে লাফিয়ে ওঠে সে। তারপর ধাতস্থ হয়ে, গলার সামনে ব্লাউজের প্রান্ত এক আঙুলে টেনে ধরে বুকে থুতু দিয়ে তাকিয়ে থাকে বিপুল বিক্রমে ঘুরতে থাকা মেশিনের ফিতা, মটর আর হলারের বড় চাকার দিকে। তারপর যেন সে আর নিজের থাকে না। কোনোভাবে যেন বাবুলেরই কোনো একটি সত্তা হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। বাবুল থাকলে যেমন যেমন করতো সে তাই করে যেতে থাকে।



এক সময় মেশিনের ভেতর থেকে আটা বেরিয়ে আসার জন্যে তৈরি মুখটিতে বাঁধা মোটা কাপড়ের চোঙটাকে সে আরেকটি বস্তার মুখে পুরে দিয়ে বস্তাটির প্রান্ত আটকায় মেশিনের মুখের আংটার সঙ্গে। তারপর টিনের চোঙ আর ক্রাশারের মধ্যকার টিনের বা ইস্পাতের পাতলা পাতটি টেনে সামনের দিকে এগিয়ে আনবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গম চূর্ণ হতে আরম্ভ করলে মেশিনের চাকার ঘরঘর শব্দ আরো গম্ভীর হয়ে ওঠে।



তখন বলতে গেলে সে মোটামুটি অবসর। চৌকো চোঙের গম পরিমাণের দিক দিয়ে কমে এলে ফের বালতিতে করে ঢেলে দিলেই হলো। আর সে উদ্দেশ্যেই শূন্য বালতিটিকে গম দিয়ে পুরো করে রাখে সে। তারপরই একবার নিচু হয়ে বস্তাটিকে টেনে কাপড়ের চোঙের ভেতরকার আটা প্রবাহের পথটিকে বাধা মুক্ত করে দিয়ে সোজা হতে হতেই শুনতে পায় বাইরে থেকে ভেসে আসা হরিনারায়ণের কণ্ঠস্বর। বাবুইল্যারে! আর সেই কণ্ঠস্বরে হঠাৎ চমকে উঠলেও তার যে কী হয়, মনে হয় দেহের আনাচে কানাচে অসংখ্য শুঁয়াপোকা একই সঙ্গে কিলবিল করে উঠে এদিক সেদিক ছুটোছুটি আরম্ভ করেছে। সেই সঙ্গে কেমন একটা ঝিম ঝিম ভাব তার পুরো দেহকে আচ্ছন্ন করে ফেলে যেন। তবু কিছুটা জোর করেই সে এগিয়ে যায় সরু দরজাটার দিকে। হরিনারায়ণের কণ্ঠস্বর সে সত্যি সত্যিই শুনেছে কি না তাই যেন যাচাই করা।



কিন্তু তাকে ততটা পথ অতিক্রম করতে হয় না। তার আগেই দরজার সংকীর্ণ পথে ঢুকে পড়ে হরিনারায়ণ। কমলাকে একা দেখতে পেয়ে সে বলে ওঠে, বাবুইল্যায় নাই? তরে কাম দিয়া হারামজাদায় বাইত যায় কিয়ারতো?



হরিনারায়ণ এগিয়ে এসে মেশিনের আশপাশে একবার উঁকিঝুঁকি মেরে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করে হয়তো। তারপরই সে মাথা ঘুরিয়ে চকচকে চোখে তাকায় কমলার দিকে। হাসি মুখে বলে, তুই কিরাম আছস? বলতে বলতে সে আরো এগিয়ে গিয়ে কমলার মুখোমুখি দাঁড়ায়।



হরিনারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে উদ্যত হলে তখনই হঠাৎ তাকে জাপটে ধরে লোকটি।



কমলা খুশি বা বিরক্ত এমনটা তাকে দেখে বোঝা যায় না। এমন কি হরিনারায়ণের বেষ্টনী থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয় না তার মাঝে। তবে মৃদু কণ্ঠে একবার বলতে শোনা যায়, কী করেন? বাইত যান! সান-খাওন সাইরা আগে জিরাইয়া লন!



কিন্তু হরিনারায়ণের হয়তো সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা যায় না, যতটা আগ্রহ দেখা যায় কমলাকে বুকের সঙ্গে পিষ্ট করতে করতে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটায় ঠেলে নিয়ে যেতে। যেখানে অনেকগুলো পুরোনো চটের বস্তা বিছিয়ে তার ওপর একটি কাঁথা বিছিয়ে অবসর সময়ে ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছিল বাবুল।



কিন্তু হরিনারায়ণের ধাক্কায় বিছানায় পড়ার অপেক্ষায় না থেকে যেন নিজের প্রয়োজনে আগে আগেই শুয়ে পড়ে কমলা। মাথার দিকে মটরের চাকায় আঘাত লেগে একটি বিচিত্র শব্দে ফিতের জোড়াটা হালকা হাওয়ার যোগান দিয়ে যাচ্ছিল বারবার। ঠিক যেন নৌকার তলায় নদীর বড় বড় ঢেউগুলোর জোরালো আঘাতের মতই শব্দ হচ্ছিল ফিতেটার পাক খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আর সেই শব্দ মুহূর্তেই তাকে টেনে নিয়ে যায় বিয়ের আগের দিনকার মাঝ নদীর সন্ধ্যাটির কাছে। যে সন্ধ্যায় নৌকায় করে পিসির বাড়ি থেকে ফেরার সময় সে অনেক চেষ্টা করেছিল বাঁশের ফালি দিয়ে বানানো পাটাতনের ওপর শুয়ে পড়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। কিন্তু মাঝি হারানের সঙ্গে শক্তির দিক দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে নি কোনোভাবেই।



(সমাপ্ত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.